লেখক : মিত্রা হাজরা
বসন্ত সমাগমে অরণ্যানী পুষ্পপত্রে অপরূপ আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। রাত্রির অপূর্ব এক রূপ আছে, বহুরূপ সুগন্ধ যুক্ত পুষ্প সমূহ শুধু অরণ্যের শোভা বাড়ায়নি, বৃক্ষ কন্টকে আচ্ছাদিত এ বনের পশু পক্ষীকুল ও উৎফুল্ল আজ। কিন্তু সে দিকে দৃষ্টি নাই এই পঞ্চ মনুষ্য ও সাথে মহিমময়ী এক নারীর। সম্ভবত ইনি এঁদের জননী ।ক্লান্ত অবসন্ন, চরণ যুগল কন্টকে, উপলখন্ড ঘর্ষনে রক্তাক্ত । তবুও না থেমে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন। প্রভাত হয়ে এল, নীলাকাশে আদিত্য উদয়ের পথে। যেহেতু অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ, তাই নগরবাসীর কৌতূহল এর মধ্যে পড়েন নি। ঐশ্বর্য, শৌর্য, বীর্য, বিদ্যায় লালিত পালিত এই পুত্ররা এতোদিন সুখ ছায়ায় কাটিয়েছেন —পিতামহ এর স্নেহ ছায়ায়, গুরুর, গুরুজন দের স্নেহছায়ায়। তবুও সব ছেড়ে তাঁরা এই বিপদ সঙ্কুল অরণ্যের পথ বেছেছেন। আসন্ন বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাই ক্লান্তি গ্রাস করলেও একভাবে পদব্রজে দক্ষিণ দিশায় চলেছেন।
ইতিপূর্বে জতুগৃহের সংবাদ এসেছে, পঞ্চপান্ডব ও জননী কুন্তী জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন, প্রজারা হা– হুতাশ করছে, তবে মনে মনে—দুর্বিনীত দুর্যোধন ও শকুনীকে ভয় পায় সকলে। এই পঞ্চ ভ্রাতা ও জননী কারা, কোথায় চলেছেন এনারা! না–এনারাই পঞ্চপান্ডব, জননী সহিত রক্ষা পেয়েছেন বিদুরের সহায়তায়। মৃত্যু কিভাবে হবে— কার্য যে বাকি এখনো! মহামতি বিদুরের বিশ্বস্ত লোক সুড়ঙ্গ কেটে ওনাদের পরিত্রাণের সু বন্দোবস্ত করেছেন। অবশেষে রাত্রি গভীরে জতুগৃহে অগ্নিসংযোগ করে নিজেরাই সুড়ঙ্গপথে গঙ্গা কিনারে এসে উপস্থিত হয়েছেন এবং বিশ্বস্ত নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে নক্ষত্র নির্দেশে সমানে দক্ষিণ দিশায় চলেছেন। আসন্ন মৃত্যুর দুর্ভাবনাকে জীবনে রূপান্তরিত করে মানসিক চাপে, রাত্রিজাগরণে, আঁধার পথে চলে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সব বটবৃক্ষের নিচে শয্যা নিলেন। একাকী শুধু মধ্যম পান্ডব চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন, কোন শত্রু এসে অকস্মাৎ আক্রমণ না করে, সাথে হিংস্র প্রাণীর ভয়, এই অরণ্যের মনুষ্যরাও হিংস্র হয় শুনেছেন। এই অগম্য পথে অনেকখানি পথ তিনি নিজস্কন্ধে জননীকে বয়ে এনেছেন। এখন সকলের তৃষ্ণার একটু জলের বন্দোবস্ত করার জন্য ইতস্তত দেখতে লাগলেন। কিছু জলচর পক্ষী সারস, বকের আওয়াজ শোনা গেল– মনে হয় নিকটে জলাশয় আছে !
জননী ও ভ্রাতাদের আশ্বস্ত করে জলের সন্ধানে গভীর অরণ্য এ প্রবেশ করলেন মধ্যম পান্ডব। চলতে চলতে মধুমদ মোদিত বনস্থলীর রূপ মাধুর্যে চলার গতি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর ।কী সুন্দর, এ বনানী! মৃদুমন্দ সমীরণের স্পর্শে ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছে, অবশেষে জলাশয় দেখতে পেলেন। হরীতকী, কদম্ব, শমী বৃক্ষের আড়ালে বৃহৎ জলাশয়—কমল দল প্রস্ফুটিত হয়ে আছে অজস্র ।কিছু বৃক্ষপত্র সংগ্রহ করলেন, তাকে পাত্রের আকার দিলেন, আর নির্মল জল সংগ্রহ করে ফিরে চললেন। আসতে বিলম্ব হয়েছে, ক্লান্ত অবসন্ন ভ্রাতারা ও জননী গভীর নিদ্রায় ডুবে আছেন। প্রথমে মনে ক্ষোভ এল দুর্যোধনের কুকীর্তি র কথা স্মরণ করে, আবার আশ্বস্ত হলেন ওদের কষ্ট একটু লাঘব হয়েছে ভেবে, সেই জল সাবধানে রক্ষা করতে লাগলেন–নিদ্রা ভেঙে সকলে তৃষ্ণা মেটাতে পারবে।
ক্রমশঃ…
লেখক পরিচিতি : মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবসি । আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।