লেখক : শিখা চক্রবর্তী
আসল নামটা তার গোবর্ধন। ডাক নাম গোবরা। ক্লাস সেভেনের ছাত্র সে। বাড়ি কল্যাণীতে। এই গল্পটা জানতে গেলে তার বাড়ির ব্যাপারেও কিছু বলতে লাগে।
গোবরার বাবার নাম প্রাণগোপাল, ডাক নাম পানু। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তিনি। আদি বাড়ি কৃষ্ণনগরে। গোবরার দাদু কল্যাণীতে চলে আসেন তাঁর বড় ছেলে লন্ডন চলে যাবার পর। ইতিমধ্যে তাঁদের মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে ব্যারাকপুরে। ঠাকুমার বাপের বাড়ি কল্যাণীতে। তাই গোবরার দাদু তাঁর স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে কল্যাণীতেই চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাস করতে। বি.কম. পাসের পর পানুকে কল্যাণী স্টেশনের কাছে একটা বিরাট স্টেশনারি দোকান করে দেন তাঁর বাবা, মানে গোবরার দাদু। সেইথেকে ব্যবসা নিয়েই পানু সবসময় ব্যস্ত থাকেন, এবং ওই দোকানই তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। এর কিছুদিন পর গোবরার দাদু ও ঠাকুমা অল্পদিনের ব্যবধানে ইহলোক ত্যাগ করেন।
গোবর্ধনের মা শান্তা। শ্রীরামপুরের খুব নামকরা এক বনেদি ঘরের মেয়ে। শ্যামলা রঙের হলেও তাঁকে দেখতে ভারি মিষ্টি। স্বভাবেও খুব ঠান্ডা মেজাজের। বেশি আদরে মানুষ বলে গৃহস্থালির সব কাজ ঠিক মত করতে পারেন না। গোবর্ধন তার বাবামায়ের মতই খুব শান্ত। স্কুলে যেতে সে বড় ভালোবাসে, কামাই করতে একদম চায়না। তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হলো অঙ্ক। মাধব উকিলের ছেলে ভোম্বল হ’ল তার প্রাণের বন্ধু। এই গোবরার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তাকে একটা বেড়াল ভীষণভাবে আঁচড়ে দিয়েছিল, যার জন্য তাকে পেটে ইনজেকশন নিতে হয়েছিল বেশ কয়েকটা। সেই থেকে ওই বেড়ালটাকে দেখলেই গোবরা ভয়ানক অস্বস্তি নিয়ে ওকে এড়িয়ে যেতে চায়। তার মাও ভয় পান ওটাকে দেখলে।
ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার পর হঠাৎ করেই এই গোবরার জীবন খুব ঘটনাবহুল হয়ে উঠল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে গোবরা দেখল, কাঁচা পাকা চুল, চশমা পরা, লম্বা মতো একটা লোক বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসে তার বাবা মায়ের সঙ্গে খুব জোরে জোরে কথা বলছে। সে আরও লক্ষ্য করলো যে তার বাবা মায়ের চোখমুখে খুব অস্বস্তি। তাকে দেখে লোকটা বলে উঠল, “এই ছোকরাটা কে রে পাঁচু? তোর ছেলে?” তার কথা বলার ধরণ দেখে রাগে গোবরার পিত্তি জ্বলে গেল। সে বেশ বুঝতে পারল যে তার বাবার নামটা লোকটা ইচ্ছে করে পানু না বলে পাঁচু বলছে। এরপর সে গোবরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা তোর নামটা কি রে ছোঁড়া? ঘেঁচু না পেঁচু?” বলেই হ্যা-হ্যা করে সে কি বিকট ব্যাঙ্গভরা হাসি। গোবরা অতিকষ্টে নিজেকে সামলে তার নাম, ডাকনাম সবই বলল। নামগুলো শুনে “গোবর, গবু, গবেট” এইরকম নানান নামে ও লোকটা তার দিকে আঙুল তুলে ডাকতে লাগল, বাবা মায়ের সামনেই। তার সেই হ্যা-হ্যা করা হাসির মুহূর্তে সেই বেড়ালটা না জানি কোথা থেকে এসে তাদের বারান্দায় হাজির হ’ল। সেটাকে দেখে গোবর্ধন এক লাফ দিয়ে প্রায় ছুটে তার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
লোকটা জিজ্ঞেস করল, “এ কি পাঁচু, তোমার ওই গবেটরাম ছেলে বেড়ালটাকে দেখে এমনটা করল কেন?” বারান্দায় তাদের মধ্যে যা কথা হচ্ছিল, সবই গোবরার কানে আসছিল। তার পেটে ইনজেকশন দিতে হয়েছিল শুনে লোকটা প্রায় অট্টহাসি হেসে উঠল, যেন পেটে ইনজেকশন নেওয়াটা খুব মজার ব্যাপার। বাবা মায়ের এরপরের নিচুস্বরের কথাগুলো আর তার কানে এল না।
সেদিন রাতে গোবরা ভাল করে খেল না। তার মা অনেক সাধাসাধি করে ব্যর্থ হলেন।
পরের দিন সকালে গোবরা যখন স্কুলে যাবে, সেই বেড়ালটা কোত্থেকে কে জানে তার ঘরের দরজার সামনে এসে ঘুরঘুর করতে লাগল। কিছুতেই সেখান থেকে সেটা আর সরে না। তার বাবা তখন বাজারে, আর মা গেছেন স্নানে। আর সেই লোকটা বারান্দায় তখন একভাবে বসে আছে, নড়ার কোনও লক্ষণ নেই তার। সামনে একদিকে বেড়াল আর একদিকে ওই লোক। গোবরা বিরক্তি নিয়ে আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো কাঁটা সাড়ে ১০টা র ঘর পেরিয়ে গেছে। ১১ টায় স্কুলের গেট পুরো বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে লেট হলে আর মাত্র পাঁচ মিনিটের স্পেশাল পারমিশন। গোবরার মন ভয়ানক অশান্তিতে ভরে উঠল। স্কুলে তার উপস্থিতির রেকর্ড খুব ভালো। আজ অবধি এমন ঝামেলায় তাকে কখনো পড়তে হয় নি।
ইতিমধ্যে মা স্নান সেরে ঘরে এসে দেখলেন তাঁর ছেলে ব্যাজার মুখে বসে আছে, স্কুলের পোশাক পরা। অবাক হয়ে মা জানতে চাইলেন, “কি রে? ইস্কুলে যাবি না?” ছেলে ইশারায় তাঁকে ঘড়িটা দেখালো। ১১ টা বাজতে দশ মিনিট বাকি। পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে দশ মিনিটের একটু বেশি ই লাগবে। সে যাবে টা কী করে?
ক্ষোভের সঙ্গে গোবরা তার মাকে এই কথা যখন বলছে, ঠিক তখনই তার বাবা ফিরলেন বাজার থেকে। ব্যাপার বুঝে তিনি বললেন, “শিগগিরী আমার সাইকেলে গিয়ে ওঠ।” তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার বাবা যেন এক পক্ষিরাজ ঘোড়ার মতো তাকে স্কুলে পৌঁছে দিলেন। ব্যাপারটা এমনভাবে হ,ল, যে গোবরার মনে হ’ল ঠিক যেন একটা গল্প। সে তো এটা আশাই করেনি। কপাল ভাল যে স্কুলে ঢুকতে সেদিন কোনও স্পেশাল পারমিশন লাগল না তার।
স্কুলে পৌঁছতে পেরে গোবরা বেজায় খুশি হলো। ওদিকে আসার সময় সে দেখেছে যে তাদের বাড়িতে নতুন আসা সেই লোক টা পাড়ার পানের দোকানে বসে খুব আড্ডা দিচ্ছে। গোবরা কে সে লক্ষ্যই করে নি।
টিফিনের সময় ভোম্বল এল, তার প্রাণের বন্ধু। একই ক্লাসে পড়ে, তবে দুজনের সেকশন আলাদা। গোবরা একে একে সব কথা শোনাল তার বন্ধুকে। সব শুনে ভোম্বল বলল, “লোকটাকে একবার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ও তোদের আরও জ্বালাবে, বুঝলি? সম্পর্কে তোদের কে হয় জানিস কি?”
গোবরা ঘাড় নেড়ে না বলল। “নামটাই তো এখনও জানি না ঠিক করে। মনে হয় বাবার দিকের অনেক দূরের কেউ হবে।”
“তুই যখন বাড়িতে থাকবি, লোকটার ওপর খুব নজর রাখবি। কিন্তু সাবধান , ও যেন একদম টের না পায়। আর কাকুর সঙ্গে আমার বাবার দেখা হওযার দরকার আছে, বুঝলি?”
ভোম্বলের কথায় গোবরা মাথা হেলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, একদম।”
ভোম্বলের সঙ্গে কথা বলে গোবরার মন খানিকটা হালকা হল, তার সঙ্গে সঙ্গে আবার একটু ভরসাও পেল সে। কারণ ভোম্বলের বাবা উকিল, আর উকিলদের মাথায় যে অনেক বুদ্ধি থাকে, গোবরা সে কথা শুনেছে তার বাবার কাছে।
এই লোকটা আসার পর থেকে তার শুধু মনে হচ্ছে যে বাবা মা তার একদম ভাল নেই। তাদের মুখে এরকম অশান্তির ছায়া সে আগে কখনো দেখেনি।।গোবরা ছোট বলে তাঁরা হয়তো তাকে সবটা বলছেন না। কিন্তু কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। এত আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসে,কই তাদের দেখে তো বাবামায়ের মুখের ভাব এমনটা হয় না!
পরের দিন আবার ঠিক ওই একই সময়ে বেড়ালটা এল, ঠিক গোবরা যখন ব্যাগ নিয়ে স্কুলে বেরোবে তখন। সেদিন তার বাবাকে অনেক আগেই দোকানে চলে যেতে হয়েছিল, তাই তাঁর সাহায্য পাওয়া গেল না। আর গোবরার মা অনেক চেষ্টা করেও বেড়ালটাকে ওখান থেকে তাড়াতে পারলেন না। তাড়াতে গেলেই ওটা তার মায়ের দিকে এমন ভাবে তেড়ে আসতে লাগল, যে সেই পেটে ইনজেকশনের কথা মা-ছেলে দু’জনেরই একসঙ্গে মনে পড়ে গেল। গোবরার সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হল না। অদ্ভুত ভাবে সেই সময়ে ওই বুড়োকেও কোথাও দেখা গেল না। সে দিনটাই নয়, এই রকম ব্যাপার আরও দু’দিন হলো। তার মাঝে অবশ্য একদিন গোবরার বাবা তাকে বুদ্ধি করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এলেন।
এর পর রবিবার এল। ছুটির দিন হওয়ার জন্য গোবরার স্কুল ছিল না। সেদিন যা ঘটল, সেও একটা কান্ড বটে! তাতে সবার চিন্তা আরও বেড়ে গেল।
সকালবেলার পড়াশোনা শেষ করে ভোম্বল এল গোবরাদের বাড়ি। গোবরার মা তখন লুচি তৈরিতে ব্যস্ত। আর সেই লোকটা যথারীতি বারান্দায় বসে। বারান্দার
ধারের একটা ঘরে তাকে থাকতে দেয়া হয়েছে। ভোম্বলকে দেখেই সে বলে উঠল, “এইটা আবার কে? আমাদের গবেটরামের বন্ধু নাকি? তা তোর নামটা কী রে ছোঁড়া? হাঁদুরাম না ভোঁদুরাম?” যথারীতি সেই তাচ্ছিল্যের সুর।
কিন্তু ভোম্বল একটুও বিরক্তি না দেখিয়ে খুব সহজভাবে বলল, “আমার নাম ভোম্বল, ভাল নাম প্রবাল। আমি গোবরার বন্ধু।” তারপর খুব অন্তরঙ্গ সুরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোমার নাম কি? কি নামে ডাকব তোমায়?”
ভোম্বলের এই প্রশ্ন শুনে লোকটা সরু চোখে তার দিকে চেয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর আবার সেই তাচ্ছিল্যের সুর, “ও তুই তো তাহলে অম্বল। তা এখানে কেন বাপ? বাড়ি গিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক গে যা। যা যা। গোবরার আর মাথা খেতে আসিস না। সাহস কত? আমার নাম জানতে চাওয়া হচ্ছে আবার! বলব না আমার নাম। কী করবি তুই শুনি?”
