মুহূর্ত যে জীবন

লেখক : অয়ন মৈত্র

অভ্যাসমত এমনিই ফোনটা ঘাঁটছিলাম। ঘাঁটা মানে ওই রিল দেখা। হঠাৎ একটা রিলে চোখ আটকে গেল। বাহান্ন সেকেন্ডের একটা ভিডিও। একবার দেখলাম, তারপর আরও বেশ কয়েকবার দেখলাম পরপর। অসামান্য কোন ঘটনা বা দৃশ্য নেই ভিডিওটিতে। দুজন ব্যক্তি ক্যামেরা তাক করে বসে আছে বরফের ভেতর। সামনে একটি তুষার চিতা তার দুই শাবকসহ হেঁটে যাচ্ছে। ক্যামেরা তাক করে যিনি বসে আছেন, তাঁকে অন্যজন প্রশ্ন করছেন, “কি হল ছবিটা তোলো! বসে আছ কেন?” ক্যামেরার পিছনে যিনি আছেন তিনি ততক্ষণে ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে অনিমিখ দৃষ্টিতে চিতা ও তার শাবককে দেখতে দেখতে বিড় বিড় করে বললেন – “Beautiful things don’t ask for attention. If I like a moment, me, personally, I don’t want the distraction of camera…just want to stay in it.”

মুহূর্তকে তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করার মধ্যে এক ধরনের গভীর জীবনবোধ থাকতে হয়। কিন্তু এই বোধ যে এত সহজলভ্য নয়! ফ্রেমবন্দী করে মুহূর্তকে অমর করবার লোভ সামলাতে পারাটাই যে ভীষণ কঠিন! মনে হয়, একটাই তো জীবন। উপভোগের থেকে ভোগকেই তাই আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি তাই। আস্বাদন নয়, আত্মসাৎ-এর মধ্যেই সুখ পাওয়া যায় বেশি।

হল্যান্ড পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে মানুষ গতির বিপরীতে ছোটে। সাইকেল কিনা এই দেশের জাতীয় প্রতীক! ভাবা যায়! দেশে জনসংখ্যার থেকে সাইকেল বেশি। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মাঝে সাঝে সাইকেলে চেপে অফিস যান। যে দেশ জোহান ক্রুয়েফ, আর্জেন রবেনের মত গতিমান ফুটবলার দিয়েছে, সেই দেশে সাইকেলের মত মন্থরগতির যান এত প্রাধান্য পেল কেন? এই ‘কেন’-র উত্তর লুকিয়ে আছে ডাচ্দের জীবনদর্শনে। ডাচ্ জীবনদর্শনে স্তব্ধতা, স্থিরতা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ডাচ্ ভাষায় এই মূল্যবোধের নাম ‘নিকসেন’ (Niksen)। গতি আর স্থিরতার মাঝে যে সমতল ভূমি রয়ে যায়, সেটাকে মন্থরতা বলে। সারা পৃথিবী যখন উইকএন্ড বলতে পার্টিটাইম বোঝে, ডাচরা এর উল্টোটা করে। অধিকাংশ ডাচ্ এই তিনদিন ফোন, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল চুপ করে তাকিয়ে দেখে মুহূর্তরা কেমন উদ্বায়ী হয়। দায়বিবর্জিত এই সময়টা কেবল আমার। তাই এই ক’টা দিন কিচ্ছু করব না, জাস্ট কিচ্ছু না। এই কিচ্ছু না করা মুহূর্তটাই উপভোগ করব তারিয়ে তারিয়ে। ইতালীয়রা ইচ্ছাকৃত অলস জীবনযাপনের এই পন্থার একটা নামও দিয়েছে আবার – ‘ডোলচে ফার নিয়েনতে’ (dolce far niente)।

জাপানি সংস্কৃতিতে অনেকটা এই ধরনের একটা রীতি আছে, যাকে জাপানিরা বলে ‘শিনরিন ইওকু’ (Shinrin-yoku), যার বাংলা অর্থ ‘অরণ্য স্নান’। দিনের যে কোন একটা সময়ে অরণ্যের মধ্যে হেঁটে যাওয়া। পাখির ডাক, ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনি, মাতাল হাওয়ার ‘শোঁ-শোঁ’ শব্দ সারা শরীরে মেখে হেঁটে চলা একাকী। অফিসের ডেডলাইন, ইএমআই-এর চাপ সব কিছু জনপদে ফেলে এসে এই আদিম অরণ্যে কেবলই নিজেকে খোঁজার নিরন্তর চেষ্টা। সন্ন্যাস ও সাংসারিক জীবনের মাঝে এটা এমন একটা নিউট্রাল জোন, এমন একটা নো ম্যানস ল্যান্ড, যেখানে শূন্যই পরম সত্য। এই অরণ্য তাই সেই শূন্যস্থান, যেখানে আমার আমিটাই সব। যেখানে আমার ভাললাগাটাই একমাত্র ফ্যাক্টর। শুকনো পাতা মাড়াতে ইচ্ছে করছে আমার। ওই যে পর্ণমোচী বৃক্ষ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে, ওটাই প্রাণ ভরে দেখে যাওয়ার স্বাধীনতা শিনরিন ইওকু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চেয়ে এই অনুভূতি বোধ হয় আর কেউ ভালো বোঝাতে পারবে না:

“একদিন গাছেরা মানুষের সঙ্গে কথা বলবে
লতা গুল্মে শোনা যাবে ফিসফিস ধ্বনি
দোপাটি ঝাড়ের কাছে থেমে যাবে কিশোরীর হাত
ফুলগুলি খিলখিল করে হেসে উঠবে
একদিন সবাই জেনে যাবে মনে মনে
যার কাছ থেকে তুমি কিছু নাও, তাকেও কিছু দিতে হবে
একটা দোয়েল পাখি শিস শোনালে তাকে কিছু দেবে না?
নদীকে একটি গান, মাটিকে দু ফোটা চোখের জল
ভোরের সোনালি আলো-কে আর কিছু না হোক
অন্তত একটি প্রণাম!”

মুহূর্তকে উপভোগ করার ও সেই সাথে নিজেকে আবিষ্কারের এই দর্শনটিকে ফরাসিরা বলে ‘ফ্ল্যানেরি’ (flânerie)। যে ব্যক্তিরা এই আদর্শ মেনে চলেন, তাঁদের বলা হয় ‘ফ্ল্যানেউর’ (flaneur)। কোন নির্দিষ্ট  উদ্দেশ্য ছাড়াই মানুষ চেনার জন্য, মানুষ দেখার জন্য পথে পথে একাকী ঘুরে বেড়ানোই হল ফ্ল্যানেরি। চার্লস বোদলেয়ার তাঁর The painters of Modern Life – এ এই বিষয়টি নিয়ে বিশদে লিখে গেছেন। টি এস এলিয়ট তো তাঁর The Love Song of J. Alfred Prufrock কবিতাটি শুরুই করছেন এই দর্শন দ্বারা:

“Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table;
Let us go, through certain half-deserted streets,
The muttering retreats
Of restless nights in one-night cheap hotels
And sawdust restaurants with oyster-shells:
Streets that follow like a tedious argument
Of insidious intent
To lead you to an overwhelming question …”

আমরা কেউ এখন আর নিজের ভালো লাগার জন্য কিছু করিনা। pure joy, বাংলায় যাকে নির্মল আনন্দ বলা হয়, সেটা পাওয়া এখন আর আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা যেটাকে ভালোলাগা বলি, খেয়াল করলে দেখব সেগুলো সব জীবন কিংবা জীবিকার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যদি সেটা নাও হয়, তাহলে অবশ্যই সামাজিক চাহিদা দ্বারা প্রবল ভাবে অনুপ্রাণিত। এমন একটা ইচ্ছে, এমন একটা ভালোলাগা, আমি ইদানীংকালে দেখিনি আমার কোন পরিচিতের মধ্যে, যেটা সৃষ্টিছাড়া, যেটা ট্রেন্ডিং নয়, যেটার সঙ্গে জয়ের কোন সম্পর্ক নেই। ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে। ভালো লাগে কারণ বাজারে ওই একটা খেলার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আঁকতে ভালো লাগে, কারণ আমি আঁকতে পারি। যার নাচতে ভালো লাগে, সে আলবাত ভালো নাচে। আপনি বলতেই পারেন, তাহলে গান গাইতে পারেনা কিন্তু গান শুনতে ভালোবাসে, এমন ব্যক্তি কি নেই? নাকি সিনেমাপাগল ব্যক্তিরা সকলেই অভিনয় পারে? ঠিক কথা। কিন্তু এ ভালোলাগার পেছনে নিজের মানসিক যন্ত্রণা নিরসন, কখনও বা অনুপ্রেরণার সন্ধান, কখনও বা প্রতিবাদের মাধ্যম, আবার কখনও বা নিজের পূর্ণ না হওয়া ইচ্ছেপূরণের মাধ্যম হিসেবে এদের ভালো লাগে। আমি বলতে চাইছি সেই পিছুটানহীন, দায়হীন ভালোলাগার কথা, যেটা কেন ভালোলাগে তার ব্যাখ্যা নিজের কাছেই নেই। এমনিই ভালো লাগে। তার নিজের কাছে এর ব্যাখ্যা না থাকলেও এরও একটা ব্যাখা আছে। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ আছে ওই দৃশ্যগুলোর মধ্যে। সামাজিক পরিমণ্ডলের বিচারে যে অতিরিক্ত গুণগুলো সকলের থাকে, তার কোনটিই নেই আমার। আর পাঁচজনের ভালো লাগার বিষয় আমার সাথে মেলেনা। তেমনি আবার সবার খুব খারাপ লাগার বিষয়গুলো আমার খুব খারাপ লাগেনা। এই দুই চূড়ান্ত অবস্থার মাঝে আমি সেই গ্রস্ত উপত্যকা, যেখানে বারান্দার রেলিং ছুঁয়ে বৃষ্টির জল পড়ে টুপ টুপ টুপ। হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা বাসের জানলা দিয়ে দমকা বাতাসে এলোমেলো হয়ে যায় চুল। লোধাশুলির জঙ্গলের মাঝে সিঁথির মত কালো রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে যায় অষ্টাদশী যুবতী। যেখানে বহুজাতিক সংস্থার অফিসের একত্রিশ তলার অফিস স্পেসের জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে বিকেল নামতে দেখা যায়। সময় থমকে যায়, ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকে বোধ, ডানা মেলতে শুরু করে চিন্তারা। আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষের জীবনে এই সময়টাই মোক্ষ। এটাই বোধি, এটাই নির্বাণ, এটাই স্যালভেশন।

আমি যে স্কুলে শিক্ষকতা করি, সেখানে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসর বসেছে। ৮০০ মিটার দৌড় ইভেন্টটি রয়েছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের জন্য। হঠাৎ দেখি ক্লাস ফাইভের ছোটখাট চেহারার একটি ছেলে আমার কাছে এসেছে এই ইভেন্টে নাম লেখাতে। তাকে বোঝালাম এই ইভেন্টটি কাদের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু সে মানতে নারাজ। ছেলেটির একটাই কথা, “আমি নাম দিতে চাই।”
আমি খানিক বিরক্ত হয়েই বললাম, “তুই পুরোটা দৌড়তে পারবি যে নাম দিতে এসেছিস?”
ছেলেটি তৎক্ষণাৎ বলল, “জানিতো স্যার পারব না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তো নাম দিচ্ছিস কেন তাহলে?”
ছেলেটি হেসে বলল, “এমনিই স্যার। আমার দৌড়তে ইচ্ছে করছে এখন তাই নাম দিতে এসেছি। কিছু হব বলে দৌড়তে আসিনি স্যার। এমনিই দৌড়ব। আমার দৌড়তে ভালো লাগে স্যার।”

এই যে জগৎ সংসারের চাহিদা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবলই মুহূর্ত আস্বাদনে বাঁচতে পারা, এই বিচ্ছিন্নকরণ কিন্তু মোটেও এত সহজ নয়। এ অনেকটা গার্হস্থ্য জীবনের মাঝে সন্ন্যাস পালন করার মত। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ডি.এইচ.লরেন্স তাঁর ‘Insouciance’ গদ্যে এই ভালো লাগার জন্য বাঁচার বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তাঁর মতে বাঁচার মতো বাঁচা একটা শিল্প, যেটা রপ্ত করতে হয়। ধরে রাখবার অভীপ্সা নয়, ছেড়ে দেওয়ার ঔদার্য থাকতে হবে সেই শিল্পের মধ্যে।  চোখের সামনে এই মুহূর্তে উপস্থিত সব কিছুকে আমি ধরতে পারব না, এটা মানতে শিখতে হবে আমাদের। যেমন সমুদ্রের গর্জন সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে শোনা আর তার রেকর্ডিং শোনা এক বিষয় নয়। তাই সেই গর্জনকে চিরস্থায়ী করতে যাওয়া এক ধরণের বোকামি। জীবনে প্রথম পাহাড় দেখা, প্রথম সমুদ্র, প্রথম অরণ্য দেখার সেই বিস্ময়কর অনুভূতির  সমতুল্য কিছু হতে পারে না। বিভূতিভূষণ তাই আরণ্যক গল্পতে লিখছেন:

