লেখক : মোঃ রিমেল
কামারখাড়া হতে তিন মাইল পথ হাঁটলে নান্নয়ার বাজারের বুড়বুড়িয়া গ্রাম। আজকাল গ্রামের সবার মুখে এক গল্প শোনা যায়। রাজা গোবিন্দ মাণিক্য নয়, এক সাধারণ পরিবারের একটি ছেলের গল্প। খালেক মিয়ার ছেলে বায়েজিদ গ্রামের একমাত্র ছেলে হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। বায়েজিদ গ্রামের সবার অনুপ্রেরণার প্রতীক। পড়াশোনার পাশপাশি পরিবারের জন্য টাকা পাঠানোতে চারদিকে খালেক মিয়া আর তার ছেলে বায়েজিদের প্রসংশায় মুখরিত সারা বুড়বুড়িয়া আর নান্নয়ার বাজার।
সেদিন নান্নুয়ার বাজারের বটতলার চায়ের দোকানে সানু মিয়া বলে, “শোন খালেক মিয়া, তোমার ছেলে দেখবা একদিন অনেক বড় হইব। আমার পোলাডারে তো বোঝাই কোন লাভ হয় না। এখন থেকে তোমার পোলা পরিবারের হাল ধরতাসে, দেইখো তোমাগো সুখের দিন আর বেশি দূরে নাই।”
“তা তো বটেই। ছেলেডা অনেক পরিশ্রম করে, বুঝলা? দোয়া কইরো।” এই বলে খালেক মিয়া বাড়ির পথে রওনা দেয়।
ঢাকা শহর জাদুর শহর। রবিবারে মেসে বায়েজিদকে দেখে মনে হ’ল, কোন এক মুমূর্ষু রোগীর মত। কোন এক কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মেসের বেডে শুয়ে আছে। নামাজের বেলা গড়িয়ে যাওয়ার খানিকক্ষণ পূর্বে নামাজের কথা মনে হ’ল। আজকের মোনাজাতে অন্য দিনের তুলনায় ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। মোনাজাতে হয়ত বিশেষ কিছুর আবেদন সৃ্ষ্টিকর্তার নিকট।
পরের দিন সকালে শহুরে রাস্তায় বায়েজিদ মনে মনে কল্পনা করছে, “যদি আজকে টিউশনিতে ছাত্র আমাকে কোন কঠিন কিছু জিজ্ঞেস করে আটকিয়ে দেয়, তখন কী করব? যদি আমি কিছু ভুল করে বসি ছাত্রের সামনে, বা ছাত্র যদি বলে স্যার আপনি পারে না? আচ্ছা যদি অভিভাবক জিজ্ঞেস করে কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো? আমি যদি বলি… পড়ি, আর তার পরের দিন যদি টিউশনটা চলে যায়?” কিছুদিন আগে একটা টিউশন বায়েজিদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কারণ শিক্ষার্থী গণিত, পদার্থবিদ্যা, এবং রসায়ন পড়বে, আর বায়েজিদ বাংলা বিভাগে পড়ে বলে অভিভাবক পরের দিন থেকে আসতে নিষেধ করেছে। এলাকার আঞ্চলিক সংগঠন আর সিনিয়রদের পরামর্শে কিছু টিউশন পেয়েছে। টিউশন থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিজে চলার মত কিছু রেখে বাকিটা পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দেয়। স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেও ভাগ্যের লেখনিতে এখন সে বাংলা বিভাগে অধ্যয়নরত।
শহরের রাস্তায় বাসের হর্ণে মূহুর্তে কল্পনা জগৎ থেকে বাস্তব জগতে পদার্পণ করে বায়েজিদ। পাঁচতলা দালানের সামনে এসে দাঁড়াতেই অভিভাবক এসে উপস্থিত হয়। টিউশন শেষে মেসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। হঠাৎ কিছু একটা জিনিস পায়ে গেঁথে রক্ত বের হয়ে গিয়েছে। মনের আর্তনাদ, আত্মসম্মান, আর একটা যত্ন না নেওয়া খাঁচায় আটকে থাকে। কী জিনিস? হাতে তুলতে দেখে – একটা ইঁটের কণা। দোষ কি ইটের কণার? আসলে বায়েজিদের জুতাজোড়া শেষ চিহ্নটুকু নিয়ে কোনরকমে বেঁচে আছে। জুতা কোনরকমে পায়ে দিয়ে টিউশন করাতে যায়।
মেসে আসার পরে পায়ের রক্ত মুছতে গেলে ফোনে কল বেজে উঠল,
“বাবা, কেমন আছস?”
