লেখক : অয়ন মৈত্র
বিখ্যাত আমেরিকান লেখিকা, হেলেন কেলারের একটি স্মরণীয় উক্তি আছে- “ আমি অনেক কিছু পারি না, তবে কিছু তো পারিই, আর যেটা পারি সেই কাজে আমার
ব্যর্থ হওয়া চলবেই না।” তোমরা যারা উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে গেলে, তাদের মধ্যে অনেকেই আছো যাকে স্কুল না চেনে পড়াশোনার জন্য, না চেনে খেলাধুলো কিংবা এক্সট্রা
ক্যারিকুলার কোন অ্যাক্টিভিটির জন্য। এমন যারা আছো, তারা মনে মনে জানো স্কুলের কাছে আমি একটা সংখ্যা, স্রেফ একটা ডিজিট। এর বেশি কিছু নয়। এমন অনেকে আছো যারা স্কুলকে কোনদিন নিজের মনে করনি, কারণ মনে মনে হয়ত অনুভব করেছিলে স্কুলও কোনদিন তোমাকে নিজের মনে করেনি। মনে করায়নি তোমাকে, তুমিও সম্পদ হতে পার। এই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই ধারনাটা তোমরা অনেকেই ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছ।এই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই ধারনাটা, আপ্রাণ চেষ্টার পরও অনেকেই আছো, যারা বদলে দিতে পারনি। ঠিক যেমনটা ছিলে এতদিন, আজ রেজাল্ট বেরনোর পরও একই রয়ে গেলে।
আমি ভুল বললাম। তোমরা কেউ আর একই রইলে না আজকের পর। আজকের পর তুমি সেই অধিকারটা পেলে যে অধিকারের বলে তোমাকে জোর করে আর পড়তে বসানো যাবে না। আজ থেকে তুমি চাইলে মা বা বাবা কেউই আর তোমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবে না, পড়তে বোস…পড়তে বোস বলে। যে যে অসহ্য বিষয়গুলোকে তোমাকে এতদিন জোর করে সহ্য করতে হয়েছে, আজ চিৎকার করে বলে দিতে পার – আমার বাংলা পড়তে জাস্ট বিরক্ত লাগে।… কেমিস্ট্রিটা এতদিনে গেল! উফফ! বাঁচলাম যেন।আজকের পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত তোমার।তুমি ঠিক করবে তোমার জীবনের আটশো স্কোয়্যার ফুটের বাড়িটায় সদর দরজা সেগুন কাঠের হবে না শাল কাঠের। দেওয়ালে বাই-কালার হবে না স্রেফ চুনকাম।আজ থেকে তুমিই ঠিক করবে তুমি ঠিক কী করবে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ তোমার জীবনে, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তার পরের জীবনে কতটা তুমি নিজের স্বপ্নকে, নিজের ইচ্ছে অনুসারে জীবনের বাঁক ধরে,ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ক্রিস্টোফার মরলে, আমেরিকান কবি- ঔপন্যাসিক একবার বলেছিলেন, “জীবনের একমাত্র সাফল্য হল, জীবনটাকে নিজের ইচ্ছে মত কাটানো।” তোমরা যখন আরও বড় হবে, দেখবে কীভাবে হাজার হাজার বাধা তোমাকে ঠেলতে হচ্ছে মাত্র দু ইঞ্চি এগোনোর জন্য।উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তাই তোমাদের যার যাই রেজাল্ট হোক, মাথায় রেখো তোমার প্রতিভার বিচার ওই কয়েকটা নম্বরে করা যায় না।আজকের পর মাথায় রেখো, এই গোটা পৃথিবীটা তোমার।এই পৃথিবী জুড়ে তুমি বিচরণ কর।
বিশ্বাস কর, বাবা মুখে যাই বলুক তোমার রেজাল্ট দেখে, মনে প্রাণে মানুষটা কিন্তু বিশ্বাস করে – তার মেয়েটা তার রক্ত, তার ঘাম, তার কান্না, তার আনন্দ।বিশ্বাস কর, মা যতই চিৎকার করুক তোমার ওপর, মা’র কাছে আজকের পরও তোমার কোন বিকল্প তৈরি হবে না। তুমিই তার পৃথিবী আজও।
সৌরভ গাঙ্গুলী একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – জীবনে তুমি যাই কর না কেন, সবার আগে একজন ভাল মানুষ তোমাকে হতেই হবে।একমাত্র তবেই তোমার কৃতিত্ব অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ভাল মানুষের কোন বাউন্ডারি হয় না, কোন পরিসীমা হয় না।
এই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাটা একটা পরীক্ষা মাত্র যেমন পরীক্ষা তুমি আগামী জীবনে আরও অনেক দেবে। তোমার পরিচয় কিন্তু তৈরি হবে সেই পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে নয়, তুমি মানুষ হিসেবে পৃথিবীর জন্য কী অবদান রেখে গেলে তার ওপর। একদিন এমন আসবে, যেদিন তোমার বাবার পরিচয় হবে, বাবা কে চিনবে তোমার গ্রাম তোমার বাবা হিসেবে, অমুকদার ছেলে কিংবা মেয়ে হিসেবে নয়। আজকের পর তোমার হাতে একটা গোটা জীবন পড়ে, সেই সমস্ত মানুষদের উত্তর দাও যারা বলেছিল আর্টস নিয়ে কিস্যু হয় না। দেখিয়ে দাও, তুমি ভুল ছিলে না সেদিন, যেদিন এর জন্য মায়ের সাথে ঝগড়া করেছিলে। আজকের পর যাই কর না কেন, কেবল নিজের সবটা উজাড় করে দিয়ে কর। যেন কোন আফসোস না থাকে, যেন বলতে পারো এর চেয়ে বেটার আর সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। আজকের পর জীবন তোমাকে আরও একবার সুযোগ দিচ্ছে ইতিহাস তৈরি করার। তুমি যখন সবাই ঘুমিয়ে গেলে গল্প লিখতে বসবে, তুমি জানবেও না তোমার অজান্তেই তোমার চেনা মানচিত্রটার ভূমিরূপ বদলে যাচ্ছে তোমার প্রতিটা শব্দ চয়নের সাথে সাথে। আজকের পর তুমি যখন আবার নেট প্র্যাকটিসে যাবে, তুমি জানবেও না তোমার মারা প্রতিটা স্ট্রোক আসলে সেই মানুষগুলোর কাছে পোঁছে যাচ্ছে যারা কার্বন দেখলেই কয়লা ভাবে, ভুলে যায় হীরে কিন্তু কার্বন দিয়েই তৈরি হয়।
যারা ভাবছ, আজকের পর জীবন বোধ হয় থেমে গেল, যারা সকাল থেকে শুনছ এই নম্বর নিয়ে জীবনে কিস্যু করা যাবে না, তাদের জন্যে বিল গেটস এর একটা অসাধারণ উক্তি রইল – আমরা বেশিরভাগ মানুষই বড্ড বেশি আশা করে ফেলি একদিনে আমরা কী কী করে ফেলতে পারি এবং একই সাথে বড্ড কম আশা করি দশ বছরে আমরা কী কী করতে পারি।
মনে রেখ, ইতিহাস যারা তৈরি করেছেন তাদের কেউ ছিলেন সম্রাট, কেউ ছিলেন ফুটবলার, কেউ বিজ্ঞানি, কেউ বা কবি কিন্তু তারা সবাই একদিন ছাত্র ছিলেন।