রোগ নিরাময়ে হলুদের ব্যবহার

লেখক: মিজানুর রহমান সেখ

তরকারিতে হলুদের পরিমাণ ঠিক না হলে যেন তরকারির আভিজাত্য কমে যায়। সাধারণ গৃহস্থালিতে হরেকরকম ব্যঞ্জনের রঙ করার উদ্দেশ্যেই প্রধানত হলুদ ব্যবহার হয়। তবে শুধু রঙ ও স্বাদ বাড়ানোর জন্য নয়, হলুদের নানান গুণ শরীর সুস্থ রাখতেও আবশ্যক। মশলার মধ্যে হলুদ প্রায় শীর্ষ স্থান দখল করে আছে। কাঁচা হলুদ থেকে শুরু করে গুঁড়ো হলুদের ব্যবহার সর্বত্রই দেখা যায়। রোগ নিরাময়ে হলুদের ব্যবহার এখানে তুলে ধরা হল।

মুখের ঔজ্জল্যতা বৃদ্ধি : হলুদের এক নাম ‘হরিদ্রা’; আর এক নাম ‘বর্ণ বিধারণী’। মুখের লালিত্য বজায় রাখার জন্য মুসুর ডাল ও কাঁচা হলুদ বেটে দুধের সর মিশিয়ে মুখে ও হাতে মাখার রেওয়াজ গ্রাম বাংলায় বিশেষ ভাবে প্রচলিত।

ব্রণ নিরাময় : বলা হয় সকালে খালি পেটে কয়েকটা নিমপাতা ও অল্প কাঁচা হলুদ একসঙ্গে চিবিয়ে খেলে ব্রণ সেরে যায়। শুধু তাই নয়, এতে নাকি দেহের রঙও উজ্জ্বল হয়। নিম ও হলুদ এই দুটোই আমাদের জন্য ভীষণ উপকারী।

পেটের কৃমির নিরাময় : হলুদ কৃমিনাশক। কাঁচা হলুদের কয়েক ফোঁটা রস অনেক সময় কৃমির চিকিৎসায় ঘরোয়া পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়।

চর্মরোগ এবং চুলকানি নিরাময়: কাঁচা হলুদ, কমলালেবুর খোসা ও নিমপাতা একসঙ্গে জল দিয়ে বেটে গায়ে মেখে এক ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেললে গায়ে ঘামাচি সেরে যায় । শুধু তাই নয়, এইভাবে হলুদের ব্যবহারে বিভিন্ন চর্মরোগও কমে। হলুদের অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল,অ্যান্টি ভাইরাল ও অ্যান্টি ফাংগাল ধর্ম আছে। কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা বাটার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা খাঁটি সরষের তেল মিশিয়ে স্নানের আগে শরীরে লাগিয়ে একটু অপেক্ষা করে, তারপর স্নান করলে চুলকানি কম হতে পারে।

শরীরের দাগ : গায়ে হাম, বসন্ত বা চুলকানির দাগ থাকলে ডাবের জল,কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা একত্রে বেটে কয়েক দিন লাগালে দাগ কমে যায় ও চামড়া ফর্সা হয় ।

দেহের কোন অংশ মচকে গেলে : দেহের কোনো অংশ মচকে গেলে ১ ভাগ নুন, ২ ভাগ চুন ও ৪ ভাগ হলুদ বাটা একত্রে ভালো করে মিশিয়ে গরম করে মচকে যাওয়া অংশে ২-৩ দিন লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

অ্যালার্জি বা আমবাত : বিশেষ কিছু খাবার খেলে অনেকের দেহে চাকা চাকা হয়ে ফুলে ওঠে এবং এলার্জি হয়। সেইসঙ্গে এগুলো চুলকায় লাল বা গোলাপি রঙ ধারণ করে যাকে বলা হয় আর্টিকোরিয়া বা আমবাত। এ ক্ষেত্রে নিমপাতার গুঁড়ো ১ ভাগ,হলুদ  গুঁড়ো ২ ভাগ এবং শুষ্ক আমলকী গুঁড়ো ৩ ভাগ একসঙ্গে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে বেশ কিছু দিন অল্প মাত্রায় খেলে এই সমস্যা দূর হতে পারে।

