আকিফা

লেখক : পিনাকী চক্রবর্তী

“Fatima. On April 9, Fatima completed three years in prison, after the Delhi Police arrested (under FIR 48/2020) her for her alleged involvement in the clashes that rocked Jaffrabad in northeast Delhi when the city witnessed riots in early 2020. ”

– Tarushi Aswani, The Wire

ইমরান তিহার জেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আরেকবার হাউ হাউ করে কেঁদে বলল, “আমি দোজখে যাব। আপনি এক লওতি বেটি কো বাঁচা না সকে…” ভিড় জমেছে, একটা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, পরাক্রান্ত ও একান্ত দুপুরে এবং অনেক মানুষের জমায়েত হয়েছে, খবর পৌঁছে গিয়েছে। একজন পুলিশ কনস্টেবল এগিয়ে এসে বলল, “শান্ত হতে বলুন, এটা হাই অ্যালার্ট জোন।”
ইমরান কাঁদছে, কনস্টেবলের কথায় পাত্তা না দিয়ে চিৎকার করে বলল, “আকিফা, আমাদের কথা একবারের জন্যও ভাবলি না!”
ঘিরে থাকা ভিড়ের ভিতর থেকে একজন বৃদ্ধ বলে উঠল, “এই বার ওঠো। অনেক কাজ আছে। বডি ওরা কাটাছেঁড়া করতে পাঠিয়েছে।”
ইমরান আরও জোরে কেঁদে ফেলল, লম্বা সাদা ঝোলা পাঞ্জাবিতে ঘামের দাগ জলছবি হয়ে ভেসে উঠছে, গাল ভর্তি সাদা লম্বা দাড়ি, মাথায় রং করা চুল, বলল, “ছোটবেলা থেকে তোর পরভরিশে খামতি রাখিনি, কাজ তোকে ওরা কাটবে বলে নিয়ে যাচ্ছে!”

একটা সাদা বোলেরো এসে থামতেই, অনেকের সাথেই একজন বছর পঁয়তাল্লিশ বছরের যুবক নেমে আসতেই দিল্লির সাংবাদিক ও লোকাল ব্লগাররা ঘিরে ধরেছে। এক হিন্দি মাধ্যমের সংবাদ চ্যানেলের সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, “আপনি তো আকিফার হয়ে দশ বছর কেস লড়ছিলেন?”
যুবক শক্ত, মজবুত চেহারার, চোয়াল ভাঙা, চাহনিতে রুক্ষতা। বলল, “ইয়েস, আই অ্যাম লইয়ার রঙ্কবৃত পাল। আকিফার প্রতি অন্যায় হয়েছে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় মদতে নিরাপদে থাকা আমলাতন্ত্রের অত্যাচারের বলি হয়েছে আমার বোন। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চলবে।”

জাতীয় টিভিতে খবর আগুনের মত ছড়িয়ে যায়। আকিফা প্রায় দশ বছর ধরে জেলেই কাটিয়েছে, ভারতবর্ষের বহু রাজনৈতিক বন্দীদের মতই বিচার প্রক্রিয়া লম্বা সময় ধরে চলেছে। আচমকাই আজ সকালে খবর পাওয়া যায়, জেলে রাজনৈতিক বন্দী আকিফা আত্মহত্যা করেছে! আমরা যারা খবরের শিরোনাম নিয়েই ব্যস্ত হই, তাঁরা শিরোনামের ভিতরের গল্প নিয়ে আগ্রহ দেখাই না। আকিফার গল্প এখানেই শেষ নয়।