ভোম্বল কিছুক্ষণ একদৃষ্টে বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর আস্তে আস্তে বলল, “কি আর করব? বাড়ি গিয়ে তোমার কথা বলব বাবার কাছে। আর বাবা তখন আসবে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে। আর তখন তো তোমাকে তোমার নামটা বলতেই হবে। আর তাতেই আমি জেনে যাব, যে কি নামে তোমায় ডাকা যায়।”
“বটে, তোর বাবাকে গিয়ে বলবি? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। তোর বাবাকে গিয়ে বলা এখুনি বেরিয়ে যাবে।”
এই বলে লোকটা ভোম্বলকে মারবে বলে তার ডান হাতটা মাথার ওপর তুলতেই ভোম্বল সেকেন্ডের মধ্যে তার মাথাটা টুক করে সরিয়ে নিল, আর লোকটার সেই বিরাশি সিক্কার চড়টা গিয়ে সটান পড়ল তাদের সামনে রাখা সেগুন কাঠের চেয়ারটার ওপর। পুরনো দিনের ভারী চেয়ার। বারান্দায় রাখা এই চেয়ারটার ওপরেই লোকটা দু’দিন ধরে বসছে। সেটাকে ঘিরেই তিনজন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। নিরীহ চেয়ার খানা বিনাদোষে এমন একটা চড় খেয়ে সশব্দে সবেগে ভূলুণ্ঠিত হ’ল। সঙ্গে সঙ্গে ‘উরে ব্বাপ রে, উ: উ: বাপ রে বাপ রে’ বলে চিৎকার করতে করতে লোকটা প্রায় ছিটকে তার ঘরে ঢুকে গেল। গোবরা ভোম্বলের হাত চেপে ধরে বলল, “চল চল, আমরা ছাদে যাই,” এই বলে দৌড়ে দু’জনে ছাদে চলে গেল।
এদিকে আচমকা ওই রকম একখানা আওয়াজ শুনে ভেতরের ঘর থেকে গোবরার বাবা আর রান্নাঘর থেকে তার মা “কি হয়েছে, কি হয়েছে” বলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। কিন্তু দেখা গেল যে কেউ কোথাও নেই, শুধু চেয়ারটা চিৎপাত হয়ে বারান্দার মাঝখানে পড়ে আছে, আর বাইরে থেকে বারান্দায় ঢোকার মুখের দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের কাজের ঝি হারুর মা ঝাঁটা-বালতি হাতে শুধু হাঁচছে। পানুবাবুর দুই গাল বেয়ে শেভিং ক্রিমের ফেনা গড়িয়ে গড়িয়ে নামছিল, হাতে ব্রাশ ধরা। দু’চোখে জিজ্ঞাসা। আর গোবরার মা শান্তাদেবীর হাতে খুন্তি, লুচি ভাজছিলেন তিনি। ঠিক যেমন করে কোনও লোক কাউকে হাত দিয়ে “এস এস” বলে ডাকে, ঠিক তেমনি করে ক্রমাগত খুন্তি নেড়ে “বাইরে কেন? ভেতরে এস, ভেতরে এস” বলে হারুর মাকে তিনি ডাকতে লাগলেন। সেই ডাকে হারুর মা হাঁচতে হাঁচতেই ঘরে ঢুকল। কত্তা গিন্নি দুজনেই এবারে আবার একসঙ্গে বলে উঠলেন, “কি হয়েছে, কি হয়েছে?”
হারুর মা কোনওমতে বলল, “নতুন মেসোরে আজ আর লুচি দিবেন না। ওনার খুব অম্বল হইসে।” এইটকু বলেই সে কলঘরের দিকে চলে গেলো। গোবরার বাবা-মা পরস্পরের দিকে হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অগত্যা যে যার ঘরে ঢুকে গেলেন।
এর কিছুক্ষণ পরে সবার জন্যে লুচি তরকারি এলো। আর বাড়ির সেই অতিথির জন্যে এলো জল মুড়ি। ইতিমধ্যে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি আবার এসে বসেছেন সেই চেয়ারে। “আমায় জল মুড়ি কেন?” বলে তিনি ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলে গোবরার মা বললেন “আপনার নাকি খুব অম্বল হয়েছে, হারুর মা বলল। লুচি খাওয়া ঠিক হবে না এই অবস্থায়, তাই তো..”
তাঁর কথা আর শেষ হ’ল না, লোকটা হঠাৎ উঠে পায়ে চটি গলিয়ে রাগে গরগর করতে করতে বাইরে চলে গেল।
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় পাড়ার মিষ্টির দোকানের মালিক গোবরার বাবাকে রাস্তায় ডেকে জানাল যে ওই ভদ্রলোক নিজেকে পানুর বড় দাদা বলে পরিচয় দিয়ে সেদিন সকালে প্রচুর খাবার খেয়েছেন তার দোকানে বসে। পানুবাবু আর থাকতে না পেরে সেদিনেই গেলেন ভোম্বলের বাবার কাছে। সব শুনে তিনি বললেন, “আজ রাতেই আমি যাবো আপনাদের বাড়ি। যত ফ্যামিলি অ্যালবাম, সব খুঁজে বার করে রেডী করে রাখবেন। আপনার এই অতিথিটিকে একটু স্বচক্ষে দেখতে চাই। আমার পরিচয় ওনাকে এখন জানাবেন না। আপনার দিদির বাড়ির ঠিকানাটা মনে করে একটু লিখে দেবেন। আর একটা হাত চিঠিতে আমার পরিচয় এবং আমি কেন আপনার দিদির কাছে যাচ্ছি, সেটাও লিখে দেবেন। সকালবেলা গোবরা কে স্কুলড্রেস, ব্যাগ সব কিছু দিয়ে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। ভদ্রলোক যেন সেটা টের না পায়। ওখান থেকেই ভোম্বলের সঙ্গে ও স্কুলে যাবে। দরকার হলে আমাদের বাড়িতেই দুদিন থাকবে নাহয়। আর একটা কথা, উনি সঙ্গে কী কী এনেছেন বলতে পারেন?”
“না, তেমন কিছু তো দেখিনি, শুধু কাঁধে এক টা কাপড়ের ছোট ঝোলা ব্যাগ। তাতে এক সেট জামা কাপড়। ওটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উনি পরেন আর কিছু ওষুধপত্র,সেগুলো প্রায় সবই জ্বর, পেটখারাপ আর গ্যাস-অম্বলের জন্য। এছাড়া দেখেছি গামছা আর শেভিং সেট। একটা খাতা,পেন আর একটা অংক বই উঁচু ক্লাসের। এ ছাড়া আর কিছু দেখেছি বলে তো এখন মনে পড়ছে না। ভদ্রলোককে প্রথম থেকেই অচেনা লাগছিল বলে ওনার অজ্ঞাতেই আমি ওই ঝোলাটা চেক করেছি,” বললেন গোবরার বাবা।
“বেশ করেছেন। আমি হলে আমিও তাই করতাম।”
ভোম্বলের বাবার এই কথা শুনে পানুবাবু অনেক টা ভরসা পেয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
