হলোকস্ট এবং আনা ফ্রাঙ্ক

লেখক : অভি সেখ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাতজি জার্মানি ইউরোপিয় ইহুদি দের উপর যে হত্যা কান্ড চালিয়ে ছিল সেই ঘটনাকে হলোকস্ট বলা হয়।
এই হলোকস্ট শব্দ টা প্রাচীন গ্রিক শব্দ holokaustos থেকে এসেছে, যার অর্থ, হল SACRIFICE BY FIRE, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকান্ডকে বর্ণনা করার জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করা হত, কিন্তু 1945 এর পরে এই শব্দটি শুধু মাত্র ইহুদিদের উপর ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতীক হয়ে যায়।
1933 সাল থেকে 1945 সাল পর্যন্ত হিটলারের রাজত্বে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত নাতজিরা ষাট লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলে। ইহুদিদের খুঁজে খুঁজে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হত, যেখানে তাদের উপর চলত নির্মম অত্যাচার, কেন হয়ে ছিল হলোকস্ট? কারন নাতজিরা ইহুদিদের শেষ করে ফেলতে চেয়েছিল এর একমাত্র কারন ছিল ধর্মীয় হিংসা, শুধু নাতজি নয় এর আগেও ইউরোপে যুগের পর যুগ ধরে ইহুদিদের উপর অত্যাচার হয়ে এসেছে, কারন যীশুকে ক্রুস বিদ্ধ করে হত্যা করার জন্য,ইহুদিদেরই দায়ী করা হয় , এমন কি কোনো ইহুদি যদি নিজের ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে চাইত তাহলে কি তারা বেঁচে যেত? না সেটাও হত না, কারন নাতজি রা মনে করত ইহুদি দের রক্ত টাই অপবিত্র আর জার্মানরা ইহুদিদের থেকে অনেক বেশি উচ্চ শ্রেণীর।
নাতজিরা ইহুদিদের সম্পূর্ণ ভাবে শেষ করে ফেলার জন্য, একটা সিস্টেমেটিক প্ল্যান করে যার নাম ছিল Final Solution To The Jewish Question
আর এই প্ল্যান এক ভয়াবহ রূপ নিয়ে নেয়, জার্মান শাসিত ইউরোপে ইহুদিদের খুঁজে খুঁজে একত্রিত করা হত, আর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হত সেই সমস্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প গুলো তে, যে ক্যাম্পগুলোকে নরক বললেও ভুল হবে না।
ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে, শুরুতেই তাদের সমস্ত জিনিস নিয়ে নেওয়া হত, তারপর পুরুষ দের মহিলা এবং বাচ্চা দের থেকে আলাদা করে দেওয়া হত, যারা শারীরিক ভাবে কমজোর তাদেরকে শুরুতেই গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে, মেরে ফেলা হত, বাদবাকি মানুষ দের মাথার চুল কেটে নিয়ে তাদেরকে ছেঁড়া জামাকাপড় দেওয়া হত পড়ার জন্য। কয়েদিদের দিয়ে প্রতিদিন আট থেকে দশ ঘন্টা একটানা কাজ করানো হত। আর দিনের শেষে, তাদের সামান্য কিছু খাবার দেওয়া হত, যার পরিমান এতটাই কম ছিল যেটা খেয়ে তারা শুধু বেঁচে থাকার ক্ষমতা টুকু পেত। বেশির ভাগ মানুষ তো শুধু, খিদে আর বিভিন্ন রোগের কারনেই মারা গেছিল। সেই সময় অসংখ্য এরকম ক্যাম্প ছিল সম্পূর্ণ ইউরোপ জুড়ে যার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল, পোল্যান্ড এর Oswith conserntration camp , 1945 সালের মে মাসে ব্রিটিশ আর্মি নাতজি দের হারিয়ে এই সমস্ত ক্যাম্প গুলো মুক্ত করিয়ে দেয়। আর শেষ হয় ভয়াবহ হলোকোস্ট, এই ছয় বছরের সময় কালে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলা হয়।
এই ষাট লক্ষ মানুষের মধ্যে একজন ছিল আনা ফ্রাঙ্ক, সে হলোকোস্ট এর সবচেয়ে চর্চিত একজন ব্যক্তিত্ব, মাত্র 15 বছর বয়সে conserntration ক্যাম্পে সে মারা যায়। আনা নিজের ডাইরি তে লিখেছিল – “যা ঘটে গেছে সেটা আর পরিবর্তন করা যাবে না, তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি যেন এমন ঘটনা দ্বিতীয় বার না ঘটে “।
এই ইহুদি মেয়েটি যে ডাইরিটা লিখেছিল সেটা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে মহান গ্রন্থ গুলোর মধ্যে একটা। নেলসন মেন্ডেলার মত ব্যক্তিত্ব এই বই টির দারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
