লেখক: সংহিতা সেনগুপ্ত
স্বাধীনতা একটি আপাতনিরীহ শব্দ। সন্ধিবিযুক্ত করে স্ব+অধীনতা থেকে বেশি কিছু পাওয়া যায়না। কিন্তু, শব্দটির পরতে পরতে বহুবর্ণ রূপ এবং তাৎপর্য মিশে রয়েছে অত্যন্ত সুন্দর অনুপাতে; যা ব্যক্তিভেদে ও পরিস্থিতিভেদে ভিন্ন মাত্রা বহন করে।
একটি শিশুর কাছে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য চিৎকার করে কান্নাই স্বাধীনতা। বাল্যবয়সে চেনা গণ্ডি ছেড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার নামই স্বাধীনতা। কৈশোরে একাকী প্রথম কোথাও যাওয়া, বা সরস্বতী পুজোর দিনে প্রথম সিগারেট বা শাড়ি সামলে একজোড়া চোখের মুগ্ধ দৃষ্টি উপভোগ করাই স্বাধীনতার নামান্তর। প্রথম চাকরির প্রথম বেতনের মেসেজের টুংটাং বা হাতে পাওয়া নতুন টাকার সুগন্ধ আবার অন্যরকম স্বাধীনতা। আবার মাঝবয়সীদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ ছেলেবেলার বন্ধুদের গেট-টুগেদার বা সংসার থেকে বেরিয়ে শীতল পানীয়ে একা একা চুমুক দেওয়া। পরাধীন দেশের দেশপ্রেমিকের কাছে স্বাধীনতা মানে শৃঙ্খলমোচন, আবার আমাদের সমাজে এখনো অনেকের কাছেই স্বাধীনতা মানেই পনেরোই অগাস্টে সেল্ফির গায়ে ফোটোশপে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে প্রোফাইল পিকচার সেট করে মাংসের দোকানে লাইন দেওয়া বা সন্ধ্যায় শপিং মলে তেরঙা সজ্জার সামনে হাসিমুখে দাঁড়ানো।
অর্থাৎ, এ’কথা অনস্বীকার্য যে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি বহুমাত্রিক। কিন্তু, স্বাধীনতা মানে কোনো মুক্তি নয়। স্বাধীনতা মানে বন্ধনও বটে। সে বন্ধন আবার দ্বিবিধ। একদিকে এক অদৃশ্য বাহ্যিক বন্ধন, অন্যদিকে তা যেন মনের বন্ধন। বেসরকারি অফিসে নারী-কর্মচারীরা যেরকম glass ceiling এর বাধায় একটা না একটা সময় হতাশ হয়, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি যেন ঠিক সেইরকম glass ceiling, ঘিরে দেওয়া পরিসরের মধ্যে pre-defined স্বাধীনতার মন্ত্র পড়া হয়, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা কখনো কোথাও কাউকে দেওয়া হয় না বলেই আমার বিশ্বাস। এটা স্বাধীনতার বাহ্যিক অসুবিধা। আর ব্যক্তিমনের ভিতরের অসুবিধাটা হলো স্বাধীনতার সাথে দায়িত্বের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। দেশ স্বাধীন হলেই দেশ গড়ার দায়িত্ব নিতে হয়, ব্যক্তিজীবনে আপাত – স্বাধীনতার স্বাদ পেলেই পাশের মানুষদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়। স্কুলে, কলেজে, কর্মক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করতে পারলে তার সঙ্গে কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মর্যাদারক্ষা করার দায়িত্বও বর্তায়। কিন্তু, স্বাধীনতার বিভিন্ন তাৎপর্য অতিক্রম করেও আমাদের দেশের প্রায় দু’শ বছরের পরাধীনতার গ্লানিমোচন করে স্বাধীনতা প্রাপ্তির যে তৃষ্ণা আজকের আমরা পরোক্ষে অনুভব করেছি, সেই পিপাসার কোনো তুলনাই হয় না। আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলের সামনে দণ্ডায়মান হয়ে গাইডের মুখে ভাষ্য শুনেই হোক, শরৎচন্দ্র রচিত ‘পথের দাবী’ পড়েই হোক, উত্তম কুমার অভিনীত সব্যসাচী চরিত্রটি দেখেই হোক, সৃজিত মুখার্জী পরিচালিত ‘গুমনামী’ দেখেই হোক বা অনুজ ধর-চন্দ্রচূড় ঘোষ রচিত ‘Conundrum’ পড়েই হোক – সেই অতুলনীয় স্বাধীনতা-পিয়াসা আমায় বারেবারে আপ্লুত করে; নতজানু হই সেই অগ্নিযুগের বীরদের প্রতি, কারণ, তাঁদের উদ্যম ব্যতীত আমরা আক্ষরিক স্বাধীনতার পথে এগোতে অক্ষম।
তাই, সব কিছুর শেষে মনে আসে এই উপলব্ধিই যে ‘স্বাধীনতা’ অশেষ মধুরিমায় পরিপূর্ণ একটি অনুভূতি।
ছবি: কুন্তল
লেখকের কথা: সংহিতা সেনগুপ্ত
শ্রীমতী সংহিতা সেনগুপ্ত, ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী, যিনি বাংলা ভাষায় গদ্যসাহিত্য রচনায় বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে পরিচিত মুখ। কর্মরতা হলেও শখ কন্ঠসঙ্গীত ও দেশভ্রমণ। ব্যক্তিজীবনে ভারী শান্তশিষ্ট এই লেখিকার প্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথ।
superb writing.
superb writing. hat’s off for the writer.