পরের দিন অনেক সকালে উঠে চটপট তৈরি হয়ে গোবরা চলে গেল ভোম্বলদের বাড়ি। সেখান থেকেই সে স্কুলে যাবে, আর লোকটা তাকে বিরক্ত করতে পারবে না ভেবে গোবরার মনে সেদিন বেজায় আনন্দ হ’ল। ইতিমধ্যে ভোম্বলের বাবা এসে তার বাবার সঙ্গে আবার অনেক কথা বলেছেন, আর ওই লোকটির সঙ্গেও তাঁর মুখোমুখি দেখা হয়েছে, তবে কথা কিছু হয়নি। এরপর সকালে যখন বাজারটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে দোকান খুলবেন বলে পানুবাবু তৈরি হয়ে রওনা হলেন, তখন দেখলেন পাড়ার মিষ্টির দোকানে বসে সেই লোকটা মহানন্দে মিষ্টি খাচ্ছে। আর দোকানের মালিক তার দিকে একটা ক্যামেরা তাক করে আছে। পানুবাবু এর মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলেন না। এরপরের ঘটনাগুলো ঘটল এইরকম:
হারুর মায়ের গোয়েন্দাগিরি তে জানা গেল যে এই অচেনা লোকটি মাছের বাজার থেকে কাঁটাকুটো নিয়ে এসে গোবরার ঘরের দুয়ারে একটা ইটের খাঁজে ঢুকিয়ে রাখে, আর বেড়ালটাও ঠিক যখন গোবরা স্কুলে বেরোবে তখন হাজির হয়ে যায়। বুড়ো বেড়ালটাকে এমন ট্রেনিং দিয়েছে, যে ঠিক গোবরার ইস্কুলে যাবার সময়ই একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে গোবরার ঘরের দরজার সামনে মাছের কাঁটার খোঁজে সে চলে আসে। আর ঠিক ওই সময়টায় তাদের বাড়ির কেউই ওখানটায় থাকেনা।
দেখা গেল যে বুড়ো আসার পর থেকে এই এক সপ্তাহের মধ্যে গোবরার তিনদিন কামাই হয়ে গেছে। বাকি ক’দিন অনেক হ্যাপা করে তবেই সে স্কুলে যেতে পেরেছে। কেন যে গোবরাকে এইভাবে উত্যক্ত করছে ওই লোকটা, সেটা তার বাবা মা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। শুক্রবার দিন তো সে ভোম্বলের বাড়ি থেকে স্কুলে গেল। কিন্তু শনিবার গোবরা নিজেই চাইল যে সে তার বাড়ি থেকেই স্কুলে যাবে। তার বাবা এই ব্যাপারে তাকে খুব সহায়তা করলেন। বুড়ো যখন বারান্দায় নেই, সেইরকম একটা সময়ে বাবা টুক করে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ওদিকে হারুর মা তার ছেলেকে দিয়ে বেড়ালটাকে কিডন্যাপ করাল। রেললাইনের ওপারে সাইকেল করে গিয়ে সে ছেলে ছেড়ে দিয়ে এল বেড়ালটাকে। লোকটা এ সব জানতেও পারল না। কিন্তু সে একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছে, যে তার কীর্তি এরা বোধহয় ধরে ফেলেছে। নাহলে আগের দিন গোবরা স্কুলে গেল কখন? সে যখন জানতে চেয়েছিল, এরা কেউই ঠিক করে তার জবাব দেয় নি।
আবার আজও সে বাজার ঘুরে এসে থেকেই গোবরাকে দেখতে পাচ্ছে না। ওদিকে বেড়ালটাও আসছে না। ভদ্রলোকের কপাল আর ভুরু কুঁচকেই থাকল। গোবরার মা তখন রান্নাঘরে। সে মহিলা তো তার সঙ্গে কথাই বলতে চায়না। হারুর মাও কাজ শেষ করে চলে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন গোবরা বা তার বাবা কাউকেই যখন আসতে দেখা গেল না, তখন লোকটা মনে মনে কি যেন এক ফন্দি এঁটে বাইরে বেরিয়ে গেল।
বেলা সাড়ে বারোটার সময় যখন রান্না শেষ করে শান্তা ঘর গোছাতে ব্যস্ত, সেই সময় লোকটা হাতে একটা বড় মোচা আর চিংড়ি মাছ নিয়ে ঘরে ঢুকে সেগুলো শান্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে হুকুমের সুরে বলে উঠল, “এই মোচা চিংড়িটা এখুনি বেশ জম্পেশ করে রেঁধে ফেলো দিকি। জমিয়ে খাবো দুপুরে ভাতের সঙ্গে। জেনে রাখো, এ’ আমার খুব পছন্দের খাবার। হাঁ করে দেখছ কি? এগুলো ধরো আর এক্ষুনি লেগে পড়ো। আর হ্যাঁ, চিংড়ির খোলাগুলো একদম ফেলবে না। ওগুলো যত্ন করে রেখে দেবে। আমার বেড়ালটাকে খাওয়াব।”
শান্তা এই কথা শুনে বেড়ালের সাম্প্রতিক সংবাদটা বলতে গিয়েও যেন কথাটা গিলে নিলেন। তারপর খুব শান্ত ও দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন, “আমার উনুনের আঁচ চলে গেছে, আর আমার আজকের সব রান্নাও হয়ে গেছে। কালকে হারুর মা এসে দু’টো জিনিসই ছাড়িয়ে কেটে দেবে, তখন আপনাকে রান্না করে দেবো। আজ হবে না।” আগে বলা হয়নি, এই গল্প যখনকার তখনও বাজারে গ্যাসের ওভেন আসে নি। সব বাড়িতেই উনুনে রান্না হত। এখনকার সময়ের তুলনায় অনেক বিষয়ে মানুষ তখন পিছিয়ে ছিল।
এবারে ওই রান্না হবে না শুনে লোকটা রাগে একেবারে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠল। সে ঝাঁঝালো ভাষায় নানা রকম কটুকথা বলতে শুরু করল গোবরার মায়ের উদ্দেশ্যে। তার গলার স্বর ক্রমশ যখন ঊর্ধ্বমুখী, ঠিক সেই সময় এক মহিলার গলার আওয়াজে তার চিৎকারে ভাটা পড়ল। আরও অদ্ভুত হল, হঠাৎ করে দোরগোড়ায় ওই মহিলাকে দেখে লোকটা কেমন যেন চমকে উঠে নিজের ঘরে সেঁধিয়ে গেল। ব্যাপারটা এতই আকস্মিক যে শান্তা হতচকিত হয়ে গেলেন। মহিলা আর কেউ নন, ভোম্বলের মা কামিনী দেবী। “কি হয়েছে শান্তা? এত চিৎকার, চেঁচামেচি কিসের?” বলতে বলতে তিনি ঘরে ঢুকলেন। ভোম্বলের মায়ের মুখশ্রী অনেকটা তাঁর ছেলের মতই। কোঁকড়া চুল আর বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল দুটি চোখ। চোখ দিয়েও যে মানুষ হাসতে পারে, ভোম্বলের মায়ের চোখদুটি তার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ। তাঁর দুটি ভূরুই জোড়া। এমনটা চট করে দেখা যায়না। এবং মুখে পান।