দিল্লীর কীর্তি নগরে, ছোট্ট এক কামরা বেডরুম ভাড়া হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মেয়েটা। বয়স মাত্র ঊনত্রিশ, তাতেই জীবনের অনেকটা পথ মনে হয় পেরিয়ে এসেছে। আজই ফ্ল্যাটের মালিকের হাতে অগ্রিম দিয়েই কিছুক্ষণ আগে ঘরের চাবি খুলে ভিতরে এসে বসেছে। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। নিরজের ফোন নম্বরটা ভেসে উঠতেই আকিফা ফোন ধরল।
“আকি, সব ঠিক আছে?”
আকিফা কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, “সব ঠিক আছে। আজ অফিসকে খুব মিস করছিলাম।”
“বলো, শ্রোতাদের।”
“ইয়েস অভিইসলি। রেডিও জকির জীবনে সবচেয়ে বড় গভীর সম্পর্ক হয় শ্রোতার সাথে।”
“আজ কতবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে! লাইভ প্রোগ্রাম ছিল।” নিরজের গলায় উত্তেজনা। বলল, “আমাদের প্রোগ্রাম শোনা হয়নি!”
আকিফা বলল, “নিরজ, মেস থেকে জিনিস নিজে এনে ফ্ল্যাট সাজাতে সাজাতে দুপুর তিনটে বেজে গিয়েছে। সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম।”
“তা, ছ’টায় কফি খেতে আসতে পারবে?”
“কোথায়?”
“তোমার ফ্ল্যাট থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার, রেনবো কফি ক্যাফেতে।”
আকিফা হেসে বলল, “ইউ আর ম্যাড।”
নিরজ হেসে বলল, “ইয়েস ডিয়ার, আই অ্যাম এ ম্যাড, ম্যাড লাভার।”

আকিফা ফোন রেখে দিয়ে সোফায় শরীর হেলিয়ে দিয়েছে। এই শহরে আসবার আগে সে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চোখে ছিল আইন নিয়ে পড়বার অদম্য ইচ্ছা। তবে উকিল হতে চেয়েছিল কিনা, নিজেও সেই নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লী চলে এসেছিল এমবিএ করবার পরেই। এইচআর হয়ে একবছর কাজ করতে করতে জীবনের মুখ ক্রমশই পাল্টে গিয়েছিল। নেশা আর পেশা, ছোটবেলা ও আরেকটু বুঝদার বড়বেলায় আকিফা নিজেকে একজন রেডিও জকি হিসেবে দেখতে চেয়েছিল, ধীরে ধীরে সেই দিকেই এগিয়েছে।

আজ এই চারটের সময়, বিকেলের ভরা আলোয়, ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আকিফার পুরনো দিনের কথা মনে ভেসে উঠছে। এখনও হয়ত কিছু অনুভূতি থেকে রেহাই নেই। ফ্ল্যাটের কাচের জানলার বাইরে যে জগৎ আছে, সেখানে তাকিয়ে বহু পুরনো স্মৃতি ভেসে ওঠে।

স্মৃতি মানে ক্যাণ্টিনে বসে কফি, স্মৃতি মানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গন্নার রস, স্মৃতি মানে মুশাহরার মেহফিল, স্মৃতি মানে পথনাটিকা – এক সাথে হাতে হাত রেখে, সে হাত শক্ত পুরুষের, নির্ভরযোগ্য আর খুব কাছের। উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লী, আকিফা ভুলতে পারেনি! নিকাহ ঠিক হয়ে যায়, মেহেন্দির রঙিন নকশায় দুধ সাদা হাতের তালু আরও মূল্যবান হয়ে ওঠে, কলেজ বন্ধুকে জীবনসাথী পাওয়ার সেই মুহূর্ত এখনও চোখে ভাসছে।

আকিফা সোফার উপর শুয়ে আছে। জীবনের দশটা বছর হারিয়েছে, দশ বছরের সম্পর্কের পুঁজি হারিয়েছে, প্রথম প্রেমের গন্ধ এখনও শরীরে মেখে আছে। প্রথম ভালবাসা ভুলে যাওয়ার অভিনয় করা যতটা সহজ, ভুলে যাওয়া ততটা সহজ নয়। আজ আচমকাই কেন মনে হচ্ছে? দানিশের কথা ভুলে যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু এখনও ভুলতে পারেনি। আজ যখন আচমকাই দানিশের মুখোমুখি হ’ল, চমকে গিয়েছিল। দানিশের চেহারা আগের থেকে ভেঙে গিয়েছে, হতেও পারে বয়সের ভারে, পরিবারের দায়িত্বের চাপে, কিংবা শুধুই নিজের চোখের অতৃপ্তি বহুদিন বাদে আপনজনের চেহারার রুগ্নতায় ফুটে ওঠে।

