লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
দুপুরের পর থেকেই আজ ঝড় উঠেছে বেশ জোরে। ঝড়ের পূর্বাভাস অবশ্য আগে থেকেই ছিল। বাইরেটা ধুলো উড়ছে প্রচণ্ড। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। আমি দোতলার জানলাগুলো বন্ধ করছিলাম, তখনই খেয়াল করলাম নীলিমাকে। বারান্দায় রেলিং ধরে উদাস দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আমি জানি কেন আজ উদাস ও। বৃষ্টি আসার আগের গন্ধটা আসছে এখন। বাতাস এই গন্ধটা বয়ে আনলেই ওর মনে একটা ছটফটানি শুরু হয়ে যায়। আর বৃষ্টির ফোঁটা! তার ছোঁয়ায় কি হয় নীলিমার, দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে।
সেদিন আমরা বাড়ি ফিরছিলাম একসাথে। রাস্তার ধারে ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম আমরা। তখন বিকেল প্রায় শেষের দিকে। বৃষ্টি আসার আগের গন্ধটা অনেকক্ষণ আগেই এসেছিল আমাদের নাকে। তখনই খেয়াল করেছিলাম ওর ভেতরের ছটফটানি।
“আজ বৃষ্টিতে ভিজব”, আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে আবদার করেছিল ও। উত্তরে আমি ছাতাটা খুলে দুজনের মাথার ওপর ধরেছিলাম। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি ততক্ষণে চালু হয়ে গিয়েছিল। রাগের মুখ করে আমার দিকে তাকিয়েছিল ও। মনে মনে হাসছিলাম আমি। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ক্রমশ বড় হচ্ছিল। সেইসঙ্গে বাড়ছিল নীলিমার মনের ছটফটানিটাও। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল। বৃষ্টির ছোঁয়ায় ওর আনন্দটা চোখে-নাকে-ঠোঁটে স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছিল। এই জায়গাটায় এলে আমার রাগ হত। বৃষ্টির ওপর আমার তখন রাগ হত খুব। কি সুন্দরভাবে ওকে ছুঁয়ে যায়। আর আমি ছুঁতে গেলেই ও বাধা দিত। বাধা দিয়ে হেসে বলত, “বিয়ের পর”। আমি হতাশ হতাম। সেদিন বৃষ্টিকে আবার ওকে ছুঁতে দেখে ছাতাটা বাড়িয়ে ধরছিলাম বারবার। ও বেশ রেগে যাচ্ছিল। রাগ বাড়ছিল ধীরে ধীরে। সাথে বাড়ছিল বৃষ্টির দাপটও। বৃষ্টির সেই দাপটে বাড়ছিল ওর ছটফটানি। আর ওকে ওভাবে দেখে বাড়ছিল আমার দুষ্টুমি। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ ও থেমে দাঁড়াল। আমার হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল রাস্তার ওপর।
ওর এমন কাজে আমি তো অবাক। কারণ ও যে কোনও কিছুই খুব ভেবেচিন্তে করে। এরকম পাগলামো সচরাচর ও করে না। ও বৃষ্টি ভালবাসে জানতাম। কিন্তু বৃষ্টির জন্য যে পাগল, সেটা সেদিন জানলাম। অবাক হয়ে ওকেই দেখছিলাম। আর ও? আমায় এমন অবাক দেখে সে কি হাসি! একেবারে প্রাণখোলা সে হাসি। ওকে অমন হাসতে দেখে আমিও হেসে ফেললাম। ও তখন আমার কাছে এল। ছাতাটা তখনও পড়ে ছিল রাস্তার ওপরেই।
হাসি থামতে ওর খেয়াল হল ছাতাটার কথা। একটু লজ্জিতও হয়েছিল। ছাতাটা কুড়োতে ফুটপাথ থেকে নেমে গেল রাস্তায়। তখনই একটা গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছিল। ও সেটা না খেয়াল করলেও আমি করেছিলাম। ছাতাটার কাছে ও পৌঁছনোর আগেই ওকে আমি টেনে নিলাম ফুটপাথে। ছাতাটাকে ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেল গাড়িটা। আর বৃষ্টির জলের সাথে রাস্তার জলেও ভিজিয়ে দিল আমাদের।
নীলিমার কনুইদুটো ধরা ছিল আমার হাতে। দুজনেরই বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছিল বেশ। তবে ধীরে ধীরে ওরটা শান্ত হচ্ছিল, আর আমারটা হচ্ছিল অশান্ত। অবশভাবে আমার চোখ-নাক-ঠোঁট এগিয়ে যাচ্ছিল ওর দিকে। ও বাধা দিয়ে বলেছিল, “কি করছ! বলেছি না বিয়ের পর!”
