সমুদ্রের সোনা

লেখক : আবু হানিফ শেখ

ফরাসি শব্দ অ্যাম্বার আর গ্রিস মিলে ইংরেজি অ্যাম্বারগ্রিস শব্দটি এসেছে। অবশ্য ‘ফ্লোটিং গোল্ড: এ ন্যাচারাল অ্যান্ড (আনন্যাচারাল) হিস্ট্রি অব অ্যাম্বারগ্রিস’ বইয়ের লেখক ক্রিস্টোফার কেমপ অ্যাম্বারগ্রিসকে তিমির বমি বলতে নারাজ। কারণ কোনো খাবার খাওয়ার পর হজম না হলে সাথে সাথে মুখ দিয়ে কোনো কিছু বের হলে তাকে বমি বলা হয়।

পৃথিবীর বিরল প্রজাতির তিমি হলো স্পার্ম তিমি। আর এই মাছের বমিকে বলা হয় ‘অ্যাম্বারগ্রিস’। স্পার্ম তিমি হাজার হাজার স্কুইড খায়। মাঝে মাঝে সেই স্কুইড পাকস্থলি ও অন্ত্রের মাঝখানে জায়গায় গিয়ে জমা হয়। আর সেটা দীর্ঘদিন পর অ্যাম্বারগ্রিসে পরিণত হয়। পরে এক সময় স্পার্ম তিমি তা মুখ দিয়ে বের করে দেয়। অ্যাম্বারগ্রিস দেখতে অনেকটা মোম জাতীয় শক্ত পুরু। অনেকটা পাথরের মত দেখতে দাহ্য পদার্থ।

স্পার্ম তিমির অন্ত্রে তৈরি মোমের মতো এই পদার্থ মাছটি উগড়ে দিলে সাগরের পানিতে ভাসতে থাকে। ভাসতে ভাসতে উপকূলে চলে আসে। এজন্য একে ‘floating gold’ বা ভাসমান সোনা বা প্রকৃতিক সোনা বা বোকাদের সোনা বলা হয়। এটি ‘সমুদ্রের ধন’ নামেও পরিচিত। এক কেজি সোনা সম পরিমান অ্যাম্বারগ্ৰিসের দাম প্রায় ৩০ কোটি টাকা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা প্রচুর থাকার কারনে তাকে “সমুদ্রের সোনা” বলা হয়।

একেকটি অ্যাম্বারগ্রিসের ওজন ১৫ গ্রাম থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এটি দেখতে হালকা সাদা বর্ণের মোমের মতো নরম ও আঁশটে গন্ধবিশিষ্ট হয়। সময়ের সাথে সাথে এটি সূর্যের আলো ও সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রভাবে শক্ত ও ধূসর বা বাদামি রঙের হয়। বয়স বৃদ্ধির ফলে এ থেকে সুন্দর গন্ধ বের হতে থাকে।

অ্যাম্বারগ্রিস সনাক্ত করার জন্য কর্মকর্তারা একটি পরীক্ষা করেন। তাতে একটি লাল গরম সুই সেই পদার্থের উপর রাখা হয়। যদি এর ফলে সেই পদার্থ থেকে সাদা ধোঁয়া এবং গন্ধ বের হয় তবে পদার্থটিকে অ্যাম্বারগ্রিস হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পরে অবশ্য তা আরও পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়ে।

 অ্যাম্বারগ্রিস চোরাচালানের অনেক ঘটনা ঘটেছে ভারতে। এই পদার্থের এক কিলোগ্রামের দাম কমপক্ষে ১ কোটি টাকা। ভারতে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন গভীর সমুদ্রের স্পার্ম তিমি প্রজাতিকে রক্ষা করে। এই আবহে গভীর সমুদ্রে স্পার্ম তিমি শিকারের মাত্রা বেড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মহামূল্যবান এই অ্যাম্বারগ্রিস মূলত পাওয়া যায় আটলান্টিক মহাসাগর এবং দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল, ব্রাজিল, মাদাগাস্কার, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মালদ্বীপ, চীন, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং মলুচ্চা দ্বীপপুঞ্জে।

তিমির এই বমি নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান ব্যবহার হয় বিলাসবহুল সুগন্ধি পারফিউম তৈরিতে। এ ছাড়াও বাহারী খাবার বানাতে। ইউরোপে হট চকোলেট এবং তুরস্কে কফিতে ফ্লেভার হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। মিশরে অ্যাম্বারগ্রিসকে সিগারেটে ঘ্রাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যৌন উত্তেজক, ব্রেইন, মাথাব্যথা, সর্দি, মৃগী, হার্ট এবং ইন্দ্রিয়ের রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ হিসেবেও এর ব্যবহার আছে।

ছবি : লেখক


 

 

লেখক পরিচিতি : আবু হানিফ শেখ
পবিত্রতার স্বচ্ছ জলে নবাবের ভেলায় ভাসানো কুসুম ঘেরা প্রদীপের আলো। আবু হানিফ শেখ মুর্শিদাবাদ জেলার লালনগর গ্ৰামের নিবাসী। বাংলা সাহিত্য, জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলা নিয়ে একটুআধটু লেখালেখির মাধ্যমে মানসিক ভাবনা প্রকাশ করে থাকাই নেশা। তার প্রকাশিত “সমিধ” পত্রিকায় “কলমবাবু” এবং “মোহনা” পত্রিকায় “ঠান্ডা ও ভুতের কাহিনী” দুটি গল্প।

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন