লেখক: বর্ণশ্রী বকসী
কবিতা তোমার হাত ধরে হেঁটে যাই
পৃথিবীর গভীরতম অভিমানী ভোরে…
সাহিত্যের জননী তুল্য যে মাধ্যমটি তা কবিতা। নারীর সুনিপুণ সাজ-সজ্জায় যে সৌন্দর্যের বিকাশ তাই অনুরণিত চলনের ছন্দে আর এই নিয়েই কবিতার ক্রমো উন্মোচন। আদি কবি যে পথ দেখিয়েছিলেন সেই পথেই মনের রাজ্যের বিকাশ লাভ। কবিরা সেই পুরোহিত যাঁরা লৌকিক ভাবকে মনের কন্দরে জারিত করে অলৌকিকত্ব দান করেন। এই কারণেই তাঁরা অপার এই কাব্য সংসারে প্রজাপতি ব্রহ্মার মতই সতত সৃজনশীল ।তাঁদের সৃজনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় ঝরনার অনর্গল প্রবহমানতা। কবিতাকে প্রেয়সীর ভূমিকায় বসিয়েই যেন কবিদের মানস অভিসার চলেছে যুগ যুগান্ত ধরে।
কবিতার হয়ে ওঠার পেছনে থাকে নানা উপাদান, অবশ্যই তা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিন। কবি তাঁর ভাবাবেগ মিশিয়ে কিছু লিখলেই তা কবিতা হয়ে যায় না।বরং বলা যায় কবিতা হয়ে ওঠে ধ্বনি, রস, ছন্দ ,অলংকারও ভাবের সুবিন্যস্ত রূপ।যখন একজন কবি তাঁর হৃদয়ের ভাষাকে নির্মাণ করছেন তখন তা তাঁর হৃদয় নিঙড়ে উঠে উঠে আসছে।আমরা অর্থাৎ পাঠকেরা সব লেখাকেই সমভাবে মর্যাদা দিই না তার কারণ কবিতার পরম উপাদান যে রস তার অভাব। কবিতা ও রসের সম্পর্ক গভীর ও দৃঢ় বন্ধন যুক্ত। আলংকারিকেরা কাব্য সম্বন্ধে আলোচনায় তার আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা কখনো রীতিকে কাব্যের আত্মা বলেছেন আবার কখনো ধ্বনিকে আত্মা হিসেবে দেখতে না দেখতেই বলেছেন রস কাব্যের আত্মা, কারণ “বাক্যং রসাত্মকম্ কাব্যম্”। রস যুক্ত বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে ।এই রস আসলে এমন এক গভীর অনুভূতিবেদ্য সংবেদনশীল বস্তু যা কবিতাকে পাঠকের হৃদয়ের কাছে তুলে ধরতে পারে। দুটি কবিতার তুলনামূলক দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যেতে পারে।প্রথমের উদাহরণটি রসহীন কাব্যের —
শিবের ক্রোধে জ্বলল মদন
শরীর হলো ছাই
তবু তাকে খুঁজে বেড়ায়
প্রেমিক যুগলরাই।
ছড়িয়ে পড়া ভস্মরাজি
মাতল তাতে বিশ্ব আজি
কৌতুকময় চারিধার ।
এই কবিতার বিপরীতে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মদন ভস্মের পর’ কবিতাটি লক্ষ্য করি তবে সেখানে দেখি রসের ধারায় কবি বলেছেন —
পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একী সন্ন্যাসী,
বিশ্বম য় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসী,
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
রসের নিষ্পত্তিতে এই কবিতা হয়ে উঠেছে কালজয়ী।
কবিতা আমাদের মরমের বার্তাকে তুলে ধরে পৌঁছে দেয় সেই অজানালোকে, যেখানে শব্দ ব্রহ্ম জীবিত শরীর ধারণ করে এঁকে যায় জীবনের বলা ও না বলা নব নব অনুরাগমালা। স্বল্প কথায় পৌঁছে যায় যে কথা অন্য মানুষের মনের গহীনে তার প্রধান রথী কোলাজের বিমূর্তরূপ অন্বেষণ। কবিতার মোহময়ী খোলস দর্পণের মত স্বচ্ছ মনের অধিকারীর হৃদয়ে গিয়ে দোলা দেয় অনুষঙ্গী রসকে নিয়ে। নয়টি রস জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে ক্রিয়া করে অন্তরের অন্দরমহলে।