লেখক : রানা চক্রবর্তী
হাজার বছরের এক পুরাতন ব্যবসার নাম পতিতাবৃত্তি। লোকমুখে যার আরো অনেক বিচিত্র নাম আছে – গণিকাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি, দেহব্যবসা ইত্যাদি। বিচিত্র এই দোকানীরাই আমাদের সমাজে পতিতা, গণিকা, বেশ্যা, রক্ষিতা নানাভাবে পরিগণিত হয়। যে প্রতিষ্ঠানে তারা বিক্রি করে মাপ-পরিমাপহীন এই পণ্য সেটিই পতিতালয়, গণিকালয় বা বেশ্যালয়। সভ্যতার বিবেচনায় একে অন্ধকার গলি বলা হয়ে থাকে। হয়তো অন্ধকার গলি বলেই আলোর মানুষেরা চেনে না এ গলি, জানে না এ জগৎ। কিন্তু তারপরও সত্য, কৃষ্ণ গহ্বরের মত অস্তিত্বমান এই অন্ধকার গলি। খুব সুনির্দিষ্ট করে হয়তো বা বলা মুশকিল পৃথিবীর ইতিহাসে কবে কখন কিভাবে উৎপত্তি ঘটেছে বিচিত্র এ ব্যবসার। তবে যতদুর জানা যায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার গর্ভে অর্থাৎ সামন্তীয় সমাজের পাপের ফসল এই পতিতাবৃত্তি। সেই অবধি দুনিয়াব্যাপী বিস্তৃতি এ ব্যবসার।
পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলো সেই সকল নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করতে নিজেদের দেহ দিয়ে আপন জীবিকা উপার্জন করে। বেশ্যারা প্রয়োজনমত নিজেকে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও অলঙ্কারে ভূষিতা রাখেন। যেন এক প্রকার পণ্য দ্রব্য। তারা সব সময় মনে করে সৌন্দর্য্য দিয়ে পুরুষকে জয় করতে পারলেই মিলবে তার যাচিত অর্থ। বেশ্যাদেরও ঘটক বা দূত থাকে। তারা অন্য লোককে তার গুণ পণ্য বলে তাকে আকর্ষন করে নিয়ে আসে।
পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো ইতিহাসের আদিকাল থেকেই। যেমন – দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোগু, গণিকা ইত্যাদি। তবে কামসুত্র গ্রন্থের লেখক ‘বাৎস্যায়ন’ পতিতাদের ৯ টি ভাগে ভাগ করেছেন, তা হলো – “বেশ্যা বিশেষ প্রকরণ – ‘কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনষ্টা, রূপজীবা এবং গনিকা—এই কয়টি বেশ্যা বিশেষ (তথ্যসূত্র – কামসুত্র : চতুর্থ ভাগ – ষষ্ঠ অধ্যায় – ২৪)।
ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে আছে –
“সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা”
ইতিহাসবিদ, ‘মরিস ভিন্টারনিৎসের’ মতে এখানে যে “বিশ্যা” শব্দটি আছে তার থেকেই নাকি “বেশ্যা” কথাটির উৎপত্তি।
George Ryley Scott তার (A history of prostitution from antiquity to the present day) ‘পতিতা বৃত্তির ইতিহাস’ নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে – “পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলো সেই সম্প্রদায় ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে – জীবিকা অর্জন করে।” তবে জর্জ রালি স্কট তার বইতে, আরো এক শ্রেনির পতিতার কথা বলেছেন, যারা অর্থ ছাড়াই পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে তাদেরকে তিনি Amateur Prostitutes অর্থাৎ ‘পেশাহীন পতিতা’ বলে অভিহিত করেছেন।
এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটেনিকায় পতিতার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এইভাবে- ‘পতিতা এমন মহিলা যে টাকা বা পণ্যের বিনিময়ে পরিচিত, অপরিচিত, দেশ, ভাষা নির্বিশেষে যে কোনো লোকের সঙ্গে যৌন মিলনে রত হয়’।
পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর অপ্সরার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন – উর্বশী, মেনকা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী,সরলা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু – এরকম অনেক স্বর্গ বেশ্যার নাম আমরা পাই। বাংলা ডিকশোনারী মতে অপ্সরা অর্থ – স্বর্গের বারাঙ্গনা বা বেশ্যা; সুরসুন্দরী। (সং. অপ্ + সৃ + অস্ = অপ্সরস্ = অপ্সরা)।
মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, একজন বেশ্যা ভাল প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এই জীবিকা সম্বন্ধে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। (তথ্যসুত্র: বাংলা পিডিয়া)। মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনি ঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা ‘স্বর্গবেশ্যা’ দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন মিলন করেছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই হলো সেইসব মুনি! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মান জনক বৃত্তি গুলির মধ্যে পতিতা বৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। ঐ কারণেই বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর লিখেছেন – ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’ (দেবলোকের যৌনজীবন,পৃঃ ৬২)। বাংলা অভিধান মতে মৈথুন অর্থ ; রতিক্রিয়া, রমণ, স্ত্রী-পুরুষের যৌন সংসর্গ। (সং. মিথুন + অ)।
মানব জন্মের শুরু থেকেই মানুষকে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। সৃষ্টির বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য কাজ করে আসছে। কারণ জীবন ধারণের জন্য এই তিনটি উপাদান অপরিহার্য। সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে কখনো পুরুষ, কখনো নারী- সংসার নির্বাহের দায়িত্ব নিয়েছে। সংসার নির্বাহের জন্য, জীবন ধারণের জন্য সমাজের প্রথম থেকেই কৃষিকার্য, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। জীবন ধারণের জন্য আয়ের কয়েকটি নির্দিষ্ট পন্থা সমাজ কর্তৃক আজও সাধারণভাবে স্বীকৃত। যেমন কৃষিকাজ, ব্যবসা, শিল্প, শ্রম বিক্রি ইত্যাদি। কিন্তু সমাজ বিবর্তনের একটি পর্যায়ে এসে নির্দিষ্টভাবে নারী দেহ বিক্রির মাধ্যমে আয়ের একটি ব্যবস্থা চালু হয়ে গেল। এর নাম পতিতাবৃত্তি যা ঘৃণিত। অথচ স্বীকৃত পেশা হিশেবে আজ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। অপরদিকে প্রকৃতি মানুষকে যে কয়েকটি সাধারণ জিনিস দিয়েছে যেমন ক্ষুধা, ঘুম, লোভ, দয়া, জৈবিক তাড়না ইত্যাদি। তারমধ্যে সবচেয়ে জোরাল জিনিস হচ্ছে ক্ষুধা ও জৈবিক তাড়না। জৈবিক তাড়নার শক্তি আবার প্রচন্ড। বিভিন্ন পরিবেশে তা বাড়ে বা কমে। স্বাভাবিকভাবে সমাজ স্বীকৃত পথে যখন মানুষ যৌনক্ষুধা নিবারণ করতে পারে না, তখনই সে অবৈধ পথে তা মেটাবার চেষ্টা করে। তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে, পুরুষ যখন যৌনক্ষুধা মেটাবার জন্য স্ত্রী ব্যতিরেকে যখন অবৈধভাবে অন্য নারীর সঙ্গে কামনা করে, অন্যদিকে নারী তার অন্ন-বস্ত্রের সংগ্রহের প্রয়োজনে তার দেহদান করতে প্রস্তুত হয়। তখনই একটা আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক একটা অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটা হল পতিতাবৃত্তির পেশাগত রূপ, তা সামাজিকভাবে ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে দোষণীয় হোক আর না হোক- এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। কিন্তু এর বাইরেও অবৈধ যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। তবে পতিতাবৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুরুষ আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে নারীদেহ ভোগ করবে যেখানে নারীর যৌন চাহিদার প্রশ্ন অবান্তর। এবার আমরা দেখবো, সময়ের চক্রাকারে কেমন ছিল এই বৃত্তিপানা।
পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। বিশেষত অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪-খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০/২০)- এর লেখায় এই পতিতাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হতো এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশীর সাথে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হতো। একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হতো সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল, যদিও কয়েকজন প্রফেট, যেমন ইজাকেইল, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে পতিতারা ছিল স্বাধীন এবং তারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করা ও কর দেবার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিল। গ্রিক হেটায়েরার মতো জাপানেও এই প্রথার চল ছিল।
‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ যুগে আরবে পতিতাবৃত্তি সহ আরো অনেক খারাপ কাজ চালু ছিল। ইতিহাসবিদ পি.কে হিট্টি বলেন, ‘মহানবী (সাঃ) এর আবির্ভাবের একশ বছর আগে আইয়্যামে জাহিলিয়া শুরু হয়।’ ঐ যুগে ইমরুল কায়স, তারাকা আমর, লাবীদ, যুহায়ের নামক কবি অশ্লীল কবিতা রচনা করতো। এ ব্যাপারে মাওলানা আকরাম খাঁ তার বইয়ে লিখেছেন, ‘পুংমৈথুন, স্ত্রীমৈথুন এবং পশু মৈথুন তাদের ভিতর প্রচলিত ছিল এবং তা তারা স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করত।’
প্রাচীন গ্রিস, এথেন্স ও রোমে বহু বছর আগেই পতিতা বৃত্তি চালু হয়েছিল। এমনকি সেসময় অনেককে বাধ্য করা হতো পতিতাবৃত্তি করতে। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে বেশ্যা ছিলেন। পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই।
(তথ্যসূত্র: Thomas A. McGinn, The Economy of Prostitution in the Roman World, 2004)
এথেন্সের আইন প্রণেতা ও কবি সোলোন (খ্রি.পূ. ৬৩৮ – খ্রি.পূ. ৫৫৮) যিনি প্রাচীন গ্রিকের তৎকালীন সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন।
(তথ্যসূত্র: Cf. Herodotus, Book I, para 199)
চীনে পতিতাবৃত্তির ইতিহাস সুপ্রাচীন।
‘Fang Fu Ruan’ তার লেখা ‘Sex in China’ বইয়ে লিখেছেন, “Ying-chi is the first independent prostitutes in Chinese history” … অর্থাৎ ‘Yang chi’ চীনের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন পতিতা। তার খদ্দের ছিল, উচ্চ শ্রেনির ব্যাক্তিবর্গ। এছাড়া চিনে Tang (তাং) রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশ্যাবৃত্তি চালু করেছিল। পরবর্তী Shang (সাঙ) রাজবংশ বিভিন্ন স্থান থেকে পতিতাদের সংগ্রহ করে ‘হাঙ চৌ’ শহরে বসবাসের ব্যবস্থা করে ফলে সেখানে বড় মাপের পতিতালয় তৈরি হয়। (তথ্যসূত্র: Sex in China; Fang Fu Ruan; Springer Science & Business Media, 31-Oct-1991)
পতিতা বৃত্তির আরো সরস বিবরণ পাওয়া যায় ‘বাৎস্যায়ন’ আমলে এবং তার লেখা কামসূত্র বইয়ে। ‘বাৎস্যায়ন’ এর বাল্যকাল কেটেছিল এক বেশ্যালয়ে। এবং সেখানে তাঁর মাসি কাজ করতেন। ঐখান থেকেই তিনি কামকলা সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করেছিলেন। (তথ্যসূত্র: Ascetic of Desire, Sudhir Kakar, Overlook Press,2000)
কামসুত্রের ০৬ – ভার্যাধিকারিক (৩.১) এর ৫৩ নম্বর শ্লোকে আছে – “স্বামী যাহাকে প্রচ্ছন্ন ভাবে কামনা করে, তাহার সহিত স্বামীর সঙ্গম করিয়া দিবে ও গোপন করিয়া রাখিবে।।৫৩।।” এই শ্লোক থেকেই বোঝা যায় অনাচার কেমন পর্যায়ে ছিল। তাছাড়া বাৎস্যায়নের সময় বেশ্যারা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো বিয়ে,সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতো বেশ্যা বৃত্তিকে ত্যাগ না করেই। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বেশ্যা বৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না।