গোবরার মা হাতে যেন স্বর্গ পেলেন। একটু আগেই ঘরের মধ্যেকার সেই গুমোটভাব মুহূর্তের মধ্যে অন্তর্হিত হল। ভোম্বলের মায়ের দু’হাত ধরে পরম আগ্রহে শান্তা তাঁকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলেন। তাঁর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘর জুড়ে সুগন্ধি জর্দার চমৎকার একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।
শান্তার মুখে মোচা-চিংড়ির বৃত্তান্ত শুনে কামিনীর চোখেমুখে দু’সেকেন্ডের জন্য যেন একটা দুষ্টুমি খেলা করে মিলিয়ে গেল। আন্তরিক স্বরে তিনি বললেন, “তোমরা কাল সবাই দুপুরে আমাদের বাড়ি খাবে। এই কথা বলতেই তো এসেছি। কাল আমাদের পাশের জমিতে নতুন অফিসঘর দু’টোর শুভ উদ্বোধন হচ্ছে। একটু পুজো দেবার ইচ্ছে, আর সেই সঙ্গে তোমাদের একটু খাওয়ানোরও বাসনা। তোমার এই মোচা-চিংড়ি আমি নিয়ে যাচ্ছি। ওখানেই রান্না করে তোমাদের বাড়ির এই নতুন অতিথিটিকে এই পদও আমরা খাওয়াব। উনি যেন অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে আসেন। আর হ্যাঁ, কাল আমাদের বাড়িতেও একজন বিশেষ অতিথি উপস্থিত থাকবেন।”
এরপর সেই নাম না জানা লোকটির ঘরের দোরগোড়ায় গিয়ে ভোম্বলের মা তাকেও বিশেষ ভাবে নিমন্ত্রণ করলেন। সে খানিকক্ষণ জুলজুল করে তাকিয়ে থেকে তার ঘাড় কাত করল, মানে সে যেতে রাজি।
“তোমরা সবাই এসো কিন্তু,” এই কথা বলে ভোম্বলের মা আর দাঁড়ালেন না। তাঁর অনেক কাজ যে এখনও বাকি।
পরদিনটা ছিল একটা আশ্চর্য দিন। অবাক হবার দিন। সত্যি বলতে এতো অবাক গোবরা তো নয়ই, তার বাবা মাও কখনও হন নি। প্রথম চমক এল, যখন তাঁরা দেখলেন যে তাঁদের সেই অতিথি সেলুন থেকে গিয়ে তার চুল কেটে বাড়ি এলো। তার জুলপির দুই পাশ আর কপালের সামনে ঝুঁকে পড়া সব চুল সাদা থেকে বিলকুল কালো হয়ে বয়েস একধাক্কায় অনেক কমিয়ে দিয়েছে। চুল আঁচড়ানোর স্টাইলও একদম অন্যরকম। এতে করে তার চেহারা এমন হয়েছে, যে কিছুতেই তাকে আর বুড়ো ভাবা যাচ্ছে না।
পানু যারপরনাই উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলেন, “আপনাকে আজ ধুতি পাঞ্জাবিই পরতে হবে। আপনার ওই পুরনো জামাকাপড় আজ আর কিছুতেই পরা চলবেনা। না বললে শুনবো না।” এর উত্তরে একটা হাসিমুখের ঘাড় নাড়া দেখা গেল, যার মানে হ্যাঁ পরব।
এই মানুষটার মুখে হাসি তাঁরা এই প্রথম দেখতে পেয়ে একেবারে তাজ্জব বনে গেলেন। কারণ এখানে আসা অব্দি এই লোক কোনওদিন একবারের জন্যও সত্যিকারের স্বাভাবিক হাসি হাসেনি। সবই ছিল কৃত্রিম ও ব্যঙ্গের হাসি। সরলভাবে হাসলে যে তাকে এত ভাল লাগে, সেটাও এই প্রথমবার তাঁদের নজরে এল।
এরপরের চমকটা হ’ল, যখন বাথরুমে থেকে গানের আওয়াজ ভেসে এল। চান করতে ঢুকে লোকটা গান গাইছে! এই খিটখিটে লোকটা এতো ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে জানে! কী আশ্চর্য ! কী আশ্চর্য! কিন্তু এত আশ্চর্য হয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। রেডী হয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হবে তো! তাই সবাই তখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ভোম্বলদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলেন।
সবে যখন ভোম্বলদের গেট পেরিয়ে তাঁরা ভেতরে পা রেখেছেন, তখন হঠাৎ করেই খুব জোরে শঙ্খধ্বনি হ’ল। উলুর আওয়াজও শোনা গেল। পুজোবাড়িতে তো এমন হতেই পারে। মাধব উকিল সস্ত্রীক বাড়ির আরও কয়েক জনকে নিয়ে এগিয়ে এলেন এই অতিথিদের আপ্যায়ন করতে। ভোম্বল কোথা থেকে দৌড়ে এসে গোবরার হাত ধরে তাকে টেনে নিল। আর তার বাবা মা অবাক হয়ে নতুন ধুতিপাঞ্জাবি পরা গোবরাদের সেই নাম-না-জানা অচেনা অতিথিটির দিকে তাকিয়ে যেন পুতুলের মতো স্থির হয়ে গেলেন। তারপর সম্বিৎ ফিরতে মহাসমাদরে তাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাবার জন্যে অগ্রসর হলেন, পেছনে বাকি সবাই। পরিবেশটা এমন, যেন মনে হ’ল বিয়েবাড়িতে বর আর বরযাত্রী ঢুকছে।
এরপর সকলে বাড়িতে ঢুকে দেখলেন সত্যনারায়ণ পুজো চলছে। পুজো শেষে ঠাকুরের সিন্নিপ্রসাদ গ্রহণ করে কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর সবাই এলেন পাশের জমিতে, যেখানে নতুন অফিসঘর তৈরি হয়েছে। সেখানে সকাল সকাল আগেই পুজো হয়ে গেছে। দুপুরের খাবার আয়োজন হয়েছে ওই বাড়িতেই।
খাবার সময় সেদিনের সেরা চমক সবার জন্য অপেক্ষা করছিল। খাওয়া যখন শেষ হতে চলেছে, ঠিক সেইসময় একজন দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী মহিলা সেই ঘরে প্রবেশ করলেন। বয়সে শান্তা ও কামিনীর থেকে কিছু বড়। পরনে চমৎকার একটি শাড়ি। হাতে একটি পাত্র। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে কামিনী, মানে ভোম্বলের মা। পাত্র হাতে সেই মহিলাকে নিয়ে গিয়ে কামিনী দাঁড় করালেন একেবারে গোবরাদের বাড়ির সেই অতিথিটির সামনে। তাঁর পাতে পড়ল মোচা-চিংড়ি। ভদ্রলোক এতক্ষণ মাথা নিচু করে খাচ্ছিলেন। হঠাৎ মোচা-চিংড়ি দেখে চমকে উঠে তিনি মুখ তুলে পরিবেশনকারিণীর দিকে তাকিয়ে মহাবিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর এঁটো হাতেই “মালিনী! তুমি!!” বলে ভদ্রমহিলার হাত চেপে ধরলেন। সেই মহিলার অবস্থাও তাই। মুখ দিয়ে তাঁরও কোনও কথা সরছেনা। এক্কেবারে বিস্ময়ে বাকবন্ধ দশা দুজনের। যারা খাচ্ছিল তারাও সকলে খাওয়া বন্ধ করে একদৃষ্টে চেয়ে যুগল মূর্তির দিকে। এই দৃশ্যে প্রথম কথা বলে উঠলেন কামিনী, “আজ আমাদের পরম সৌভাগ্য। হারানদা এতদিনে তাঁর হারিয়ে যাওয়া সাত রাজার ধন এক মানিক স্ত্রীকে খুঁজে পেলেন। আর আমার দিদিও খুঁজে পেল তার স্বামীটিকে।”
