লেখক: অয়ন মৈত্র
ডিজাস্টার বলতে আমাদের অর্থাৎ ভারতীয়দের চোখে তিনটে অবস্থা বোঝায়- ১. ঘূর্ণিঝড় ২. বন্যা ৩. ভূমিকম্প। বইতে পড়েছি বটে এক পিস আগ্নেয়গিরি আছে আন্দামানের ব্যারেন দ্বীপে কিন্তু ওই খাতায় কলমেই যা আছে। এই ভলক্যানো বাবাজীবনকে নড়তে চড়তে আমাদের শেষ তিন চার পুরুষ দেখেছে এমন খবরও নেই। অবশ্য ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ৪ ঘন্টার জন্য একটু নড়ে টড়ে লাভা টাভা বমি করেছিল বটে, কিন্তু ওকে অগ্ন্যুৎপাত বলে অত মহান করার দরকার নেই। আমরা আগ্নেয়শিলা নিয়েই খুশি। আগ্নেয়গিরি-ফিরির ঝামেলা যে আমাদের পোহাতে হয়না তার জন্য ‘পকিতি মা’কে এক পিস সেলাম। মাঝে উত্তরাখন্ডে হঠাৎ শুনলাম ‘ক্লাউড বার্স্ট’!’ বোম টোম, কপাল ফপাল এই সব ফাটে শুনেছি, ছোট বেলায় টাইট প্যান্ট পরে স্কুলে তিনটে সিঁড়ি একসাথে টপকাতে গিয়ে প্যান্টও যে ফাটে সেটাও দেখেছি। কিন্তু মেঘ ফাটা ব্যাপারটা জন্মে শুনিনি। যাক সেটা ফাটলে যে কী হয় সেটা দেখার পর বুঝেছি বোম-টোম এর কাছে বাচ্চা। ডিজাস্টার এর লিস্টে এটাও ঢুকল। কিন্তু পঙ্গপাল ঢুকেছে রাজস্থানে এটা কীরকম ডিজাস্টার! তো ওরকম পোকা তো আমরা কত দেখি কালীপূজার সময় ল্যাম্প পোস্টের আলোর তলায় ঝাঁক বেঁধে ঘুরছে। শ্যামা পোকা বলে। তো ওরকম পোকাই না হয় এসেছে। কালা হিট বা লাল হিট স্প্রে করে দাও! ব্যস! পঙ্গপাল তখন গোপাল হয়ে যাবে।
আমরা যারা উমপুনের হারপুনে গেঁথে আছি তাদের কাছে এটা একটা খবর। নিজেরা এখনো ঘেঁটে ঘ হয়ে আছি পঙ্গপাল বা ভোপাল কাউকে নিয়েই আমাদের মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই। ঠিক কথা। কিন্তু পঙ্গপাল নিয়ে যদি আমাদের নুন্যতম একটু ধারণা থাকত তাহলে আমরা এই ‘বিপদ’টিকে নিয়ে এত নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম না। এটা একটা প্রাচীন ডিজাস্টার যার আচরণ এবং আগমন সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে। ভারতে বারে বারে পঙ্গপাল হানা দিয়েছে কিন্তু তা এতদিনে জাতীয় খবর হল। করোনা, ভাইজাগ গ্যাস লিক, উমপুন, মনিপুর ভূমিকম্প, উত্তরাখন্ড দাবানল এই লাইনে পঙ্গপাল এল বলেই এবারে খবর হল। এই সুযোগে একটু জেনে নেওয়া যাক তাহলে পঙ্গপাল সম্পর্কে।
পঙ্গপাল বলতে ছোট শিংওলা ঘাসফড়িং এর একটা ঝাঁককে বোঝায়। এই ঘাসফড়িংদের প্রাইভেসি ব্যাপারটা আবার খুব বেশি। এরা কখনোই দলবেঁধে থাকেনা। একা নিজের মত করে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এরা যখন দলবদ্ধ হয় তখন সেই দলটাকে বলে পঙ্গপাল। ইংরেজিতে বলে Locust। এই শব্দটি আবার ল্যাটিন শব্দ Locusta থেকে এসেছে যার অর্থ – ফড়িং।