লেখক: ইন্দ্রনীল মজুমদার
“আচ্ছা, আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছিল কীভাবে?” এই প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগজনই বলবেন, “কীভাবে আবার? ওই তো এক বিশাল বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে জন্ম নিয়েছিল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড (Universe)। আবার এই বিস্ফোরণের মাধ্যমেই জন্ম হয়েছিল স্থান ও কাল (space & time)-এর।” অর্থাৎ তাঁরা বলবেন ‛বিগ ব্যাং থিওরি’-র কথা যা সহজ ভাষায় বলা যায় যে, প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে এই সুবৃহৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত ভর একটি অকল্পনীয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র-বিন্দুতে সীমাবদ্ধ ছিল যার আয়তন শূন্য, ঘনত্ব অসীম, আর সেই অভাবনীয় অবস্থায় প্রবল চাপে এক বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। সেজন্যই এর নাম ‛বিগ ব্যাং’। আর এই বিস্ফোরণের ফলে জন্ম নেয় স্থান-কাল এবং সবচেয়ে বড়ো কথা জন্ম হয় আমাদের এই মহাকাশের। আমরা অনেকেই হয়তো জানি যে, এই ‛বিগ ব্যাং’ নামক ক্রিয়াটি আজও চলছে। কেননা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বিগ ব্যাং ঘটনার থেকে যে শুরু হয়েছিল তা আজও সমানতালে চলছে। বরঞ্চ ডপলার ক্রিয়ার মারফতে দেখা গেছে যে, যে বস্তু যত দূরের তার আমাদের ছেড়ে আরও দূরে চলে যাওয়ার বেগও তত বেশি। কিন্তু আমরা ক’জন জানি যে, এই বিগ ব্যাং তত্ত্বটি আমাদের জানিয়েছিলেন জর্জ ল্যমেত্র্ নামক একজন বেলজীয় পাদ্রী? যাইহোক, এই তত্ত্বের পক্ষে রয়েছে বিজ্ঞান সমাজ থেকে আরম্ভ করে সাধারণ মানুষের এক বিপুল অংশ। কিন্তু, সব মত বা তত্ত্বের পক্ষ-বিপক্ষ তো থাকবেই। এই বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে দাঁড়িয়েও তো কেউ কেউ বলেন যে, “পৃথিবী স্থির, সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।” যদিও এঁদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য এবং আমরা এঁদের সঠিক মস্তিষ্কের অধিকারী হিসেবে দেখি না। কিন্তু বিগ ব্যাং-এর বিপক্ষে যাঁরা দাঁড়িয়েছেন তাঁরা কিন্তু বেশ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। প্রত্যেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশেষ করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণাও করে গেছেন। আর এঁরা হলেন তিনি ইংরেজ গবেষক –– হার্মান বণ্ডি (১৯১৯-২০০৫), ফ্রেড হয়েল (১৯১৫-২০০১) ও থোমাস গোল্ড (১৯২০-২০০৪)। ১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া এঁদের তত্ত্বের নাম হল –– ‛স্টেডি স্টেট থেওরি’। এই তত্ত্ব বলে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে যেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা হোক না কেন এটা অপরিবর্তনশীল। আজ যেমন আছে সেরকমই চিরটা কাল ছিল অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্থান-কাল নির্বিশেষে একই রয়েছে, এর গড় ঘনত্বও একই রয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও সম্প্রসারণ ঘটেনি। তাই, বলা যায় যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো ‘শুরু’ বা ‛উৎপত্তিকাল’ নেই আবার ‘শেষ’ বা ‘বিনাশকাল’-ও নেই।নিঃসন্দেহে, এ তত্ত্ব বড়োই সহজ, সরল কিন্তু অনেক কিছু প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না। এই যেমন ধরা যাক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একই রয়েছে কোনও সম্প্রসারণ করছে না তবে তো বলতেই হবে যে, এই যে এত নক্ষত্র জন্মাচ্ছে, তাদের আলো তো আমাদের পৃথিবীতে আসছে। তাহলে এত অসংখ্য তারা রাতের আকাশে দেখা যেত যে রাতের আকাশও দিনের বেলার মতোই আলোকিত থাকত। কই তা তো থাকে না। জানি বিগ ব্যাং-এর স্বপক্ষে দাঁড়ালে স্টেডি স্টেটবাদীরা বলবেন যে, এমনও নক্ষত্র বা মহাজাগতিক বস্তু দেখা গেছে যা ১৪০০ কোটি বছরের বা তারও পুরোনো। যখন বিগ-ব্যাং তত্ত্ব সঠিক প্রমাণিত হল তখন এই তত্ত্ব জানাল যে, ব্রহ্মাণ্ডে স্থানের এক বৈশিষ্টানুযায়ী প্রতি কিউবিক মিটারে প্রতি বছর ১০-১০ নিউক্লিওন (প্রোটন ও নিউট্রন) জন্মাচ্ছে। তবুও, বেশিরভাগেরই স্টেডি স্টেট তত্ত্বে বিশ্বাস নেই, কেননা এই তত্ত্ব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে থাকা মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি, পারেনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে। এরফলে, এই তত্ত্ব বিগ ব্যাং তত্ত্বের কাছে হার মেনেছে। “বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হয়তো একইরকম ছিল” –– এ কথাটি মানতে নারাজ অনেকেই। আর তাই, স্টেডি স্টেট থিওরির জনপ্রিয়তা আজ ফিকে হয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র:
Oxford Dictionary of Science
Manorama Tell Me Why(October,2009- The Universe issue)
উইকিপিডিয়া।
লেখকের কথা: ইন্দ্রনীল মজুমদার
বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর ও বিজ্ঞান লেখক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতেই মূলত তাঁর লেখালিখি।