সবার কৌতূহল তখন চরমে উঠেছে। পানু এগিয়ে এসে ভোম্বলের বাবার হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলে উঠলেন, “এইটুকু বললে কিছুতেই হবে না। সবটা জানতে চাই। আমি জানি আপনি সব জানেন। দয়া করে বলুন। এত রহস্য আর সহ্য করা যাচ্ছে না।”
মাধব উকিল বললেন, “নিশ্চয়ই। সব বলব আপনাদের। হারানদা এবং মালিনী বৌদির এতদিন পরে দেখা হ’ল। খাওয়া শেষ করে নিশ্চিন্তে একান্তে যাতে তাঁরা এখন কথা বলতে পারেন, তার ব্যবস্থা আগে করা দরকার। আমরা এঁদের এখন কেউ ডিস্টার্ব করব না।”
হারান এতক্ষনে কথা বললেন, “না না, আমি আর মালিনী নিজেদের মধ্যে কথা তো বলবই। কিন্তু এখন সবার আগে আমায় গোবরা আর ভোম্বলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওদের সঙ্গে আমি যা খারাপ ব্যবহার করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য। পানু ও শান্তা – তোমাদেরও আমি কম কষ্ট দিই নি। পারলে আমায় মাফ করে দিও তোমরা।”
এরপর ছেলেদুটির খোঁজে তিনি ছাদে উঠে গেলেন। এদিকে বাকিদের খাওয়া শেষ হলে বড় ঘরটার মধ্যে সবাই বসলেন এতক্ষণ জমে থাকা সেই কৌতূহলের নিরসনে।
পানুবাবুর অনুরোধে মাধব উকিল যা জানালেন তার সার মর্ম হলো এই:
হারানদার পুরো নাম শ্রী হারানচন্দ্র মিত্র। জন্ম কৃষ্ণনগরে। ছোটবেলা থেকেই অংকে তুখাড়। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংকে লেটার পেয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে পানুবাবুর দাদা নিত্যগোপালের সঙ্গে একই স্কুলে পড়াশোনা হারানের। ক্লাসমেট ছিলেন দুজনে, সেই সুবাদে নিত্যদের বাড়িতে তাঁর নিত্যই যাতায়াত ছিল বলা যায়। প্রাণগোপাল বা পানু সে সময় একেবারে দুগ্ধপোষ্য শিশু, তাই তাঁর পক্ষে হারানকে এতদিন পর চেনার কোনও প্রশ্নই নেই। একই ভাবে হারানেরও তাই। কারণ তাঁর দেখা সেই শিশু এতদিন পর দেখতে কেমন হয়েছে সেটা তিনি জানেনই না।
এরপর দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ বলতে গেলে প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। হরগোপাল, মানে নিত্য আর প্রাণগোপালের বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে কল্যানী চলে আসেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ততদিনে নিত্যগোপাল চলে গেছেন লন্ডনে। আর কলেজের পাট শেষ করে হারানদা রানাঘাট বয়েজ হাইস্কুলে চাকরি পেয়ে রানাঘাটে। চাকরি পাবার বেশ কয়েক বছর পরে হারানের সঙ্গে মালিনীর পরিচয় ও বিবাহ। বিয়ের কিছুদিন পরেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে দুজনের মধ্যে গোলমাল ও মনোমালিন্য শুরু হয়, এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, যে মালিনী হঠাৎ করে একদিন তাঁর স্বামীগৃহ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অনেক খুঁজেও তাঁর কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না।
মাধব বলতে থাকেন, “এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাল রকম খোঁজ খবর করতে আমায় ব্যারাকপুর আর রানাঘাট যাতায়াত করতে হয়েছিল। সেই সময় মিষ্টির দোকানের মালিক সন্তুকে ক্যামেরাটা দিয়ে বলেছিলাম, ভদ্রলোক দোকানে এলে একটা ছবি তুলে রাখতে, কারণ ওনার একটা রিসেন্ট ফটো না হলে কিছু বোঝা যাবে না। এরপর এই বাড়ির ফটো অ্যালবাম আর সন্তুর তোলা ফটো নিয়ে আমি প্রথমে ব্যারাকপুরের দিদির বাড়ি যাই। সেখানে ওইসব ফটো থেকে বিশেষ কিছুই উদ্ধার হয় নি। সাম্প্রতিক কোনও খবর দিদির কাছে ছিল না। তবে ওনার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে তাঁর ভাই নিত্যগোপালের স্কুলের বেশ কিছু বন্ধু ছিল। তাদের মধ্যে হারান বলে একটি ছেলে ছিল। সন্তুর তোলা ফটো দেখে দিদি বলাবাহুল্য চিনতেই পারেন নি যে ওটা কার ছবি। তবে ঐ ফটোটাই আমার রানাঘাটে গিয়ে খুব কাজে লাগে।
দিদির কাছে জানতে পারি যে হারান আর নিত্যর মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। দুজনের মধ্যে পড়াশোনা নিয়ে খুব কথা হত। হারান তাঁদের বাড়ি প্রায়দিনই আসত। সে ছেলে যে ম্যাট্রিকে অংকে লেটার পেয়েছিল, একথা তাঁর এখনও মনে আছে। আর ভাইয়ের মুখে তিনি পরে শুনেছিলেন যে রানাঘাট বয়েজ হাইস্কুলে হারান টিচার হয়ে জয়েন করেছে।
মাধব একটানা এতক্ষণ কথা বলার পর একটু থামতেই শ্রোতাদের মধ্যে একজনের উচ্ছসিত মন্তব্য শোনা গেল, “আরিব্বাস! আপনি তো দেখছি সাক্ষাৎ একদম শার্লক হোমস! কী অনুসন্ধান!”