এই ডাইরি তে সে নিজের জীবনের অসংখ্য কথা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাতজি দের দারা ইহুদিদের উপর অত্যাচারের কথা লিখেছে , আর খুব ভালো ভাবে বর্ণনা করেছে সেই সময়ের যুদ্ধ কালীন পরিস্তিতি। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহরে জন্ম হয়েছিল মেয়েটির, তার বয়স যখন চার বছর তখন নাতজিরা জার্মানি দখল করে নেয়। নাতজি দের অত্যাচারে তাদের পরিবার সেই শহর ছেড়ে নেদারল্যান্ড এর আমস্টারডাম শহরে চলে যায়, কিন্তু কিছু সময় পর নাতজিরা সেই শহরও দখল করে নেয়। নাতজিরা ইহুদি দের খুঁজে খুঁজে হয় মেরে ফেলছিল না হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ভরে দিচ্ছিলো, সেই সময় ফ্রাঙ্ক ফেমিলি সেই শহরের একটা বাড়িতে গোপন ভাবে আশ্রয় নিলো সেই বাড়ি এখন Secret annex নাম পরিচিত, সেই বাড়িতে তাদের সাথে আরো চারটি পরিবার লুকিয়ে ছিল।
12ই জুন 1942 আনার তেরো তম জন্মদিনে তার বাবা তাকে এই ডাইরি টি দিয়েছিল। তার ঠিক চব্বিশ দিন পরেই ইহুদিদের ভয়ে তাদের Secret annex এ আশ্রয় নিতে হয় , যেখানে তারা দুই বছর পঁয়ত্রিশ দিন লুকিয়ে ছিল, এই দুই বছরের সময় কালেই আনা তার ডাইরি লিখে ছিল ।
4ই আগস্ট 1944 সালে নাতজি রা তাদের ধরে ফেলে, তাঁদের পাঠানো হয় অসউইথ কনসনট্রেশন ক্যাম্পে, সেই ক্যাম্পে পুরুষ দের মহিলা এবং বাচ্চা দের থেকে আলাদা করে দেওয়া হত, ফলে আনার পিতা কে তাদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়, তারপর বেশ কিছু সময় আনা তার দিদি মারগট এবং তাঁদের মা একসাথে ছিল সেখানে তাঁদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করানো হত, কিছু সময় পরে আনা এবং তার দিদিকে সেখান থেকে Bergen Belsen concentration camp এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সেখানেই তারা দুজন মারা যায়।
এখনো পর্যন্ত জানা যায় নি, কে বা কারা তাদের পরিবারের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল, তবে সে যেই হয়ে থাকুক সে খুব ভালো ভাবেই জানতো ফ্রাঙ্ক পরিবার কোথায় লুকিয়ে আছে।
Karl Silberbaur নামক নাতজি অফিসার সেই জায়গায় গিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে, তাদের পরিবার কে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় সমস্ত মূল্যবান বস্তু আর টাকা পয়সা তারা নিয়ে নেয়, কিন্তু কিছু কাগজ পত্র আর নোট বুক তারা অপ্রয়োজনীয় মনে করে সেখানেই ফেলে চলে আসে, যার মধ্যে এই ডাইরিটিও ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যখন আনার ডাইরি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় তার কিছু সময় পরে এই নাতজি অফিসার স্বীকার করেছিল যে আমিও সেই বই কিনেছিলাম এই আশা নিয়ে যে হয়ত সেই বইতে কোথাও না কোথাও আমারো নাম থাকবে, কিন্ত সে পায় নি। এই বই টি প্রকাশিত হওয়ার পর অসংখ্য মানুষ সিক্রেট এনেক্স নামকে ওই বিল্ডিং টি দেখতে যেতে শুরু করল পরবর্তী কালে দেশের সরকার সেই জায়গা টিকে একটা মিউজিয়াম বানিয়ে দেয়। সেই জায়গা টি আজ, আনা ফ্রাঙ্ক হাউস নাম পরিচিত, প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই মিউজিমে যায়। এটাও জানা যায় যে আনার দিদিও একটা ডাইরি লিখত কিন্তু সেটা খুঁজে পাওয়া যায় নি।
যে আট জন্য মানুষকে সিক্রেট এনেক্স থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের মধ্যে একমাত্র আনার বাবাই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে জীবিত ফিরে এসেছিলো। সে ফিরে এসে জানতে পারে তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা আর বেঁচে নেই। Miep Gies ছিলেন ফ্রান্স ফ্যামিলির খুব কাছের একজন মানুষ, যে সময় ফ্রাঙ্ক ফ্যামিলি সিক্রেট এনেক্স এ আত্মগোপন করে ছিল, সেইসব সময় Miep নিজের প্রাণ ঝুকি নিয়ে তাদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এবং খাবার এনে দিত।