এইসব ভাবতে ভাবতে ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে ওঠে, ঘড়িতে বিকেল সাড়ে চারটে। আকিফা দরজা খুলে দেখল সামনে দানিশ দাঁড়িয়ে।
“আকি, কেমন আছো?”
দানিশের কথা শুনে আকিফা বলল, “তুমি এখানেই থাকো?”
“হ্যাঁ, রেবেতার বাবা এক বছর হ’ল ফ্ল্যাটটা আমাদের নামে লিখে দিয়েছে। আমি আর রেবেতা থাকি। তুমি ভাড়া এসেছো?”
“আজই এলাম। অফিস সামনেই, মেসে থাকতে অসুবিধা হচ্ছিল।”
দুজনেই চুপ করে রয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে আকিফা বলল, “আব্বুর শরীর ভাল নেই। সে দিল্লী আসতে চাইছে, তাই ভাবলাম নিজের কাছেই এনে রাখব।”
“সেই ভাল, কাজের শেষে ঘরে ফিরে ঘরের মানুষকে দেখতে পেলে মন ভাল হবে।”
কথা শুনে আকিফা বলল, “ঘরে ফিরে সব সময় ঘরের মানুষকে দেখা যায়?”
কথা শুনে দানিশ চুপ করে থেকে বলল, “সিগারেট ধরাতে পারি?”
“এখনও তুমি সিগারেট ছাড়তে পারলে না।”
“আকি, জীবনে অনেকেই ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটা আমি আজও মেনে নিতে পারছি না!”
“বিয়ে করেছো। সুখের সংসার।”
“হ্যাঁ, রেবেতা ছয় মাসের প্রেগনেণ্ট।”
“আমরা দু’জন নিজেদের জায়গায় ঠিক ছিলাম। এই নিয়ে নিজেদের দোষারোপ করা ঠিক নয়।”
দানিশ চোখ দুটোকে শক্ত করে বলল, “এত বছর বাদে আমায় ভুলতে অসুবিধা হয়নি না?”
“ভুলে আমি অনেকদিন আগেই গিয়েছিলাম। নতুন করে মনে করতে অসুবিধা হয়েছে।”
“আকি, তুমি সেই আগের মতই রয়ে গেলে।”
আকিফা স্মিত হেসে বলল, “নিজের মত থেকে যাওয়া খুব দরকার। আমি সকাল থেকে রাত মেহনত করি, নিজের আত্মসম্মান রক্ষার জন্যই।”
“তোমার কাছে তুমিই চিরকাল গুরুত্ব পেয়ে এসেছ।”
আকিফা হাসছে।
“হাসছ!”
“দানিশ, তোমার সাথে যেই দিন আমি নিকাহ করবার কথা ভেঙে দিলাম, জানতাম আমাদের সমাজে আব্বুর সম্মানহানি হ’ল। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল। একসময় নিজেকে ভুলও মনে হয়েছে। আমি নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, আমার কাছে নিজের স্বাধীন মতামত যতটা জরুরি, তেমনটা আর কিছু নেই।”
“মানে?”
“এখন এত বছর বাদে তোমার কথা শুনে বুঝেছি, নিজেকে সেই দিন ঠিক বুঝিয়ে ছিলাম। তুমি সেইদিন আমাকে ছিটেফোঁটাও বুঝতে চাওনি। আমি যদি সেই সব মেনেও তোমাকে নিকাহ করে ফেলতাম, আজ অন্তত নিজেকে নিয়ে লজ্জা হত!”
দানিশ কথাগুলো শুনে খুব একটা খুশি হয়নি। বলল, “আমাকে বিয়ে করলে লজ্জা পেতে?”
“ইয়েস, সেইদিন তুমি আমার আত্মমর্যাদাকে গুরুত্ব দাওনি। আর আজও সেই মনোভাব পাল্টায়নি।”

বেশিক্ষণ কথা হয়নি। দানিশ চলে যেতেই আকিফা ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পাঁচটা বেজে গিয়েছে, নিরজের সাথে ছ’টায় কফিশপে দেখা করতে হবে।

