ভূতুড়ে জমি

লেখক : মোঃ নিয়ামুল ইসলাম

।। ১ ।।

মা ফোন দিয়ে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো, “শিয়াল পাড়ার ক্ষেতে তোর আব্বারে কাল রাইতে জ্বীনেরা মাটির মধ্যে কোমর পর্যন্ত গাইড়া রাখছিল। এখনও ওনার হুঁশ ফিরে নাই।”
আমি স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “হসপিটালে নিয়েছিলা আব্বাকে? ওনার অবস্থা এখন কেমন?”
“অবস্থা বেশি ভালো না। কালু কবিরাজরে তোর চাচা খবর দিয়া আনাইছে। উনি ঝাড়ফুঁক করতেছে কিন্তু এখনো তার জ্ঞান ফেরার নাম নাই।”
আমি উত্তেজিত কন্ঠে বললাম, “আরে তোমাদের মাথা কি পুরোপুরি গেলো নাকি? হসপিটালে না নিয়ে কিসব কবিরাজ টবিরাজ নিয়ে পরে আছো? এদের দুই নাম্বারি তো গতবারই গ্রামবাসীর সামনে উন্মুক্ত করলাম। যত দ্রুত সম্ভব আব্বাকে হসপিটালে নিয়ে যাও। আমি বাসে উঠে রওনা দিচ্ছি।”
আমার মা কিছুক্ষণ কেঁদেকেটে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে। তুই তাড়াতাড়ি আয়”।
মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তৎক্ষনাৎ আমি ফোনটি রেখেই সামান্য কিছু কাপড়চোপড় ব্যাগে ঢুকিয়েই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার মেসের বড়ভাই আকিব আমার এমন তাড়াহুড়ো দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যপার মারুফ? ব্যাগপত্র গুছিয়ে কই যাচ্ছো?”
“জ্বী ভাই! ঐ আব্বু একটু অ্যাক্সিডেন্টে করেছে তো তাই বাড়িতে যাচ্ছি। আপনাকে পরে সব জানাবো, এখন আসি তাহলে।”
এই বলে তার কোনো প্রতি উত্তর না শুনেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
আকিব ভাই এমনিতেই এসব জ্বীন-ভূত সম্পর্কে খুবই স্পর্শকাতর, মাঝেমধ্যে ফ্রি সময় পেলেই আমাদের মেস মেম্বারদের নিয়ে জ্বীন-ভূত এর গল্প নিয়ে মেতে উঠেন। অন্য মেস মেম্বাররা এসব বিশ্বাস করলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারি উনি এসব বিনোদনের জন্যই অর্ধেকটাই মিথ্যা বলেন।

বাবার সাথে আমার সৎ চাচাদের জায়গা জমি নিয়ে বহু বছরের একটি কোন্দল ছিল। আর মায়ের ভাষ্য মতে যেখানে বাবাকে অজ্ঞান অবস্থায় মাটির মধ্যে পাওয়া গেছে সেখানের জমি নিয়েই মূলত আসল সমস্যা। আমার যতটুকু ধারণা আমার সৎ চাচারাই বাবাকে কোনোরকম আহত করে ঐ মাটির মধ্যে গেড়ে এটাকে জ্বীন-ভূত হিসেবে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে। তারা হয়তো ভেবেছে এসব করলে আমরা ভয়ে ভুলেও ঐ জমিতে পা বাড়াবো না। কিন্তু আমার বাবার এমন তরতাজা এক যুবক ছেলে থাকতে তাদের এসব কুবুদ্ধি যে কখনোই সফল হবে না সেটা হয়তো তারা ভাবতে পারেনি।

বাস থেকে নেমে বাড়িতে না গিয়ে সরাসরি হসপিটালে চলে আসলাম। হাসপাতালটি সরকারী এবং বেশ পুরোনো, আমাদের পরিবারে কারো কোনো শারীরিক সমস্যা কিংবা রোগ হলেই এই হাসপাতালে চলে আসি।
বাবা শুয়ে আছে আর আমার মা রক্তিম চোখে বাবার সাথে বসে আছে। এখন আপাতত আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেউ উপস্থিত নেই, হয়তো তারা বাবাকে দুএক নজর দেখে যার যার কাজে চলে গেছেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বার কি অবস্থা?”
মা নির্লিপ্ত স্বরে বললেন, “জ্ঞান ফিরছিলো! একজন নার্স আইসা ঘুমের ঔষধ খাওয়াইয়া দিছে আবার, তাই এখন ঘুমাইতেছে। ওনারা বললো, এই মুহূর্তে নাকি তোর আব্বার জেগে থাকা ঠিক হইবো না।”
আমি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলি, “হুম তাহলে ঠিক আছে। আর তোমরা কিনা ঐসব ভন্ড কবিরাজ নিয়া উঠে পড়ে লাগছিলা। ওরা হলো কোনোরকম দুই একটা হাবিজাবি মন্ত্র পড়ে টাকা কামানোর ধান্দা। যাইহোক এখন কিভাবে কি হলো সেটা বলো।”
“তোর বাপে কালকে রাতে গেছিলো শিয়ালপাড়ার জমিটা একটু দেখতে। এর আগেও বহুবার রাতে গেছিলো কিন্তু তেমন কিছুই হয় নাই। কালকে রাত বারোটার পরও যখন তোর আব্বায় বাড়ি ফিরছিল না তখনই আমার চিন্তা শুরু হয়। কারণ এতো রাইত কইরা সে কোনোদিন বাড়ি ফিরে নায়। উল্টা বেশি কাজ কাম থাকলে দশটার আগেই বাসায় চলে আসে। তখন আমি চিন্তা মন নিয়া তোর ছোট চাচার ঘরে যাই। কিন্তু তোর ছোট চাচায়ও গঞ্জে গেছিলো কি জানি এক কামে। এরপর পাশের বাড়ির সবুজ আর সাদেকরে অনেক বুঝাইয়া শুনাইয়া সেই ক্ষেতে পাঠাই। ওরাও তো পোলাপান মানুষ তাই এতো রাইতে যাইতে চায় নায় প্রথমে। ওরা নাকি যাইয়া দেখে তোর বাপের জমির পাশে যেই পুকুরটা আছে সেটার কিনারায় কাদামাটির মধ্যে তোর বাপেরে জ্বীনেরা কোমর পর্যন্ত গাইড়া রাখছে অজ্ঞান অবস্থায়। এরপর ওরা যখন আমারে কল দেয় তখন আমি কোনোরকম তোর চাচীরে নিয়া সেইখানে যাই এরপর তোর বাপেরে নিয়া আসি।”

মায়ের কথা শুনে আমার একটুও বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা নিশ্চই আমার সৎ চাচাদের কাজ। তবুও কোনো প্রমাণ ছাড়া তাদেরকে দোষারোপ করাটাও আমার যে বোকামি হবে সেটাও ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি।

বিকালেই বাবাকে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। বাড়িতে আসার পর আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সবুজদের বাড়িতে চলে গেলাম। সবুজদের পরিবার আমাদের আপন কোনো আত্মীয় না হলেও ওদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা অনেক আপনজনের চেয়েও বেশি। আমার বাড়িতে আসার খবর শুনলে ওরা দুই ভাই আমাকে ছাড়া যেন কিছুই বুঝে-না। সবসময়ই আমার পিছু পড়ে থাকে। এর কারণটাও স্বাভাবিক, একজন বড় ভাই হিসেবে যতসব দায়িত্ব আর কর্তব্য আছে সবকিছুই আমি পালন করার চেষ্টা করি।
সবুজ আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে বললো, “ভাই! আপনে কখন আইলেন? আর চাচার অবস্থা কেমন?”
“হুম এখন মোটামুটি ভালো। আচ্ছা কালকে রাতে তোরা ক্ষেতের মধ্যে যাওয়ার পর কি দেখছিলি বলতো!”
“যা দেখছি তা আর বলার মতো না। ক্ষেতের পাশের পুকুরে চাচারে ভূতেরা গাইড়া রাখছিল। আমি তো এই দৃশ্য দেইখা ভয়ে সামনেই আগাই নাই। পরে সাদিককা কইলো চাচীরে কল দিয়া আনতে। এর আগেও নাকি অনেকেই ঐখানে সাদা কাপড় পরা ভূত দেখছে। কোনোরকম নাকি তারা সেই ভূতের হাত থিকা বাঁইচা আইছে। সন্ধ্যার পর ঐখানে কোনো মানুষ ভুলেও যায় না এইসব ভূতের কারণে। আর চাচায় কি বুইঝা যে গেলো সেইটাই আমার মাথায় খেলতেছে না।”
“এইসব কল্পকাহিনী তোরে বললো কে? সত্যি করে বলতো!”
“কি যে বলেন আপনে? পুরা গ্রামবাসীর মানুষ জানে ঐখানে ভূত আছে। ক্ষেতের পাশেই তো বাঁশঝাড়, আমার মনে হয়ে ওখানেই ভূত থাকে।”
“হুম আচ্ছা এখন চল, আজকে যেয়ে দেখমু ওখানে আসলেই কোনো ভূত আছে কিনা?”
“না ভাই আমি আর ঐখানে যামু না। কালকে চাচারে যেই অবস্থায় দেখছি সেইটা দেখার পরতো আরো আগে যামু না।”
আমি ধমক দিয়ে বললাম, “চুপ থাক! এখন বিকাল, এখন কোনো ভূত নাই। আর সাথে আমিতো আছি। সাদিকরেও ডাক দে।”

শিয়ালপাড়ার ক্ষেতে চলে আসলাম সবুজ আর সাদিক দুই ভাইকে নিয়ে। ক্ষেতের পূর্ব পাশ ঘেঁষেই এক বিশাল বাঁশঝাড় এবং আরো বেশ কিছু গাছপালা। কথিত আছে ঐ বাঁশঝাড়ের মধ্যে নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা বাঙ্গালীদের মেরে মেরে একসাথে গণকবর দিয়েছিল। যদিও এটার সত্যতা কতটুকু তা আমার জানা নেই। আমাদের ক্ষেতের দক্ষিণ দিকেই বিশাল এক কুয়ার মতো বড়সড় একটি পুকুর। বর্ষাকালে এই পুকুরটি পানিতে টইটম্বুর থাকলেও গ্রীষ্মের এই প্রচন্ড দাবদাহে পানি অর্ধেকটাই নেই। আশেপাশের ক্ষেতগুলোতে এই পুকুর থেকেই পানি নিয়ে সেচ করা হয়।
ক্ষেতের পাশ ঘেঁষে পুকুরের যেই সাইডটি পরেছে সেখানেই দেখতে পেলাম নরম কাদার মধ্যে বেশ কিছুটা গর্ত করা। সবুজ সেখানের দৃশ্যটি আমাকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে বললো, “ভাই এইখানেই চাচারে ভূতেরা গাইড়া রাখছিল। অনেক কষ্টে চাচারে মাটির মধ্যে থেকে উঠাইছি।”
আমি কোনো কথা না বলে জুতাটি হাতে নিয়ে সেই কাদার মধ্যে নেমে পড়লাম।
একটি বিষয় আমার চোখ এড়ালো না, খেয়াল করলাম গর্তের চারপাশটা বেশ সমান অথচ আমরা জানি কোথাও কোনো গর্ত করলে যদি মাটি অন্য কোথাও ফেলা না হয় তাহলে গর্তের চারপাশটা চাপের প্রভাবে কিছুটা উঁচু হয়ে যাবে অথচ এখানে তার কোনো লক্ষ্মণ নেই। গর্তের কিছুটা দূরে তাকাতেই রহস্যের জট কিছুটা খুললো। মানে এই গর্তের মাটি আসলেই আগে থেকে অল্প কিছু উঠিয়ে পাশেই ছুড়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এসব ক্লু দিয়েতো আর আসল রহস্য উদঘাটন সম্ভব নয়।
যখন কোনো কিছু না ভেবে সবুজ আর সাদিককে নিয়ে পাশেই ক্ষেতের আইলে বসে পরি তখনি পাশে বেশ কিছু অর্ধখাওয়া সিগারেটের শলাকা দেখতে পেলাম তখনই আমার মাথাটি কিছুটা চক্কর দিয়ে উঠলো। একটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম সিগারেট গুলো খাওয়া হয়েছে তা খুব বেশি সময় হয়নি। অর্থাৎ গতকাল রাতেই সম্ভবত কয়েকজন মিলে এগুলো খেয়েছে।
আমাকে ভাবনার জগতে চলে যেতে দেখে পাশ থেকে সবুজ বললো, “ভাই কি ভাবতেছেন? সন্ধ্যা তো হয়ে গেলো চলেন বাসায় যাই। নাহলে আমাদেরও ভূতে ধরবো।”
ওদের কথার প্রতি উত্তর না দিয়ে বাসার উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলাম।

সকালে বাড়িতে হট্টগোল শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অনেকটা ঘুমন্ত চোখে উঠোনে আসতেই সবুজ দৌড়ে এসে আমাকে বললো, “ভাই শুনছেন! কামরুল চাচারেও কালকে রাতে ভূতেরা ঐ একই জায়গাতে মাটির মধ্যে গাইড়া রাখছিল। তার অবস্থা নাকি আরো মারাত্মক।”
সবুজের কথা শুনে মুহূর্তেই আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
যেই সৎ চাচাদের আমি কালকে থেকে সন্দেহ করে আসছি আজ তারাই কিনা একই ফাঁদে আটকে গেলো? এ কীভাবে সম্ভব? এটা কি আসলেই কোনো জ্বীনের কাজ নাকি মানুষের কাজ?…

সকালে বাড়িতে হট্টগোল শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। অনেকটা ঘুমন্ত চোখে উঠোনে আসতেই সবুজ দৌড়ে এসে আমাকে বললো,
“ভাই শুনছেন! কামরুল চাচারেও কালকে রাতে ভূতেরা ঐ একই জায়গাতে মাটির মধ্যে গাইড়া রাখছিল। তার অবস্থা নাকি আরো মারাত্মক।”
সবুজের কথা শুনে মুহূর্তেই আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
যেই সৎ চাচাদের আমি কালকে থেকে সন্দেহ করে আসছি আজ তারাই কিনা একই ফাঁদে আটকে গেলো? এ কিভাবে সম্ভব? এটা কি আসলেই কোনো জ্বীনের কাজ নাকি মানুষের কাজ?
এসব ভাবনার মাঝে সবুজ পুনরায় বললো,
“ভাই আমি চাচারে দেখতে যাই! কালু কবিরাজরে নাকি খবর দিছে জ্বীন ছাড়ানোর জন্য।”
সবুজের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ আমি বাস্তবে ফিরে বললাম,
“আচ্ছা তুই একটু দাঁড়া! আমি হাতমুখ ধুয়ে আসতেছি, আমিও যাবো।”
আমার কথা শুনে সবুজ সম্মতি দিতেই কোনোরকম হাতমুখ ধুয়ে আমার সৎ চাচার বাড়িতে রওনা দেই।

।। ২ ।।

পাকিস্তান আমলে আমার দাদা ছিলেন গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। যেহেতু সেই আমলে একজন পুরুষের দুই তিনটি বিয়ে করা ছিল বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার তাই আমার দাদাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমার বাবা এবং আপন ছোট চাচা হলেন দাদার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান অপর দিকে কামরুল চাচা এবং তার ছোট ভাই সবরুল চাচা ছিলেন দাদার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। দূর্ভাগ্যবশত আমার দুই দাদীই দাদার মৃত্যুর আগেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দাদার মৃত্যুর আগে তিনি সকল ছেলেদের জায়গা জমি সুষমভাবে ভাগ করে দিলেও শিয়ালপাড়ার ঐ ভূতূড়ে জমি নিয়ে আমার সৎ চাচাদের আলাদা একটা লোভ ছিল। কেননা জমিটি এতোটাই উর্বর ছিল যে যেকোনো ফসল অতি কম খরচেই ভালো ফলন দিতো। দাদার মৃত্যুর আগে আমার বাবাকে তিনি ঐ জমিটুকু লিখে দিলেও আমার সৎ চাচারা দাদার মৃত্যুর পরই বিভিন্ন ভাবে বেঁকে বসেন। এই জমি নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক মামলা এবং শালিসি হলেও ঝামেলা এখনো পর্যন্ত চলছেই।

কামরুল চাচার বাড়িতে আসতেই বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর ভিড় দেখে আমি অবাক হলাম না। ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই দেখি একজন জটাধারী লোক মূর্ছা যাওয়া কামরুল চাচাকে তার সামনে শুইয়ে কি যেন মন্ত্রতন্ত্র পড়ছে। লোকটিকে দেখে মুহূর্তেই আমার মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ আমি সকলের সামনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে সোজা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ঢুকে দেখি আমার চাচী একজন মহিলার কোলে মাথা দিয়ে অঝোর ধারায় কান্না করছেন। পাশেই আমার একমাত্র চাচাতো বোন চোখমুখ লাল করে বসে আছে। তিথি অর্থাৎ আমার চাচাতো বোন ছোটবেলা থেকেই আমাকে পছন্দ করে কিন্তু ওর বাবার সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব থাকায় সচরাচর তেমন আমার কাছাকাছি আসেনি।
নীরবতা ঠেলে আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলাম, “কি ব্যপার তিথি? চাচাকে হাসপাতালে না নিয়ে এই ভুয়া কবিরাজকে ডাকতে গেলি কেন? তোদের কি মনে নেই গতবছর সেই ভুয়া কবিরাজকে হাতেনাতে প্রমাণসহ ধরে গণধোলাই দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছিলাম? আবারো ঘুরেফিরে তোরা একই বোকামি করছিস?”
আমার কথা শুনে তিথি ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো, “আমি কি জানি? সবরুল চাচাই তো ওনাকে ডেকে নিয়ে আসলো! ওনারা বলছে বাবাকে নাকি সত্যিই জ্বীনে আঁচড় করেছে। তুমি একটু ওনাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে বলো না বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে। আমার এসব আর একদমই ভালো লাগছে না। বাবার কখন যে কি হয়ে যায় আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছি না।”
এই বলেই তিথি ওর চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো। তিথির কথায় চাচীর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তখনি আমি ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে আসলাম।
সকলের উদ্দেশ্যে কর্কশ কন্ঠে বললাম, “এখানে আর এসব চলবে না। চাচাকে আমি এখনি হসপিটালে নিয়ে যাবো। এসব দুই নাম্বারি করে আমি চাচাকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারবো না। এইসব দুই নাম্বারি বন্ধ করেন।”
আমার কথা শুনে যেন সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তখনি সবরুল চাচা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, “বড় ভাইরে জ্বীনে ধরছে আর ওনার চিকিৎসা এই কবিরাজই করাইবো। নিজের বাড়ি গিয়া নিজের চড়কায় তেল দে। এইখানে আইসা তোরে কেউ মাতব্বরি করতে বলে নায়।”
ওনার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সামান্য জায়গা জমির কারণে উনি যে নিজের ভাতিজাকে এতোটা ঘৃণা করতে পারেন তা যেন আমার ভাবনাতেই ছিল না। তবুও নিজেকে যথেষ্ট সংযত করে বললাম, “শুনেন, আমার আব্বা আপনার সৎ ভাই বলে আমার প্রতি আপনার অনেক রাগ থাকতে পারে কিন্তু আমি কখনোই চাইবো না চাচার এই বিপদে আপনারা ভুল পথে পাড়ি জমান। আর গতবছরের এই কবিরাজদের ভন্ডামি সম্পর্কে আপনি নিশ্চই অবগত আছেন।”
আমার কথা শুনে তিনি সীমিত সময়ের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

কবিরাজকে বিদায় দিয়ে যখনই তার সামনে থেকে কামরুল চাচাকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে যাবো তখনই কালু কবিরাজ বেশ রাগান্বিত স্বরে সবরুল চাচার উদ্দেশ্যে বললেন, “এই ছোকড়ার কথায় আজ আমাকে বিশ্বাস করলি না উল্টা অপমান কইরা চইলা যাইতে বললি। এইখানেই শেষ না, দেখবি এক এক করে তোগো বংশের সবগুলারে জ্বীনে ধ্বংস করবো। আমারে করা অপমান এর ঘানি তোগো বইয়া বেড়াইতে হইবো। পরে আমারে ডাইকাও খুঁইজা পাবি না।”
কালু কবিরাজের কথা শুনে সবরুল চাচা যে বেশ ভয় পেয়েছেন সেটা তার মুখো দর্শন করেই বুঝতে পারলাম। আমি এসবে আর তেমন কান ভারী না করে তখনই চাচাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