মাধব বললেন, “দাঁড়ান , আরও আছে। আপনারা কেউ জানেন না যে আমার আজকের এই সার্থকতা আর একজনের সাহায্য ব্যতীত সম্ভবই হত না। এবং সবার ওপর আছেন আমাদের উপরওয়ালা। তাঁর ইচ্ছাতেই আজ একটা ভাঙ্গা সংসার জোড়া লাগল।”
“একশ বার। একদম সত্যি। কিন্তু আপনি এবার বাকি টা বলুন, বাকিটা বলুন,” এই বলে পানু সহ আরও অনেকের জোরাজুরিতে মাধব ফের শুরু করলেন, “হারানদার রহস্য রহস্যই থেকে যেত, যদি না আমি তাঁর বাড়িতে যেতাম, এবং ফিরে এসে সেখানকার কথা আমার স্ত্রীকে না বলতাম। যাই হোক, আমি ব্যারাকপুর থেকে এরপর সোজা রানাঘাট বয়েজ হাইস্কুলে যাই, এবং সেখানে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি যে হারানচন্দ্র মিত্র সত্যিই ওখানকার অঙ্কের টিচার ছিলেন। কিন্তু তিনি নাকি বহুদিন হয়ে গেল স্কুলে আর যান না। শেষ যখন এসেছিলেন তখন তাঁর স্বভাবের অনেক পরিবর্তন স্কুলের প্রায় সকলেরই চোখে পড়েছিল। অমায়িক ও সদাহাস্যময় এই মাস্টার মশাইয়ের এমন রুক্ষ ও রগচটা স্বভাব স্কুলের কেউ কখনও এর আগে দেখে নি। তিনি তাঁর ক্লাসের স্টুডেন্টদের অকারণে বেজায় মারধর ও বকাঝকা করতে থাকায় হেডমাস্টারমশাই একদিন তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তারপর দিন থেকে হারান স্যার আর স্কুলে যান নি।
এরপর আমি ওই স্কুল থেকে হারান স্যারের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে সোজা তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হই। ভাগ্যক্রমে তাঁর বাড়ি ওই রানাঘাটে হওয়াতে আমার সময় অনেক বেঁচে যায়। সেই বাড়িতে গিয়ে মাস্টারমশায়ের ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা ও কথা হয়। আমি তাঁকে স্যারের রিসেন্ট ছবিটি দেখালে তিনি চিনতে পারেন এবং স্বীকার করেন যে ওই ছবি তাঁর দাদারই। সেখানে তাঁর স্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের থেকে জানতে পারি হারান মাস্টারমশায়ের বিয়ে হয়েছিল একটু বেশি বয়সে। তিনি এমনিতে স্বভাবে খুব অমায়িক ও হাসিখুশি হলেও একটা ব্যাপারে খুব জেদি ছিলেন। সেটা হ’ল খাওয়া। তাঁর মায়ের হাতের রান্না ছিল চমৎকার। ছেলে যখন যা খেতে চাইত, তিনি তখনই যেভাবেই হোক তার জোগাড় যন্তর করে ছেলেকে সেইদিনই সেটা খাইয়ে ছাড়তেন। কোনওদিন এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু যদি কখনও তা না হত, তখন মাস্টারের মেজাজ সপ্তমে উঠে যেত।
এরপর হলো কি হারানদার বিয়ের পর তাঁর মা বেশ একটা লম্বা সময় নিয়ে তীর্থ করতে গেলেন। এবারে সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ল মালিনী বৌদির ওপর। তিনি একে একদম নতুন সে সংসারে, তার ওপর রান্নাবান্না বিশেষ একটা জানা ছিল না। তাই প্রথম দিকে একটু মানিয়ে চলার চেষ্টা করলেও পরে যতই দিন যেতে লাগল, মনের মতন খাবারের পদ খেতে বসে পাতে না পেয়ে হারান মাস্টারের মেজাজ ততই উত্তপ্ত হতে শুরু করল। রান্না খাওয়া ব্যাপারটা তাঁদের সদ্য বিবাহিত জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট করে দিল। এরকমভাবে চলতে চলতে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে শেষে মালিনী বৌদি একদিন কাউকে কিছু না বলে ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন।
হারানদা প্রথমে ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দেন নি। কিন্তু শেষে সব রাগ-ক্ষোভ উবে গিয়ে তাঁকে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় ধরল। যতই হোক, তাঁর স্ত্রী তো! তিনি যে তাকে সত্যিই বড় ভালবসেন, সেই উপলব্ধি এবার তাঁকে অস্থির করে তুলল। পাগলের মতন তিনি তাঁর মালিনী কে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন, সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় সন্ধান করলেন। কিন্তু কোথাও তাঁর আর খোঁজ পাওয়া গেল না, ইতিমধ্যে তাঁর মাও ইহলোক ত্যাগ করেছেন। দুইদিকের ধাক্কায় হারানদা মানসিক ভাবে দিশাহারা ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এদিকে হ’ল আর এক উটকো ঝামেলা। খবর তো আর চাপা থাকে না।পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গেল যে হারান মাস্টারের বউ নিখোঁজ। তাঁকে নাকি হারানই তাড়িয়েছেন। তিনি বাড়ির বাইরে বেরোলেই পাড়ার যত কচিকাঁচার দল সমস্বরে চেঁচাতে শুরু করত, “ঐ দেখ, ঐ দেখ, বউ হারানো হারান, বউ তাড়ানো হারান।” তাদের সেই পেছনে লাগা এমন স্তরে পৌঁছল, যে হারান তাঁর এতদিনের সেই শান্ত অমায়িক স্বভাব একেবারেই হারিয়ে ফেললেন। দেখতে দেখতে এই “বউ তাড়ানো হারান, বউ হারানো হারান” কথাটা পাড়ার চৌহদ্দির বাইরেও ছড়িয়ে গেল। ফলে হারান মাস্টারের এরপর বাড়ি থেকে বেরোনই দায় হয়ে উঠল। তাঁর বাড়ি থেকে বেরোন মানেই তখন কচিকাঁচার দলের উৎপাত আরম্ভ, আর তাঁকে দেখার জন্যে মানুষের ভিড় বেড়ে যাওয়া। এবং এতে করে ভদ্রলোকের মেজাজ এমন তিরিক্ষি হয়ে উঠল, যে তিনি কোনও ছোট ছেলেকেই আর সহ্য করতে পারেন না। স্কুলে গেলে তাঁর অতদিনের প্রিয় নিচু ক্লাসের ছাত্রদের দেখলেই তিনি হঠাৎ করেই মেজাজ হারাতেন। নানা অছিলায় তাদের শাস্তি দিতেন। তারা কিন্তু তাদের স্যারের সম্পর্কে এতসব ঘটনা কিছু জানতই না। তবু তাদের নিজেদের মধ্যে কখনও কোনও কথাবার্তা বা হাসাহাসি দেখতে পেলে হারান ভেবে বসতেন যে ওরা বুঝি এখনই তাঁর নামে দুর্নাম রটানো সেই কথাগুলো বলতে শুরু করবে। নিজের মনে এইসব চিন্তার জাল তৈরি করে নিয়ে তিনি ছেলেগুলোকে অকারণে মারধর করা শুরু করলেন। অবশেষে তার ফলস্বরূপ হেডমাস্টার মশাই যেদিন তাঁকে ডেকে পাঠালেন, হারানস্যার সেদিনের পর থেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