কফিশপে নিরজের দিকে নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে রয়েছে আকিফা। টের পায়, ছেলেটা এই মুহূর্তে সিরিয়াস কিছু উত্তর চাইছে। আকিফা কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল, “নিরজ, আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে ভাল আছে?”
নিরজ বলল, “কেন? আমি হিন্দু বলে?”
“তোমার আমার সাথে মিশে তাই মনে হচ্ছে!”
“এমনি মজা করে বললাম।”
“নিরজ, আমি খবর রাখি, আমার জন্য তোমার ছোট্ট রেডিও চ্যানেলকে বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি আসছে।”
“আকিফা, আমার এফএম চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার থেকেও বড় বিষয় হচ্ছে, তোমার লাইফ রিস্ক! সরকারের বিরুদ্ধে, পলিটিক্যাল অ্যাজেণ্ডায় ফেঁসে গিয়ে লাইফ রিস্ক হয়ে যাচ্ছে।
আকিফা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তোমার আমার মত ভারতবর্ষের শিক্ষিত মানুষরা যদি ক্যারিয়ার, লাইফ রিস্কের ভয়ে চুপ করে থাকি, অন্যায় মেনে নিই, তাহলে নতুন প্রজন্ম তৈরি হবে না।”
“তাই বলে পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডার মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে দিয়ে, নিজেকে পলিটিক্যাল প্রমাণ করাটা, অকলমন্দির কাজ নয়। এটা প্রমাণ করবে যে, তোমার বুদ্ধি নেই।”
“নিরজ, এতদিন আমরা মেলামেশা করছি, আমাকে দেখে মনে হয়না, ইউপি-র বাকি মুসলিম পরিবারের থেকে আলাদা আমাদের পরিবার? স্বাধীন চিন্তা, মতামত না রাখলে, এতদূর পড়াশুনো করলাম কেন? আমার আব্বু বাড়ির মহিলাদের স্বাধীন মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তোমার আগেও আমার একটা সম্পর্ক ছিল, নিকাহ অবধি এগিয়েও আমি পিছিয়ে আসি।”
“সেটা তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল।”
“নিরজ, আমাকে ভালবাসলে, আমার সবটা ভালবাসতে হবে। আমি জানি, আমার সব কিছু ঠিক হতে পারে না। প্রতিবাদ সব সময় ন্যায় আর অন্যায়ের মাঝের দেওয়াল হতে পারে না। প্রতিবাদ সমাজের বা রাষ্ট্রের পদক্ষেপের প্রতি নিজের মতামতের অবস্থান দেখানোর জন্য হয়।”
“আকিফা, আমি তোমার স্বাধীন মতামতে দখলদারি করছি না। কিন্তু দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়, কয়েক জায়গায় দাঙ্গা দেখা দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর করেছে।”
“এটাই তো স্বাভাবিক। এত বছর যারা এই দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসবাস করে আসছে, আজ সরাসরি তুমি তাদের কাছে নাগরিকত্বের প্রমাণ পত্র চাইবে?”
“যদি সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকত্বের প্রমাণ চেয়েও থাকে, অন্যায় তো কিছু করেনি।”
“বলছি না, ন্যায় ও অন্যায়ের ব্যাপারটা যার যার নিজের ব্যাপার।”