তিথি আমার পাশে বসে আছে শরবতের গ্লাস নিয়ে। কতবছর পর ওদের বাসায় যে পা দিয়েছি তা ঠিক মনে নেই। ভাই ভাইয়ের কোন্দল আমার বাপ চাচাদের ভিতরে যে কতটা প্রখর ছিল সেটা এমুহূর্তে বেশ ভালো ভাবেই অনুধাবন করতে পারছি। আমিও বা কিভাবে পারলাম বাপ চাচাদের এই বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে? আমারতো অন্ততঃ উচিত ছিল যতযাই হোক চাচাদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখা।
আমার ভাবনার মাঝে হঠাৎই তিথি আমার দিকে শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শরবতটা খেয়ে নেও রাফি ভাই।”
আমি আর ইতস্তত না করে শরবতের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ঢকঢক করে শরবত টুকু খেয়ে নিলাম।
খাওয়া শেষ হতেই তিথি চিন্তিত মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা তোমার কি মনে হয়? এটা কি আসলেই কোনো জ্বীনের কাজ নাকি অন্য কিছু?”
আমি কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললাম, “সত্যি বলতে পড়শু দিন আব্বাকে যখন শিয়াল পাড়ার ঐ ক্ষেতের পাশেই তোর আব্বার মতো অবস্থায় পেয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল তোর আব্বা আর সবরুল চাচা মিলেই হয়তো শত্রুতার বশে আব্বার সাথে এরকম করেছিল। কিন্তু ঘটনাতো এখন পুরোপুরি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। তুই তো জানিসই এসব ভূতপ্রেতে আমার বিশ্বাস কম তাছাড়া গতকাল বিকালে আব্বাকে যেখান পাওয়া গিয়েছিল সেখানে সদ্য খাওয়া কিছু সিগারেটের শলাকা দেখেছিলাম। জ্বীন ভূতের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে ওরা সিগারেট খাবে।”
তিথি আমার কথা শুনে কৌতূহল দৃষ্টিতে বললো, “কিন্তু এমনওতো হতে পারে যে কালকে দিনের বেলাতেই কেউ সিগারেটগুলো খেয়ে ওখান দিয়ে যাওয়ার পথে ফেলে রেখেছে। আমার তো মনে হয় এটা আসলেই জ্বীনদের কাজ।”
“সিগারেটের বিষয়টা হয়তো তোর কথা কিছুটা সত্য তবে এটা যে জ্বীন ভূতের কাজ সেটা মানতে আমি এখনই নারাজ। তবুও বাড়িতে যেহেতু কিছুদিন আছি দেখি রহস্য উদঘাটন করতে পারি কিনা।”

তিথির সাথে টুকটাক আরো কিছু কথা বলে বাড়িতে চলে আসলাম।
বাড়িতে আসতেই শুনি বাবার শরীরে নাকি প্রচন্ড জ্বর ঝেঁকে বসেছে। বাবার রুমে নিজ হাতে ঔষধ আর পানি নিয়ে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখে তিনি উঠে বসার চেষ্টা করতেই আমি তাকে আরো কিছুটা সাহায্য করলাম বসার জন্য। তখনি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করি, “আচ্ছা আব্বা সেইদিন রাতে তোমার সাথে কি হয়েছিল খুলে বলোতো।”
তিনি দুর্বল স্বরে বললেন, “বিশ্বাস কর জীবনের এই এতোগুলা বছরে কোনোদিন কোন জ্বীন-ভূতের অস্তিত্বও পাই নাই। অনেক লোকই কইতো শিয়ালপাড়ার ঐ বাঁশঝাড়ের থেকে নাকি সাদা কাপড় পরা এক মহিলারে বাইর হইয়া আসতে দেখছে অথচ আমি আজ পর্যন্ত কিছুই দেখি নাই। উল্টা সেদিন টর্চ লাইট নিয়া গেছিলাম ক্ষেতের অবস্থা দেখতে। যহনি দেখা শেষে ক্ষেতের আইল দিয়া হাঁটা ধরি তখন হঠাৎ কইরাই পেছন থেকে কেউ আমার মুখ চাইপা ধরলো। এরপর আর কিছু মনে নাই। পরে নাকি তোর মায় আর ঐ বাড়ির সবুজ সাদেক আমারে ক্ষেতের পাশেই কুয়ার মধ্যে অর্ধেক গাড়াইননা অবস্থায় পায়।”
“তোমার কি এইটা জ্বীন ভূতের কাজ মনে হয়?”
“জানিনারে বাজান! তোর চাচাগো বাদে আমার সাথেতো আর কারো শত্রুতা নাই। এখন দেখি তোর চাচারও নাকি একই অবস্থা।”

বাবার সাথে আরো টুকটাক কথা বলে তার রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।

রাত ২টা…
হঠাৎই অচেনা নাম্বার থেকে কারো ফোন পেয়ে বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। কোনো রকম ফোনটি রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ভয়ার্ত স্বরে তিথি বলে উঠলো, “রাফি ভাই! সবরুল চাচা সেই এশার নামাজের পর থেকে বাড়ি ফিরে নাই। তার নাম্বারে কল দিয়াও চাচি বন্ধ পাইতেছে। তুমি একটু দেখবা কিছু করা যায় কিনা? আব্বাও তো অসুস্থ নাহলে তিনিই যাইতো তার খোঁজ করতে। আমি অনেক কষ্টে তোমার নাম্বারটা জোগাড় কইরা তোমারে কল দিছি।”
তিথির কথায় সাথে সাথে আমার ঘুম উবে গেলো। আমি উৎকন্ঠা নিয়ে বললাম, “আচ্ছা দাঁড়া আমি এখনি দেখতেছি।”

অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই গভীর রাতে চাচাকে কোনো জায়গাতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীর অনেকেই সন্দেহের বশে সেই শিয়ালপাড়ার জমিতেও খোঁজ লাগিয়েছে কিন্তু অবাক করা বিষয় সেখানেও তার কোনো খোঁজ নেই।
ভোরের সূর্য যখন পূর্বাকাশে কিছুটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ঠিক তখনি সাদেক আমাকে ফোন দিয়ে বলে, “মারুফ ভাই! চাচারেতো পশ্চিম পাড়ার খালে কাঁদার মধ্যে গাড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসেন।”
সাদেকের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই ঠিক তখনি আমার গতকালকের সেই কালু কবিরাজের কথা মনে পরে যায়। সে বলেছিল আমাদের বংশের সকলকে নাকি জ্বীন ধ্বংস করবে। তাহলে কি এটা সেই অভিশপ্ত জমির দোষ নাকি আমাদের বংশের মধ্যেই জ্বীনের কোনো কুনজর পরেছে?…

।। ৩ ।।

ভোরের সূর্য যখন পূর্বাকাশে কিছুটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ঠিক তখনি সাদেক আমাকে ফোন দিয়ে বলে, “রাফি ভাই! চাচারেতো পশ্চিম পাড়ার খালে কাঁদার মধ্যে গাড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসেন।”
সাদেকের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই ঠিক তখনি আমার গতকালকের সেই কালু কবিরাজের কথা মনে পরে যায়। সে বলেছিল আমাদের বংশের সকলকে নাকি জ্বীন ধ্বংস করবে। তাহলে কি এটা সেই অভিশপ্ত জমির দোষ নাকি আমাদের বংশের মধ্যেই জ্বীনের কোনো কুনজর পড়েছে?
এতসব ভাবনা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার পরক্ষণেই আমি রওনা দিলাম পশ্চিম পাড়ার খালের দিকে।

আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিকের অংশটুকুকেই মূলত গ্রামবাসী সহজ ভাষায় পশ্চিম পাড়া হিসেবে আখ্যায়িত করে। পশ্চিম দিকের ঐ অংশটায় তেমন কারো আবাসস্থল না থাকলেও জায়গাটি বেশ পরিচ্ছন্ন আর তার পাশ ঘেঁষেই চলে গেছে একটি ছোটখাটো খাল। ছোটবেলায় কত যে এই খালে সমবয়সী ছেলেপেলেদের সাথে গোসল করেছি তার কোনো হিসেব নেই। গ্রামের বাজারে যেতে হলে আমাদের ঐ খালের পাশের রাস্তা দিয়েই হেঁটে যেতে হয়। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে সবরুল চাচা সন্ধ্যার দিকে বাজার থেকে আসার পথেই ওনার সাথে এই অঘটন ঘটেছে।

পশ্চিম পাড়ার রাস্তা দিয়ে যখন তাড়াহুড়ো করে হেঁটে কাঙ্ক্ষিত স্থানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি ঠিক তখনি খেয়াল করলাম সবুজ ও সাদেক সহ আরো কিছু লোক কাঁদামাখা অবস্থায় সবরুল চাচাকে রাস্তায় উঠিয়েছে। আমিও আর একমুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য মূর্ছা যাওয়া সবরুল চাচাকে একহাত দিয়ে ধরলাম। হাঁসফাঁস স্বরে সবুজকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে চাচাকে কি অবস্থায় পেলি। ওনার শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিকঠাক মতো চলছেতো?”
আমার কথা শুনে সবুজ উৎকণ্ঠিত স্বরে উত্তর দিলো, “শ্বাস প্রশ্বাসতো আছে! আর খালের কিনারায় চাচারে জ্বীনেরা অর্ধেক কাঁদার মধ্যে গাইড়া রাখছিল। করিম চাচার ছোটপোলায় সবার প্রথমে চাচারে দেখছে।”
আমি চিন্তিত স্বরে বললাম, “হুম বুঝছি! এখন চাচারে যতদ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তুই দেখ কোনো ভ্যান ঠিক করা যায় কিনা।”
“আচ্ছা আমি দেখতেছি। আপনারা ওনারে নিয়া আসেন।”
এই বলেই সবুজ হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো।

কামরুল চাচা এখন কিছুটা সুস্থ হলেও সবরুল চাচাকে বেশ অর্ধ মুমূর্ষু অবস্থাতেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বে থাকা ডাক্তার বলেছেন,
“উনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনারা ওনাকে নিয়ে যেতে পারেন।”
ডাক্তারের কথা মতো আমরাও চিন্তা করলাম ঘরোয়া ভাবে চিকিৎসা দেওয়ার থেকে উত্তম আর কিছু হতে পারে না।