“কাছারি হইতে প্রায় এক ক্রোশ দূরে একটা নাবাল জায়গা আছে, সেখানে ক্ষুদ্র কয়েকটি পাহাড়ী ঝরণা ঝির ঝির করিয়া বহিয়া যাইতেছে, তাহার দু-পারে জলজ লিলির বন, কলিকাতার বাগানে যাহাকে বলে স্পাইডার-লিলি। বন্য স্পাইডার-লিলি কখনো দেখি নাই, জানিতামও না যে, এমন নিভৃত ঝরনার উপল-বিছানো তীরে ফুটন্ত লিলি ফুলের এত শোভা হয় বা বাতাসে তাহারা এত মৃদু কোমল সুবাস বিস্তার করে। কতবার গিয়া এখানটিতে চুপ করিয়া বসিয়া আকাশ, সন্ধ্যা ও নির্জনতা উপভোগ করিয়াছি।”

এই চুপ করে বসে কেবলই সেই মুহূর্তে ঘটে চলা ঘটনার নীরব নিভৃত সাক্ষী থাকা কিংবা নিজেকে নিয়ে ভাবা আসলে এক ধরনের আত্মসমীক্ষা। ডেডলাইন, প্রত্যাশা ও পেশার চাপে কুঁকড়ে থাকা আমিটার সাথে ক্ষণকালের উদযাপন। পাবলো নেরুদা বোধ হয় সব থেকে ভালো এটার ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর The heights of Macchu Picchu কবিতায়:

“Someone was waiting for me among the violins; someone who found a world like
a buried tower sinking its spiral form deeper than all the strident
sulphur-coloured leaves; and I thrust my hand deeper yet, turbulent and sweet,
a sword sheathed in meteorites, into the gold of geology, into the most
genital portion of the mundane.
I placed my forehead among the deep waves and descended: a drop in a
sulphurous peace; and like a blind man, returned to the jasmine in the garden
of humankind’s wasted spring.”

ভারতীয় জাদুঘরে গিয়ে ২৫ কোটি বছর প্রাচীন একটি বৃক্ষের জীবাশ্ম স্পর্শ করে শিহরিত হব না? গৌতম বুদ্ধের চিতাভস্ম রাখার পাত্রের দিকে তাকিয়ে ভাববো না একবারও, আমার জানা ইতিহাস বিষয়ে যিনি সব থেকে বেশি স্থান জুড়ে আছেন, তিনি এই ভস্মাধার থেকেই আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন? রাতের সমুদ্র দেখতে দেখতে একবারও কি ভাবতে পারিনা এই নিকষ কালো অনন্ত সমুদ্রের গভীরে আরও না জানি কত রহস্য, কত প্রাণ লুকিয়ে আছে? প্রকৃত সত্যিটা বিস্ময়কর বটে। এই ভাবালুতা, এই আবেগপ্রবণতা আজ আর নেই আমাদের। অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ছবি তোলার মধ্যে দিয়েই আজকের প্রজন্ম মুহূর্তকে বন্দী করার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে চায়। তাই নির্মল ভ্রমণ বলে কিছু হয়না এখন।

ভুল বললাম, হয়। স্কটল্যান্ডে। স্কটিশরা এরকম একটা নির্মল নিরুত্তাপ নির্মেদ ভ্রমণে বেরোয়, যেখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাহাড় চূড়ায় লেগে থাকা অল্প অল্প বরফ দেখার জন্যই  ঘুরতে আসা। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এভাবেই শুয়ে বসে পছন্দের সময় কাটানোর নেশায় একটা অন্য স্তরের মাদকতা আছে। স্কটিশরা জানে সেটা। এই ভ্রমণে এসে কোথাও না ঘুরে কেবল বিছানায় আরাম করে শুয়ে সময় কাটানোর মধ্যে যে আনন্দ, স্কটিশরা তাকে hurkle durkle বলে। দিন দিন ইউরোপ জুড়ে এ ধরনের ভ্রমণের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। মানুষ বুঝতে পারছে, কিছু না করার মধ্যে আসলে এমন এক ধরনের আনন্দ আছে, যেমনটা সে আর কখনও পায় না। আসলে এই সময়টা হার-জিত, সাফল্য-ব্যর্থতা, চাহিদা-পূরণ এইসব জাগতিক সম্পর্কের উর্দ্ধে। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, নিজেকে উপলব্ধি করার একমাত্র উপায় বোধহয় এটাই। আর এটা সম্ভব তখনই, যখন নিজেকে নিঃসঙ্গ করে ফেলা যাবে ভিড় থেকে। কিংবদন্তি বিজ্ঞানী তথা ফরাসি দার্শনিক ব্লেইস পাস্কালের করা মন্তব্যটি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়: “All of humanity’s problems stem from man’s inability to sit quietly in a room alone.”

