লেখক : শুভাণ্বিতা রায়
সকাল সাড়ে ৮টা।ছেলে বউ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।বৃদ্ধা মা ছেলের ঘরের দরজায় কয়েকটা টোকা মারলেন। ও! ও! বৌমা ওঠ! ঘরের কাজ পড়ে আছে যে!
অনেকক্ষণ ধরে টোকা মারার পর নীলার ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে শ্বাশুড়িকে দেখেন।
নীলা বলেন “ মা এখানে!”
শ্বাশুড়ি : “কত বেলা হয়ে গেল , রাতের এঁটো বাসন পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি মেজে ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাবুকে নিয়ে বাপের বাড়ি যা।তোমার মা কত যত্ন করবে, কত সেবা করে খাওয়াবে।”
―“কোনো ত্রুটি যেন না থাকে। আজ জামাই ষষ্ঠী।”
শুনে নীলার চোখে জল আসে।তার মনে প্রশ্ন কেন আমার মা অসীমকে সেবা করবে, আমার মায়ের আদর খাবে। অসীম শ্বশুর বাড়িতে থাকে না। আমার বাবা ও মা কে দেখেন না। তাহলে???
আর আমি শ্বাশুড়ির সেবা করি বাড়ির প্রতিটা কাজে সেবা করি ।আমার ভাগ্যে শুধুই গঞ্জনা???
ভাবতে ভাবতে নীলার চোখে জল আসে। পাশ থেকে শ্বাশুড়ি দেখে বলেন
―“ কি হলো নীলা।দরজায় ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন?? বাবুকে ডাকো ।নিজের কাজ করো ।আশচর্য তো ! তোর বয়সে আমি কি করি নি?? বাচ্চা পেটে নিয়ে সব কাজ করেছি।কি ভাবিস কি! তুই!”
আর না দাঁড়িয়ে নীলা অসীমকে ডেকে নিজের কাজে যায়। এবার আসা যাক আসল কথায়…
অসীম সরকার।কলকাতার সেক্টর অফিসে কর্মরত।একসময় বাবা মাকে নিয়ে কোচবিহারের এক গ্রামে থাকতেন।সেখানেই পড়াশুনো।উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নীলার সাথে আলাপ।তারপর প্রেম, এরপর প্রেমের পরিণতি বিবাহে।কলকাতার চাকরি পাবার পর বাবা মা স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন গড়িয়াতে। ছোট্ট ফ্ল্যাটে তার সংসার। বছর দুয়েক পর বাবা মারা যান স্ট্রোক হয়ে।এখন মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার।বিয়ের পাঁচ বছর হলো।বাচ্চা কাচ্চা না হওয়ায় শ্বাশুড়ির বাঁকা মন্তব্য নীলাকে শুনতে হয়।এই নিয়েই সংসারে অশান্তি।
নীলা ফ্রেশ হয়ে আসে।দেখে অসীম টেবিলে বসে পেপার পড়ছে।পাশে মা বসে আসে।নীলার নামে কত কি বলে চলছে, সেই দিকে অসীমের মনোযোগ নেই। চোখ পেপারের দিকেই। নীলা রান্না ঘরে গিয়ে সবার জন্য চা করে এনে পরিবেশন করে টেবিলে বসে।চায়ে চুমুক দেবার আগেই শ্বাশুড়ির তির্যক মন্তব্য আসে।
“এ কেমন বউ? পোয়াতি হয়নি।বাচ্ছা নিতে পারেনি? ক’দিন বাঁচবো নাতির মুখটা দেখতে পাবোনি।যত নষ্টের গোড়া।
মান সম্মান নষ্ট করে দিলো গো বাবু। মেয়েটাকে বাপের ঘরে রেখে আয় ।নাক্যা চন্ডী।
বউ গেলে বউ পাওয়া যায় রে বাবু! ”
নীলা শুনে কাঁদতে থাকে। শ্বাশুড়ি বলেন “বাপের ঘর যাওয়ার জন্য রেডি হসনি কেন? বেরা জলদি।এই বোঝাটাকে বাপের ঘরে রেখে আয় তো! বাপ মরা ছেলের সুখ আনতে পারেনি।হায়! হায়!”
অসীম বলে উঠে বলো কি মা! এই সব রাখো। আজ লকডাউন।বাস গাড়ি বন্ধ।শ্বশুর বাড়ি যাবো কি ভাবে??
অসীমের মা বলে গাড়ি ভাড়া করে না।
মা পুলিশ পিটবে।বিনা কারণে বাইরে বেরোনো নিষেধ আছে মা। অসীম বলল।
অসীমের মা কুহু কপালে হাত দিয়ে চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন “ হায়! হায়! ছেলেটা কত আদর পেত, কব্জি ডুবিয়ে খেত ইলিশ মাছের ঝোল, মাছের ঝাল,পাঁঠার মাংস আরো কত কী? সবই গেলো! এই বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।অসীম বলেন “অকারণে কাঁদছো কেন? কীরকম কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছি মা। দিনকাল বড্ড খারাপ। সবাই সুস্থ হোক। একদিন খুব ভালো করে উপভোগ করবো। এখন এই খাবারের মেনুগুলো বাড়িতেই রান্না করে খেয়ে উপভোগ করি। খুব মজা হবে, নীলার রান্নার হাত খুব পাকা ! আমি বাজার করে আনি।”
কুহু কেঁদে বলে বেয়ানের ভালোবাসা পেলি না তো!
―বাড়িতে নীলা আছে তোমার কত সেবা করে। ভালোবাসা পায় কি?” বলল অসীম।
শুনে কুহু ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে “পরের মেয়ে কিসের আবার ভালোবাসা? বউ হয়ে এসেছে ঘরে কাজ করবে আর খাবে। বাচ্চার জন্ম দিতে পারেনি।”
অসীমের মাথা খারাপ হয়ে যায়।বিরক্ত হয়েও শান্ত স্বভাবে বলে “কোনো সমস্যা আছে হয় তো বাচ্চা না হবার।সমস্যা জানতে হবে।তবে এখন এই সব থাক তো! নীলা এই বাড়িতে থাকে।এই বাড়ির লোক।পরের ঘরের মেয়ে কে বললো? তোমাকে মা বলে ডাকে।মায়ের মত সেবা করে। মেয়ের মতন। রক্তের সম্পর্ক সব কিছু নয়। ভালোবাসা, স্নেহ, মায়ায় রক্তের সম্পর্ক না থাকা পর ও আপন হয়ে ।”
নীলাও অসীমের কথা শুনতে পায়। কঠিন সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। সেখানে অসীমের মতন স্বামী কঠিন পরিস্থিতিকে সহজ করে তুলতে পারে।স্বামীর এই কাজের জন্য নীলার গর্ব হয়।
এদিকে কুহু বলে চলেছে “নীলা আমার আদর পাবে আর আমার ছেলে কী পাবে?”
অসীম হেসে বললো “আজ আমি নীলা দুজনে তোমার হাতে খাবো। তুমি খুশি মনে নিজের হাতে খাইয়ে দাও এতেই দু জনেই অনেক ভালোবাসা পাবো। অনেক চাওয়া হয়ে যাবে।”
অসীম বাজার করে আনে।নীলা ও তার শ্বাশুড়ি রান্নার কাজে হাত লাগায়।রান্না শেষ হলে এক টেবিলে কুহুর দুই দিকে নীলা ও অসীম বসে।
মা তুমি নীলাকে খাইয়ে দাও।
কুহু নীলাকে খাওয়ায়।
এবার মা তুমি আমাকে খাওয়াও।
কুহু অসীমকে খাওয়ায়। এরপর দুইজনে কুহুকে খাইয়ে দেয়। আনন্দে কুহুর চোখ দিয়ে জল বেরোয়।
কুহু বলে “ আমি বুঝেছি ছেলে কি মেয়ে সে যতই পরের হোক না কেন সেবা যত্নে সে নিজের ছেলে মেয়ে হয়। রক্তের টান লাগে না রে। রক্তের টান থাকলেও কত মায়ের ছেলে মেয়ে বিদেশে থাকলেও মায়ের অসুস্থতার সময় দেশে ফিরতো বা নিজের কাছে নিয়ে যেত। কিন্তু তারা আসে না। তারা ছেলে মেয়ে নয়। আমারই দোষ! বউমা কাছে থাকলেও কোনো আদর পায়নি।আজ জামাইষষ্ঠী নয়, বৌমাষষ্ঠী পালন করবো।”
নীলা তার শ্বাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে। এই সংসারে শুধু বৌমার উপস্থিত বুদ্ধিতে যখন মানিয়ে নেওয়া যায় না তখন অসীমের মতন স্বামীরাই সমস্যার সমাধান করে দেন।
আজ জামাইষষ্ঠী নয় নীলার শ্বাশুড়ি বৌমাষষ্ঠী পালন করলেন।বললেন “নীলা আমার মেয়ে।”
লেখক পরিচিতি : শুভাণ্বিতা রায়
পূর্ব মেদিনীপুর এর মেয়ে।শিক্ষকতা করি।গল্প ও কবিতা লিখতে ভালোবাসি।
চমৎকার লেখনী। শাশুড়ি বৌমার মিলনান্তক গল্প পড়ে ভালো লাগলো।