বাড়িতে না থেকে মাঝে মাঝেই তিনি এদিক ওদিক চলে যেতেন। রেলস্টেশনে রাত কাটাতেন। নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে একদিন কল্যানী স্টেশনে নেমে বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পানুবাবুর দোকানে টাঙানো পানুবাবুর বাবার ছবিটা তিনি দেখতে পান। তারপর সেখান থেকে কোনওভাবে ঠিকানা জোগাড় করে তাঁদের বাসায় এসে উপস্থিত হন। এবং নিজের পরিচয় না দিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেন।
সমস্ত ঘটনার কথা যখন আমি আমার স্ত্রীকে শোনালাম, দেখলাম সে যেন অস্বাভাবিক রকমের কৌতুহলী হয়ে পড়ল। প্রথমে সব ফটোগুলো দেখল। তারপর একদিনের জন্য বাপের বাড়ি যেতে চাইল। কারণ জানতে চাইলে বলল, “দাঁড়াও, আগে ঘুরে আসি। যা ভাবছি যদি তাই হয়, তবে আমার থেকে খুশি বোধ করি আর কেউ হবে না। আর তোমার এই রহস্যের সব সমাধান হয়ে যাবে।”
স্ত্রীর বাপের বাড়ি রানাঘাটের লাগোয়াই একটা গ্রামে। আমার অনুমতিতে সেদিনেই সে বাপের বাড়ি রওনা হ’ল এবং দু’দিন পরে অনেকগুলো মিষ্টির বাক্স হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে আমায় যা শোনাল, সেটা শোনার পর গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে মনে হ’ল ঠিক যেন একটা সিনেমার মত। প্রথমে তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
যা শুনলাম এবারে বলি – আমার কাছ থেকে গোবরাদের বাড়িতে আসা এই অজানা অচেনা লোকটি সম্পর্কে শুনতে শুনতে কামিনীর একদিন হঠাৎ করে তার এক দূরসম্পর্কের দিদি মালিনীর কথা মনে পড়ে যায়। সম্পর্ক দূরের হলেও মালিনী তার নিজের দিদির মতই। তাদের মধ্যে খুব ভাব ভালবাসা ছিল। মালিনীর বিয়েতে সে গিয়েছিল এবং সেই বিয়ের বাসরে খুব আনন্দও হয়েছিল, হয়েছিল অনেক গান। সে নিজেও কয়েকটা গান গেয়েছিল। সবার অনুরোধে নতুন জামাইও গান শুনিয়েছিল। মালিনীদি শ্বশুরবাড়ি যাবার পর তাদের দুই বোনের মধ্যে আর সেরকম কোনও যোগাযোগ হয়নি। এই বিয়ের প্রায় বছর খানেক পরে কামিনী জানতে পারে যে তার মালিনী দিদি শ্বশুর বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। বিয়ের দিন অতি অল্প সময়ের জন্যই সে জামাইবাবুটিকে দেখতে পেয়েছিল। তার সম্বন্ধে সে শুধু এটুকুই জেনেছিল যে ভদ্রলোক রানাঘাটেরই কোনও একটা স্কুলের টিচার।
এরপর এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সময়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও ধূসর থেকে ধূসর তর আজ। এ’রকম একটা সময়ে আমার মুখ থেকে হঠাৎ করে গোবরাদের বাড়িতে আসা আগন্তুকের কথা শুনে তার মানে হয় এই ভদ্রলোক তার মালিনী দিদির স্বামী নন তো? শুধুমাত্র এই অনুমানের ওপর নির্ভর করে সে রওনা দেয় এবং মালিনীদির বাড়ি গিয়ে গিয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো তার দেখা পেয়ে যায়। কালবিলম্ব না করে সে এরপর মালিনীকে নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে আসে।”
এতক্ষণ নির্বাক হয়ে যারা এই বিবরণ শুনছিলেন তাদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলেন, “ভদ্রমহিলা তাহলে এতদিন কি নিজের বাড়িতেই ছিলেন?”
এবারে জবাব দিলেন কামিনী। বললেন, “না, আমার দিদি লখনউতে ছিলেন। তাঁর মা অসুস্থ, এই খবর পেয়ে ক’দিন আগে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বরাবরই ছিল। মালিনীদির এক প্রতিবেশী তাঁকে ছোটবেলা থেকে নিজের মেয়ের মতন ভালবাসেন। লখনউতে তাঁদের কিছু জমিজমা আছে। সেগুলো বেহাত হয়ে যেতে পারে, এই খবর পেয়ে বেশ কয়েকবছর আগে তাঁরা লখনউ চলে যান এবং ওখানেই সেটল করেন। মালিনীদি সেখানেই ছিলেন এতদিন।”
এবারের প্রশ্ন টা এলো মুখচোরা শান্তার কাছ থেকে। সে জানতে চাইলো কামিনী যেদিন তাঁদের বাড়ি নিমন্ত্রণ করতে গেছিলেন তারপর থেকে হারান এমন আশ্চর্য রকম বদলে গেলেন কি করে। তার উত্তর দিলেন এবার মাধব। বললেন, “হয়ত উনি কামিনীকে চিনতে পেরেছিলেন, পারার কারণও আছে। কামিনীর ওই জোড়া ভুরু এবং ওই সুগন্ধি জর্দা, যার গন্ধ তাঁর বিয়ের আসর জুড়ে সারারাত ছিল, তাকে তিনি ভোলেন নি। কামিনীদের বাড়ির সবাই এই সুগন্ধি জর্দা পান খেতে অভ্যস্ত আর সেদিনের সেই বিয়ের আসরে কামিনীদের বাড়ির অনেকেই ছিলেন। এবার যখন গোবরাদের বাড়ি নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে হারানদা কে কামিনী বিশেষভাবে আমাদের বাড়ি আসার কথা বলে, তাতে করে ভদ্রলোকের মনে পুরনো সুখস্মৃতি হয়তো কোনো আশার আলো জাগিয়েছিল। তাই হয়তো তিনি নিজেকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এটাই আমার অনুমান।”
মাধবের কথা যখন শেষ হ’ল, ঠিক তখন ভোম্বল আর গোবরা হঠাৎ ছাদ থেকে নেমে এসে তাদের বাবা মায়ের হাত ধরে টানতে শুরু করলো। তাদের সবাই কে নিয়ে তখুনি তারা ছাদে যেতে চায়। তখন সেই দুই জোড়া যুগলের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত বাকি সকলেও ছাদের দিকে পা বাড়ালেন। সিঁড়িতে লাইন পড়ে গেল। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে উচ্ছসিত ভোম্বল আর গোবরার মধ্যে চলা কথাবার্তায় সবাই বুঝলেন যে ওপরে এতক্ষণ হারানস্যার তাদের সঙ্গে একটা ভারি মজার অঙ্কের ধাঁধার খেলা চালাচ্ছিলেন। এরপর ছাদে গিয়ে সবাই অবাক হয়ে দেখলেন মাস্টারমশাই নিপুণ হাতে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন আর মালীনির হাতে লাটাই। সবাই একযোগে হাততালি দিয়ে উঠলেন। কামিনী বললেন, “আজকে আমাদের চা-পানটা তাহলে এই ছাদেই হয়ে যাক?”
সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন “হ্যাঁ হ্যাঁ, হয়ে যাক হয়ে যাক”।
পড়ন্ত রোদের আলো গায়ে মেখে ভাসতে ভাসতে উড়তে উড়তে ঘুড়িটাও মনে হ’ল যেন সেই কথা বলল।
লেখক পরিচিতি : শিখা চক্রবর্তী
গৃহবধূ, নিবাস কোন নগর , নিবাস কোন নগর শ্রীরামপুর কলেজের স্নাতক, স্বামীর কর্মসূত্রে ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে বসবাস করার সৌভাগ্য এবং তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় , ভীষণ নেশা ছিল কিন্তু শারীরিক কারণে বর্তমানে তাতে ছেদ পড়েছে।