লেখক: আশিকা তারাননুম লস্কর
সন্তান প্রসবের পর যদি পরিবারের মুখে হতাশার ছাপ দেখেন, তাহলে বুঝবেন কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে।
কন্যা অর্থাৎ নারী। যে নারী জন্মের পর উলুধ্বনি বা আজান শোনেনি, শুনেছে শুধুই অভিশাপ। ধিক্কার জানিয়েছে সমাজ। পথ চলতে সাথে পেয়েছে হাজারো বাধা। অনেক তো করলে নারী আন্দোলন, তা মর্যাদা পেয়েছো সমাজে?
আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ইকুয়ালিটি কি এসেছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে নারী পুরুষের সমানাধিকার কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজে? নারীরা গৃহবন্দি দশা থেকে বেরিয়ে লেখাপড়া করলেই কি তারা পুরুষের সমান? চাকরি করলেই কি সমানাধিকার পাওয়া যায়? কয়েকজন হয়তো বলবেন, হ্যাঁ মেয়েরা তো পুরুষের সমান মর্যাদা পায়। তাই কি? যদি তাই হয় তাহলে কোনো মেয়েকে রাত করে বাড়ি ফেরার পর শুনতে হতো না “কিরে এতক্ষণ কোথায় ছিলি? এত কী পড়া যে রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়? বলি আমরা কি লেখাপড়া শিখিনি?”
এতো গেল বাড়ির কথা। নিজের বাড়ি ছাড়াও রাস্তার কিছু মানুষ আর প্রতিবেশীদের থেকে শুনতে হবে আরও কুকথা।
“…জানো অমুক বাড়ির মেয়ে প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরে..
– কি বলো রাত ৮টার পর বাড়ি ফেরে? কি জানি বাবা এমন পড়া জন্মে দেখিনি এতো রাত পর্যন্ত? দেখো আবার পড়তে যায় নাকি ছেলেদের সাথে ঘুরতে! কত ছেলের সাথেই তো কথা বলতে দেখেছি…চরিত্রহীন মেয়ে…পরপুরুষের সাথে এত কিসের কথা বুঝিনা বাপু।” শুনতে হয় বখাটে ছেলেগুলোর মুখ থেকে অশ্লীল কিছু শব্দ। আবার কখনো শুনতে হয় “মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছিস গলার আওয়াজ যেন বাইরে না যায়…ঐ মেয়ে এত জোরে জোরে হাসছিস কেন।” আচ্ছা কখনো নিজের ছেলে রাত করে বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞাসা করেছেন এত রাত হলো কেন? কখনো তাকে বলেছেন নিচু স্বরে কথা বলতে? কখনো বলেছেন এত জোরে হাসবি না? বলেননি তো? কেন মেয়েদেরকেই শুনতে হবে বলুন তো? কি মনে হয় মেয়েরা পড়াশোনা করছে বলেই তারা পুরুষদের সমান হয়ে গেছে? যাঁরা বলছেন সমাজে ইকুয়ালিটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তাঁদের বলছি, জানেন কতটা নারীদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে? কখনো সম্মুখীন হয়েছেন “ভার্জিন কিনা” এই প্রশ্নের? হননি তো?
নারীদের ঠিক কী কী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তা কল্পনাও করতে পারবে না। শাড়ির আঁচলটা একটু বেশিই ছোটো হয়ে গেলে লোকে চরিত্রের আঙুল তুলবে, বেশি হাসলে নোংরা মানে বার করবে। স্বামী যদি রাত জেগে অফিসের কাজ করেন তাহলে, “আমার ছেলে কত রাত জেগে কাজ করছে, কী পরিশ্রমটাই না করছে।” আর সেই একই কাজ যদি স্ত্রী করে তাহলে, “এমন কী কাজ যে রাত জেগে করতে হবে?” সমাজের চোখে নারীর সংজ্ঞা দেখে কখনো কখনো মনে হয় নারী হয়ে জন্মানোই বোধ হয় পাপ। যদি পড়াশোনা না জানি তাহলে অশিক্ষিত… যদি শিক্ষিত হই তবে অহংকারী । বিয়ে না করলে অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে… আর বিয়ের কথা বাবা মা কে জানালে “কী মেয়েরে বাবা, লাজ লজ্জা কিছুই নেই, বিয়ের কথা কেমন বলছে দেখ”…আর পড়াশোনা করে ঘর সংসার সামলালে “এতদিন পড়ে কী লাভ হলো?” আর চাকরি করলে “ডানা গজিয়েছে”। লিস্ট অনেক বড়ো, মেয়েরা যে ঠিক আর কী কী – ব’লে শেষ হবে না।
পুরুষদের জন্য রাখীবন্ধন, ভাইফোঁটা আর নারীদের জন্য সতীদাহ প্রথা, সিঁদুর খেলা, শিবরাত্রি । আচ্ছা, বলতে পারেন স্বামী তার স্ত্রীর ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলো নাকি স্ত্রী তার স্বামীর রক্ষাকবচের? বেয়াদপ, অলক্ষ্মী, অপয়া কতো নামই কানে এলো.. জানো বাবা, আজ তোমার মুখে একথা শুনে মনটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেলো। মাকেও বুঝি তুমি এভাবেই দমিয়ে রেখেছো? মা, বোন, কাকিমা, অমুকের বউ এইসব শুনতে শুনতে নিজের অস্তিত্বটা কখন যে হারিয়ে গেছে মনেই নেই! … নিজের অস্তিত্ব হারানোর যন্ত্রনাটা কেমন একদিন মেয়ে হয়ে দেখুন আশা করি বুঝতে পারবেন।
হে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, বাঁচতে চাই আমরা… আমরাও রক্তমাংস দিয়ে তৈরি। মেয়ে, বোন, বউ সব কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমাদের যে দম বন্ধ হয়ে আসছে…বাঁচার অক্সিজেনটুকু ভিক্ষে চাইছি। এটুকুও কি প্রাপ্য নয় আমাদের ? মনে রাখবেন পিতৃসত্তা আজ যে নারীকে আপনারা লাঞ্ছিত করছেন সেই নারীর গর্ভেই আপনার উৎস… সেই নারীর জন্যই আপনাদের অস্তিত্ব।
“বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, মতামত দিলেই চড় লাগাও, কারণে অকারণে চরিত্রে দাগ লাগাও ” – অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে যদি অসভ্য, দিকভ্রষ্ট, চরিত্রহীন হতে হয় তবে শোনো পিতৃসত্তা, আজ হলাম আমরা চরিত্রহীন, আজ নিজ হাতে লাগিয়ে নিলাম কলঙ্কিনীর দাগ।
গর্বিত আমরা নারী।।
লেখকের কথা: আশিকা তারাননুম লস্কর
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের (দ্বিতীয় সেমিস্টারের) ছাত্রী। হাওড়ার কুশাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। শখ – সাধ্য নেই তবে সাধ আছে লেখালিখির।