নাজিদের ফ্রাঙ্ক পরিবার কে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে, Miep সিক্রেট এনেক্স এ গিয়ে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিজের কাছে রেখেছিল, তারমধ্যেই সেই ডাইরি টি ছিল। আনার পিতা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে এলে Miep তার হাতে সেই সমস্ত জিনিস তুলে দেয়। কিছু সময় পর তার বন্ধু রা তাকে এই ডাইরি টি পুস্তক আকারে প্রকাশিত করার জন্য রাজি করিয়ে নেয়। ডাইরি প্রকাশিত হওয়ার পরে Miep যখন সেই বইটি পড়েছিল, সে জানিয়ে ছিল আমি একবারও এই ডাইরি টি পড়ে দেখিনি যদি পড়তাম, সেটা আমি পুড়িয়ে ফেলতাম কারন সেখানে আমার এবং আমার স্বামী সহ সেই সমস্ত মানুষের নাম লেখা ছিল যারা সিক্রেট এনেক্স এ লুকিয়ে থাকা মানুষ দের সাহায্য করেছিল, সেই ডাইরি নাতজি রা পেলে, তারা আমাদেরও মেরে ফেলত, আনারর পিতা একবার বলেছিল শুরুতে আমি সেই ডাইরি পড়তে পারিনি কারন আমি এই ডাইরি হাতে নিলেই দুঃখ কষ্টে ভেঙে পড়তাম, আমি ধীরে ধীরে ওটা পড়া শুরু করলাম আর আনার লেখা পড়ে আমি উপলব্ধি করলাম এটা সেই মেয়ের লেখা না যাকে আমি এতদিন চিনে এসেছি, আমি কখনো তার এত গভীর অনুভূতি এবং ধারণার ধরা ছোঁয়া পাই নি। এটা পড়ে আমি বুঝতে পেরেছি অধিকাংশ মাতাপিতা তাদের বাচ্চা দের ভালভাবে বুঝতেই পারে না। নেলসন মেন্ডেলা একবার বলেছিলেন, তিনি যখন জেলে ছিলেন তিনি একবার আনা ফ্রাঙ্কের ডাইরি পড়েছিলেন, সেটা পড়ে তিনি ভীষণ প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং আশাও পেয়েছিলেন।
1994 সালে মেন্ডেলা কে আনা ফ্রাঙ্ক ফাউন্ডেশন এর তরফ থেকে, Humanatarian Award দেওয়া হয়েছিল। এটাও মনে করা হয় এই বই টি বাইবেলের পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় সবথেকে বেশি পাঠা করা একটা বই এই বই টি 70 টির ও বেশি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
আনার লেখা থেকে জানা যায় তার মায়ের সাথে তার সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না , তাদের মধ্যে প্রায় ঝগড়া হত, তার সাথে তার পিতার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল, কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা অনেক মানুষ জানিয়েছে আনার এর মা খুবই কেয়ারিং একজন মা ছিলেন, তিনি রুটির শেষ টুকরো টুকু বাঁচিয়ে রাখতেন নিজের মেয়েদের জন্য। ষ্টারভেশন এর জন্য আনার মা ডিটেনশন ক্যাম্পের ভিতরেই মারা যায়। আনার স্কুলের দুইজন বন্ধু যাদের সাথে ডিটেনশন ক্যাম্পে আনার দেখা হয়ে ছিল। যাদের নাম ছিল, Nanette এবং Hannah, তারা তার সাথে তারের এপার থেকে কথাও বলেছিল। তারা হলোকষ্ট সার্ভাইভ করে নিয়েছিল এবং এখনো বেঁচে আছে যাদের বয়স 92 বছর।
এটা এখনো জানা যায়নি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কবে আর কোন দিন আনার মৃত্যু হয়েছিল, তবে এটা মনে করা হয় মাসটা ছিল ফ্রেব্রুরি থেকে মার্চের মধ্যে , ডাচ অথরিটি এটা ধারণা করে মার্চের শেষ দিকে আনা এবং তার দিদি মার্গট মারা যায়, সেই সময় মার্গট এর বয়স ছিল উনিশ বছর আর আনা ছিল 15 বছরের।
15 ই এপ্রিল 1945 সালে ব্রিটিশ আর্মি Bergen Belsen concentration camp মুক্ত করিয়ে দেয়, দুঃখের বিষয় এর কয়েক সপ্তাহ আগেই আনা মারা যায়। আনা একজন সাংবাদিক এবং অনেক বড় লেখিকা হতে চেয়েছিল। সে নিজের জীবনে মহান কিছু করতে চেয়েছিল,তারা ডারির 5th এপ্রিল 1944 এর পাতায় সে লিখেছিল,
“আমি সেই সমস্ত মহিলা দের মত জীবন যাপন করার কথা ভাবতেও পারি না, যারা নিজেদের কাজকরেই নিজেদের জীবন কাটিয়ে দেয় এবং ইতিহাস তাদের ভুলিয়ে দেয়, বেশিরভাগ মানুষ যে ধরনের জীবন কাটায় আমি সেই ধরনের জীবন চাই না। আমি আমার জীবন কে সেই সেই ভাবে কাটাতে চাই যেভাবে কাটালে অসংখ্য মানুষের ভালো হয় এমন কি যাদের আমি চিনি না তাদেরও। আমি মরে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকতে চাই ।”
আজ আনা যদি দেখত এত কম বয়সে সে কত মানুষকে Inspire করেছে এবং করে চলেছে, সে খুব খুশি হত, আনার লেখা কিছু শব্দ দিয়েই শেষ করব –
“Everyone has inside of him a piece of good news. The good news is that you don’t know how great you can be! How much you can।ove! What you can accomplish! And what your potential is!”
Anne Frank


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
Musician, Writer, Vocalist

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।