“হ্যাঁ মা, ভাল। তুমি কেমন আছ?”
“ভাল বাজান। বাবা,শোন না… গতকাল পাশের বাড়ির রানু…”
“মা, চিন্তা করই না। আমি এ মাসেই পাঠিয়ে দেমু রানুর টাকা।”
কল কেটে রক্ত মোছা শেষ হলে সে ক্লাসের প্রেজেণ্টেশন রেডি করে।
সবাই প্রেজেণ্টেশনে বই নিয়ে এলেও বায়েজিদের হাতে বই ছিল না। শিক্ষকের কাছে কিছুটা বকা শোনে, প্রেজেণ্টেশন শেষ হয়। ক্যাফেটেরিয়াতে খাওয়ার সময় নেয়ামত এসে বলে, “কীরে, সবসময় তুই কেন ভাত আর ভাজি খাস? ভেজেটেরিয়ান নাকি? কোনদিন তো তোকে মুরগি নিতে দেখলাম না।”
“হুম, সবজি আর ডাল খুব ভাল লাগে রে।”
ভার্সিটি শেষে মেসে এসে দেখে এ মাসে চলার মত আর ৫০০ টাকা আছে।
“বাড়িতে কিভাবে টাকা দেব? পরের মাসে তো আর বাড়িতে টাকা দিতে পারব না। মাকে তো বলে দিয়েছি টাকা দেব। এদিকে একটা টিউশন হাতছাড়া হয়ে গেল… যদি এক-দুইটা টিউশন ম্যানেজ করতে পারি, হয়ত সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।”
রাতে টিউশন মিডিয়ার পেইজগুলোতে অনেক মেসেজ দিল বায়েজিদ। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায় বিভোর। শহরের উঁচু দালান সব ভেঙ্গে গিয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। একটু পরে একটা নোটিফিকেশনের ফেসবুকে প্রবেশ। লেখা, “কোচিং সেণ্টারে গণিত বিষয়ের জন্য গণিত শিক্ষক লাগবে। আপনি তো বাংলা বিভাগে পড়েন, আপনাকে তো নিবে না।”
বায়েজিদ লেখে, “বাংলা বিভাগে পড়লে কি কেউ নবম-দশম শ্রেণির গণিত পারবে না? কাউকে ডিপার্টমেণ্ট দিয়ে মূল্যায়ণ করা উচিত নয়।”
রাগে মোবাইল রেখে ঘুমাতে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শুরুর দিকে একটা পেইজ থেকে টিউশন দেওয়ার নাম করে বায়েজিদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে গিয়েছে, কোনও টিউশন দেয়নি। তারপরে সে অনেক পেইজে আবার চেষ্টা করেছে। কোন ভাল লোক তো থাকবে।
সকালে দরজায় ঢক ঢক আওয়াজ। কেউ হয়ত বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
এক বন্ধু এসে বলল, “বন্ধু, একটা টিউশন আছে। কাল থেকে শুরু করিস।”
ফেসবুক থেকে নোটিফিকেশন আসে, “বায়েজিদ এই টিউশনটি আপনাকে দেওয়া হয়েছে।”
উচ্ছ্বাসে বায়েজিদ উঠে দেখে চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। আসলে বায়েজিদ স্বপ্ন দেখেছিল। তারপরে আবার ঘুম।
দরজায় ঢক ঢক আওয়াজ। এবার স্বপ্ন নয়। সত্যিই ঢক ঢক আওয়াজ।
তবে বায়েজিদের সাড়া পাওয়া গেল না।
লেখক পরিচিতি : মোঃ রিমেল
মোঃ রিমেল কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলায় ২০০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আবদুল খালেক, মাতার নাম কাজল রেখা। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ৩য় বর্ষে অধ্যয়রণরত। দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, সমকাল বিভিন্ন ম্যাগাজিন সহ ৩০ টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম এর অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ২০২৪-২৫ কার্যবর্ষে। প্রথম যৌথ কাব্যগ্রন্থ রক্তাক্ত বঙ্গভূমি প্রকাশিত হয় নবপ্রত্যুষ প্রকাশনী থেকে। দ্বিতীয় যৌথ কাব্যগ্রন্থ শোকের লাল রং।

