লেখক : সৌরভ মাহাতো
১৯৫৯ সালের শরতের শুরু। আকাশে মেঘের স্তর যেন কোন অজানা অভিসন্ধির আভাস দিচ্ছিল। পুরুলিয়ার লাল মাটির গ্রাম – বেলিয়াডি। সাঁওতালদের ঝুপড়ি, কাঁচা রাস্তা, আর চারপাশে ঢিবি-ঢালা পাহাড়। গ্রামের মানুষ তখন ধান কাটার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। রবিবারের সকালে গোঁসাই হাঁসুরা, গ্রামের বয়স্ক মানুষ, চুলোর ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলেছিল, “এই বৃষ্টি ভাল না রে। মাটির গন্ধে অশনি সংকেত আছে।” কেউ গুরুত্ব দেয়নি। ঝড়-বৃষ্টি তো গ্রামীণ জীবনের সাথী। কিন্তু হঠাৎই, আকাশ যেন উন্মত্ত হয়ে উঠল। ৮ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হল অবিরাম বর্ষণ। নদী-নালা গর্জন করতে লাগল। মানুষ ভেবেছিল, কয়েকদিনে থেমে যাবে।
কিন্তু বৃষ্টি থামল না। কংসাবতীর জল ফুলে-ফেঁপে উঠল। পাহাড়ি ঝরনাগুলো অদ্ভুত স্রোতে বয়ে আসতে লাগল, যেন লাল মাটির শিরায় রক্তক্ষরণ। দশ দিন পরে, গ্রামের প্রান্তে বড় ডোবার কাছে জড়ো হয়েছিল মানুষজন। ভেসে আসছে খড়ের গাদা, গরুর জোতা। মাটির ঘরগুলো জলের স্রোতে গলতে শুরু করেছে। হঠাৎ খবর এল, পাঞ্চেত ড্যাম থেকে জল ছাড়া হয়েছে।
“সব শেষ,” কেউ একজন চিৎকার করল। রাত নামল ভিজে ছেঁড়া অন্ধকার নিয়ে। গোঁসাই হাঁসুরা হাঁড়ি, ডেকচি, কড়াই, থালা বাসন মাথায় নিয়ে ছুটছে, পাশে তার নাতি কিরণ, কাঁধে মাটির ভাঁড়। কুঁড়েঘরের কাদা সরে গিয়ে ভেসে গেল তাদের স্মৃতি, দেউলির ধোঁয়া, লাল মাটির ছাপ।
পরদিন সকালে গ্রামটা যেন ভূতের মাঠ। শুধু কাদার স্তূপ আর গবাদিপশুর মৃত দেহ। দূরে কংসাবতীর পাড় ভাঙা। পাখিরা চুপ। গোঁসাই মাটিতে বসে পলিথিনে মোড়ানো একখণ্ড ধান দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“এই ধান বাঁচলে বেঁচে যাবে প্রাণ। না হলে…”
কথা শেষ করতে পারল না সে। গলার ভেতর জমে থাকা কষ্ট আর ভয় গিলে নিল। দূরে কিরণ মাটির ভেতর থেকে বাঁশের ঝুড়ি খুঁড়ে তুলছে। বাচ্চার চোখে জল, কিন্তু মুখে দৃঢ়তা। “দাদু, আবার বানাব ঘর। আবার গাইবে মাটির গান।”
বৃষ্টি থেমেছিল, কিন্তু নদীর রাগ থামেনি। সেই বছরের শরতে পুরুলিয়ার অনেক গ্রাম ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল জল আর মাটির ক্ষতচিহ্ন দিয়ে।
লেখক পরিচিতি : সৌরভ মাহাতো
জন্ম ১৯৯৯ সালের ১ লা জুন পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম লালবাজারে। প্রথম প্রকাশিত গল্প গ্রন্থ "শ্রেষ্ঠ উপহার" এবং প্রথম উপন্যাস "আকাঙ্খা"।