বিশ্ব অটিজম দিবস ২০২২ অটিজম: কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত

লেখক : সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশজনিত মানসিক ও শারিরীক একটি রোগ। যা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করে। অটিজম সম্পর্কে  সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। ২০২২ সালের অটিজম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো,” অটিজমঃ কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তি “। অর্থাৎ অটিস্টিক ব্যক্তিরাও যেন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে সমাজের আর দশজনের মতো কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারে। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই এই রোগ সম্পর্কে অসচেতন। তাই এই রোগ সম্পর্কে আমাদের জানা খুবই জরুরী।
 
অটিজম সমস্যা কীঃ
অটিজম হচ্ছে  শিশুদের স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা সম্পর্কিত একটি রোগ। যে রোগে আক্রান্ত হলে একটি শিশু তার  সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়। তার চারপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারে না।  মোটকথা যে সমস্যা একটি শিশুকে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে অপূর্ণ করে তাকে অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলে। যদিও অটিজমকে অনেকে মানসিক রোগ মনে করে কিন্তু এটা মানসিক রোগ নয়।
 
কী কারণে অটিজম হতে পারেঃ
অটিজম স্নায়ুবিকাশ জনিত রোগ হলেও এই রোগের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো  কারণকে দায়ী করা যায় না। তবে গর্ভাবস্থার কিছু কিছু বিষয়কে অটিজমের কারণ হিসেবে দেখা হয়। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা করা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, অতিরিক্ত ঔষধ সেবন, মায়ের ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস।  গর্ভকালীন সংক্রমণ যেমনঃ মাম্পস, রুবেলা, মিসেলস ইত্যাদি হওয়া।
 
এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মায়ের  সাথে পরিবারের সম্পর্কের ঘাটতি থাকা,  দুশ্চিন্তা করা, বিষণ্ণতায় থাকা, মৃগীরোগ, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD), বাইপোলার ডিসঅর্ডার সিজোফ্রেনিয়া,  হাইপারঅ্যাক্টিভিটি  ডিসঅর্ডার (ADHD) ইত্যাদিকেও অটিজমের কারণ হিসাবে দেখা হয়।
 
অটিজমের লক্ষণ সমূহঃ
খুব ছোট থেকেই অটিজমের লক্ষণ গুলো শিশুদের মধ্যে প্রকাশ পায়। বিশেষকরে শিশু তার এক বছর বয়সের মধ্যে আধো আধো কথা বা বোল উচ্চারণ করতে না পারা। দেড় বছরের মধ্যে একটি শব্দও বলতে না পারা। দুই বছরের মধ্যে দুই বা তিন শব্দের অর্থবোধক বাক্য না বলা। কিংবা কিছু শেখার পর আবার ভুলে যাওয়া। কিংবা বাচ্চা যদি তার পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা ইঙ্গিত করতে না পারা। বাচ্চার বয়স অনুযায়ী সামাজিক আচরণ করতে না পারা ইত্যাদি হচ্ছে অটিজমের খুবই প্রাথমিক কিছু লক্ষণ।
 
উপরোক্ত প্রাথমিক লক্ষণ গুলোর পাশাপাশি যদি দেখা যায় আসলেই শিশুর ভাষা শিখতে সমস্যা হচ্ছে, বা একেবারেই মা–মা,  বা–বা,  চা–চা, ইত্যাদি এই জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। সেইসাথে কারো চোখের দিকে চোখ রাখতে পারছে না। বা নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। কিংবা সমবয়সী কারো সাথে মিশতে পারছে না বা মিশতে চাইছে না। কেউ আদর করতে চাইলে তা নিতে না পারা। হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া। অন্যের শোনা কথা বারবার বলা। বা যেকোনো বিষয়ে একই আচরণ বার বার করা হচ্ছে অটিজমের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এইসব লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে শিশুকে অতিদ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
 
পারিবারিক ভূমিকাঃ
অটিজম আক্রান্ত শিশু ও ব্যক্তির সুস্থতার জন্য পরিবার ও সমাজের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। অটিস্টিক শিশুদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন পরিবারের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাই রোগ নির্ণয়ের সাথে সাথে পরিবারকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। এই রোগ থেকে একমাত্র বাবা-মাই তার সন্তানকে যতটুকু সম্ভব সুস্থ করতে পারে। তাই বাবা-মাকে অটিজমের উপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে হবে যাতে শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
 
একইসাথে স্কুলে ও বাড়িতে শিশুকে যাবতীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিতে হবে। যাতেকরে শিশুটি সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি শেখার চেষ্টা করতে পারে। বিশেষকরে সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিশুকে সবার সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দিতে হবে।
 
এছাড়াও যে কাজ গুলো শিশু করতে আগ্রহী এবং যা সে ভালো করে করতে পারে, তাকে সেই কাজ বেশী বেশী করার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। বিশেষ করে ছবি আঁকা, গান গাওয়া, খেলাধুলা ইত্যাদির প্রতি তার আকর্ষণ বাড়াতে হবে। সেইসাথে শুরু থেকেই শিশুকে মূলধারার স্কুলে পাঠাতে হবে। যাতে সে নিজেকে সকলের সাথে মিশতে উপযোগী করতে পারে। একইভা‌বে স্কুলের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং থেরাপিস্ট সকলকে একযোগে চিকিৎসার জন্য কাজ করতে হবে।
 
