লেখক: মিত্রা হাজরা
আমরা সকলেই স্বাধীনতার পিয়াসী। কি মনুষ্যসমাজ, কি পশুপাখি বা কীটপতঙ্গ। তবে স্বাধীনতার সংজ্ঞা এক এক জনের কাছে এক এক রকম। ছোট থেকে আমরা বড় হয়েছি একান্নবর্তী পরিবারে। বাবা, কাকা, পিসী, ঠাকুমা, আত্মীয় পরিজন নিয়ে বিরাট সংসার। তাঁদের স্নেহ শাসনের ছায়ায় দিন কেটেছে আনন্দে। ছোটবেলার পুতুলখেলার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে দেশের বাড়িতে দাপিয়ে বেড়িয়েছি, পুকুরে আপাদমস্তক ভিজে পুকুর ধারের কদমগাছ থেকে কদমফুল পেড়েছি। আম, জাম, জামরুল বাগানে ঘুরে দুপুরের রোদে জাম, জামরুল কুড়িয়ে মা এর ঠ্যাঙানি খেয়ে চিলেকোঠার ঘরে বসে কেঁদেছি। মনে মনে ভেবেছি, কবে বড় হবো, তখন তো কেউ কিছু বলবে না, দাদা দিদিরা যখন তখন ঘুরে বেড়ায়, কই তখন তো কেউ বকে না ওদের। বড় হলে কী মজা! যা খুশি তাই করতে পারবো।
এই যে বাঁধন, শাসন থেকে মুক্তি, এটাই কি স্বাধীনতা! ধীরে ধীরে বড় হলাম, শাসন কিন্তু শিথিল হলো না। স্কুল থেকে ফিরতে এতো দেরি কেন? কোথায় ছিলিস্? মায়ের শুরু হতো বকুনি। চুলের অত স্টাইল কেন— টেনে উঁচু করে বেঁধে দেন–যদিও আমার চুল খুব লম্বা, আবার সে বাঁধন খুলে নেমে আসে। পাড়ার ঐ বখাটে ছেলেদের সাথে অত আড্ডা কেন? আর একটু বড় হয়ে, ভাইকে লেজুড় করে সঙ্গে বেঁধে দিতেন মা, তা সে বই কিনতে যাওয়া, বা বন্ধুর বাড়ি যাওয়া। আর আত্মীয় স্বজনের বাড়ি তো মায়ের সাথে যেতে হবে—– মানে ঐ নেমন্তন্ন থাকলে। যেমন বিয়েবাড়ি বা জন্মদিন বাড়িতে, সাজ পোশাক মা বলে দেবেন কী পরতে হবে— ।
আর স্কুল ছাড়া বেশি যেতামও না, বই পড়তে খুব ভালোবাসি, তখন থেকেই উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়, শিবরাম, রহস্য গল্প, ভ্রমণকাহিনী পড়তে থাকলাম। কবিতা পড়তাম–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, নজরুলের, আরও বড় হয়ে পড়লাম— জীবনানন্দ, সুকান্ত, বিষ্ণু দে… এঁদের কবিতা। এখনও কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসি। বাবার সাথে ভাই-বোন স্বাধীনতা দিবসে বড়দিনে বেড়াতে যেতাম বোটানিক্যাল গার্ডেন বা চিড়িয়াখানায়। পশুপাখিদের বন্দী দেখে দুঃখ পেতাম। মনে হতো এরাও তো স্বাধীন ভাবে উড়তে চায়, কেন এদের আটকে রাখা হয়েছে– বাবা বলতেন এই সমস্ত পশুপাখিদের সংরক্ষণের জন্য, এবং এদের বংশ বিস্তারের জন্য এদের যত্নের সাথে রাখা হয়েছে, না হলে এমন অনেক প্রাণী আছে, যাদের বাঁচানো মুশকিল হবে।
এর পরে পড়াশোনা চলতে চলতেই আমার বিয়ে হয়ে যায়— তবে আমার শ্বশুরবাড়ি বা আমার স্বামী আমার পড়াশোনার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিতেন। এরপরই একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পাই, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়তাম, তাদের মধ্যে হেসে খেলে খুব আনন্দ পেলাম। প্রথম মাসের মাহিনা পেলাম—মাত্র পাঁচশো টাকা। খুব খুশি, ভাবলাম বাড়ির জন্য একটু মিষ্টি ,আর ছোট একটা উপহার কিনবো ছেলের জন্য। ভাবতে ভাবতে সামনে এসে দাঁড়ালো স্কুলের পিয়ন—দিদি শুনেছেন, পড়ে গিয়ে সুবলদার হাত ভেঙেছে। সুবলদা আমাদের স্কুলের দারোয়ান। বয়স্ক মানুষ। গেলাম তাঁর বাড়ি, স্কুলের পাশেই বাড়ি–দেখলাম আরো অনেকে জড়ো হয়েছেন। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, বললাম ডাক্তার বাবুকে খবর দিয়েছেন? ওনার ছেলে বললো, না ম্যাডাম, ডাক্তারের ফীস্ অনেক, ঘরে সেরকম বেশি টাকা নেই। খামটা সদ্য পেয়েছি, তাতে পাঁচশো টাকা আছে, বের করে ওনার ছেলের হাতে দিলাম। বললাম আমি ডাক্তারবাবুকে ফোন করে দেবো, ফীস্ লাগবে না।
এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, ছাতা মানছে না, সর্বাঙ্গ জলে ভিজে লটপট করতে করতে পথ চলি, শাড়ি কাদামাখা, ব্যাগ দিয়ে জল ঝরছে। কোনক্রমে ঘরে পৌঁছে বাঁচি। স্নান সেরে ঘরে ঢুকেই ছেলে বললো, মা বলেছিলে চকোলেট আনবে, আনোনি? মনে পড়লো আজ সকালে বলেছিলাম বটে, তোর জন্য চকোলেট আনবো, মিষ্টি আনবো। কাছে টেনে এনে বললাম–না বাবু, আজ কিছু আনতে পারিনি। অন্যদিন আনবো, ঘরে গুড় আছে– রুটি দিয়ে খাও। ছেলে আমাকে আদর করলো জড়িয়ে ধরে, আমার স্বামী আমার মুখের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। আমার বড় ভালো লাগলো, মনে হলো— আজ আমি স্বাধীন হলাম, এ আমার নিজস্ব স্বাধীনতা দিবস।
ছবি: পাভেল পাল
লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।