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশেষ পরিবেশ বা পরিস্থিতি বলতে কী বোঝাচ্ছে। অনেক দিন অনাবৃষ্টি বা খরা চলার পর বৃষ্টি এলে সেই জায়গার ফসলের দ্রুত হারে বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। নতুন ফসলের গন্ধ এই ঘাসফড়িংদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। সেরোটোনিন হরমোন মানুষের ক্ষেত্রে মনে আনন্দ অনুভূতি জাগায় কিন্তু পঙ্গপালের ক্ষেত্রে এই হরমোন তার নিঃসঙ্গ একাকী থাকার ইচ্ছেটাকে প্রবল ভাবে দমিয়ে তার মধ্যে দলবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। দলবদ্ধ হওয়ার এই আকাঙ্খাকে ইংরেজিতে Gregarious বলে। ঘাসফড়িংয়ের মধ্যে একবার এই অনুভূতি জাগলেই কান্ড করেছে! হঠাৎ করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তারা সংখ্যায় বাড়তে থাকে এবং ক্রমশ দলবদ্ধ হতে থাকে। দলবদ্ধ হওয়ার পরই আসল খেলা চালু। এরা তখন যাযাবর বা পরিযায়ী হয়ে যায়। নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সদ্য হওয়া ফসলের ক্ষেতের দিকে ছুটে যায়। তবে এদের এই ছুটে যাওয়ার কিন্তু একটা ছন্দ আছে। একে Swarm বলে ইংরেজিতে। যার অর্থ একটা ঝাঁকের সকল পঙ্গপাল একই ছন্দে উড়বে বসবে ওপর নীচ করবে। গবেষকরা দেখেছেন পঙ্গপালের এই বিশেষ ওড়ার রীতির পেছনেও কিন্তু ওই সেরোটোনিন দায়ী। সেরোটোনিনের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষরণ পঙ্গপালের ক্ষিদে এবং প্রজনন ইচ্ছে ও ক্ষমতা দুইই বাড়িয়ে দেয় ব্যাপকভাবে। কেবল নতুন ফসলের গন্ধেই কিন্তু সেরোটোনিন ক্ষরণ বাড়েনা, গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন পঙ্গপালের পেছন পায়ের সঞ্চালনা বেড়ে গেলে সেই থেকেও সেরোটোনিন নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পঙ্গপাল সংখ্যায় বাড়ুক আপত্তি নেই, তাদের থেকে বিপদটা কোথায়? বিপদ হল এদের সংখ্যা আর সেই সঙ্গে এদের রাক্ষুসে খিদে। এক বর্গকিলোমিটার জায়গার মধ্যে মরু পঙ্গপালের একটা ঝাঁকে চার কোটি থেকে আট কোটি পঙ্গপাল থাকে আর এক বর্গমাইলের মধ্যে সংখ্যাটা কুড়ি কোটি। এবার এই সাইজের একটা দল এক একদিনে ননস্টপ ৮১ মাইল বা কখনো কখনো তার থেকেও বেশি পথ ১৫০ মাইল অবধি পথ অতিক্রম করে। ১৯৮৮ সালে এরকম একটা পঙ্গপালের টিম সোজা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুভযাত্রা শুরু করল এবং শেষে থামল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। বেশি দূর নয়, ১০ দিনে তারা মাত্র ৩১০০ মাইল অতিক্রম করেছে। একটি সমীক্ষা বলছে ৩০০কিমি লম্বা লোহিত সাগর এরা হামেশাই পার করে খেলাচ্ছলে।
বিপদটা এখনো আসেনি। আসবে যখন এরা কোথাও থামবে। ম্যারাথন এই যাত্রাপথে এরা যেখানে স্টপওভার নেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই এলাকার মাইলের পর মাইল ফসলী জমি শেষ হয়ে গেল। কেন? ওই যে বলেছিলাম এদের সংখ্যা আর ক্ষিদে দুটোই ভয়ানক। পঙ্গপালদের বেশ কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে মরু পঙ্গপালই সব থেকে ভয়ানক। একটি ঘাসফড়িংয়ের ওজন মোটামুটি ২ গ্রাম হয়। একটা ঝাঁকে যদি কম করেও চার কোটি পঙ্গপাল থাকে তবে মোট ওজন দাঁড়ায় পুরো ঝাঁকটার আট কোটি গ্রাম অর্থাৎ আশি হাজার কেজি। এখন মজাটা হল এরা আবার প্রতিদিন