সামাজিক ভূমিকাঃ
পরিবারের পাশাপাশি অটিস্টিক শিশুদের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কর্মকান্ড তাদের সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে সামাজিক লাঞ্চনা এবং অবহেলার কারণে পরিবার থেকেই অটিস্টিকদের সবার থেকে আড়াল রাখে। যা শিশুদের সুস্থ হওয়ার অন্তরায়। তাই আড়াল না করে সামাজিকভাবে এই রোগীদের প্রতি ভালোবাসা ও আস্থা দেওয়া উচিত। যাতে তারা সামাজিকভাবে সকলের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায়।
 
সেইসাথে তাদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা, হেয় প্রতিপন্ন  বা অবাঞ্ছিত করা কখনোই উচিত নয়। সামাজিকভাবে তাদের অযোগ্যতাকে কখনোই প্রকাশ করা উচিত নয়। বরং তাদের নূন্যতম কাজেরও প্রসংশা এবং বাহবা দিতে হবে। যাতে সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের গ্রহনযোগ্যতা সৃষ্টি হয়। এতেকরে তারাও সমাজের একটি অংশ হয়ে উঠতে পারবে। আর এভাবেই সকলের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা পেলে একটি অটিস্টিক শিশু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
 
রাষ্ট্রীয় ভূমিকাঃ
অটিস্টিক শিশুদের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো জনগণের মধ্যে অটিজম নিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ অটিজম সম্পর্কে ধারণা পায়। সাধারণ মানুষেরা যখন অটিজম সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন তারা রোগের শুরুতেই শিশুদের চিকিৎসা দিতে পারবে।
 
 
সচেতনতার পাশাপাশি  অটিজমের চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। একইসাথে প্রতিটি হাসপাতালে অটিজম কর্ণার তৈরি করে চিকিৎসা দিতে হবে। ডাক্তারি চিকিৎসার চাইতে প্রশিক্ষণই এই রোগের মূল চিকিৎসা, তাই প্রতিটি শহরে অটিস্টিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
 
যদিও ইতিমধ্যে সরকারি পর্যায়ে অটিজম নিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে৷ যেমনঃ সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে মিরপুরে চালু হয়েছে ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার’৷ সেইসাথে যারা অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, অটিস্টিক শিশুদের অবস্থা পরিমাপ সহ আরও অন্যান্য প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন’৷ এছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতালে রয়েছে ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’ ইত্যাদি।
 
কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিঃ
২০২২ সালের অটিজম দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, “অটিজমঃ কর্মক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তি”। অর্থাৎ অটিজম আক্রান্তরা যাতে ধীরে ধীরে কর্মক্ষেত্রেও প্রবেশ করতে পারে সেই ধারা শুরু করার জন্য এই পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। অটিস্টিকরা সমাজ এবং পরিবারের বোঝা নয়। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের  সহযোগিতায় পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ পেলে একজন অটিস্টিকও হয়ে উঠতে পারে সমাজ এবং দেশের সম্পদ। অটিস্টিকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি করে চাইলে কর্মক্ষেত্রেও যোগদান করতে পারে।
 
তাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেওয়াই হচ্ছে এই বছরের মূল প্রতিপাদ্য। একজন অটিস্টিক যাতে সমাজের মূল ধারার সাথে মিশে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য এখন থেকেই চেষ্টা শুরু করতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে অটিস্টিকরা সুস্থ হয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারলে, তা পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য হবে বড় পাওয়া।
 
তাই আমাদের উচিত অটিস্টিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা। যদিও এই কাজে প্রচুর বাঁধা এবং প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবুও সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকলে এক সময় না একসময় অবশ্যই সফলতা আসবে। সকলের সহযোগিতা আছে বলেই এখন অটিস্টিকরা পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। যদি এই সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রাখা যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই অটিস্টিকরাই হয়ে উঠবে দেশের সম্পদ।
 
অটিজম কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের একক সমস্যা নয়। অটিজম একটি জাতীয় সমস্যা। তাই এই সম্পর্কে সর্বস্তরের সচেতনতা খুবই জরুরী। সেইসাথে অনেক ক্ষেত্রে অনেক শিশু অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ নিয়ে জন্ম নিলেও সময়ের সাথে সাথে তা দূর হয়ে যায়। তাই কোন শিশু স্বভাবগতভাবে একটু বেশি অস্থির, চঞ্চল, রাগী ও জেদি প্রকৃতির হয়ে থাকলে তাকে অটিস্টিক মনে করা উচিত হবেনা। তাই প্রতিটি শিশুর প্রতি পরিপূর্ণ যত্নবান হওয়া উচিত। যাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ শিশুর মধ্যে প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়।

লেখক পরিচিতি : সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
আমি সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলাম।প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলামও লিখেছি। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "দেশের খবরে " নিয়মিত কলাম প্রকাশিত হতো। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে খুব সাধারণ ভাবেই বাঁচার চেষ্টা করছি।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।