লেখক : সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পৃথিবীব্যাপী পানির প্রয়োজনীয়তা, নিরাপদ পানির সংস্থান ও সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ১৯৯৩ সাল থেকে সারাবিশ্বে একযোগে ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছরের ন্যায় ২০২২ সালের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছেঃ- “Groundwater: Making the Invisible Visible” অর্থাৎ ” ভূ-গর্ভস্থ পানিঃ অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা”।
আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষেরা পানিকে কখনোই গুরুত্ব সহকারে নিই না।তাই আমাদের কাছে পানি বিষয়টি সবসময়ই গুরুত্বহীন। অথচ সুপেয় পানির অভাব দিনদিন বাড়ছেই। সেইসাথে কমছে বিশুদ্ধ পানির উৎস। বিশেষকরে ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুুদ দিনদিন কমে যাচ্ছে। যা আমাদের দেশসহ সমগ্র বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আজ বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে আমরা জানার চেষ্টা করব পানি দূষণ এবং এর প্রতিকার, ভূ-গর্ভস্থ পানির বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর রক্ষণাবেক্ষণে করণীয় কী ইত্যাদি।
মানব জীবনে পানির গুরুত্ব:
মানব জীবনে পানির গুরুত্ব অপরিসীম।মানুষের শরীরের ৭০ ভাগেরও বেশিই হচ্ছে পানি। খাদ্যে উপাদানের মধ্যে পানি হচ্ছে একমাত্র ক্যালোরি বিহীন উপাদান যা মানুষের শরীরে ক্যালোরির মাত্রা ও পুষ্টি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। পানি যে শুধু পিপাসা মেটায় তা নয়। পানি মানুষের শরীরে পানিশূন্যতা ও ক্লান্তি দূর করে তাকে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। সেইসাথে শরীরে তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, হজমশক্তি বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ, পরিপাকতন্ত্রকে সবল করা, কিডনিতে পাথর হতে প্রতিহত করা, রক্ত সঞ্চালন সঠিক রেখে রক্তচাপ ঠিক রাখা ইত্যাদি নানাবিধ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু শরীর পানিশূন্য হয়ে গেলে অনেক ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট এর ইমব্যালেন্স হতে পারে। যারফলে তীব্র মাথাব্যথা হয়ে থাকে অনেকেরই। তাই জ্বরের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিৎ। যারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ যেমনঃ খেলাধূলা, ব্যায়াম, কায়িক শ্রম ইত্যাদি করেন তাদের প্রচুর পরিমাণ পানি পান করা উচিত।
বিশুদ্ধ পানির হাহাকার:
মানব জীবনে পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান হলেও আমাদের দেশে সুপেয় পানি প্রাপ্তি একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ব্যাপক পানি দূষণ এবং বিশুদ্ধ পানির প্রাকৃতিক উৎসের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সুপেয় পানি প্রাপ্তি আজ হুমকির মুখে। আমাদের দেশে সুপেয় পানির সংস্থান হয় ভূ-উপরিস্থ এবং ভূ-গর্ভস্থ এই দুই উৎস থেকে। অথচ কল্পনাতীত পানি দূষণের ফলে বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূ -উপরিস্থ পানির ব্যবহার আজ নেই বললেই চলে।
তাই বিশুদ্ধ পানির প্রাকৃতিক আধার ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর সীমাহীন চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যা ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থান থেকে আমাদের দেশের বিশুদ্ধ পানির ভবিষ্যৎ সংস্থান চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে। তাই এই বছরের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়, “ভূ-গর্ভস্থ পানিঃ অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা”- একটি যুগোপযোগী নির্দেশনা। এবারের বিষয়টির মূল উদ্দেশ্য হলো, সমগ্র পৃথিবী আজ বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎসকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। অথচ এই উৎস লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকার কারণে সাধারণ মানুষ এই উৎস সম্পর্কে কিছুই জানেনা। যেহেতু এটা সসীম প্রাকৃতিক সম্পদ, সেহেতু এই সম্পদের অপচয়, অবহেলা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এই সম্পদকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই আমাদের সকলের উচিত পানি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, পরিমিত ব্যবহার এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা রাখা। তা না হলে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা থেকে খুব সহজে আমাদের উত্তোরণের কোনো পথ নেই।
পানি দূষণই মূল সমস্যা:
