মহররমের রোজা রাখা সুন্নাত

লেখক : শাহজাদা  মুনির উদ্দীন আজহারী

মহররম হলো আরবি তথা হিজরী সনের প্রথম মাস। এ মাসের ১০ তারিখে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। এদিনে হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। হযরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইল ফেরআউনের নির্যাতনের হতে মুক্তি লাভ করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুন্ড হতে মুক্তি লাভ করেন। হযরত আইয়ুব (আ.) রোগ মুক্তি লাভ করেন। হযরত হুসাইন (রা.) কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন প্রভৃতি।

উল্লেখিত ঘটনা সমূহের মধ্যে দুটি ঘটনা বর্তমান মুসলমান জাতি বিশেষভাবে স্মরণ করে থাকে।
প্রথমতঃ হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ফেরআউনের নির্যাতন হতে মুক্তি লাভঃ-
মুসা (অ.) এবং তাঁর অনুসারীরা দীর্ঘ বছর যাবৎ ফেরআউন ও তার অনুসারীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছিলেন। একটা সময় আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আ.) কে হিজরতের নির্দেশ দেন। নির্দেশ মতো তিনি বনি ইসরাইলদের সাথে নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে মিশরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। নীল নদের কিনারে এসে আল্লাহর কাছে নদী পার হওয়ার জন্য সাহায্য কামনা করেন।

 

আল্লাহ তাঁকে হাতের লাঠি দ্বারা পানিতে আঘাত করার নির্দেশ দেন। মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে লাঠি দ্বারা পানিতে আঘাত করেন ফলে নদীর মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। তিনি সাথীদের নিয়ে নিরাপদে নদী পার হয়ে যান। পেছন থেকে ফেরআউন ও তার বাহিনী এসে নদীর মধ্যে রাস্তা দেখে যাত্রা শুরু করে, কিছু দূর গেলে আল্লাহর নির্দেশে রাস্তা পানিতে বিলীন হয়ে যায়। তখন ফেরআউন ও তার বাহিনী নদীতে ডুবে মারা যায়। দিনটি ছিল ১০মহররম। মুসা (আ.) এর অনুসারী ইহুদি জাতি এই দিনটির স্মরণে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রাখত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করে আসার পর ইহুদিদের রোযা রাখতে দেখেন।

তখন তিনি ইহুদিদের রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা উপরোক্ত ঘটনা উল্লেখ করে। এতদশ্রবণে রাসূল (স.) বলেন আমরা ইহুদিদের চেয়ে মুসা (আ.) এর বেশি নিকটবর্তী। যে কারণে উক্তদিনে তিনি নিজে রোযা রাখেন এবং সাথীদের রোযা রাখতে নির্দেশ দেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে রাসূল (স.) আশুরার দিন নিজে রোযা রাখেন এবং ( সাহাবী আজমাইনদের রা.) রোযা রাখতে নির্দেশ দেন (বুখারী ও মুসলিম)। এছাড়া ইহুদিদের সাথে যেন মুসলমানদের রোযা মিলে না যায় তার জন্য তিনি ১০মহররমের সাথে আগে অথবা পরে একদিন যোগ করে রোযা রাখতে নির্দেশ দেন। এক্ষেত্রে তিনি ৯মহররম তারিখ প্রাধান্য দেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (স.) বলেছেন, যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখ রোযা রাখব (মুসলিম শরীফ)।

 

দ্বিতীয়তঃ ১০ মহররম তারিখে হযরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত বরণঃ-
হযরত মুয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকালের পূর্বে নিজ পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণভাবে ইসলামী রীতি নীতির খেলাপ। যার কারণে হযরত হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ করেন নি। বরং তিনি কুফা বাসীর আমন্ত্রনে ইসলামী সম্রাজ্যে খেলাফতের ধারা বজায় বাখার জন্য ২০০ সদস্যের একটি ক্ষদ্র দল নিয়ে ৬০ হিজরি শাবান মাসে মদীনা হতে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। অতঃপর তিনি ইয়াজিদের প্রেরিত ওবায়দুল্লাহর অধীনস্থ সেনাপতি ওমর ইবনে সা’দের নেতৃত্বাধীন ৪,০০০ সৈন্যের দ্বারা অবরূদ্ধ হয়ে কারবালা প্রান্তরে শিবির স্থাপন করতে বাধ্য হন। হুসাইন (রা.) এর শিবিরে পানির কষ্টের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে তিনি শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন।

১. তাঁকে নিরাপদে মদীনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক, অথবা

২. সীমান্ত রাজ্য খোরসানে অবস্থান করতে দেওয়া হোক, অথবা ৩. ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্যে দামেস্কে যেতে দেওয়া হোক। ইমাম হুসাইন (রা.) এর এই প্রস্তাবগুলো ওবায়দুল্লাহ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করে তাঁকে ইয়াজিদের অনুকূলে বিনাশর্তে আতœসম্পর্নের নির্দেশ দেয়। হুসাইন (রা.) এর শান্তি স্থাপনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। এযুদ্ধে তিনি পরাজিত হন এবং ৬১ হিজরী ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। শুধু তাই নয় ইয়াজিদ বাহিনী পরতর্বীতে পবিত্র মক্কা ও মদীনা শরীফে আক্রমণ করেছিল এবং সেখানে হত্যা,ধর্ষণসহ নারকীয় তান্ডব চালিয়েছিল। এমনকি পবিত্র কাবা শরীফে অগ্নিসংযোগ করেছিল যার ফলে হাজরে আসওয়াদও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এমন সময় খবর আসে ইয়াজিদ মারা গেছে। তখন তার বাহিনী দামেস্কে ফিরে যায়।

শিক্ষাঃ-
উপরোক্ত ঘটনা দুটির প্রথমটি হতে আমরা জানতে এবং বুঝতে পারি যে,মসা (আ.) ও তাঁর কওম বনি ইসরাইলের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল। ফলোশ্রুতিতে আল্লাহ তাকে স্বদলবলে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এবং দ্বিতীয় ঘটনা হতে জানতে পারি ইয়াজিদ হযরত হুসাইন (রা.) ও তাঁর সাথীদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা এ জালেম শাসককে (৬৮০Ñ৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) মাত্র ৪ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় রাখার পর চির বিদায় করে দেন।

ফেরয়াউন ও ইয়াজিদ উভয়ই তাদের নিজেদের রাষ্ট্র ক্ষমতা স্থায়ী ও সুসংহত করতে নবী ও তাঁদের সাথী এবং অন্যান্য মুমিন মুসলমানের উপর নির্যাতন করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারেনি। উপোরক্ত ঘটনা হতে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্বির জন্যে ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা স্থায়ী ও সুসংহত করার জন্যে কেউ কারোর উপর জুলুম নির্যাতন চালানো উচিত নয়। রাসূল (স.) জুলুম ও নির্যাতন করতে নিষেধ করেছেন ।

তিনি বলেন তোমরা অত্যাচারিত ব্যক্তির বদদোয়া হতে বেঁচে থাক, কেননা অত্যাচারিত ব্যাক্তির দোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না ( মেশকাত শরীফ কিতাবুয যাকাত)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল জুলুম অবিচার হতে হেফাজত করুন, আমিন।


লেখক পরিচিতি : শাহজাদা  মুনির উদ্দীন আজহারী
শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।