লেখক : পিনাকী চক্রবর্তী
“China and the rest of the world remain thirsty for oil..”
James David spellman
এরপর এবং অতঃপর, বাথরুমের দরজা খুলেই, বাথটবে তাকিয়ে দেখি, ভাসমান ক্রুড অয়েল, বাথটবের সুসজ্জিত জলের উপর ভাসছে। সেই দৃশ্য, দৃশ্যত ও দৃশ্যে একের পর এক দেখে চলেছি। কলকাতা থেকে লাদাখ উড়ে এসেও, আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কলকাতার ধোঁয়া, কুয়াশা, ভোর, দুপুর, মাঘী বসন্তের পরিণত ও পড়ন্ত এবং খানিক ঢলতে থাকা রোদের ভিতর, আলো কম হয়ে আসা অন্ধকার, সন্ধ্যের সময় ময়দানের মাথায় জমতে থাকা উদাসীনতার নির্জনতা, মানুষের ভীড়ে ঘনিয়ে আসা বিপদের সম্ভাবনার ঝলক দেখছি।
কিছু কথা থাকে, কিছু সংকেত, সম্ভাবনা চিরন্তন ও চিরচিন্তিত হয়ে আছে।
এখন লাদাখে দুপুরবেলা। যদিও সাদা বরফের হাতছানিতে রুমের কাঁচ গুলো ঝাপসা হয়েছে। জানালার কাঁচে চোখ রেখে বাইরে দেখি – খানিক নেই-আলো নেই বিকেল, ঘড়িতে সন্ধ্যার প্রস্তুতি নেওয়া পাঁচটা দশ। আজকের এই সময় থেকে একমাস আগে সব কিছুই ঠিক চলছিল। কলকাতার নিউটাউন, তিনতলা ফ্ল্যাটের “টু ‘রুম – ওয়ান কিচেন, ডাইনিং প্লেস, এন্ড ১৪ শো স্কোয়ার ফিটের ” বাসিন্দা। ছাপান্ন বছর বয়স।
আমার স্ত্রী গিনি আর আমি প্রায় সমবয়সী। নিশি, আদিল, ম্যাডাম নিবেদিতা বসু, আর এই বাথটব – হ্যাঁ এই গল্পের সব চরিত্রেই আমি এবং আমরা রয়েছি। মুলাকাত পর্ব শেষ, গল্প শুরু হচ্ছে।
১
বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে রাতে আমি আর নিশি ইনডোর খেলছিলাম, দু’জনেই ল্যাংটো, আদিম রিপুতে লিপ্ত, আদি ও অনাদি দুই মগ্ন – নগ্ন নারী ও পুরুষ। তখনই ঠিক করেছি, পরের দিন দুপুরে কোলাঘাটের ফার্ম হাউসে নিশিকে নিয়ে যাব। এখন ঘড়িতে বিকেল চারটে। কোলাঘাটের ফার্ম হাউস, এখানেই রবিবারের দুপুরে, নিশিকে এনে ফূর্তি করছি।
আমি আর নিশি, বিছানার উপর শুয়ে। বুকের উপর যেই সাদা চাদর রাখা আছে, দুজনেরই, সরিয়ে নিলে দুজনেরই লজ্জা করবে। গোটা দুপুর যৌনতা করেছি, বিঘ্নিত নয়, অনুভূতির আবেশে ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ দুপুরের নগ্ন মুহূর্তে, নিজেদের আদিম নগ্নতায় মগ্ন ব্যস্ত শরীর দেখে উঠতে পারিনি।
দুপুরের আলোয় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগছে।
আমি মনে মনে চাইছি, কিছু কথা বলবো, কথা মন দিয়ে শুনে গুরুত্ব বুঝুক নিশি। আমি শান্ত ভাবেই বললাম, “নিশি, সময় ফুরিয়ে আসছে।”
নিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”
বিরক্ত লাগছে, সেই একই উত্তর। আমি বললাম, “বুঝবার কিছু নেই, নতুন করে বলবার কিছুই নেই।”
পাশে টেবিলের উপর রাখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে , কিছুক্ষণ থেমে বললাম, “আমি চাইছি, তুমি আমার পাপমুক্তি ঘটাও।”
নিশি হাসলে গালে টোল পড়ে। নিশি বলল, “বৌ থাকতে, ভাড়া করা কর্লগালের সাথে রাত কাটিয়েছেন। এটা পাপ নয়, প্লেজার।”
আমি নিশির মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছি, “মেয়েটা সিরিয়াস নয় কেন? নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। আমি চেয়েছি ওরা বাঁচুক।”
নিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, টাইম হয়ে গিয়েছে। আমাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে।”
আমি বায়নার সুরে বললাম, “যেও না প্লিজ। ওই ওয়াশরুমে তোমাকে …”
নিশি বলল, “স্যার, আমার মনে হচ্ছে আমরা ইমোশনালি এটাচ হয়ে যাচ্ছি। এটা আমার পেশা।”
“আমি জানি নিশি, আরো কিছুক্ষণ থাকো। এরজন্য পেমেন্ট পাবে ডবল।”
“স্যার, আমাকে আধঘণ্টার মধ্যেই এখান থেকে যেতে হবে। নতুন পার্টির থেকে এডভান্স নিয়েছি, কোনভাবেই কাস্টমার এথিক্স ভাঙতে পারিনা।”