ভূ-উপরিস্থ পানির দূষণ দৃশ্যমান হলেও, ভূ-গর্ভস্থ পানির দূষণ এবং পানির স্থর হ্রাস হওয়া ইত্যাদি চোখের আড়ালে হওয়ায় আমরা কিছুই সে সম্পর্কে জানি না। অথচ ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ ও পানির স্থর কমে যাওয়ার জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি দূষণই দায়ী। কেননা বিভিন্ন কারণে ভূ-উপরিস্থ পানি দূষণ এবং সহজ প্রাপ্যতা না হওয়ার ফলে বিশুদ্ধ এবং সহজ প্রাপ্য ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপ বেড়ে গেছে। এই ভূ-উপরিস্থ পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সাগর, নদনদী, খাল-বিল পুকুর ইত্যাদি। পানি দূষণের প্রধান কারণ শিল্প কারখানার দূষিত রসায়নিক পদার্থ, যেমনঃ অ্যামোনিয়া, ক্লোরাইড, সায়ানাইড এবং বিভিন্ন ধাতুর জিঙ্ক, পারদ, সীসা ইত্যাদি যা পানির সাথে মিশে পানিকে দূষিত করে। সেইসাথে গৃহস্থালির আবর্জনা নদীনালা, খালবিল, হ্রদ, সমুদ্র ইত্যাদির পানির সাথে মিশে পানি দূষণ করে। নদীনালা, পুকুরে গোসল করা, গরু ধোয়া , কাপড় চোপড় ধোয়ার মাধ্যমেও পানি দূষিত হয়। জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি দেওয়ার ফলে সেগুলো বৃষ্টির সাথে মিশে নদীনালা, পুকুরে পড়ে পানিকে দূষিত করে।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো পানিতে ফেলা হয় যার ফলে পানি দূষণ ঘটে। মাটির নিচের স্তর থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিরিক্ত পানি তুলে নেওয়ার ফলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গায় আর্সেনিক বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ধাতব যৌগ তৈরি করে পানিকে দূষিত করে।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন নদীর তীরে রয়েছে হাজার রকমের জাহাজভাঙ্গা ও লঞ্চ-স্টিমার মেরামত শিল্প। সেইসাথে বিভিন্ন নৌযানের ভাঙ্গা অংশ, তেল, মবিল, তেল জাতীয় সামগ্রী সরাসরি ফেলা হয় নদীতে। সেইসাথে ছোটবড় কলকারখানার তৈলাক্ত বর্জ্য, ছাপাখানা, টেক্সটাইলের বিষাক্ত রাসায়নিক রঙ, গার্মেন্টস কারখানার ব্যবহৃত পানি, ট্যানারির মারাত্মক পানিদূষণকারী রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে মিশে পানি দূষিত করছে।
শুধু তাইনয় বড় বড় শহরের ড্রেনের লিংক রয়েছে নদীর সাথে। আর এসব ড্রেন দিয়ে প্রতিদিন শহর অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য এবং সমগ্র শহরের মানব বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে।যা ভূ-উপরিস্থ পানিকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে। এই ভূ-উপরিস্থ দূষিত পানি বিভিন্ন উপায়ে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূ-গর্ভস্থ পানিকেও নষ্ট করে তুলছে।
এখনই উচিত দূষণ রোধ করা:
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ব্যাপক পানি দূষণের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির অবস্থা শোচনীয়। যারফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। তাই এখনই আমাদের উচিত ভূ-গর্ভস্থ পানি রক্ষা করার জন্য ব্যাপক পানি দূষণ বন্ধ করা। আর পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে নদনদী খালবিল, সমুদ্র ইত্যাদি। তাই ভূ-উপরিস্থ এইসব পানিকে পানিদূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদনদীতে সব ধরনের কঠিন, গৃহস্থালি ও সেনিটারি বর্জ্যের মিশ্রণ রোধ করা অত্যাবশ্যক।
নদী তীরে শিল্প-কারখানা নির্মাণ বন্ধ, সেইসাথে দেশের বড় বড় শিল্প জোনের শিল্প-কারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা এবং এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবহৃত পানির পরিশোধন অতীব জরুরী। কেননা বর্তমানে এই শিল্পে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার এবং দূষণ উভয়ই ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। তাই প্রতিটি শিল্পকারখানার সাথে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক।
নদী ও সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণসহ মেরামত কালে নদী ও সমুদ্রের পানিতে কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্যরে মিশ্রণ প্রতিহত করতে হবে। কৃষি জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে মিশতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতসহ পানি দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদনদী দূষণ রোধে দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
ভূ-গর্ভস্থ পানির বর্তমান অবস্থা:
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে কৃষি, গৃহস্থালি এবং শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত পানির অধিকাংশের যোগান আসে ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে। সমীক্ষায় দেখা যায় যে বিশ্বব্যাপী সমস্ত পানীয় জলের প্রায় অর্ধেক, সেচের জন্য প্রায় ৪০ শতাংশ এবং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানির এক তৃতীয়াংশ ভূ-গর্ভস্থ পানি থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