নিজের ওজনের সমান ওজনের খাবার খায়। তাহলে হিসেবটা যেটা দাঁড়াল সেটা হল চার কোটি পঙ্গপালের একটা ঝাঁক একেক দিন আশি হাজার কেজি ফসল সাবাড় করে। ফসল বলতে? ফসল বলতে যাত্রাপথে খাদ্য জাতীয় যা পড়ে সব…সব নিমেষে উজাড় করে দেয়। এর মধ্যে পাতা, মূল, ফুল, ফল, বীজ, কান্ড, গাছের ছাল, ধান, গম, জোয়ার বাজরা, রাগি মিলেট, ভুট্টা, বার্লি, আখ, ঘাস, তুলো, খেজুর, কলা, সবজি এমনকি আগাছাও। একটা পঙ্গপালের মাঝারি সাইজের ঝাঁক একেক দিন প্রায় দশটা হাতি বা পঁচিশটা উট বা আড়াই হাজার মানুষের সমান ফসল খায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন এর তথ্য অনুযায়ী এরা একেক দিন প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের এক বছরের খাবার নিঃশেষ করে দিতে পারে।
একজায়গার সব খাবার সাবাড় না করা অবধি এরা এই জায়গা ছেড়ে নড়ে না। জমি কে জমি ফসলহীন করে তারপর নতুন ফসলের লোভে আবার উড়ে যায়। বাতাসের গতিপথ যেদিকে থাকে, পঙ্গপাল সেদিকে অগ্রসর হয়। ফলে তারা সবসময়ই নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে যায় – এমন এলাকায় যেখানে বৃষ্টি হয়, অর্থাৎ শস্য উৎপাদনের জন্য আদর্শ জায়গা।
দিল্লীর যা আয়তন সেই আয়তনের একটা ঝাঁক একদিনে যে পরিমাণ শস্য খায় গোটা রাজস্থান বা মধ্য প্রদেশের সমস্ত বাসিন্দার একদিনের খাবারের সমান। ওহ! বলতেই ভুলে গেছিলাম যে দিল্লীর আয়তন ১৫০০ বর্গ কিমি। ১৫০০ বর্গ কিমি আয়তনের ঝাঁক শুনেই যদি চোখ কপালে ওঠে, তাহলে আরও আছে গুরু, তিষ্ঠ ! ১৮৭৫ সালের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী আমেরিকাতে পঙ্গপালের একটা ঝাঁক দেখা গেছিল যার আয়তন মোটামুটিভাবে কম বেশি ৫,১২,৮১৭ বর্গ কিমি। এখন আশা করি একটু আধটু আন্দাজ করা যাচ্ছে এরা ঠিক কতটা ফসল নষ্ট করতে পারে।
এ জিনিস আজকের আমদানি নয়। সেই বাইবেল কোরানের আমল থেকে এরা মানুষকে এভাবে পথে বসিয়ে আসছে বংশ পরম্পরায় একেবারে। ইতিহাসের পাতা জাস্ট খোলার অপেক্ষা! ধর্ম সাহিত্য সব জায়গা জুড়ে এরা হাজির।
বাইবেলের বুক অব এক্সোডাস-এর ১০ নং এক্সোডাসে আমরা এই পঙ্গপালের আক্রমণে প্লেগ প্রাদুর্ভাবের উল্লেখ পাই। মোজেস এবং অ্যারন মিশরের ফ্যারাওকে সতর্ক করছেন – “This is what the Lord, the God of the Hebrews, says: ‘How long will you refuse to humble yourself before me? Let my people go, so that they may worship me. If you refuse to let them go, I will bring locusts into your country tomorrow. They will cover the face of the ground so that it cannot be seen. They will devour what little you have left after the hail, including every tree that is growing in your fields. They will fill your houses and those of all your officials and all the Egyptians—something neither your parents nor your ancestors have ever seen from the day they settled in this land till now.”