প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতা বৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের যে চিত্র পাওয়া যায় তা হল, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময় কৌটিল্যের হাত ধরে দেহব্যবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়,যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। ঐ সময় দেহব্যবসা ছিল সন্মানিত পেশা। জ্ঞানী লোকেরা এ শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। (তথ্যসূত্র: কৌটিল্য : প্রেম ও নৈতিকতা, ড. প্রতাপ চন্দ্র, কলকাতা, ২০০০)
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, কৌটিল্যর আরেক নাম ছিল চাণক্য। তিনি প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রের’রচয়িতা। তিনি প্রথম মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কাউন্সেলর ও উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত অর্থশাস্ত্রের মতে, দেহব্যবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপন নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এর অনুমোদন করে এবং সংগঠকের ভূমিকা নেয়। ঋগ্বেদ এবং জাতকেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতরা। কৌটিল্য জানান যে, তখন দেহব্যবসা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রীক। নগরজীবনের অবশ্যঅঙ্গ ছিল এটি। রাজকোষের আয়ের যে বিভিন্ন উৎস ছিল তার মধ্যে ‘দুর্গ’ নামক বিভাগটিতে বেশ্যা, জুয়াখেলা ও আবগারী বিভাগের পরিদর্শকের কথা বলেছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে এমনকি গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। তাঁর কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের যে চিত্র পাওয়া যায় টা নিয়ে পণ্ডিতে-পণ্ডিতে মতদ্বৈধতা আছে।
প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস প্রথম মৌর্যশাসক চন্দ্রগুপ্তের সময়ে ভারতে এসেছিলেন। তিনি তাঁর রচিত গ্রন্থে এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যারা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের ওপর গণিকাদের সহায়তায় নজর রাখতেন এবং রাজার কাছে গোপন রিপোর্ট দিতেন। স্টার্নবাকের মতে, গণিকা মানে সরকারি কর্মচারী। অন্য যেকোনো সরকারি কর্মীর মতোই এরা। কৌটিল্য এই অর্থেই ব্যবহার করেছেন শব্দটি। অর্থশাস্ত্রে গণিকারা ছাড়াও সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যারা দেহব্যবসা করতেন তাদের একটি তালিকা দেয়া আছে– যথা পুংশালী অর্থাৎ সাধারণ দেহব্যবসায়ী, সুরাসুন্দরী অর্থাৎ পানশালার ওয়েটার, বন্ধকী অর্থাৎ ঘটনাচক্রে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়া গৃহবধূ, বেশ্যা অর্থাৎ কারুকুশীলব বা গুপ্তচর, সাধ্বি-ব্যঞ্জনা অর্থাৎ সতীত্বের ভান করে থাকা পুলিশের গুপ্তচর, দেবদাসী অর্থাৎ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত পবিত্র বারাঙ্গনা, পরিব্রাজিকা অর্থাৎ আড়কাঠি বা দালাল। এঁদের সামাজিক মর্যাদা ছিল রাজঅনুগ্রহপুষ্ট গণিকাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। যুদ্ধক্ষেত্রে, শিকারে এবং আরো অনেক সময় রাজার সঙ্গে গণিকাদের থাকবার কথা লিখেছেন গ্রিক লেখকরা। মহাভারতেও গণিকাদের বর্ণময় জীবন ও রাজকীয় জাকজমকের বর্ণনা আছে। যেমন উদ্যোগপর্বে কৌরবপক্ষের বেশ্যাদের কাছে যুধিষ্ঠির শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণ যখন শান্তির জন্যে দৌত্য করতে আসেন তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানান গণিকারা। রামায়ণে দেখা যায়, রাম ভরতকে জিজ্ঞাসা করছেন যে তিনি গণিকা, ঘোড়া ও হাতির ব্যাপারে সন্তুষ্ট কি না। জৈন লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ আছে যে, রাজা নন্দ গণিকার গর্ভজাত এক নাপিতের সন্তান। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বিখ্যাত গণিকা অম্বাপালী, সালাবতী, সামা, সুলমা ছাড়াও এমন অনেকের কথা বলা আছে, যারা বুদ্ধি ও শিল্পীত দক্ষতার গুণে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ তৎকালীন গণিকা নারীরা সমাজে-রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান পেতেন এবং সাধারণ সভ্যসমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া রাজরাজড়ারাও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। তাদেরকে যখন তখন যে কেউ ভোগার্থে ব্যবহার করতে পারত না কিংবা মন্দ কথা বলতে পারত না। এমনকি গণিকাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও অধিকার ছিল। রাজকোষ থেকে বেতন ছাড়াও তাঁরা অলংকার, পোশাক-আশাক, অন্যান্য উপঢৌকন, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি লাভ করতেন। কোনো গণিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে বা তাঁর অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে বলপূর্বক দেহমিলনের চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ আর্থিক সাজা হতো।
সেই সময় আরো এক ধরনের পতিতাবৃত্তি চালু ছিল ভারতে – (Sacred prostitution) ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি। অর্থাৎ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে যৌন মিলন। এ ধরনের কাজে যে ব্যাক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী। দেবদাসী মন্দির সেবিকা। বর্ধিত অর্থে মন্দিরের বারাঙ্গনা,দেহোপজীবিনী বা গণিকা। এখনো গোপনে ভারতের অনেক মন্দিরে দেবদাসী প্রথা চালু আছে। এছাড়া “উত্তর ভারতে জিপসি সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়ে শিশুকে পতিতা বানানোর এক ধরনের প্রথা ছিল। বিহার ও উত্তর প্রদেশে ছিল নায়েক, পশ্চিম ভারতের গুজরাটে দেহে ও বর্ণের পতিতা এবং দাক্ষিণাত্যে ছিল মোহর নামক উপজাতীয় পতিতা।
মধ্যযুগে পতিতার প্রসঙ্গ ও পরিচয় সাহিত্যে পাওয়া যায় ব্যাপকভাবে। “পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিদারের রাজসভায় রচিত হয় গ্রন্থ ‘লজ্জত উন নিসা’ (একটি ভারতীয় কামোদ্দীপক উপাখ্যান)। যা ঐ যুগেরই বিদ্যমান কামোদ্দীপক রচনা গুলির একটি।
(তথ্যসূত্র: Lazzat Un Nisa, translated by Jane Fine, Classex Books, 2002)
সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তাঁর “কাদম্বরী” গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিতো। “নবম শতকে ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থ লিখেছিলেন কাশ্মীরের মন্ত্রী ও কবি ‘দামোদর গুপ্ত’। ‘বিকরবালা’ নামের এক বৃদ্ধা বেশ্যার উপদেশ নামা নিয়েই মুলতো ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থ লেখা। বাৎসায়নের কামসূত্রের মতোর ‘কুট্টনীমত’ একটা কামশাস্ত্র গ্রন্থ। এছাড়া মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্য গুলিতেও বেশ্যা নারীর উল্লেখ আছে। দোনা গাজির- সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল, আবদুল হাকিমের- লালমতি সয়ফুল মুল্লুক, শুকুর মাহমুদের- গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস — এইসব কাব্য পুথিতে বেশ্যা- সংস্কৃতির সরস বিবরণ দেওয়া রয়েছে।
(তথ্যসূত্র:
১- Murphy Emmet (1983).Great Bordellos of the World. Quartet Books.
২- PK Sing, ‘Brothel Prostitution in India’ 2004.
৩- S.N Sinha and N.K. Basu: ‘History of Prostitution in India’,1994.
৪- Mc Ginn, ‘The Economy of Prostitution’.
৫- নগেন্দ্রনাথ বসু,বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, কলকাতা।
৬- বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত,১৯৯৯।
৭- পৃথ্বীরাজ সেন, বাবু কোলকাতার বিবি বিলাস।
৮- দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়, সংস্কৃত সাহিত্যে বারাঙ্গনা।)
লেখক পরিচিতি : রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।