রস কী বস্তু একথা বলতে গিয়ে আলংকারিকেরা জানিয়েছেন ‘রস্যতে ইতি রসঃ’। রস এমন এক অবস্হা যার সাহায্যে গড়ে ওঠা রীতিগত প্রকৃতিকে ক্রমশ মরমিয়া হার্দ্রিকতায় নিয়ন্ত্রিত করে। কবিরা তাদের দেখা ও না-দেখা বিষয়কে কাব্যে ব্যঞ্জিত করতে আশ্রয় নেন নানা জিনিসের, সেইসব কিছুর মধ্যে অন্যতম রস। যখন কোনো কবিতা পাঠের মাধ্যমে হৃদয়ে বিভিন্ন অনুভূতির উজ্জীবন ঘটে তখন আমারা বুঝতে পারি লেখাটি রসগ্রাহী হয়ে উঠেছে। প্রেম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেই প্রেমের আকুল বহি:প্রকাশ ঘটে বিরহে, বৈষ্ণব কবি যখন চিরকালের প্রেমিক সত্তার প্রতিনিধি রাধা কৃষ্ণের বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলে রসের চরম উৎকর্ষ প্রকাশ করেন তখন তা ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সর্ব জনীন হয়ে ওঠে। কবি বলেন —
“দুহুঁ ক্রোড়ে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া…”
কবিতার ক্ষেত্রে রস নির্বাক নিস্পন্দ দেহে প্রাণ সঞ্চার করে। রসের সন্নিবেশেই সাধারণ বক্তব্যও অসাধারণত্ব লাভ করে পাঠকের হৃদয় হরণ করে। আমরা যখন কবি শক্তি চট্টপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’ কবিতাটি পাঠ করি তখন দেখি কবি একদম আটপৌরে ভাষায় তাঁর বাচ্যকে ভাবের মালায় গেঁথেও অনির্বচনীয় করে তুলেছেন রসের মিলনে। তিনি এই কবিতার শুরুতে বলেছেন —
“দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
অবনী বাড়ি আছো?
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে —
‘অবনী বাড়ি আছো?”
কবি এই কবিতায় রসালোকের বা রসভাষ্যের তুরীয় অবস্থায় তাঁর লেখাকে পৌঁছে দিয়েছেন আর সেইজন্যই সহজ সরল ভঙ্গিতে বলা কবিতাটি পাঠকের হৃদয়ে এক আলাদা মাধুর্যের সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত।
‘A thing of beauty is a joy forever’ কবিতা সেই সৌন্দর্যময় বস্তু যা আমাদের শাশ্বত আনন্দের অংশীদার করে। কবিতার সেই অপূর্বতা প্রকাশ হয় রসের যথাযথ মিশে থাকায়। আহারের রস যেমন আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে ঠিক তেমনি আমাদের মন তৃপ্তি লাভ করে রসোত্তীর্ণ কাব্য পাঠে। কবিতা ও রস যেন বর ও বধূ যাদের সুন্দর সহাবস্হানেই ছড়িয়ে থাকে কাব্য দাম্পত্যের মধুরিমা।
লেখক পরিচিতি: বর্ণশ্রী বকসী
বর্ণশ্রী বকসী চাকরি সূত্রে আসামের বরাক উপত্যকায় বাস করেন। সাহিত্য চর্চা তাঁর জীবনের অঙ্গ। কবিতা লেখার পাশাপাশি সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল এম.ফিলে বিদ্যাসাগরের অনুবাদ সাহিত্য এবং পি.এইচ. ডি করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যভাষার চিহ্নতাত্ত্বিক অধ্যয়ন নিয়ে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
১. রবীন্দ্রকাব্যের চলিষ্ণুতা (প্রবন্ধ গ্রন্থ)
২.শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যচর্চা (প্রবন্ধ গ্রন্থ)
৩.আমিও ওথেলো হবো (কাব্যগ্রন্থ)