কারবালার রক্তাক্ত অক্ষরে লেখা এক অবিনশ্বর সত্য

লেখক : মোবাররম হায়দার

পাশেই বইছে ফোরাত নদী। পানির ঢেউ খেলছে নিরন্তর, বড় বড় ঢেউ যেন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তবুও আজ, আশুরার এই দিনে, পানির এক বিন্দুও নেই ইমামের তাঁবুতে। ইমামের কারবালায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই শত্রুপক্ষের প্রথম নির্দেশ—ফোরাতের ধারে থাকা সব জলাধার ঘিরে ফেল! যেন এক ফোঁটাও না পৌঁছয় আহলে বাইতের তৃষ্ণার্ত শিশুর ঠোঁটে। তাবুর ভিতরে বসে আছেন আহলে বাইতের পবিত্র নারীরা— নিঃশব্দে, অসহায়, তৃষ্ণার্ত আলির কন্যারা, আলোর প্রতীক জয়নাব, কাঁদছেন না, তবু তাঁর নিঃশ্বাসে ঝরে পড়ছে একেকটি পিপাসার কান্না।

ইমাম দাঁড়িয়ে আছেন, গভীর চিন্তায় নিমগ্ন— তাঁর চোখে যেন খায়বরের স্মৃতি, যেখানে সাহাবারা পানির অভাবে করুণ পরিস্থিতিতে, আর সেদিন যেই নবীর আঙুলে ঝর্ণা ঝরেছিল। আজ তাঁরই রক্তের উত্তরসূরীরা পানিহীন!
“হে জালেম, তোরা কী পানি বন্ধ করবি?”
হোসাইন তো ঠোঁট নাড়ালেই আল্লাহ্ পানির বন্যা বইয়ে দিতে পারেন, শত্রুর প্রাসাদ ডুবে যাবে ফোরাতের স্রোতে। কিন্তু না, আজ তিনি এসেছেন ইতিহাসকে এক নতুন বার্তা দিতে, ইসলামের অস্তরাগ ঠেকাতে, হক ও বাতিলের মাঝে রক্তরাঙা রেখা আঁকতে।

শত্রুপক্ষের সেনা অগণিত, আর ইমামের পক্ষে কেবল বাহাত্তর। তবে এই বাহাত্তরের একেকজন একেকটি সূর্য, একেকটি পাহাড়। প্রতিজন যোদ্ধা সহস্র শত্রুকে জাহান্নামের দ্বারে ঠেলে দিয়েছেন। কিন্তু একে একে সবাই তীরের আঘাতে, তলোয়ারের ঘায়ে, রক্তাক্ত দেহ নিয়ে, শেষ চাওয়া— এক ফোঁটা পানি— নিয়েই শহীদ হয়েছেন। যদি পানির নাগাল পেতেন, তবে এই বাহাত্তর বীরের সামনে শত্রুপক্ষের লক্ষ সৈন্য তো দূরের কথা, সমগ্র অন্যায়ের সাম্রাজ্যই বিলীন হয়ে যেত। একে একে সবাই রণভূমে শহীদ— প্রিয়পুত্র, ভাই, বন্ধু, সহচর— শুধু ইমাম দাঁড়িয়ে আছেন একা। তাঁর পাশে আজ নেই কেউ— আব্বাসও নন, যিনি তো তাঁবুতে শিশুর কান্না শুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রুর বেষ্টনী ভেদ করে। আলমদার আব্বাস—দুই হাত হারিয়েও পানি নিয়ে বীরবিক্রমে ফিরেছিলেন, কিন্তু একটি নির্মম ঘা তাঁকে থামিয়ে দেয় পথেই। তবু তাঁর দৃষ্টি ছিল পানির দিকে, আর হৃদয় তৃষ্ণার্ত শিশুদের দিকে। অন্দরমহল থেকে ভেসে এল এক মর্মান্তিক আহ্বান। দুধের শিশু আলী আসগর— তৃষ্ণায় কাতর, দুধ পাচ্ছে না, পানি তো বহুদূর। মায়ের কোলে ছটফট করা এক নিরীহ প্রাণ, যার চোখে শুধু এতটুকু পানির আকুতি, কান্নার জলরাশি।