জোঁক ধরলে : গ্রামের দিকে বর্ষায় জোঁকের উপদ্রব খুব বেশি হয়। কখনো জোঁকে ধরলে জোঁকের মুখে হলুদ গুঁড়া দিলে সঙ্গে সঙ্গে জোঁক পড়ে যাবে এবং রক্ত বন্ধ হবে। উল্লেখ্য, জোঁক কোনো প্রাণীর গায়ে কামড় বসানোর সময় হায়াসিন নামক রাসায়নিক প্রয়োগ করে যা রক্ত তঞ্চনে বাধা দেয় তাই রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না।

ক্যান্সার প্রতিরোধ : আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে, কাঁচা হলুদের কারকামিন নামক উপাদানের ক্যান্সারনিরোধী ক্ষমতা আছে। কারকামিন টিউমারের কোষকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে বাধা প্রদান করে থাকে। এছাড়া এই কারকামিন আথ্রাইটিস বা অস্থিসন্ধির প্রদাহ কমাতেও কাজ করে।

কিডনী ও হার্টে ভালো রাখে : গবেষণায় জানা গেছে, হলুদের রয়েছে রক্ত জমাটবিরোধী উপাদান ও রক্তজালিকা রক্ষাকারী কাজ(endothelial function)। ফলে হার্ট ভালো থাকে। এছাড়া এর অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ভাইরাল উপাদান শরীরের জীবাণু সংক্রমণ কমিয়ে কিডনী ভালো রাখতে সাহায্য করে।

ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে বাধা সৃষ্টি : ত্বকের কোনো রকম ঘা বা ক্ষতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলে সেখানে হলুদের প্রলেপ দিলে হলুদ ক্ষতের চারদিকে শক্ত আবরণ সৃষ্টি করে, যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার করতে বাধা দান করে। হলুদের ব্যাকটেরিয়া নিরোধী গুণাবলির জন্য ক্ষতস্থান ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হতে রক্ষা পেয়ে থাকে।

খাদ্য পরিপাক: হলুদ পিত্তথলিকে পিত্তরস নিঃসরণে উদ্দীপ্ত করে। ফলে খাদ্য পরিপাক দ্রুত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, হলুদ অন্ত্রে আসা এককোষী পরজীবীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

পচন থেকে খাদ্যবস্তুকে রক্ষা: মাছ, মাংস ও শুঁটকি জাতীয় বস্তুকে প্রক্রিয়াজাত করার আগে হলুদ ও লবণ মিশিয়ে নিলে জীবাণুর আক্রমণ কম হয় ও দীর্ঘসময় ভালো থাকে ।

সাবধানতা : হলুদের অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও হলুদ ব্যবহারে বেশ কিছু ঝুঁকি আছে । বিশেষ করে যাদের লিভারের সমস্যা বা রোগ আছে তারা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হলুদ খাবেন। বেশি হলুদ গ্রহণ তাদের জন্য ক্ষতিকর। ল্যাক্টোস ইনটলারেন্ট হলে দুধের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে খাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে দুধ বাদ দিয়ে মধু, সয়া দুধ অথবা শুধু হলুদ অল্প পরিমাণে খাওয়া যাবে। দুরারোগ্য কোনো লিভারের অসুখ হলে হলুদ যতটা পারা যায় এড়িয়ে চলতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ত্বকে সহ্য না হলে হলুদের ব্যবহার বাদ দিন। একাধারে দীর্ঘদিন কাঁচা হলুদ না খেয়ে মাঝে মধ্যে বিরতি দিতে হবে। পরিমাণমতো হলুদ খেতে হবে। অতিরিক্ত হলুদ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।

তথ্য সূত্রঃ
1)http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details/
2)https://www.banglatribune.com/lifestyle/news/
3)https://www.healthline.com/nutrition/golden-milk-turmeric


লেখকের কথা: মিজানুর রহমান সেখ
মিজানুর পেশায় শিক্ষক এবং একজন সমাজসেবক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যই মূলত লেখালিখি। লেখক পদার্থবিদ্যা ও শিক্ষাবিজ্ঞানে মাস্টার্স।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum