লেখক : ইহতেমাম ইলাহী
পাটের আঁশ পাক দিয়ে দিয়ে দড়ি বানাচ্ছেন আছিমত মিয়া। দড়ি পেঁচিয়ে রাখছেন বাঁশের বেতের একটা চারকোণা কাঠামোতে। প্রতি হাটবার তিনি এই দড়ি বিক্রি করেন। বেশি দাম পাওয়া যায় না অবশ্য। তবে মৌসুমের পাট বিক্রি করে দেয়ার পরও কিছু পাট রেখে দেন তিনি। সেগুলো দিয়ে দড়ি পাকিয়ে পাকিয়ে প্রতি হাটবার বিক্রি করে টুকটাক খরচ চালাতে হয়। পাটের দামের তুলনায় এই দড়ির দাম পাওয়া যায় প্রায় দ্বিগুণ।
সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। বাড়ির উঠোন ভেজা। এবার গমের নতুন নাড়া (খড়) দিয়ে ঘরের চাল তোলা হয়েছে। বর্ষায় আরাম হচ্ছে। নাহলে চাল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ে। এবার সেই সমস্যা নেই। আকাশে আবার মেঘ করেছে। গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ হচ্ছে। আবার বৃষ্টি হবে প্রায় নিশ্চিত। বৃষ্টিবাদলার দিনে দড়ি পাকানোর কাজ করতে খুব আরাম। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়া। বৃষ্টির ছন্দে অতি দ্রুত হাত ঘুরতে থাকে আছিমত মিয়ার। গত চল্লিশ বছর ধরে দড়ি পাকাচ্ছেন তিনি। তাঁর মত দ্রুতগতিতে দড়ি পাকাবে, এইরকম মরদ এই এলাকায় নেই! ভাবছে আছিমত মিয়া। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। পাশেই রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে। তার স্ত্রী মনা বিবি ভাত বসিয়েছে। এরপর রান্না হবে বেগুন দিয়ে শিঙি মাছ। তার স্ত্রী এই তরকারি যে কীভাবে রান্না করে! স্বাদ হয় ভয়াবহ।
বাইরে কার যেন কথা শোনা যাচ্ছে। হেঁটে এই বাড়ির দিকে আসছে। কণ্ঠ অপরিচিত লাগছে। কে হতে পারে? আছিমত মিয়া কান উৎকর্ণ করে। শোনা যাচ্ছে, “হ্যাঁ, এইটা বাড়ি, এইটা বাড়ি।”
বাড়ি দিয়ে যাকে ঢুকতে দেখা গেল, তাকে দেখে আছিমত মিয়ার চোখ প্রায় উল্টে গেল। বুক ধড়াস করে উঠল। লোক দু’টির একজন চিৎকার করে বলল, “আরে আছিমত মিয়া, আছ কেমন?”
“ভাল, ভাল। আপনে কেমন?”
আছিমত মিয়া লোকদু’টির বসার জন্য একটা লম্বা বেঞ্চি এগিয়ে দেয়। এছাড়া বসতে দেওয়ার মত আর কিছু নেই তার বাড়িতে। তার হাত কাঁপছে। আতঙ্কে তার শরীর প্রায় অসাড় হয়ে আসছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, আকবর ডাকাত তার বাড়িতে কি উদ্দেশ্যে এল। এই ভয়ানক ডাকাত সর্দার ধনী মানুষদের বাড়িতে হানা দেয় রাত্রি বেলা, লুটপাট চালায়। বাড়ির কেউ বেশি উচ্চবাচ্য করলে গুলি চলে। বাড়ির কোন মেয়ে সুন্দরী হ’লে সে হয় ধর্ষণের শিকার। আকবর ডাকাত দিনে কারও বাড়ি আসা মানে, সতর্ক করে দেওয়া। চাহিদামত নজরানা পাঠানোর নিশ্চুপ নির্দেশ। অথবা অন্তত তাদের দলের সবাইকে গরু খাসি দিয়ে দাওয়াত খাওয়াতে হবে। তাহলে সেই বাড়ি নিরাপদ। নাহলে, গজব নেমে আসে কয়েক রাতের মধ্যেই…
আছিমত মিয়া বলার মত কিছু পাচ্ছে না, আমতা আমতা করছে। সে বুঝতে পারছে না, তার মত নিম্নবিত্ত একটা মানুষের কাছে কী দরকার পড়ল এই ডাকাত সর্দারের? সে তড়িঘড়ি করে বলল, “বাজি (বাবাজি), পান নিয়া আসি, পান। আপনেরা বসেন।”
আকবর ডাকাতের পাশে বসে আছে ছকু শেখ। কালো, বলশালী শরীর, চোখগুলো রক্তবর্ণ। দুজনই পান চিবোচ্ছে। আকবর ডাকাতের মুখ হাসি হাসি। আছিমত মিয়া হাত কচলাচ্ছে।
“আছিমত!”
“হ্যাঁ, বাজি।”
“তোমার ঘরে মেয়া কয়টা?”
“তিন মেয়ার দুইটার বিয়া দিছি। ছোটটা বাড়িত থাকে।” আছিমত মিয়ার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে। তার চেহারা রক্তবর্ণ। আজ তার হার্ট এটাকই বা হয় কি না, কে জানে!
“মেয়ার বিয়াশাদি দিবা না?”
“হ্যাঁ, তা তো দিবার লাগবেই।”
“হ্যাঁ, বিয়া দাও। এই ছকুর সাথে বিয়া হবে। কি রে ছকু?”
ছকু আছিমত মিয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দিল। ঘৃণায় আছিমত মিয়ার মুখে থুথু এসে পড়েছে। কিন্তু এদের সামনে সেই থুথু ফেলা যাবে না। আকবর ডাকাত আবার হাঁক পারে, “তোমাগো কোনো অমত আছে? ডাকাইতের সাতেহ বিয়া দিবা না! হা হা।”
আছিমত কিছ বলে না। আকবর বলে, “যদি কোন নয় ছয় করার চেষ্টা নিছ, তয় তোমার মেয়ারে আমি তুইলা নিয়া যামু। কী? কথা কও না কেনে?”
আছিমত মিয়া ঘোরের মধ্যে বলে, “না না, আমার কোন কথা নাই। আপনি যেইটা কইছেন… এইটাই।”
আকাশে মেঘ কালো হয়ে এসেছে। এই হয়ত বৃষ্টি আসবে। মেঘগুলো দেখাচ্ছে ভয়ঙ্কর। দুনিয়াটা কালো অন্ধকার হয়ে আসছে। আজ বড় দুর্যোগের দিন। আকবর ডাকাত চলে যাচ্ছে। আছিমত মিয়া যাচ্ছে পেছনে পেছনে।
“আছিমত! তোমার ছোট মেয়াটা শুনছি সুন্দরী। এইজন্য ছকুর জইন্য পছন্দ। পরশু দিন সইন্ধ্যার পর বিয়া হইব। হ্যাজাকের ব্যাবস্থা রাইখবা। ছকু কাইল একসময় আসি তোমার মেয়ার জন্য কাপড় চোপড় দিয়া যাবে। বিয়া, নতুন কাপড় চোপড় লাইগব না? হা হা।”
ডাকাত দু’টো চলে গেছে। তবে আছিমতের বাড়ি ফাঁকা নয়। পুরো পাড়ার মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে তার বাড়িতে। আছিমতের স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আছিমত বেঞ্চিতে বসে আছে, তার দৃষ্টি পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে। সে কারও কোন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। আধাআধি পাক দেয়া দড়িগুলো একদিকে পড়ে আছে। আছিমতের ছোট মেয়ে ফুলোকে জড়িয়ে ধরে আছে তার দাদি। মেয়েটা হালকা হালকা কাঁপছে।
পাড়ার সব লোককে অবাক করে দিয়ে আছিমত একসময় উঠে বসল। তার হাঁটার ভঙ্গি আচ্ছন্নের মত। সে কুয়া পাড়ে যাচ্ছে, তার পিছু পিছু যাচ্ছে কয়েকজন। তাদের আশঙ্কা আছিমত কুয়ায় ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে বসে কি না। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, আছিমত কুয়া পাড়ে বসে ওজু করছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। লোকেরা বলে উঠল, “আহারে, আহারে। আল্লাহ, রক্ষা করো মওলা।” আছিমত মিয়া দু’রাকাত নামাজ পড়ল। এরপরে ঘরের চৌকির উপরে কিবলামুখী হয়ে বসল । বাইরের মানুষেরা শুনতে পেল, আছিমত হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে “আল্লাহ, আল্লাহ।” আছিমতের কান্না শুনে অনেকেই কেঁদে ফেলল।
গল্পটা একাত্তরের মক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের । দেশের আইনশৃঙ্খলা সেভাবে ফিরে আসে নি। যুদ্ধের সময়টাতেই অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল আকবর ডাকাত গ্যাং। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু করেছিল ভয়ানক ডাকাতি। পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দেয় ত্রাস। জনশ্রুতি আছে, আকবর ছিল ভয়ানক কালো জাদুকর। সে তার হাতের মাংস কেটে ভেতরে তাবিজ ঢুকিয়ে সেলাই করে দিয়েছে। এজন্য কেউ তাকে ধরতে পারে না। দারোগারা খুব একটা সাহস দেখায় না তাকে ধরার। আকবর ডাকাতের দল খুবই সাংঘাতিক। কোন সময় না আবার দারোগার পরিবারের কোনো ক্ষতি করে দেয়। তাছাড়া থানা এই এলাকা থেকে পনের কিলোমিটার দূরে। এতদূর থেকে পুলিশ এসে আকবর ডাকাতকে ধরে ফেলবে– এটা সহজ নয়।
সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে প্রায়। আছিমত মিয়া চৌকি থেকে নামছে না। কিবলার দিকে মুখ করে বসেই আছে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অস্ফুট স্বরে বলছে, “আল্লাহ, আল্লাহ।” গ্রামের লোকেরা আছিমতকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কয়েকজন তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আছিমত খাবে না। আছিমতের স্ত্রী বিলাপ করে কেঁদে চলেছে, মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাচ্ছে। তের বছর বয়সী ফুলো মেয়াটার চোখ ভাবলেশহীন, চেহারা রক্তশূন্য। তাকে জোর করে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে এক দূরসম্পর্কের ফুফু।
রাত প্রায় বারো’টা। দুইটা লম্ফবাতি জ্বলছে। আছিমত মিয়ার বাড়ির পরিবেশটা কেমন আধিভৌতিক লাগছে। বাইরে তীব্র অন্ধকার। ব্যাঙ ডাকছে। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সবাই বলছে, “আছিমতের মাথা মনে হয় খারাপ হয়ে গিয়েছে।” সে তার চৌকিতে এখনও বসে আছে, ওঠার কোন নাম নেই। সে কোনদিকে মুখ ফেরাচ্ছে না। অস্ফুট স্বরে বলছে, “আল্লাহ, আল্লাহ।” তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কিনা, অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। হয়ত পড়ছে।
পাড়ার মানুষ এখনও আছিমতের বাড়িতে ভিড় করছে। বিপদের সময় প্রান্তিক গ্রামের এই মানুষগুলো একসাথে জড়ো হয়ে থাকতে পছন্দ করে। তবে কেউই আকবর ডাকাতের বিরুদ্ধে কিছু বলার বা করার সাহস পাচ্ছে না। কোনোভাবে যদি কোনোকথা এই ডাকাতের কানে পৌঁছে, তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কাঠমিস্ত্রী মজিবার মিয়া হঠাৎ এ বাড়িতে এসে ঢুকল। লোকেরা বলল, “কি রে মজিবার! কোনঠে ছিলু? (কোথায় ছিলে?)”
মজিবার হাঁফাচ্ছে। সে ঘরের আঙিনায় উঠে এসে বলল, “হঠাৎ পাড়ার রাস্তায় আকবর ডাকাইত ডাকাতি করিছে, মোর (আমার) চোখের সামনত। আজিদের গরুর গাড়ি ভরা ছিল ব্যাবসার মাল। গরু, গাড়ি সব ধরি নিয়া গেইছে। গুলির শব্দ শুনিছু।”
একজন বলল, “তুই লুকি (লুকিয়ে) ছিলু কোনঠে? (কোথায়?)”
মজিবার বলে, “পাকুড় গাছটার গোড়াত।”
সবাই হা-হুতাশ করতে থাকে। কী দিন শুরু হ’ল, কি জামানা এল — এই নিয়ে সবাই আলোচনা করছে। মাঝে উঠে আছিমতের খবর নিতে ঘরে ঢুকল কেউ কেউ। আছিমত বসা থেকে এখন শুয়ে আছে। তবে কিবলার দিক থেকে মুখ ফেরায় নি। চোখের পানিতে তার চেহারা ভেজা। বিছানাও খানিকটা ভেজা। সে অস্ফুট স্বরে বলছে, “আল্লাহ, আল্লাহ।”
বৃদ্ধ শতীবুল্লাহ জিজ্ঞেস করল, “আরে আছিমত, বাউরে (বাবারে)। কি করিবু এলা? এমন করি কতক্ষণ থাকিবু। উঠিবু না? খাবু না?”
আছিমত জবাব দেয়, “আল্লাহ মোর কথা না শুনিলে মুই উঠিম না। এইঠে মরি যাম (মরে যাব)।”
বৃদ্ধ শতীবুল্লাহ বলে উঠে, “আরে, পাগলা রে!”
আজ দিনটা আলোকজ্জ্বল। আকাশে মেঘ নেই। ডাকাত ছকু শেখের মন মেজাজ খুবই ভাল। আগামীকাল তার বিবাহ। কাপড় চোপড় কিনতে হবে। কিন্তু এখন যাওয়া যাচ্ছে না। দবির উদ্দীন মাস্টারের বাড়িতে আজ দুপুরে দাওয়াত। কয়েকদিন আগে সর্দার আকবরের পক্ষ থেকে শূন্য পাতার চিঠি পৌঁছেছে দবির মাস্টারের বাড়িতে। তাতেই কাজ হয়েছে! দবির মাস্টার সবাইকে দাওয়াত করেছে। খাসি, মুরগী, হাঁস সব একসাথে খাওয়া হবে। দবির মাস্টারের দীঘিতে আজদাহা সাইজের মাছ আছে। সেই মাছও রান্না হবে।
দবির মাস্টারের আঙিনায় জনা পনের মানুষ পাটি পেতে বসেছে। তাদের খাবার দেয়া হচ্ছে। দবির মাস্টার নিজে বেড়ে খাওয়াচ্ছে। বড় বড় কাঁসার প্লেটে খাবার দেওয়া হচ্ছে। মাটির হাড়িতে গরুর মাংস, খাসির মাংস। প্লেট ভর্তি করে মাংস দেওয়া হচ্ছে ডাকাতদলের প্রতিটা সদস্যের উদ্দেশ্যে। ডাকাতদের শাহী ভোজ হচ্ছে আজ। প্লেটের পর প্লেট মাংস সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। একেকটা মানুষ এত মাংস কিভাবে খেতে পারে কে জানে। ডাকাতদের শরীরে অবশ্য বল দরকার। অল্প স্বল্প খেলে হবে?
নিঃশব্দে খাওয়া চলছে। হঠাৎ করে সবাই শুনতে পেল, “ওহ! মরি গেইনু রে!” বিকট চিৎকার।
সবাই ফিরে তাকাল চিৎকারের দিকে। তাজি ডাকাতের পেট দিয়ে বের হয়ে আছে একটা টেউর (মাছ মারার ট্যাঁটা)। পিঠের দিক থেকে কেউ একজন সজোরে আঘাত হেনেছে!
এরপর অতি দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটে গেল। ভালমত কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভোজনরত ডাকাতদলটি জনা ত্রিশেক মানুষের আক্রমণের শিকার হ’ল। তাদের হাতে টেউড়, হাশুয়া দা (রামদার মত লম্বা, মাথাটা ভেতরে বাঁকানো), লাঠিসোটা। চোখের সামনেই ৫/৬ জন ডাকাতের রক্তে খাবার প্লেট, চাটাই ভেসে গেল।ডাকাতদের পাশেই তাদের বন্দুক। সব পুরাতন আমলের। লোড করা, তাক করা, ফায়ার করা বেশ সময়সাপেক্ষ। এত সময় নেই কারও হাতে। তীব্র হামলার সম্মুখীন হয়ছে তারা। ডাকাতদল বুঝতে পেরেছে, জীবন বাঁচাতে হলে ছুটে পালাতে হবে। এছাড়া উপায় নেই।
“ঐ ডাকাইত, ডাকাইত, ধরো, ধরো, ধরো।” পুরো গ্রামে শোরগোল ছড়িয়ে গেল। সাত-আটজন মানুষকে তাড়া করছে প্রায় দুইশ’র মত মানুষ। সবার হাতেই কোন না কোন হাতিয়ার বা লাঠি। আজ ডাকাতদের রক্ষা নেই। আধ ঘন্টার মধ্যে প্রায় সবাই গনপিটুনিতে নিহত হল। ছকু শেখ দৌড়নোর পথ না পেয়ে একটা কুয়ায় লাফিয়ে পড়েছে। তাকে কুয়ার উপর থেকে জনা পঞ্চাশেক মানুষ বাঁশ দিয়ে খোঁচাচ্ছে। মানুষগুলোর মধ্যে তীব্র আক্রোশ। দুর্ধর্ষ ডাকাত, খুনি ও ধর্ষক ছকু শেখ প্রাণ বাঁচানোর জন্য আকুতি করার চেষ্টা করছে। লম্বা লম্বা বাঁশের তীব্র খোঁচা খেয়ে তার শরীরের অনেক জায়গা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে। সে বাঁচবে বলে মনে হয় না। গ্রামবাসী মানুষগুলোর ইচ্ছে নেই ছকু ডাকাত বেঁচে থাকুক। শত শত মানুষের ঘেরাও ভেদ করে কীভাবে যেন আকবর ডাকাত বের হয়ে গেছে। শুধু তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা বোধহয় সত্যিই জাদুকর, ভাবছে অনেকে। লোকে বলে, বিপদে পড়লে সে মাছির আকৃতি নিয়ে উড়ে যেতে পারে। গ্রামে কত অদ্ভুত কথাই না প্রচলিত থাকে, এসব কিছুর কি কোন বাস্তবতা থাকে?
মজিবার মিস্ত্রী ছুটছে আছিমত মিয়ার বাড়িতে। সে রীতিমত দৌড়চ্ছে। আছিমত মিয়ার মরো মরো অবস্থা। সে খাদ্য পানি কিছুই গ্রহণ করছে না। কিবলামুখী হয়ে এখনও শুয়ে আছে। তার চোখ মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে।
“আছিমত দা! আছিমত দা!”
একজন চেঁচিয়ে বলল, “কী হইছে রে?”
মজিবার হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, “আকবার ডাকাইতের দলের সোবাকে (সবাইকে) মারি ফেলাইছে। সর্দারপাড়ার দবির মাস্টারের বাড়িত দাওয়াত দিয়া, ডাকেয়া (ডেকে) টেউর দিয়া হানি (হেনে) মারিছে।”
মজিবার মিস্ত্রীর কথা শুনে সবাই হাঁ-হাঁ করে উঠল। তারা নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইতিমধ্যে আরও তিন-চারজন লোক দৌড়ে এল এই বাড়িতে। সবাই একই কথা বলছে, আকবর ডাকাতের দলের সবাই নিহত হয়েছে।
আছিমত মিয়া সব কিছু শুনল। হঠাৎ সে জোরে “আল্লাহ” বলে চিৎকার করে উঠল। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। বাড়ির লোকেরা তার কাছে ব্যস্ত হয়ে দৌড়ে গেল। বৃদ্ধ শতীবুল্লাহ বলল, “ডাক্তার ডাকি আন। স্যালাইন দিবার লাগবে। গতকাইল থাকি দানাপানি কিছুই মুখে দেয় নাই আছিমত।”
কয়েকমাস পরের কথা। হাজার খানেক মানুষ মিলে একটি নিথর শরীরকে নদীতে চুবাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের ক্ষোভ যেন কমছেই না নিথর দেহটার উপর। কারণ সেটা আকবর ডাকাতের মৃতদেহ। থানায় দুই দিন ভরা মারের পর পুলিশরা যখন বুঝতে পেরেছে আকবর ডাকাত মৃত, তখন ঝামেলা এড়াতে তার মৃত দেহটাই ছেড়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে। থানা থেকে রিপোর্ট করা হবে, “দুর্ধর্ষ খুনি ও ডাকাত আকবর জনতার গনপিটুনির স্বীকার হয়েছে। গনপিটুনির পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে নদীর পানিতে চুবানো হয়। পরে নদী থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।”
লেখক পরিচিতি : ইহতেমাম ইলাহী
গল্পের মাঝে জীবন খুঁজি, আর জীবনের মাঝে গল্প। গল্প আমার মাঝে ঘোর তৈরি করে। এই ঘোর আমি ছড়িয়ে দিতে চাই। ব্যক্তিজীবনে আমি একজন সন্তান, একজন স্বামী, এক কন্যার পিতা। চোখ বুঝলেই দেখতে পাই-- আমার শ্রদ্ধেয় পিতামাতা, প্রিয়তমা স্ত্রী, আর আদরের কন্যার মায়াভরা চোখগুলো আমাকে ঘিরে রেখেছে পরম মমতায়। এই মমতাও আমার মধ্যে ঘোর তৈরি করে৷ আচ্ছন্নতা যাকে বলে। আমি আল্লাহ তা'আলাকে রব, আর নবী মুহাম্মাদ (স.) কে নবী হিসেবে পেয়ে খুশি। এই খুশি সীমাহীন।