নিজেকে বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ করতে না পারলে জীবন অনুধাবন করতে পারা যায় না। সৃষ্টিশীলতার মৌলিক শর্ত তাই নিঃসঙ্গতা। এই স্বতঃস্ফূর্ত আরোপিত নিঃসঙ্গতা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একান্তভাবে প্রয়োজন। আইনস্টাইন তাঁর পদার্থবিদ জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতেন বেহালা বাজানোর মাধ্যমে। বিখ্যাত বাঙালি পদার্থবিদ অধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ বসু নিঃসঙ্গ করে তুলতেন নিজেকে এস্রাজ বাজানোর মাধ্যমে। আইনস্টাইন মূলত মোজার্টের সিম্ফনি বাজাতে পছন্দ করতেন। মোজার্টের সুরগুলির বৈশিষ্ট্য তার সহজ সরল উচ্ছ্বাসহীন এক প্রাণবন্ত আমেজ, যে আমেজ আইনস্টাইন তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবনের সব ক্ষেত্রে বিশেষ করে পদার্থবিদ্যার জটিল তত্ত্বকে অকল্পনীয় সরলতায় ব্যাখ্যা করেছেন।

শুরু করেছিলাম মুহূর্তকে আস্বাদন করা নিয়ে। নিঃসঙ্গ নিবিড়তাই সেই মুহূর্ত, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন আমরা বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাই। এই বেঁচে থাকাটাই তো জীবন, এই বোধটাই আমাদের মানুষ বানিয়েছে হাজারো প্রাণের ভীড়ে। আমেরিকান কবি মায়া আঞ্জেলৌর কথাটা এ প্রসঙ্গে শিরোধার্য: “Life is not measured by the number of breaths we take, but by the moments that take our breath away.” একটাই জীবন। জন্মান্তর আছে না নেই, সে তো বিশ্বাসের ব্যাপার। কিন্তু এই একটা মাত্র জীবনে যেটুকু পাওয়ার, যেটুকু দেখার, যেটুকু নেওয়ার, যেটুকু দেওয়ার, এবং যেটুকু বাঁচার সুযোগ পাচ্ছি, তার অধিকাংশ নয়, তার পুরোটা, তার সমগ্রটা উপভোগ করার নামই জীবন। জীবন একটাই, তাই লর্ড টেনিসনের স্বরে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে বলতেই পারি, “I will drink life to the lees.”


তথ্যসূত্র:

  1. https://en.wikipedia.org/wiki/The_Secret_Life_of_Walter_Mitty_(2013_film)
  2. https://www.euronews.com/next/2022/09/17/the-worlds-cycling-nation-how-the-netherlands-redesigned-itself-as-a-country-fit-for-bikes
  3. https://time.com/5622094/what-is-niksen/
  4. https://www.maiaconsciousliving.com/the-blog/how-to-embrace-il-dolce-far-niente/
  5. The Book of Human Emotions – by Tiffany Watt
  6. https://www.nationalgeographic.com/travel/article/forest-bathing-nature-walk-health
  7. https://banglasahitya.net/%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8-sunil-gangopadhyay/
  8. https://psychogeographicreview.com/baudelaire-benjamin-and-the-birth-of-the-flaneur/
  9. https://www.poetryfoundation.org/poetrymagazine/poems/44212/the-love-song-of-j-alfred-prufrock
  10. https://mouritz.org/system/files/libitemfiles/2025/poise_2025_dhlawrence_insouciance.pdf
  11. https://archive.org/details/in.ernet.dli.2015.298127
  12. https://www.poetryinternational.com/en/poets-poems/poems/poem/103-22593_from-THE-HEIGHTS-OF-MACHU-PICCHU
  13. https://timesofindia.indiatimes.com/travel/destinations/would-you-like-to-go-hurkle-durkling-with-your-frolleague-here-are-the-top-5-travel-trends-of-2025/articleshow/115053989.cms
  14. https://www.nationalgeographic.com/adventure/article/einstein-genius-violin-music-physics-science
  15. https://www.indiascienceandtechnology.gov.in/featured-science/sn-bose-physicist-par-excellence-and-forgotten-%E2%80%98father-god-particle%E2%80%99

লেখক পরিচিতি : অয়ন মৈত্র
পেশায় ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। হাওড়ার দেউলপুর হাই স্কুলে কর্মরত বর্তমানে। অবসর সময়ে কবিতা ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা নেশা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।