২৪৭০ থেকে ২২২০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে মিশরীয়রা তাদের সমাধিতে পঙ্গপালের ছবি আঁকত। এছাড়া কোরানের সুরা আরাফের ১৩৩ নং আয়াতে পঙ্গপাল শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় – “فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ ٱلطُّوفَانَ وَٱلْجَرَادَ وَٱلْقُمَّلَ وَٱلضَّفَادِعَ وَٱلدَّمَ ءَايَٰتٍ مُّفَصَّلَٰتٍ فَٱسْتَكْبَرُوا۟ وَكَانُوا۟ قَوْمًا مُّجْرِمِينَ” যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় – “অতঃপর আমি তাদের উপর প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্তের বিপদ পাঠিয়েছিলাম সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে, কিন্তু তারা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল। তারা ছিল এক অপরাধী জাতি।”
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল পঙ্গপালের আচরণ, তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তার প্রমাণও ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়।
পঙ্গপালের উল্লেখ সাহিত্যেও আছে। ইলিয়াডের একুশ অধ্যায়ে অ্যাকিলিসের জান্থাস নদীর জলে দলে দলে ট্রোজান সেনাকে ডুবিয়ে মারার দৃশ্যে হোমার ট্রোজান সেনাদের পঙ্গপালের সাথে তুলনা করেছেন। আমেরিকান লেখক ন্যাথানিয়েল ওয়েস্ট তাঁর The Day of the Locust বইটিতে পঙ্গপাল হানার উল্লেখ করেছেন। চিনুয়া আচেবের Things Fall Apart-এ নাইজেরিয়ার গ্রামে পঙ্গপাল হানার উল্লেখ পাওয়া যায়। শওকত ওসমানের ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’ -এ পঙ্গপালের আক্রমণের উল্লেখ আছে। গফুরের স্ত্রী সাখিনার সমস্ত শাড়ি কেটে ফেলে পঙ্গপাল। শেষে লজ্জা ঢাকার কোনও রাস্তা না পেয়ে আত্মহত্যা করে গফুরের স্ত্রী। রবীন্দ্রনাথ সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগের তৃতীয় পাঠে লিখছেন, ” …এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ করে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে। ঈশানবাবু ইঙ্গিতে বলেছেন, তিনি কিছু দান করবেন।”
কেবল সাহিত্য নয় পঙ্গপাল জায়গা করে নিয়েছে সিনেমা থেকে ডকুমেন্টারি সর্বত্র। BBC এর PLANET EARTH II নামের ডকুমেন্টারির ‘মরুভূমি’ এপিসোডে এই পঙ্গপাল নিয়ে দেখানো হয়েছে। টেরেন্স মালিকের Days of Heaven (১৯৭৮) নামের সিনেমাটিতেও পঙ্গপাল হানা অসাধারণ ভাবে দেখানো হয়েছে। বিখ্যাত শিল্পী সালভাদর দালি আবার পঙ্গপাল নিয়ে বেশ মুগ্ধ ছিলেন। অদ্ভুত মানুষ ছিলেন বটে। ঝিঁঝিঁ, ফড়িং পঙ্গপাল এসব দেখে ভয় পেতেন আর এই ভয়কে চ্যানেলাইজ করতেন তাঁর আঁকা ছবিতে। Locust and Grasshopper হল তাঁর সেরকম একটি লিথোগ্রাফ পেন্টিং। জেমস টিসটের The Plague of Locusts পঙ্গপালের ওপর আঁকা একটি বিখ্যাত ছবি।
ভারতে বারে বারেই পঙ্গপাল হানা দিয়েছে। বঙ্গ দেশে অত্যাচারটা কম বলেই এদের সম্পর্কে বাংলার মানুষের ধারণাটাও তাই কম। ১৮৭৯ তে পঙ্গপালের আক্রমণে এমন ধ্বংস হয় জমিজমা যে খরা চলতেই থাকে মাসের পর মাস। এরপর ১৯০২ তে ট্রমবে, ১৯৬০ বিদর্ভতে এই পঙ্গপালের বাহিনী জমি কে জমি একেবারে শ্মশান করে দেয়।
পঙ্গপালকে যুক্তিগ্রাহ্য কোন কিছু দিয়েই যখন আটকাতে ব্যর্থ হল আক্রান্ত রাজ্যের গ্রামবাসীরা তখনই সেখানে গ্র্যান্ড এন্ট্রি নিল বাবা ভোলানাথ। মানে? পঙ্গপালকে শিবের ঘোড়া হিসেবে মানা শুরু হল। যুক্তি যেখানে কূল পায়না বিশ্বাস সেখানে দ্বীপ গড়ে। টাইমস অব ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত ১৯২৯ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামবাসীরা পঙ্গপাল জ্যান্ত ধরে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে তাদের ঘরে সঞ্চিত খাবার থেকে সেরা খাবার খাওয়াত। খাওয়ানোর পর তাদের পুজো করা হত। শেষে কাতর ভাবে মিনতি করা হত জেলা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। পঙ্গপালকে শিবের রথের ঘোড়া হিসেবে মানার পেছনে ক্রুদ্ধ দেবতাকে তুষ্ট করার এবং তার লুঠ করার ইচ্ছেকে প্রশমিত করার অসহয়ায় প্ৰচেষ্টা থাকত।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পঙ্গপালের হানাকে ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে দেখা হত। সাতপুরা পাহাড়ে যখন পঙ্গপাল এল তখন তাকে জুড়ে দেওয়া হল স্থানীয় এক জমিদারের অনৈতিকভাবে ব্রিটিশদের কাছে পাহাড়ের একটা অংশ বেচে দেওয়ার অভিশাপ হিসেবে। এরকমই আরেকটি কাহিনী প্রচলিত আছে মধ্য ভারতের ছিন্দওয়ারাতে যেখানে একটি পাহাড়ের নাম দেওয়া হয় ‘টিদ্দি খট’। টিদ্দি হল পঙ্গপালের হিন্দি নাম।। ‘টিদ্দি খট’ অর্থাৎ পঙ্গপালের ঘর। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশরা প্লেনের মাধ্যমেও পঙ্গপাল তাড়ানোর কথা ভেবেছিল। শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি এই কারণে পঙ্গপাল মারার বদলে প্লেনের ইঞ্জিনে পঙ্গপাল ঢুকে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলে পাইলটের জীবনের ঝুঁকি হয়ে যেতে পারে।
মানুষের যুক্তিগ্রাহ্য সমস্ত পদ্ধতি যখন অসহায় ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল প্রকৃতির এই বর্গী হামলার কাছে তখন প্রকৃতিই এর আ্যন্টিডোট নিয়ে হাজির হল। ১৮৭৯ সালে এক অনামী লেখক লক্ষ্য করেন পঙ্গপাল মারতে ময়না, ডাহুক, বক, শকুন এদের কোন বিকল্প নেই। দলে দলে পাখি জড়ো হতে থাকে পঙ্গপাল দিয়ে ফিস্ট করার জন্য। চারপেয়েরাও পিছিয়ে থাকল না। ফিস্ট করতে এগিয়ে এল গরু, ছাগল, বেজি, নেকড়ে শিয়াল এমনকি কুকুরও। মেঠো ইঁদুরদের তো পোয়া বারো হল এত পঙ্গপাল পেয়ে। গরু, ছাগল, ভেড়া, উট সকলেই যখন এগিয়ে এল তখন আর দুপেয়েরাই পিছিয়ে থাকে কেন। সর্বভুক হিসেবে নতুন এই ডেলিকেসিটা ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে! একদমই না। নেমে পড়ল মানুষও পঙ্গপাল খেতে। পা দুটো ছিঁড়ে অল্প ঘিয়ে মশলা মাখিয়ে আগুনে সেঁকার পর নুন মরিচ দিয়ে…আহা! ভারতে মানুষের পঙ্গপাল খাওয়া নতুন হলেও সারা পৃথিবী জুড়েই মানুষের পঙ্গপাল খাওয়ার চল আছে। এটাও একটা অন্যতম পদ্ধতি পঙ্গপালের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার।
লিখিত তোরা’র তৃতীয় বই লেভিটিকাস-এর একাদশ অধ্যায়ের বাইশ নং নিয়মে পঙ্গপালকে ‘কোশার’ খাদ্য বলা হয়েছে-
“אֶת־אֵ֤לֶּה מֵהֶם֙ תֹּאכֵ֔לוּ אֶת־הָֽאַרְבֶּ֣ה לְמִינ֔וֹ
וְאֶת־הַסָּלְעָ֖ם לְמִינֵ֑הוּ וְאֶת־הַֽחַרְגֹּ֣ל לְמִינֵ֔הוּ וְאֶת־הֶֽחָגָ֖ב
לְמִינֵֽהוּ:”
অর্থাৎ বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় – “পঙ্গপাল গোত্রের মধ্যে লাল, হলুদ এবং ধূসর ছিট ছিট যুক্ত এবং সাদা পঙ্গপাল খাওয়া যেতে পারে।” এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ‘কোশার’ খাদ্য বলতে বোঝায় তোরায় যে যে খাবার খাওয়ার ব্যাপারে ইহুদিদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এই পঙ্গপালের টিম সাধারণত পূর্ব আফ্রিকা থেকে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বেরোয়। তারপর ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, কেনিয়া-সহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশকে পথে বসিয়ে সৌদি আরব হয়ে পাকিস্তানে ঢোকে। পাকিস্তানে প্রায় বছরই ব্যাপক ফসলের ক্ষতি করে। পাকিস্তানকে সম্প্রতি ছারখার করে দেওয়ার পর এদের লক্ষ্য এখন ভারত। রাজস্থানের ১৮টি এবং মধ্য প্রদেশের ১২টি জেলাকে এরা মরুভূমি করে দিয়েছে কার্যত। ভারতে গত ২৭ বছরে এমন দৃশ্য দেখা যায়নি। ভারতে এর আগেও পঙ্গপাল হানা দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগ সীমাবদ্ধ থাকত রাজস্থানের মধ্যেই। কিন্তু এবারেই প্রথম রাজস্থানের সাথে মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত সর্বত্রই এরা ছড়িয়ে পড়ছে। যোধপুরে অবস্থিত Locust Warning Organization সব রকম উপায়ে চেষ্টা করছে পঙ্গপালের হাত থেকে শয়ে শয়ে হেক্টর জমি বাঁচাতে। তার জন্য ড্রোন উড়িয়ে ক্লোরপাইরিফোস কীটনাশক স্প্রে পর্যন্ত করা চলছে। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর ৬০টি দেশ পঙ্গপালের আক্রমণে বিধ্বস্ত। কেনিয়াতে এই মুহূর্তে যে আক্রমণ চালাচ্ছে টিম পঙ্গপাল তা শেষ ৭০ বছরের মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতে পঙ্গপালের এই বৃদ্ধি যদি এখনই না আটকানো যায় জুনের শেষে এদের সংখ্যা এখনকার তুলনায় চারশো গুণ বৃদ্ধি পাবে। শুধু ইথিওপিয়াতেই ৩,৫৬,২৮৬ মেট্রিক টন ফসল নষ্ট হয়েছে এদের আক্রমণে।
তবু এখানে একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছেই। এখন যে পঙ্গপালের দলটা ভারতে হানা দিয়েছে তাদের উৎপত্তি পাকিস্তানের বালোচিস্তানে। কিন্তু এর থেকেও কয়েক‘শ গুন বড় একটা দল রিজার্ভে রয়েছে যাদের জন্ম আফ্রিকা এবং আরবে। ২০১৮ সালে মধ্য প্রাচ্যে বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন করেছে যে পঙ্গপালের সংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা তারাও ভারত ভ্রমণে বেশী দেরী করবে না। বৃষ্টিপাতের সাথে এদের বংশবৃদ্ধি সমানুপাতিক হারে বাড়ে। আর চিন্তা এখানেই। ভারতে বর্ষা আর কিছুদিনের মধ্যেই ঢুকবে। তারপর?
তথ্যসূত্র:
1. https://en.wikipedia.org/
2. https://en.wikipedia.org/
3. https://www.nationalgeographic.com/
4. https://www.bbc.com/
5. https://timesofindia.indiatimes.com/
6. http://www.fao.org/
7. https://bigyan.org.in/
8. https://qurano.com/
9. https://zeenews.india.com/
10. https://www.anandabazar.com/
11. https://www.indiatoday.in/
12. https://theprint.in/
13. https://economictimes.indiatimes.com
14. https://www.livemint.com/
15. https://www.biblegateway.com/
16. The Entomology of Aristotle :Harry B. Weiss: Journal of the New York Entomological Society: Vol. 37, No. 2 (Jun., 1929), pp. 101-109
17. https://books.google.co.in/
18. https://www.poetryintranslation.com/
19. https://tagoreweb.in/
20. http://shodhganga.inflibnet.ac.in/
21. https://en.wikipedia.org/wiki/Kosher_locust
22. https://www.chabad.org/
23. https://www.chabad.org/
24. https://www.worldbank.org/