কিছুক্ষণ থেমে, নিরজ কফিশপের বাইরের রাস্তায় তাকিয়ে দেখছে, সন্ধ্যা সাতটায় মানুষের ভিড় বাড়ছে, যানবাহনের হল্লা ভেসে আসছে, ওরা খোলা জায়গায় বসে আছে। এই চত্বরে এমন কফিশপ প্রচুর তৈরি হয়েছে।
আকিফা বলল, “আমি জানি, যে কোন সময় ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তাই সারাদিন আমি একটা কঠোর ডিসিশন নিয়েছি।”
“বলো।”
“আমি তোমার রেডিও চ্যানেলের চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি।”
কথাটা শুনে নিরজ চুপ করে থাকল। আকিফা বলল, “এইবারের লড়াই আমার একার।”
নিরজ বলল, “আমি তোমার পাশে থাকতে চাইছি।”
আকিফার হাতের উপর হাত রেখে বলল, “রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে তোমার লড়াই। প্লিজ, আমাকে পাশে থাকতে দাও।”
আকিফা ফিসফিস করে বলল, “আমাকে হয়ত নেক্সট উইকে কোর্টে তুলবে ওরা। দাঙ্গায় আরও অনেকের নাম উঠে এসেছে।”
নিরজ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দাঙ্গায় রাজধানী জ্বলছিল। চোখের সামনে পরিচিত এলাকায় আগুন, হত্যা, রক্ত দেখেছি। এখনও স্বাভাবিক নয়।”
কথাগুলো শুনেই আকিফা বলল, “নিরজ, সত্যি করে বলো, আমাকে দোষী বলে মনে হচ্ছে?”
“তা হলে কি আমি তোমার পাশে থাকতে চাইতাম?”
“হ্যাঁ, চাইতে। আমার প্রতি তোমার দুর্বলতা।”
“এটা ভালবাসা। তোমার কি আমার বন্ধুত্ব নিয়ে ডাউট আছে?”
“দাঙ্গাকে কেউ সমর্থন করেনি।”
“কিন্তু উস্কানিমূলক রাজনীতি – আমি সেই সময় তোমাকে বলেছিলাম নিজেকে আলাদা রাখতে।”

আকিফা ঘড়ি দেখল, রাত আটটা বেজেছে। মোবাইল বেজে উঠতেই সে ফোন রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ, ইভিনিং।”
ফোন রেখে বলল, “নিরজ, কাল থেকে আমার কোর্টে যাতায়াত শুরু হবে। তোমার রেডিও চ্যানেলের জন্য শুভ কামনা রইল।”
নিরজ বলল, “আমি কিন্তু তোমার সাথে থাকব।”
আকিফা হেসে বলল, “দেখা যাবে।”

আজ, দুপুর দু’টো, কোর্টরুমে অপরিচিত ও পরিচিত মুখের ভিড়ে অনেক হিংসা, ক্ষোভ দেখেছে আকিফা। বিচার এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, জাতীয়স্তরের সংবাদ মাধ্যম এর মধ্যেই আকিফাকে দোষী বানিয়ে দিয়েছে! এই একমাসে সে ভারতবর্ষের বহু চর্চিত নাম হয়ে উঠেছে। আজ রায়দান হবে, কোর্টরুমে বসে আছে। দূরে দিপালী আসছে। দীপালীর দিকে আকিফা হেঁটে গেল।
“দিপালী, তুই একা?”
নিরজের রেডিও স্টেশনে আকিফার মতই একজন রেডিও জকি। দুজনেই একসাথে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেছিল। দিপালী বলল, “ওরা আর কেউ আসবে না।”
আকিফা নিস্পৃহ হেসে বলল, “সিএএ নিয়ে আমার অবস্থানের পরিবর্তন হবে না। অফিসের অনেকেই আমার বিরুদ্ধে, তাও বলব, আমি মনে করি সরকারের উচিত সিএএ বাতিল করা।”
দীপালীর মুখ স্থির, স্থবির। সে বলল, “এমনটা আমরা মনে করিনা। একটা দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার।”
“হতে পারে, তাই বলে নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে?”
“ভয় সরকার দেখায়নি, রাজনৈতিক দলগুলি দেখিয়েছে, দাঙ্গা করিয়েছে, যার সমর্থক হয়ত তুই।”
“আমি?”
“আকিফা, নিজের অজান্তে আমরা রাজনৈতিক ফাঁসে জড়িয়ে যাই।”
“তাহলে তুই এসেছিস কেন ? আমাকে একাই থাকতে দে।” এই প্রথমবার আকিফা কাঁদছে! শক্ত মনের মেয়েটার মন ভেঙে যাচ্ছে!
“আব্বু, আম্মা এদের ছাড়া কেউই নেই। আকি, ইউ আর অ্যালোন নাও।” কথাগুলো বলে দীপালি চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “নিরজ আজ আমাকে বলল, সে তোকে বেনামে ফিনান্সিয়াল হেল্প করবে, কিন্তু প্রকাশ্যে কোর্টরুমে আসবে না। তাতে সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে।”
আকিফা কথাগুলো শুনে স্মিত হেসে বলল, “আমি একাই লড়াই চালিয়ে যাব। যতদিন মানসিকভাবে লড়তে পাচ্ছি, লড়াই করব।”
দীপালি বলল, “কত দিন?”

