লেখক : ড. বিশ্বজিৎ বাউনা
০১: ঠুনকো
ঠুনকো করে রাখি নিজেকেই লেখার খাতায়-
নিশ্চুপ পড়ে থাকি যেন বা অক্ষরের হত্যাদেশে।
অকপটে দেখি শূন্যরা ঠেস দিয়ে বাতাসের গায়
উড়ে আসা পাখির বিকেল খায় ঝাঁপিয়ে শেষে।
অবশেষ পড়ে থাকে, হাড়ে হাড়ে বেদুইন প্রহর-
আলোর শরীরে জ্বলে ওঠে ম্লান জোনাকির ফুল।
জ্ঞানের গভীরে স্মৃতি আজ বিলীয়মান ভর,
বলতে পারিনি ভালবাসা ছিল কত নির্ভুল।
দোলায়িত হই, ছায়ানাট্যে দুরূহ অভিমান খসে।
স্নাত শিশিরের অবয়ব পড়ে থাকে নিশুতি ক্ষেতে-
পরাজিত আগুনের মত শীতল পোড়া-কাঠে বসে
বিষাদ যাপন আঁকি হৈমন্তিক ঝরাপাতা পেতে।
ডাগর প্রতীক্ষার তলানিতে জেগে তবু প্রতিক্ষণ
হতাশ্বাস থেকে খুঁটে নিই বালি ভেঙে চাঁদের জল।
চিরায়ত অভিশাপ বুঝি নিজেরই লেখার মন-
তাই আঁকড়ে খড়কুটো হয়ে ভাসাই সম্বল।
০২: আত্মগ্লানি
শুরুতেই পড়ে আছে সন্দেহ, ভাঙ্গা কাঁচের ধার।
তির্যক চাহুনির শেষে পড়া বালির শামিয়ানা।
মানুষের প্রতি রাখা থাকে সব মানুষেরই হাতিয়ার,
প্রয়োগের নেপথ্যে হন্তারক কৌশল জানা।
এত হিংসে আর কেউ রাখে আত্মজঠরের প্রতি?
শুধু দখলের অভিপ্রায় নিয়ে মাথা তার মশগুল।
কবে আর পাখি মেনে নেয় নিজের ডানার ক্ষতি!
মানুষ যেই ডালে বসে তাতে কোপ দেয় কুড়ুল।
প্ররোচিত বাতাস রাখে, ছড়ায় ভানের খোসা-
হৃদয়ের আয়তনে কেটে রাখে সারি সারি মাছরাঙা।
স্বার্থে আঘাত পেলে চকিতে হয় তার গোঁসা,
চলার পথে রেখে যায় বিরূপ কথার ভাঙা।
ভেদাভেদ নিপুণ হয়ে পড়ে আছে যেন তরবারি-
কে কাকে কত কেটে জয়ী হবে ভেবে এত হানাহানি!
সংকটকালে কে কাকে কত ভালবাসা দিতে পারি!
ভাবিনি তা, চাই আগে নাশ হোক সব আত্মগ্লানি।
০৩: সব ছিন্ন করে
নির্জনতা দিয়ে রেখেছ প্রিয় অস্ত্রের গায়-
ছত্রাকের ঋতু হামাগুড়ি দেয় দু’বেলা দুই ধারে।
বলেছি, ভালবাসা স্থির। অবিশ্বাসে দূরে গড়ায়…
কামার আগুনের মুখ ঠিক থেঁতলে দিতে পারে।
আজ ন্যায়ালোকে নেমেছে কস্তুরী বিরহের পাল,
ঘাসের নরম শিশু চেয়ে দেখে দুরাগত জ্যোতি।
পীড়নে প্রকাশিত হয়ে ভাসে স্নায়ুতে জঞ্জাল…
অভিযোগ নেপথ্যে রাখে দু’জনের টক্সিক ক্ষতি।
গোধূলি আজ জেনে যাক স্বীয় ডানার পরিতাপ,
আদিম খরা নিয়ে রোজ বেজে যায় সে প্রিয় হ্যামলিন।
অনাশ্রিত তাঁবুর নিকটে তবু একে ফুল-ছাপ-
ভাবি, আমি একা বিভ্রম ভেঙে উপড়ে নেব দিন।
ভারী আজ প্রস্তুত রাত্রির দিকে কুৎসিত যাত্রা-
জানিনা কতখানি খেসারত নেবে শীতল আড়ি।
নিবিড় ভাঙনের দিকে মুখরিত শূন্যের মাত্রা…
সব ছিন্ন করে এস, গড়ি নিজেদের প্রিয় বাড়ি।
০৪: প্রেত-রঙ
অন্ধকার দৃশ্যের দিকে রাখি ঈশ্বরের মণি,
আঁধার সব জ্বলে যাবে ভাবি সকাতর বৃত্তাকারে।
ভবিতব্যে ভুগি, কপালে নেচে যায় প্রণম্য শনি।
সাবলীল বাসন্তিক বায়ু নেই প্রিয় ইস্তাহারে।
কুটিল জলের থেকে যেন তুলে আনা পাহাড়
সূঁচালো হয়ে আছে উত্থিত আরোহণের দিকে।
আত্মগোপনে আরও খসে গেলে স্বীয় স্বপ্নের হাড়,
কী পড়ে থাকে? কতটুকু সঞ্চয় রাখা যায় লিখে?
সেই শালপ্রাংশু ছলনায় এঁকে সুবাসিত তিল
বিপন্ন কোটরে নিচু হয়ে আছে আরাধনা।
হলুদ পাতার ঠোঁটে খাবি খায় আকাশের নীল,
ভালবাসা আরোগ্যের বিশ্বাস ছাড়া কিছু চায় না।
দেখি ধীরে ঘোলাটে হয়ে পড়ে কামনার ব্যবহার,
ছবির আলো জ্বলে খাক ডুবে যায় সে পোড়া-তেলে।
আজ ব্যাখ্যাতীত ভ্রমের দুলুনিতে প্রজাপতি তার
সুদূরে চলে যায় প্রেত-রঙ থেকে মৃত ছায়া ফেলে।
০৫: প্রাক্কালে
খাপছাড়া হয়ে পড়ে আছি হে দোদুল্যমান স্থিতি,
সাপের বিষের মত জ্যোৎস্নার ছলাৎ পলি…
বহুভুজ বিনয়ে অতর্কিত বিঁধে যায় নীতি-
আজ আহত প্রণয়ের দিন, মুখে আর কি বলি!
সহ্যের অতীত এসে পাথর রেখে যায় বুকে,
ডেঁপো ফেসবুকে তাক করে রাখা লাল অক্ষরের তীর।
সেই পাথর ধীরে গলে যায় দুই অশ্রুর সুখে-
অসম্ভব উচাটনে কান্নারা মৌন, বিচলিত স্থির।
যেন জলের জঠরে ভেঙে ভেঙে ভাসে প্রিয় ভেলা,
অপমানিত দাঁড়ে লেগে দিগন্তের শূন্য চোখ।
জানি ভালবাসা চিরদিন সহ্য করে শীত অবহেলা,
প্রতি বাতাসের বাঁকে বাঁকে রাখে নিজের চেরা শোক।
স্থানিক সেই বিরহের কোলাজে নিচু অবক্ষয়,
প্রলম্বিত হয়ে পড়ে অগাধ উপেক্ষার ঢালে-
এখনও বাহুর বন্ধনে আছে সমঝোতা, জয়…
পাতা চিরকাল ছায়া হয় ঝরে যাওয়ার প্রাক্কালে।
লেখক পরিচিতি : ড. বিশ্বজিৎ বাউনা
জন্ম ১৯৮৬। পশ্চিম মেদিনীপুরে। পিংলায়। ২০১০-এ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (ফার্স্ট ক্লাস/সিলভার মেডেলিস্ট), বি. এড., পিএইচডি। পেশা: শিক্ষকতা। মূলত কবিতা লেখেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত বই: ডুলুং পাহাড়ে রহস্য, ঈশ্বরীকে হলুদ সনেট, আত্মক্ষরণের ফসিল, অক্ষরের কালকেতু, ধুনুরি তফাৎগুচ্ছ, লুণ্ঠন শেষের শূন্যতা, বেতাল রহস্য, বিরসা মুন্ডা: উলগুলানের সনেটগুচ্ছ, পীড়াপর্বে একলব্য ইত্যাদি। পেয়েছেন 'দ্বৈরথ সাহিত্য সম্মান', 'চূনী কোটাল স্মৃতি সম্মান','বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার' ও কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী স্মৃতি পুরস্কার।


Bravo..
Carry on..
I will read them minutely later on.
Thanks dear friend. Your presence means a lot to me as always.