লেখক : সৈকত প্রসাদ রায়
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন মানেই কেবল রাজনীতিবিদদের ইতিহাস নয়। এটি বহু নীরব ত্যাগ, আত্মদানের ইতিহাস, আর ইতিহাসের পাতার বাইরেও অনেক “অদৃশ্য শক্তি”-র ছায়া, যাঁরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ না নিয়েও যুগকে প্রভাবিত করেছেন। তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব হলেন মাতৃরূপিনী, ভগিনী নিবেদিতার ভাষায় ‘the Holy Mother’—মা সারদা দেবী।
সারদা মা নিজে কখনও সরাসরি রাজনীতিতে জড়াননি। কিন্তু তিনি ছিলেন সেই নৈতিক, আধ্যাত্মিক ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে বহু সত্যসাধক, বিপ্লবী, সন্ন্যাসী গড়েছেন ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। তাঁকে বুঝতে হলে কেবল বাইরের ঘটনাই নয়, বুঝতে হয় তাঁর চিন্তা, অনুভব আর নৈতিক অবস্থান।
বিশ্ব মাতৃত্বের পরিচয়
সারদা মা ছিলেন এক বিশাল হৃদয়ের প্রতীক। তাঁর মধ্যে যে বিশ্বমাতৃত্বের পরিচয় ফুটে উঠেছে, তা কোন গোষ্ঠীর সীমায় আটকে থাকে না। একবার পুজোর সময় মেয়েদের জন্য কাপড় আনতে পাঠিয়েছিলেন একজন ব্রহ্মচারীকে। ব্রহ্মচারী স্বদেশী ভাবাপন্ন মানুষ, তিনি স্বদেশী মোটা কাপড় নিয়ে এলেন, মেয়েদের সেটা পছন্দ হ’ল না। তারা সেটি পাল্টে আনতে বলল। ব্রহ্মচারী স্বভাবতই বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওগুলো তো বিদেশী হবে, ও আবার কি আনব?” মা পাশে বসেই সমস্তটা শুনছিলেন, হাসতে হাসতে বললেন, “বাবা তারাও (বিলেতি সাহেবরা) তো আমার ছেলে, আমার সকলকে নিয়ে ঘর করতে হয়, আমার কি একরোখা হলে চলে? ওরা যেমন যেমন বলছে, তাই এনে দাও।” এই একটি বাক্যেই তিনি বুঝিয়ে দেন, তাঁর ভালবাসা কোন ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ নয়। তিনি যেমন ভারতের সন্তানদের আশীর্বাদ দিয়েছেন মুক্তির জন্য, তেমনি শত্রু জাতির সন্তানদের প্রতিও ছিল সমান মমত্ব। একজন ব্রিটিশকে ‘বিলাতের ছেলে’ বলে মায়ের স্নেহে দেখা – এ কেবল কথার কথা নয়, এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রতিচ্ছবি। এখানেই প্রকাশ পায় মা’র বিশ্বজননী রূপ – যে মাতৃত্ব শত্রু-মিত্র কিছু চেনে না।
সত্য উপলব্ধির শাণিত দৃষ্টিভঙ্গি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে যখন বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো মুখে মুখে বলছিল “আর যুদ্ধ নয়”, তখন অনেকেই হয়ত আশাবাদী হয়েছিল নতুন বিশ্বব্যবস্থার। কিন্তু সারদা মা এই কথার ভিতরের ফাঁক বুঝেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এ তো খুব ভাল কথা। কিন্তু ওরা যা বলে সব মুখস্থ। যদি অন্তঃস্থ হত, তাহলে কথা ছিল না।”
এই মন্তব্যে ফুটে ওঠে তাঁর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণশক্তি এবং মানুষের বাইরের মুখোশ আর ভিতরের অভিপ্রায়ের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা। মা কেবল আধ্যাত্মিক শিক্ষয়িত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন মনোবিজ্ঞানী, সমাজ পর্যবেক্ষক এবং নৈতিক দৃষ্টিসম্পন্ন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে মায়ের গর্জন
কিন্তু সারদা মা কেবল কোমল হৃদয়ের জননী ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রয়োজনে অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা এক ন্যায়সঙ্গত কণ্ঠ। এমন এক সময়, যখন একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী ব্রিটিশ পুলিশের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তখন মা চুপ ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, “বলো কী… এটা কি কোম্পানির আদেশ, না কি পুলিশ সাহেবের কেরামতি? এ যদি কোম্পানির আদেশ হয়, তবে আর বেশি দিন নেই। এমন কোন বেটাছেলে কি সেখানে ছিল না, যে দু’টো চড় মেরে মেয়েটিকে ছাড়িয়ে আনতে পারে?” এই উক্তি শুনলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। কারণ একজন ঘোর ধর্মনিষ্ঠা নারী, যিনি সাধারণত সংসার, সেবা ও সংযমের ভাষাতেই কথা বলেন, তিনি এত দৃঢ় কণ্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন। তাঁর কণ্ঠে যেমন আবেগ আছে, তেমনি আছে ন্যায়বোধ। এ প্রতিবাদ নিছক আবেগ নয়, এটি ছিল এক নৈতিক প্রতিবাদ, এক অন্তর্দৃষ্টি-নির্ভর সতর্কবার্তা, যে অন্যায়কারীদের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক পরোক্ষ ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ঋষি-সন্ন্যাসী ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকদের মাধ্যমে। বিপ্লবী সন্ন্যাসীরা, যাঁরা জাতীয় চেতনার বীজ বপন করেছিলেন, তাঁদের প্রধান ভিত্তি ছিলেন মা সারদা। তাঁর নীরব প্রেরণায় গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী দেশপ্রেমিক মনন। তিনি ছিলেন না রাজপথে, কিন্তু ছিলেন চেতনার ভিতরে। তাঁর উপস্থিতি হাজার হাজার কর্মীর হৃদয়ে যুগিয়েছে ধৈর্য, বিশ্বাস, সংযম ও সাহস।
সারদা মা না ছিলেন নেত্রী, না প্রথাগত বক্তা। তিনি ছিলেন এক নীরব দীপশিখা, যিনি নিজের আলোয় জ্বালিয়েছেন সহস্র মশাল। তাঁর বলা কথাগুলো শুনলে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন সময়ের বহু আগে এগিয়ে থাকা এক বুদ্ধিদীপ্ত নারী, যাঁর বিশ্লেষণ ক্ষমতা, দয়া, ন্যায়ের বোধ— সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ মানুষ। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান হয়ত পরোক্ষ, কিন্তু তাঁর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, মমত্ববোধ, প্রতিবাদের ভাষা এবং বিশ্বজননী রূপ— সবই এক নতুন ভারতের ভিত গড়ার জন্য অপরিহার্য ছিল।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, সারদা মাকে মনে পড়লে মনে পড়ে সেই অবিনশ্বর আলো, যাঁর প্রেরণায় ভারত তার আত্মার মুক্তির দিশা খুঁজে পেয়েছিল।
তথ্য সূত্র :- শতরুপে সারদা – স্বামী লোকেস্বরানন্দ
লেখক পরিচিতি : সৈকত প্রসাদ রায়
একজন ব্যবসায়ী, ক্লাস 9 থেকে লেখালিখির সাথে জড়িত