লেখক : শুভজিৎ দত্তগুপ্ত
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিকাশে দেশীয় রাজন্যবর্গ এক বৈচিত্র্যময়, দ্বৈত ও জটিল ভূমিকা পালন করেছিল। নবাব, রাজা, জমিদার, ঠাকুর, মহারাজা ও স্থানীয় শাসকগোষ্ঠী, যারা পূর্বে নিজস্ব আঞ্চলিক ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করতেন, ব্রিটিশ আগমনের পর একদিকে তাঁদের কেউ ব্রিটিশ শক্তির অনুগত হয়ে পড়েন, অন্যদিকে কেউ কেউ শক্তিশালী প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। এই দ্বিমুখী অবস্থান গোটা ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে এক নতুন মাত্রা প্রদান করে।
পলাশির যুদ্ধ (১৭৫৭) ও বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪)-এর পর থেকে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মীরজাফর ও জগৎশেঠদের মতো দেশীয় রাজন্যরা ব্রিটিশদের সহায়তা করে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বক্সারের যুদ্ধে শুজাউদ্দৌলা ও মীর কাসিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। এই দুই যুদ্ধ ব্রিটিশদের হাতে দেওয়ানি লাভ নিশ্চিত করে এবং দেশীয় রাজন্যবর্গের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। এরপর ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ প্রথার মাধ্যমে দেশীয় রাজন্যরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পালনের দায়িত্ব নেন এবং বিনিময়ে স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করার সুযোগ পান, যদিও প্রকৃত ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল।
ধাপে ধাপে ‘Doctrine of Lapse’ বা ‘ল্যাপস নীতি’র মাধ্যমে বহু দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ঝাঁসি, সাতারা, নাগপুর প্রভৃতি রাজ্য এই নীতির শিকার হয়। অনেক রাজন্য এই প্রক্রিয়ায় আপসহীনভাবে নিজ রাজ্য রক্ষা করতে গিয়ে যুদ্ধ করেন, আবার কেউ কেউ অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। দেশীয় রাজন্যদের বড় অংশ ব্রিটিশ রেসিডেন্টদের পরামর্শ অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করতেন, নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনেক সময় স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতেও অপারগ ছিলেন। রাজপুতানার রাজারা, হায়দ্রাবাদের নিজাম, ত্রাভাঙ্কোরের মহারাজা, বরোদার গায়কোয়াড় প্রভৃতি শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে সামান্য শাসনক্ষমতা ও আভিজাত্য ধরে রাখেন।
তবে এই চিত্র সম্পূর্ণ একপাক্ষিক নয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে বহু রাজন্য সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, কানপুরের নানাসাহেব, দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, ফৈজাবাদের বেগম হাজরত মহল, বিহারের কুয়ার সিংহ, ও মহারাষ্ট্রের তাতিয়া টোপি এঁরা সকলেই নিজ নিজ প্রদেশে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। যদিও এই আন্দোলন একত্রিত ও সুসংহত ছিল না, তবুও রাজন্যদের এই অংশ উপনিবেশবিরোধী আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার স্মারক হয়ে রইলেন।
এছাড়া কিছু রাজন্য সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ না বেছে সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজ উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন। বরোদার মহারাজা সায়াজিরাও গায়কোয়াড়, ত্রাভাঙ্কোরের রাজা ও কাশীর রাজারা নারীশিক্ষা, বাল্যবিবাহ নিরোধ, বিদ্যালয় স্থাপন, কৃষি উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা নেন। তাঁরা সরাসরি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধরলেও তাঁদের জনমুখী নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ আধিপত্যের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এই রাজন্যরা আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভিত্তি নির্মাণ করেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্বে দেশীয় রাজ্যগুলোর ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ব্রিটিশ শাসনের অধীন প্রায় ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য ছিল, যাদের প্রত্যেককে স্বাধীন ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা তৈরি হলেও অধিকাংশ রাজ্য স্বেচ্ছায় ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। ভারতের প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা ভি.পি. মেননের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘Instrument of Accession’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে দেশীয় রাজ্যগুলোর ভারতীয় ইউনিয়নে একীভূতকরণ সম্ভব হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনও বড় রক্তপাত ছাড়াই ভারতকে একটি একক রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত করা সম্ভব হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ভারতীয় দেশীয় রাজন্যবর্গের ভূমিকা শুধুমাত্র আত্মসমর্পণকারী বা প্রতিরোধকারী নয়। এটি ছিল এক বহুমাত্রিক ইতিহাস যেখানে রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, কৌশল, সংস্কার, দ্বন্দ্ব ও সমঝোতা—সবকিছুই স্থান পেয়েছে। কেউ রাজক্ষমতা রক্ষার্থে ব্রিটিশদের সমর্থন করেন, কেউ বা তাঁদের বিরুদ্ধেই জীবন উৎসর্গ করেন, আবার কেউ কেউ নিজের জনগণের উন্নয়নে নীরব বিপ্লব ঘটান। এই সমস্ত ভূমিকা একত্রে ভারতের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরে।
আজ ইতিহাসের এই অধ্যায় থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়—যেখানে আত্মমর্যাদা, নেতৃত্ব, ঐক্য ও জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ—এইসব গুণাবলীই এক জাতির শক্ত ভিত্তিরচনার উপাদান হয়ে ওঠে। দেশীয় রাজন্যদের ইতিহাস তাই শুধু উপনিবেশের গৌরব চিহ্ন মাত্র নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের নির্মাণকালের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
তথ্যপঞ্জি:
• Ramusack, Barbara. *The Indian Princes and their States*. Cambridge University Press, 2004.
• Bipan Chandra et al. *India’s Struggle for Independence*. Penguin Books, 1989.
• V.P. Menon. *The Story of the Integration of the Indian States*. Orient Longman, 1956.
• Sarkar, Sumit. *Modern India: 1885–1947*. Macmillan, 1983.
• Butler Committee Report (1927–29), British Government Archives.
• National Archives of India: Records on Princely States.
• www.csirs.org.in
• www.ijrar.org
• www.historyjournal.net
• www.en.wikipedia.org
লেখক পরিচিতি : শুভজিৎ দত্তগুপ্ত
লেখক একজন সমাজকর্মী