হনুমানের ঠিকুজি

লেখক : তনিমা হাজরা

প্রত্যেকটা আচার উৎসবের পিছনেই একটা মহত্তর সামাজিক দিক থাকে। কিন্তু তথাকথিত ধার্মিক বলে নিজেদের পরিচয়প্রদানকারী মানুষেরা সেই উৎসব বা আচারের অন্তর্নিহিত মূল ভাবনাটিকে না বুঝে স্থূল কামনা বাসনার দিকটির দিকেই সচরাচর ধাবিত হন।
যাঁরা প্রতি মঙ্গলবার মেয়ের বিয়ে, ছেলের প্রমোশন, নাতির ভালো ইস্কুলে এ্যাডমিশন, প্রেমিকের সাথে আবার মিলন, আসচে ভোটে টিকিট পাওয়া ইত্যাদি এজেন্ডা নিয়ে হনুমানবাবুকে নিত্য কলাটা লাড্ডুটা খাওয়াচ্ছেন এবং হনুমান চালিশা পড়ছেন তাঁরা একটু আসুন, শ্রীল শ্রীযুক্ত হনুমানবাবুর ঠিকুজি কুলুজিটা একটু খতিয়ে দেখে নিই বরং।

ঠিকুজী কুলুজি
————-
শ্রীযুক্তবাবু হনুমান ওরফে বজরঙ্গবালী
পিতা – কেশরী অর্থ্যাৎ কেশযুক্ত, মানে যিনি নিয়মিত আপনার মতো সেলুনে যান না
পালক পিতা – মরুৎ বা বায়ু বা পবন বা পবন নিয়ন্তা
মাতা – অঞ্জনী বা কৃষ্ণ বর্ণ ধারিনী
জন্মস্থান – কিস্কিন্ধ্যা প্রদেশের কোপ্পাল জিলার অঞ্জনাদ্রি পাহাড় সংলগ্ন কোনো অঞ্চল
জন্ম সময় – চৈত্র মাসের পূর্ণিমা
স্ত্রী – শুভর্চলা
পুত্র- মকরধ্বজ।

যে সময়ে শ্রীযুক্ত হনুমানবাবুর জন্ম বলে আপনারা জানাচ্ছেন সেই যুগে কিস্কিন্ধ্যা জায়গাটা অধুনা দন্ডকারণ্য ও কর্ণাটক মিলিয়ে বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে বিস্তৃত জঙ্গলমহলকেই বলা হত। অঞ্জন শব্দের অর্থ কাজল অর্থ্যাৎ কৃষ্ণ মানে কৃষ্ণমৃত্তিকার দেশ মানে অঞ্জনাদ্রি পাহাড় মানে পূর্বঘাট পাহাড়ের তরাই অঞ্চলের কালো মাটির অরণ্যমন্ডিত অঞ্চল। মাটি তো মায়েরই মতো, খাদ্য সরবরাহ করে যিনি জীবন সেঁচন করেন।

পূর্বঘাট পর্বতের অন্য নাম মলয়াদ্রি। মলয় একটি বায়ু বা বাতাসের নাম এতো আমরা সবাই জানি, মানে যে পাহাড়ের গায়ে এই মলয় বাতাস ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি ঝরে সেই বায়ুমন্ডলে তিনি লালিত ও পালিত, তাই পবন অবশ্যই তাঁর পালক এবং জনক ( যিনি জীবন দান করেন এই অর্থে)

এখানে কেশরী মানে সেখানকার আদিম অধিবাসী দীর্ঘ কেশ ও লোমশ উপজাতি মানুষজন যাঁরা উন্মুক্ত ব্রহ্মাণ্ডের মতো গভীর অরণ্যের স্বাধীন প্রতিনিধি। তাঁর ঔরসদানকারী পিতা বা বায়োলজিক্যাল ফাদার। এই ব্রহ্মাণ্ডচারী শব্দের অপভ্রংশ থেকেই হয়ত হনুমানকে আমরা ব্রহ্মচারী হিসেবে ভেবেছি।

সুতরাং এই স্বাধীন ব্রহ্মাণ্ডচারী প্রজাতির তিনি প্রতিনিধি, তিনি কালো মানুষদের মুখপাত্র। বজরঙ্গবালী শব্দের অর্থ হলো অজেয় বা বিজয়ী। তাঁর একহাতে সবুজ অরণ্যমন্ডিত পাহাড়, অন্য হাতে গদা। মানে তিনি দিচ্ছেন অরণ্য সংরক্ষণের সুগভীর বার্তা, দিচ্ছেন অরণ্যচারী মানুষ এবং প্রাণীদের সংরক্ষণের আবেদন।

এই আবেদন, এই সংরক্ষণের দায়িত্ব তো কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বিশেষের নয়, সমগ্র মানব জাতির। তাঁর পুত্র মকরধ্বজ অর্থ্যাৎ আয়ুর্বেদ মতে যাকে বলে উদ্ভিদ থেকে আহৃত সর্বরোগহর ঔষধ । অরণ্যের বিভিন্ন গাছ গাছড়ার সংরক্ষণের দ্বারাই তার উৎস। তাই সেই ঔষধ পুত্রসম নিরাপত্তাদায়ী সমগ্র মানব প্রজাতির কাছে।

আর আমরা উৎসবের মূল অভিপ্রায়টিকে শিকেয় তুলে দিয়েছি নিশ্চিন্তে। লড়ছি তাকে নিয়ে ধর্মের নামে এবং নিজস্ব সংকীর্ণ মানসিকতার প্রার্থনায় মেতে।

শুনুন হনুমান পুজো যে আপনি করছেন তা খুবই ভালো একটা কাজ করছেন।

কিন্তু দয়া করে হনুমানবাবুকে কলা মন্ডা ঘুষ খাইয়ে মেয়ের চাকরি, ছেলের রেজাল্ট, জামাইয়ের প্রোমোশন, নিজের চাকরিতে উন্নতি, ব্যবসায় লাভ, নাতনির ব্রেক আপ জোড়া লেগে যাওয়া কিংবা জ্বালাতুনে শাশুড়ির মৃত্যু ইত্যাদি বর চাইবেন না, কারণ ওসব কিছুই বেলাইনে করে দেবার ক্ষমতা ওনার নেই। ওগুলো যা হবার তা আপনার জীবনে এমনিই ঘটে যাবে পরপর।

বরং ওই সব মন্ত্রতন্ত্র চুলোয় গুঁজে এবার থেকে এটা ভাবতে শিখুন যে হনুমান হলেন সেই কালো মানুষদের প্রতিনিধি, সেই সবুজ অরণ্যের প্রতিনিধি, সেই সুউচ্চ বিজয়ী পাহাড়ের প্রতিনিধি, সেই অরণ্যে জন্ম নেওয়া অনেক রোগ বালাইনাশক গাছ গাছড়ার প্রতিনিধি, সেই অরণ্যে বসবাসকারী অনেক পশু পক্ষীদের প্রতিনিধি।

আসুন তাঁদের যত্ন, পালন ও সংরক্ষণ করার কথাটা একবার সিরিয়াসলি ভেবে দেখি এবং তার মাধ্যমেই হনুমান পূজা করি।।


লেখক পরিচিতি : তনিমা হাজরা
তনিমা হাজরা - লিখি উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum