মনোরম মধুমাস – এক অনার্য ভূমি কন্যার প্রেম – দ্বিতীয় পর্ব

লেখক : মিত্রা হাজরা

আগের অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত এই বনে শত পুষ্পবৃক্ষের সাথে হিংস্র শ্বাপদ ও মনুষ্য ও ছিল। এমন অবস্থায় নরমাংসভোজী হিড়িম্ব দেখতে পেল পঞ্চপান্ডব ও দেবী কুন্তীকে। এতগুলো মানুষ কে ভোজ্য হিসাবে পেয়ে সে উদগ্রীব হয়ে বোন হিড়িম্বা কে তাদের ধরে আনতে বলল— ঐ মানুষদের তুই মেরে আমার কাছে নিয়ে আয়, বহুদিন মানুষ ভক্ষণ করি নি। অনার্য সম্ভূত এই সব মানুষদের অতিমানুষিক ক্ষুধা, লোভ ও চেহারার বিরাটত্ব এদের রাক্ষস বলা হয়েছে মহাভারতে। তাদের ভাষাও আর্যেতর গোষ্ঠীর মানুষের। হিড়িম্বাও লোভে পড়ে সুখসুপ্ত পান্ডবদের কাছে এল। কিন্তু বলিষ্ঠ চেহারার বিশালকায় মধ্যমপান্ডব কে দেখে বড় ভালো লাগলো হিড়িম্বার। বাহ্! বেশ পৌরষদীপ্ত চেহারা, সোনার বরন রঙ, দীর্ঘ বাহু, পেটানো কাঁধ ও মসৃণ ত্বক, হিড়িম্বা ভালো বেসে ফেলল ভীমসেন কে। সে বনবালা –ভীমের মত পুরুষের আসঙ্গলিপ্সায় সে নিজের দিকে তাকালো। নাহ্—এভাবে হবে না, হিড়িম্বা এক সুন্দরী কন্যার রূপ ধারণ করলো, নিজেকে মোহিনী রূপে সাজালো।

কি ভাবে রাক্ষস রূপ থেকে মোহিনী রূপ হবে— অলৌকিক কিছু? সম্ভবত নিজের বেশবাস পরিবর্তন করেছিল, পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তুলতে ফুলের মালা টালা দিয়ে কেশ সজ্জা করেছিল। সলজ্জ ভাব এসেছিল চোখে, তাই বনবালা হিড়িম্বা কে মোহিনী লাগছিল। তবে কাশীরাম দাস—হিড়িম্বার রূপ বর্ণনায় লিখেছেন—‘বিনা মেঘে স্থির যেন তড়িৎ তরঙ্গ। ‘তাই মনে হয় অরণ্যচারী হলেও হিড়িম্বা যথেষ্ট সুন্দরী ছিল। লক্ষ্য করার বিষয় হিড়িম্বা কিন্তু পান্ডব বংশের প্রথম বধূ মাতা। এখানে হিড়িম্বা দৌপদীর উপরেই আছে। যদিও হস্তিনাপুর বা ইন্দ্রপ্রস্থে সে ভাবে উপস্থিত হতে দেখা যায় না। তবে কাশীরাম দাসের লেখা মহাভারতে হিড়িম্বা উপস্থিত আছে ইন্দ্রপ্রস্থে।

এখন প্রেম এসেছে অনার্য কন্যা হিড়িম্বার, সে বনবালা—ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে জানে না, তাই সরাসরি প্রেম নিবেদন করছে মধ্যম পান্ডব কে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের জীবনেই প্রেম আসে, তবে তার প্রকাশ পৃথক। ফুলের আভরণে সেজে সে ভীমের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো—তোমরা কোথা থেকে এসেছো, এই স্ত্রী লোকটি কে, সব মাটিতে শুয়ে আছে কেন? জানো না এ জঙ্গল ভয়াবহ, পাপাত্মা হিড়িম্ব থাকে এখানে? ভীম দেখে ভাবছে–কে এই অপ্রতিমা নারী? বলল— সে খোঁজে তোমার দরকার কি! আর তুমিই বা এ অরণ্যে কেন? ভীম দেখছেন—দীর্ঘ দেহ, কৃষ্ণবর্ণ কিন্তু মুখশোভা শশধরের নায় অর্থাৎ চন্দ্রবদনী ,সুনাসা, চারু সর্বাঙ্গী। এবার হিড়িম্বা তার ভাই এর কথা সব বলে দিল, তারা অরণ্যচারী অনার্য, তাদের মারার জন্য ভাই হিড়িম্ব পাঠিয়েছে। বলল— আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, আমি তোমাদের ভাই এর হাত থেকে রক্ষা করবো, সকলকে পিঠে করে নিয়ে নিরাপদ জায়গার চলে যাব। আমি তোমার সঙ্গ কামনা করছি।

ভীমসেন এখন বিরাট কার্যে ব্যস্ত আছেন, ঐ সব কথায় কোনো মনের পরিবর্তন হলো না—যাও যাও, আমাদের রক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজেদের আমরা রক্ষা করতে জানি। এদিকে দেরি দেখে ভাই হিড়িম্ব তেড়ে এল– এসে দেখে সেজেগুজে বোন প্রেম নিবেদন করছে অচেনা এক মানুষ কে। বলল— দাঁড়া আগে এদের মারি, তারপর তোর ব্যবস্থা করবো। ভয় পেয়ে হিড়িম্বা তখন ও বলে চলেছে—-আজ আমার ভাই এর হাত থেকে বাঁচতে পারবে না, শোনো আমার কথা, আমি সকলকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যাই বরং। রূপমুগ্ধ পতঙ্গের ন্যায় হিড়িম্বা নিজেকে মনে মনে যে সমর্পণ করে বসেছে ভীমসেন কে। শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ ভীমসেন আর হিড়িম্বর। সেই বিকট গর্জনে চারভাই আর জননীর নিদ্রা ভেঙে গেল। সামনে হিড়িম্বা কে দেখে কুন্তী জিজ্ঞাসা করলেন—কে মা তুমি? আর আমার ছেলে কার সাথে ভীষণ যুদ্ধে রত? হিড়িম্বা বলল— মা এ অরণ্য আমার ভাই হিড়িম্বর,আমি তার বোন হিড়িম্বা, আমাকে মারতে পাঠিয়েছিল ভাই, আমি তোমাদের রক্ষা করতে চেয়েছি। এখন দুজনে ভীষণ লড়াই করছে, কেউ বাঁচবে না হিড়িম্বর হাত থেকে। কুন্তী বললেন— বাছা চিন্তা কোরো না, আমার ছেলে একাই ওকে শেষ করবে। তাই হোল এই যুদ্ধে হিড়িম্ব ভীমের হাতে নিহত হলো। যুদ্ধজয়ের পর সকলে যখন ভীমের প্রশংসা করছে হিড়িম্বা দুঃখী মনে দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

এরপর অর্জুন বললেন— আর অরণ্য নয়, আমরা নগরের মধ্য দিয়ে যাব। নির্জন পথ ধরে তাঁরা চলতে শুরু করলেন, দেখা গেল হিড়িম্বা ও তাদের পিছনে পিছনে চলছে। ভীম দেখলো মহা বিপদ, অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু হিড়িম্বা ভীমকে ত্যাগ করতে নারাজ। এখন যুধিষ্ঠির কুন্তীকে বললেন— মাতা হিড়িম্বা তার ধর্ম রক্ষা করেছে আমাদের বাঁচিয়ে, ও যা চাইছে তাই আপনি অনুমতি দিন। কুন্তীও দেখলেন মেয়েটি সহজ সরল, আমার সন্তান কে ভালোবাসে, তাই অনুমতি দিলেন। ভীমকে নিয়ে হিড়িম্বা হিমালয়ের উপর প্রত্যন্ত ভূমিতে বিহার করতে চলে গেল। স্ত্রী পুরুষের মিলন যদি বিবাহের অন্যতম অঙ্গ হয়, তবে সন্তান লাভ বিবাহের শেষ মর্ম। পুত্রলাভের মধ্য দিয়ে হিড়িম্বার মিলন মধুরতর হলো, তার মন আনন্দে পূর্ণ হলো। এবার বিচ্ছেদের দিন আগত, শেষ বিদায়ের জন্য হিড়িম্বা প্রস্তুত হলো। জননী কুন্তীর কাছে ঘটোৎকচ কে নিয়ে হাজির হলো। উপস্থিত সকল কে বলে গেল– যখনই প্রয়োজন পড়বে, এই পুত্র জীবন দিয়েও এই বংশ কে রক্ষা করবে। তারপর সন্তান নিয়ে হিমালয়ের গহীন অরণ্যে চলে গেল।

হিড়িম্বা অনার্য সম্ভূত হলেও ভীমের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য এ আপন সন্তান কে কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনে পাঠিয়েছে, যথারীতি শত্রু বধ করে মহাবীর ঘটোৎকচ কর্ণের একাঘ্নী বাণে নিহত হয়ে পিতৃব্য অর্জুন কে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে যে মধুমাসে অরণ্যচারী কন্যা ভালোবেসে ভীমের সাথে বিহার করেছিল , সারাজীবন নিজেকে ভীম বা ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে দূরে রেখেছিল নিঃস্বার্থ ভাবে। সেটা আজকের দিনে —যেখানে ভীম অর্জুনের নায়কোচিত গুণকীর্তন করা হয়,হিড়িম্বার কথা আমরা স্মরণ রাখি না। অনার্য ভূমি কন্যা বলে কি!


লেখক পরিচিতি : মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবসি । আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।