নীলিমার কনুইয়ের স্পর্শে সম্বিৎ ফিরল আমার। আমার স্পর্শে সম্বিৎ ফিরল ওর।
“তুমি!” চমকে উঠে বলল ও। বাইরে তখন বৃষ্টি বেশ জোরেই চালু হয়ে গেছিল। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল ওর। আমায় প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল, “এমা! সরো সরো! শুকনো জামাকাপড়গুলো ছাদেই মেলা আছে! সব ভিজে যাবে! ইসস!” বলতে বলতেই ছাদের দিকে প্রায় দৌড় লাগালো নীলিমা। পেছন পেছন ধীরে-সুস্থে আমিও উঠলাম ছাদে।
ছাদের দরজার একটা পাল্লা ভেজানো আর একটা খোলা ছিল। ওর দৌড়ে আসার ফলে এমন হয়েছে। দরজাটা ঠেলে ঢুকতে বৃষ্টিটা গায়ে লাগল আমার। নীলিমার দিকে চেয়ে দেখলাম সব জামাকাপড় এখনও তোলা হয়নি। মাথায় আঁচলটা টেনে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে নিজেকে। মনে মনে হাসলাম। বৃষ্টি এলে যে নীলিমা পাগল হয়ে যেত, সেই আজ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে নিজেকে! আসলে বিয়ের পর বদলে যায় অনেক কিছু। পরিবারের স্বার্থে নিজের অনেক ইচ্ছেই বিসর্জন দিতে হয়। বিশেষ করে মেয়েদের। নীলিমাও বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে বৃষ্টি থেকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে চলছে নিজেকে। কিন্তু বৃষ্টি বোধহয় অবিবাহিত। তাই নিজের ইচ্ছে পূরণ করতে তার বাধা নেই কোনও। ইতিমধ্যেই সে নীলিমাকে ভিজিয়ে দিয়েছে অর্ধেক।
বাকি ছিলাম আমি। মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছি কি করব। ছাদের দরজাটা বন্ধ করে হুড়কো দিয়ে দিলাম। ততক্ষণে নীলিমা কাপড়জামা নিয়ে এগিয়ে আসছে দরজার দিকে। কাছে আসতেই ওর থেকে সব জামাকাপড় নিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম দূরে। দুই হাতে ওকে বন্দী করলাম আমার বুকের মাঝে।
“কি করছ! ছা-আ” বাকি কথাগুলো আটকে গেল ওর ঠোঁটেই, কারণ আমার ঠোঁট তখন ডুব দিয়েছে তাতে। কথা ছিল বিয়ের পর ওকে ছুঁতে পারব আমি। ছুঁয়েওছিলাম নিজের মত করে। কিন্তু বৃষ্টিতে তো ছোঁয়া হয়নি কখনও। আজ সে কথা রাখার দিন। বৃষ্টির ওপর আমার আর রাগ নেই কোনও। আজ বৃষ্টি আমার বন্ধু, পরম বন্ধু। চারপাশটা সে ঝাপসা করে দিয়েছে। দূরে চক্কোত্তিদের বাড়ি, মনুদের বড় গাছটা, ল্যাম্পপোস্ট , বাচ্চুদের বাগান সব ঝাপসা হয়ে গেছে বৃষ্টিতে। বৃষ্টিভেজা নীলিমার চোখ-নাক-ঠোঁট আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।