সারা বিশ্ব সেচের জন্য ৪০ শতাংশ পানি ভূ-গর্ভস্থ থেকে ব্যবহার করলেও বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। শুধু তাইনয় বাংলাদেশে বড় বড় নগরী গুলোতে বিশুদ্ধ পানির জন্য ব্যাপকভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। সমীক্ষা মতে ঢাকা শহরে ৭০ শতাংশ পানির যোগান দেওয়া হয় ভূ-গর্ভস্থ থেকে। একইভাবে গ্রামবাংলার ৯৭ শতাংশ পানি আসে ভূ-গর্ভস্থ থেকে।সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা হচ্ছে শিল্পকারখানায়, বিশেষকরে গার্মেন্টস শিল্পের ওয়াসিং সেক্টর পুরোপুরি ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল।
দিনদিন ব্যাপক হারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে, বাংলাদেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর কল্পনাতীতভাবে নেমে যাচ্ছে। আজ থেকে দশ বছর আগেও যেখানে ৫০/৬০ ফুট নীচে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যেতো, সেখানে এখন ১২০/১৬০ ফুটে নীচেও বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাইনয় প্রতিবছর পানির স্তর ৪/৫ ফুট নেমে যাচ্ছে। যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও বন্যায় অতীতে ভূ-গর্ভস্থ পানি রিচার্জ হলেও, বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পরিমিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি রিচার্জ পর্যাপ্ত পরিমাণে হচ্ছে না। ফলে ধীরে ধীরে পানির স্তর কমে যাচ্ছে। শুধু পানি স্তর কমে যাচ্ছে তাইনয়, নানান কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষিতও হচ্ছে। যারফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির নিরাপদ ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে উঠছে।
ভূ-গর্ভস্থ পানির দূষণের ক্ষতিকর দিক:
আবহমানকাল থেকে ভূ-গর্ভস্থ পানি নিরাপদ থাকলেও বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ পানি আর নিরাপদ নেই। বিভিন্ন কারণে বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ পানিতেও এখন মিলছে নানান ধরনের ক্ষতিকারক উপদান। যা নির্বিশেষে গ্রহণের ফলে শরীরে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ও নন ক্যান্সারজনিত রোগ। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ দূষণের ফলে বিশেষকরে শিল্পকারখানার বর্জ্য যা সরাসরি ভূ -উপরিস্থ পানিতে মিশে বিভিন্ন উপায়ে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করে। যা মারাত্মকভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে। আর অপরিশোধিত সেই পানি পান করে বেড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ঝুঁকি:
মানব জীবনের প্রয়োজনে গৃহস্থালি, সেচ এবং শিল্প কলকারখানায় ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যাপক উত্তোলন হচ্ছে। এরফলে কল্পনাতীতভাবে পরিবেশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনের কারণে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষকরে মাটির নিচের স্তর থেকে অতিরিক্ত পানি তুলে নেওয়ার ফলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গায় আর্সেনিক বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ধাতব যৌগ তৈরি করে পানিকে দূষিত করে। আর্সেনিক ছাড়াও লোহার উচ্চমাত্রা ও ম্যাঙ্গানিজের অত্যধিক আধিক্য পানির গুণকে নষ্ট করছে। দূষণের ফলে পানিতে মিশে থাকা কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন দূষিত পদার্থ শুধু সিদ্ধ করার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। তা সরাসরি শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করছে।
তাছাড়া অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানিতে প্রাকৃতিক ফ্লোরাইডের উপস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে উচ্চ মাত্রার ফ্লোরাইড একটি গুরুতর সমস্যা।এছাড়াও প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তাহলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলার কারণে সেখানে ব্যাপক খালি জায়গার সৃষ্টি হয়। ফলে সেখানে বিভিন্ন কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে।
উত্তরণের উপায়:
এভাবে ব্যাপকহারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলিত হলে খুব শীঘ্রই পৃথিবী একটি হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তখন বিশুদ্ধ পানির অভাবে পৃথিবীতে জীবের বেঁচে থাকাই হয়ে উঠবে কঠিন। তাই এখনই উচিত আমাদের এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা।