তিহার জেলের বাইরে ভিড় জমছে। প্রায় চার বছর আকিফা জেলবন্দী! এখনও বিচার চলছে, কোর্ট এত তাড়াতাড়ি মুক্তি দেবে না, পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। দিল্লীর জাতিগত দাঙ্গায়, পুলিশ সন্দেহভাজনদের মধ্যে আকিফাকে রেখেছে, রিপোর্ট জমা দেয়। আজ কোর্ট চত্ত্বরে আবার ভিড় জমছে, বড়-ছোট রাজনৈতিক দলের নেতারা এসেছে।

আকিফা শুরুতে একাই ছিল। ধীরে ধীরে সিএএ আন্দোলন যতই এগিয়ে যায়, নিজের মত প্রচারে যুক্ত হয়, ধীরে ধীরে বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠন নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী ভারতবর্ষের সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের যুবক যুবতীদের উস্কাতে শুরু করে। এটা একটা বিপদজনক রাজনৈতিক খেলা, ভারতবর্ষের সব কয়টি রাজনৈতিক দল দেশের তরুণ প্রজন্মকে ধর্মীয় ভাবে পৃথক করে, ভোটের ময়দানে নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখবার খেলা খেলে। আকিফা বুঝতে পেরেই ধর্মীয় সংগঠনগুলির কারসাজি থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। সংগঠনগুলি একটা ধর্মীয় প্রজন্মকে আলাদা রাখতে চাইছে। সরকারের নীতির ভুল আছে, তার বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই সরকারবিরোধী ধর্মীয় সংগঠনগুলির সাথে থাকা নয়। এটা বুঝতে বুঝতেই আকিফা দিল্লীর দাঙ্গার সাথে জড়িয়ে যায়, সন্দেহজনক প্রভাবশালী হিসেবে নাম উঠে আসে।

আজ তিহার জেলে আকিফার মৃতদেহ নিয়ে বেশ কয়েকটি বড় বড় সংগঠন মিছিল, প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছে। ওই তো, দূর থেকে বড় বড় গাড়ি, প্ল্যাকার্ড আর অনেক মানবতাকামী, বুদ্ধিজীবী, নিয়ে আসছে। এতদিন যারা আকিফার খোঁজ নেয়নি, বিচারের নামে দীর্ঘ চারবছর কারাবাসে থাকা দেশের সাধারণ নাগরিকের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে আদৌ চিন্তিত ছিল না, দেখাও যায়নি এই চত্ত্বরে, তাঁরাই এগিয়ে আসছেন। আকিফার আব্বুর চেয়েও ওদের অধিকার বেশি। রাজনৈতিক বন্দীর মৃতদেহ – এখনই সরকারকে চাপে ফেলা যাবে।

দীপালি দূর থেকে এই অদূরদর্শী ঘটনাক্রমগুলো দেখছিল। মনে মনে ভাবছে, “আকিফা সুইসাইড করেছে, মুক্তি পায়নি। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বাজার চাহিদার কাছে, এক অসহায় রাজনৈতিক বন্দীর বিচারের নামে কারাবাসযাপন ততটা বড় ইস্যু নয়, যতটা আকিফার মৃতদেহের সংখ্যালঘু নারীকে খুন করেছে সংখ্যাগুরুর সরকারের প্রোপোগাণ্ডা!” ওই তো নিরজের বড় নীল রঙের গাড়িটা ঢুকছে! আজ বড় কিছু হবে। “কভারেজ” ছাড়া আপন ভালবাসার লোকটি আকিফাকে শেষ সময়ে দেখতে এসেছে।

দীপালি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “গত রাতে, মেয়েটা মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। সরকার পক্ষ চারবছর মেয়েটাকে ঘুমোতে দেয়নি। ও এখন শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে।”


লেখক পরিচিতি : পিনাকী চক্রবর্তী
কলকাতায় থাকি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।