বহুবছর পর আব্বা তার সৎ ভাইদের বাড়িতে এসেছেন। তিনি হয়তো অনুধাবন করতে পারছেন যে বিপদ যেহেতু সব ভাইদের একত্রে এসেছে তাই এই মুহূর্তে অযথা পারিবারিক কলহকে পুঁজি করে ভাই ভাইয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিৎ হবে না। আমার আপন ছোট চাচা সগীর চাচাও এসেছেন কামরুল চাচার বাড়িতে। সব ভাইদের একত্রে দেখে অজান্তেই আমার মনটা খুশিতে আন্দোলিত হলো।
বাবা অনেকটা ইগোর বশেই নিজে থেকে কামরুল চাচার সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলছেন না। তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখলাম না। নীরবতা ঠেলে সকলের উদ্দেশ্যে আমি বললাম, “এখন ভাই ভাইয়ের প্রতি কোনো রাগ পুষে না রেখে আমি মনে করি সকলের এক হওয়া উচিৎ এবং এসব ঘটনার পিছনে কে কলকাঠি নাড়ছে সেটাও বের করা উচিৎ।”
আমার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে আমার চাচাতো বোন তিথি বললো, “হ্যাঁ! রাফি ভাই ঠিক কইছে। আপনারা তো অনেক জায়গা জমি নিয়া কেস মামলা শালিশ করছেন এমনকি এক ভাই আরেক ভাইকে মারতেও চাইছেন। এখন এই বিপদের মুহূর্তেও কি আপনারা একজনের প্রতি আরেকজন রাগ কইরা থাকবেন?”
এক এক করে আমার মা চাচিরা এমনকি ছোট চাচাও তাদেরকে সবকিছু ভুলে এক হতে বললো।
সকলের কথা শুনে ঘরের মধ্যে এক শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে, আমার আব্বা কিংবা কামরুল চাচা কেউই কোনো কথা বলছেন না। আচমকাই নীরবতা ঠেলে কামরুল চাচা অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন,
“সেটা না হয় আমরা মিললা গেলাম, কিন্তু এই জ্বীন ভূতের কাজরে তোরা কিভাবে থামাবি? এমনকি সেদিন নাকি কালু কবিরাজরে অপমান কইরা বাইর কইরা দেওয়ার সময় নাকি সে কইছিলো আমাগো বংশের সবাইরে জ্বীন ভূত ধ্বংস করবো। আমার মনে হয় সেদিন তোগো ওরে তাড়াইয়া দেওয়া ঠিক হয়নাই।”
কামরুল চাচার কথা শুনে আমি বললাম, “এটা জ্বীন ভূতের কাজ নাকি মানুষের কাজ সেটা সময়মতোই টের পাবেন। বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দেন। তাছাড়া জ্বীন ভূতেরতো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে সে সামনে না এসে পেছন থেকে মানুষের মুখ চাপ দিয়ে মাটির মধ্যে গেড়ে রাখবে। জ্বীন ভূতে কি মানুষের সামনে আসতে ভয় পায় নাকি?”
আমার কথা শুনে সবাই আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। তখনি আমার বাবা বললো, “হুম এইটাতো ঠিক কইছোস। কিন্তু আমাগো সাথে কার এমন শত্রুতা যে যেইখানে সেইখানে আমাগো অজ্ঞান কইরা কাঁদার মধ্যে গাইড়া রাখে?”
আমি নির্লিপ্ত স্বরে বললাম, “যেহেতু টানা তিন রাতে আপনাদের তিন ভাইয়ের উপর হামলা হয়েছে সেহেতু আজকে রাতেও হামলা হবে আর সেটা সগীর চাচার উপরে।”
আমার কথা শুনে সবাই হকচকিয়ে উঠলো। তখনি তিথি কৌতূহল দৃষ্টিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে এখন কি করার?”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “সব প্ল্যান ঠিকঠাক করা আছে। সবকিছু এখন বলা যাবে না। সময় মতোই টের পাবি।”

রাত ১০টা…
সগীর চাচা গঞ্জের বাজার থেকে বেশ কিছু বাজার করে পশ্চিম পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। তার মনের মধ্যে এক অজানা ভয় বাসা বেঁধেছে কারণ গত তিন রাতে তার তিন ভাইকে জ্বীনেরা অজ্ঞান করে কাঁদার মধ্যে গেড়ে রেখেছিল। মনে মনে বলছেন, “আজকে আসতে যে এতো রাত হবে সেটা জানলে কখনোই বাজারে যেতাম না।”
এরকমই বিড়বিড় করে রাস্তা দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎই তার পিছনে শুকনো পাতার কড়মড় শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ান পাশাপাশি তার বুকের গহীনেও ভয়ের মাত্রায় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পিছনে ঘুরতেই খেয়াল করেন কেউ নেই। মনের ভুল ভেবে যখনই পুনরায় হাঁটা ধরেন তখনই পেছনে পুনরায় পাতার কড়মড় শব্দ আরো তীক্ষ্ণ হতে থাকে। হঠাৎ করে পেছনে তাকাতেই খেয়াল করেন এই পূর্ণিমার আলোতে দুটো আবছায়া পাশের এক গাছের ওপাশে নিজেদের আড়াল করে ফেলেছে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “কেরে ঐখানে?”
কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিনি মনের মধ্যে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে সেই আবছায়ার অস্তিত্ব খোঁজার জন্য সেদিকে পা বাড়ান। যখনই গাছের কাছাকাছি চলে আসেন ঠিক তখনি একটি আবছায়া দ্রুত গতিতে তার দিকে ধেঁয়ে এসে তার মুখে কিছু পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই তিনি নিজেকে যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ছায়া মানব দুটো তার এমন প্রচেষ্টা দেখে তারাও থেমে থাকেনি বরং তারা পুনরায় তার দিকে ধেয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই রাস্তার দুইপাশ থেকে বেশ কিছু লোক লাঠি-সোঁটা নিয়ে ছায়া মানব দুটোকে ঘিরে ফেলে। আচমকাই এমন কান্ড দেখে ছায়া মানব দুটো হতভম্ব হয়ে যায় এবং পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
আমি হাতে থাকা টর্চলাইটটি নিয়ে দুইজনের সামনে চলে আসি। এতক্ষণে আগত সবাই বুঝতে পেরেছে এই কদিনে আমার বাপ চাচাদের সাথে যা কিছু ঘটেছে তা কোনো জ্বীনের কাজ নয় বরং জ্বীন রূপী মানুষের কাজ।
ওদের মুখ থেকে পেঁচানো গামছা দুটো সরাতেই আশেপাশের সকলেই অবাক চিত্তে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ কিভাবে সম্ভব? শেষ পর্যন্ত কিনা…