ভূ-গর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে হলে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ হারে বাড়াতে হবে। বিশেষকরে পানি দূষণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রোধ করতে হবে। পানি দূষণ রোধ করার জন্য ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি নদীনালা, খালবিল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে খনন করতে হবে। যাতে ভূ-উপরিস্থ পানির মজুদ বাড়ে।
প্রতিবছর সকল নদনদীর নাব্যতা বাড়ানোর জন্য ড্রেজিং করতে হবে। যাতে নদনদীতে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে। সেইসাথে ব্যয়সাপেক্ষ হলেও নদীর পানিকে পরিশোধন করে সুপেয় পানিতে রূপান্তরিত করা যায় সেই প্রক্রিয়া বাড়াতে হবে। যতদ্রুত সম্ভব প্রতিটি ওয়াসাকে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে।
কোনো প্রকার প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক জলাশয় যেমনঃ হ্রদ, পুকুর, দীঘি, ডোবা ইত্যাদি ভরাট করা যাবেনা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এইসব মুক্ত জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজনে আইন করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে এইসব রক্ষা করতে হবে।
গৃহস্থালি কাজে বেশী বেশী ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিল্প কলকারখানায় বেশী বেশী ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত পানিকে পরিশোধন করে পূনঃব্যবহার করতে হবে।
সারাদেশে ব্যাপক প্রচারণা করে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেইসাথে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সর্বোচ্চ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাইনয় সরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূঅভ্যান্তরে প্রবেশ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভুJগর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নতি হয়।
ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র যেখানে সেখানে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ করতে হবে। নলকূপ এবং গভীর নলকূপ বসানোর জন্য একটা নীতিমালা করে ডাটা তৈরি করতে হবে। যাতে করে একই এলাকায় হিসাবের বাইরে নলকূপ না থেকে। সকল ওয়াসার লাইনে ডিজিটাল মিটার বসাতে হবে। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত নলকূপেও মিটারিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে কেউ অতিরিক্ত পানি অপচয় করতে না পারে।
পানির অপচয় রোধ করতে পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। এইজন্য সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শুধু তাইনয় নতুন নতুন আবাসিক ভবনে পানি সাশ্রয়ী সরঞ্জাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আসুন সচেতন হই:
ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যাপক দূষণ এবং মিঠা পানির সহজ প্রাপ্যতা না হওয়ার কারণে সারাবিশ্বসহ আমাদের দেশেও দিনদিন ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে। অথচ পানি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ মানের। পানি সম্পর্কে আমরা কেউ তেমন ওয়াকিবহাল নই। অথচ সারাবিশ্বে ব্যাপকহারে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুদ আজ হুমকির মুখে। তাই এই বছরের পানি দিবসের লক্ষ্য হলো ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষকে আরও বেশী সচেতন করা। যাতে বিশুদ্ধ পানির এই উৎস সম্পর্কে মানুষ আরও বেশী সজাগ হয়।
বিশেষকরে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, দূষণ রোধ এবং এর বিকল্প উৎসের সংস্থান করা। যাতেকরে পৃথিবী আরো বেশিদিন এই উৎস থেকে পানি আহরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পানি দূষণের কারণে পৃথিবীতে আজ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ চরম হুমকিতে। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক ভূ-গর্ভস্থ পানিও যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকির মখে পড়বে। তাই ২০২২ সালের পানির প্রতিপাদ্য , ” ভূ-গর্ভস্থ পানিঃ অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা” একটি যুগোপযোগি বিষয়। আমাদের সকলের উচিত এই বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
লেখক পরিচিতি : সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
আমি সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলাম।প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলামও লিখেছি। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "দেশের খবরে " নিয়মিত কলাম প্রকাশিত হতো। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে খুব সাধারণ ভাবেই বাঁচার চেষ্টা করছি। আল্লাহ্ যেন তাঁর রাস্তায় সালেহীনদের পথে আমাকে পরিচালিত করেন। আমিন।
পাঠ সংখ্যাঃ 176