ইমামকে বলা হ’ল, “হে ইমাম, আপনি অন্তত শত্রুপক্ষের কাছে বলুন, হয়ত একটি কোমল হৃদয় দয়া করে দেবে এক ফোঁটা পানি। মায়ের মন মানতে চায় না।” ইমাম সন্তানকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এলেন শত্রুর দিকে, কণ্ঠে শান্ত আহ্বান, “এ দুধের শিশুর সাথে তোমাদের কোন শত্রুতা নেই। সে যুদ্ধ করতে জানে না, সে তো শুধু পানি চায়। তাকে একটু পানি দাও, আল্লাহর নামে।”
কিন্তু ফিরল না পানি, ফিরে এল বর্বরতার ইতিহাস কাঁপানো এক তীক্ষ্ণ বার্তা। এক জালেমের ধনুক থেকে ছুটে এল তিন শাখাবিশিষ্ট এক বিষাক্ত তীর, যা এসে বিঁধে গেল শিশুর কোমল গলায়। এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল কাঁপা কাঁপা কান্না, বুকে নিঃশব্দ এক বিস্ফোরণ। ইমাম হতবাক—নির্বাক—নিঃশব্দ। শিশুকে কোলে করে নিয়ে গেলেন মায়ের কাছে, নীরবে বললেন, “আমার আসগর আর পানি পান করবে না, সে মোস্তফার হাতে হাউজে কাওসার থেকে পান করবে।”

এখন ইমাম একা। সঙ্গী-সাথী কেউ নেই। প্রিয় ভাই, সন্তান, সাহাবি সবাই শহীদ। থেকে গেছে কেবল তাঁবুতে শুয়ে থাকা অসুস্থ সন্তান, আলী ইবনে হোসাইন (জয়নুল আবেদীন)। বিছানা থেকে কষ্ট করে উঠে, পিতার সামনে এসে বিনীত অনুরোধ করলেন, “আমার সময় এসেছে, আমাকে অনুমতি দিন রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার।”
কিন্তু ইমামের কণ্ঠে অপার মমতা, “না, তুমিও যদি শহীদ হও, তাহলে আমার নানার (দ.) বংশের আলো নিভে যাবে। কীভাবে টিকবে ইসলাম, যদি সে আলো নিভে যায়?” এই পরিবার কুরআনের সহচর, যে পরিবার ইসলামকে ত্যাগ দিয়ে টিকিয়ে রাখবে যুগে যুগে। হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য দেখানোর জন্য এই রক্তই হবে দলিল। এই পরিবারের আত্মত্যাগই হবে হেদায়াতের নিশান। এখনও ইমাম বারবার সুযোগ দিচ্ছেন, হয়ত জালেমরা ফিরে আসবে, হয়ত তারা ভুল বুঝবে। তাই একে একে প্রিয়জনদের কুরবানি দিয়েছেন, তাঁদের হারিয়েছেন। কারণ, তাঁদের শহীদ করা মানে মুমিনদের শহীদ করা। কিন্তু হোসাইনকে শহীদ করা মানে— ইমানকেই হত্যা করা। ইমাম জানতেন, তাঁর শাহাদাত হবে পৃথিবীর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ডের এক করুণ অধ্যায়। একদা যাঁর নানাজান (দ.) অন্ধকারে ডুবে থাকা বর্বর জাতিকে এনেছিলেন আলোর পথে, করেছিলেন আলোকিত, আজ তাঁরই পরিবার রক্তাক্ত— এই বর্বরদের হাতেই। তবুও ইমাম দৃঢ়। চেয়েছেন তারা ফিরে আসুক, কিন্তু তিনি নিজে এক বিন্দুও অন্যায়ের সামনে মাথা নত করেননি। প্রয়োজনে পরিবার কুরবান করেছেন, এবার নিজেকেও করবেন কুরবান।
বুকভরা আস্থা, চোখে সত্যের দীপ্তি, কণ্ঠে নীরব ঘোষণা, “শির দেগা, নেহি দেগা আমামা!” ইসলামের নামে কোন জুলুমকে মেনে নেওয়া মানে ইসলামের সূর্যকে অস্ত যেতে দেওয়া।

কিন্তু ইমাম জানেন, যতক্ষণ তাঁর প্রাণ আছে, ততক্ষণ ডুবতে দেবেন না এই আলোকিত দীপ্তি, তাঁর নানাজানের রেখে যাওয়া সেই পবিত্র ইসলাম। এবার সময় এসেছে— ইমাম হোসাইন (আ.) নিজে রণভূমিতে অবতীর্ণ হবেন। আকাশ থমথমে, পৃথিবী স্তব্ধ— কারণ এবার ইতিহাসের বুক কাঁপিয়ে নামবেন সত্যের সর্বশেষ কণ্ঠস্বর।


লেখক পরিচিতি : মোবাররম হায়দার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা জমা দিতে ছবিতে ক্লিক করুন