সকাল ৮টা…
সেই জ্বীনরূপী মানুষ দুটোকে কামরুল চাচার উঠোনের মোটা দুটি খুঁটির সাথে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে সমস্ত গ্রামে জ্বীন ধরার তথ্য ছড়িয়ে পরেছে। তাই এদেরকে দেখার জন্য গ্রামের শিশু থেকে বুড়ো অবধি কেউ বাদ থাকছে না। উঠোনে মানুষের আনাগোনা দেখে যে কেউই বলবে এ যেন এক বড় কোনো সমাবেশ।
পাশ থেকে গ্রামের এক মুরব্বি বললেন, “ছি ছি ওগোরে মানুষ কত বিশ্বাস করতো আর ওরা কিনা এই আকাম করলো? কালুর কাছ থেকে গত পাঁচদিন আগেও বাত ব্যথার একটা তাবিজ নিছি। এই তাবিজ এখন কেমনে হাতে রাখি তোরাই ক।”
এই বলেই তিনি তার হাতে থাকা তাবিজটি ছিড়ে ফেলে দিলেন।
আগত সবাই আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীরবতা ঠেলে আমি সকলের উদ্দেশ্যে বললাম, “আপনাদের মনে নিশ্চই প্রশ্ন জাগছে যে কালু কবিরাজের সাথে আমাদের কি শত্রুতা আর ওর সাথেরজনই বা কালু কবিরাজের সাথে কি করছে? ওর দিকে আপনারা একটু ভালো ভাবে তাকানতো! দেখেন চিনতে পারেন কিনা?”
হুট করে কামরুল চাচা বলে উঠলেন,
“আরে এইটাতে সেই ভুয়া কবিরাজ যারে গতবার আমরা চার ভাই মিললা দুই নাম্বারি করার জন্য গ্রাম থেকে পিটাইয়া তাড়াইয়া দিছিলাম।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “হুম চাচা ঠিক ধরছেন। আর ঐ হারামজাদাই হলো কালু কবিরাজের ভাই। মূলত ওর অপমানের প্রতিশোধ নিতেই কালু কবিরাজও ভুয়া কবিরাজগিরি করার জন্য এই গ্রামে আসে। আর আমাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আপনাদেরকে প্রতিরাতেই ক্লোরোফরম দিয়ে অজ্ঞান করে কাদার মধ্যে গেড়ে রাখে। যাতে আমরা বিশ্বাস করি এটা জ্বীন ভূতের কাজ আর সেই উসীলায় কালু কবিরাজ আমাদের থেকে টাকা মারার ধান্ধা করতে পারে। মূলত কালু ওর ভাইয়ের মতো বোকা না হওয়ায় এবং ধূর্ত প্রকৃতির হওয়ায় ওর দুই নাম্বারি গ্রামের সহজ সরল মানুষজন ধরতে পারেনি।”
আমার কথা শুনে ইতোমধ্যে আগত সকল মানুষদের মাঝে কথোপকথন শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে ওদেরকে এখানে বেঁধে রাখতে, আবার কেউ বলছে হাত পা ভেঙ্গে দিতে আর কেউবা বলছে জরিমানা এবং মার দিয়ে ওদেরকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু আমি গ্রামবাসীর এই মতের সাথে একমত নই তাই তৎক্ষনাৎ পুলিশকে ফোন দিয়ে এদেরকে থানায় নিয়ে যেতে বলি। কারণ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে যদি নিজেরাই আবার কোনো অঘটন করে ফেলি তখন হতে পারে অন্য বিপদ।

উক্ত ঘটনার দুইদিন পর…
কামরুল চাচার বাড়িতে আজ আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। কারণ তিনি ভাইদের মিলনমেলা উপলক্ষে একটি খাসি জবাই দিয়ে আমাদের সকলকে দাওয়াত করেছেন। খাওয়াদাওয়া শেষে যখন একসাথে বসে সবাই রেষ্ট নিচ্ছি তখনই তিথি ভিতরের ঘরে থেকে পানের থালা নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করে। সেসময় কামরুল চাচা আমার বাবার উদ্দেশ্য শান্ত স্বরে বললেন, “তোর কাছে আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই যদি তুই কিছু মনে না করোস।”
বাবা কৌতূহল দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের প্রস্তাব?”
“আমি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া কিছু বলি না সেটা তুই জানোস এইখানে যেহেতু সবাই আছে তাই কইতাছি, আমি চাইছিলাম আমার মাইয়ার লাগে তোর পোলার বিয়া দিতে যদি তোর মতামত থাকে।”
চাচার কথা শুনে সকলেই বেশ অবাক হয়ে যায়। বাবা শান্ত স্বরে বললেন, “আমার মতামত নিয়া কি হইবো? আমার পোলা যদি রাজি থাকে তাইলে আমার কোনো দ্বিমত নাই।”
তখনি সকলে আমার দিকে তাকায় এমনকি তিথিও তাকিয়ে আছে অনেকটা মায়ামাখা দৃষ্টিতে। হয়তো মেয়েটি আমার মুখে হ্যাঁ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম, “আমার কোনো আপত্তি নাই।”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিথি লজ্জায় দৌড়ে বসার রুম ছেড়ে চলে গেলো। তখনই আমার মনে হলো, হায় হায় এই মুরব্বিদের সামনে এতোটা তাড়াতাড়ি আমি কিভাবে সম্মতি দিয়ে ফেললাম? সবাইতো ভাববে আমি তিথিকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে আছি।
“ধুর!” এটাকি ঠিক হলো? বলুনতো!


লেখক পরিচিতি : মোঃ নিয়ামুল ইসলাম
MD Neyamul islam

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।