“আমি ডবল পেমেন্ট করছি।”
“হয়না স্যার। পার্টির সন্তুষ্টি সবার আগে।”
নিশি নামতেই, আমার আচমকাই মাথা গরম হয়ে গেলো। নেশার ঘোর হাল্কা কেটেছে, আমি ওর হাত দুটো ধরে বললাম, “নিশি, রেগুলার কাস্টমার আমি।”
“তাহলে ডিস্টার্ব করছেন কেন? এমনিতেই কাল রাতে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় বিপদ ঘটে গিয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“আমার মা, আচমকাই এক্সপায়ার করেছেন। মায়ের ডেডবডি দেখতে যাবো। প্লিজ স্যার।”
নিশি কান্নায় ভেঙে যেতেই, আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, “জানি, তাইতো আরো কিছুক্ষণ তোমাকে আমার কাছে রাখতে চাইছি।”
“আপনি মানুষ নন। জানোয়াররা আপনার থেকে ভালো।”
নিশির মুখে, আমার জন্য ঘৃণা ফুটে উঠেছে। উঠুক, এই গল্প যখন শেষ হবে, বুঝতে পারবে। অসহায় আমি, নিশির জন্যই আমাকে নিশির ঘৃণা নিতে হবে।
নিশি খাট থেকে নেমেই ব্রা আর প্যান্টি পড়ে নিয়েছে, বাথরুমে ঢুকে গেলো। বলতে বলতেই দেখলাম, নিশি বাথরুমের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বুঝতে পারছি, সেই ঘটনাটা ঘটবে। বিড়বিড় করে বললাম, “নিশি, আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
দরজা খুলে, নিশি দাঁড়িয়ে বলল, “হতে পারি আমরা সার্ভিস গার্ল, কিন্তু মানুষ আমরা।”
ওর হাত ধরে টানতেই, নিশি পিছন দিকে সরে যেতেই, বড় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
চোখ বন্ধ করতেই নিশির আর্তনাদ, কানের ভিতর ফেটে যাচ্ছে। নিশি আচমকাই পা পিছলে বাথরুমের মেঝেতে চিত হয়ে পড়ল, আমি ভয়ে ওর নাক থেকে অনবরত রক্ত দেখে, নিশিকে বাথটবের ভিতর চুবিয়ে দিলাম।
নিশির ডেডবডি বাথটবে ভেসে ওঠে। পুরো ওয়াশরুম রক্তে ভরে গিয়েছে। না, কোথাও গুলির কোনও চিহ্ন দেখিনি। তাহলে? নাক দিয়ে অনর্গল রক্ত, আত্মহত্যা,না খুন ?… জানি সেই গুপ্তঘাতক, শার্প শুটার, খুন করে গেছে।
২
আমি বসেছি এবং বসে আছি, পাশে আমার স্ত্রী গিনি, উল্টো দিকে ডাক্তার ম্যাডাম নিবেদিতা বসু। ফর্মাল সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্স পড়ে, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। নিবেদিতা বসু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?”
গিনির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কালো রঙের সালোয়ার কামিজে, গিনির বয়স স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি, পঞ্চাশ ছুঁয়ে নিলেই মহিলাদের শরীরে আগল ভেঙে যায়। দেহ নশ্বর, আভিজাত্য থেকে যায়।
গিনি বলল, নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে, “প্রায়ই ঘুমের মধ্যে একজন গুপ্ত ঘাতকের কথা বলছে । নিশি নামের একটি মেয়ে, কোলাঘাটের ফার্মহাউসে আত্মহত্যা করেছিল। খবরটা সকালে নিউজ পেপারে পড়তেই বলতে শুরু করে, নিশির সাথে গত রাতে ছিল, ওঁর সামনেই নাকি খুনটা হয়েছে।”
গিনির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, “নিশি নয়, তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।”
গিনি বলল, “আবার শুরু করলে?”
আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম, “গিনি, প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
“ভুলভাল বলা শুরু করলে।”
“তোমাকে আমি বাঁচাতে পারবো না। প্লিজ আমাকে মাপ করে দিও।”
গিনি উত্তেজিত হয়ে বলল, “নিশি তোমার কল্পনা।”
আমার হাত দুটো হাতে নিয়ে, চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার দিকে তাকিয়ে দেখো। নিশি বলে কেউ নেই, এখানে শুধু আমরা রয়েছি।”
“না, তুমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই …”
গিনি চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “মারা যাবো?”
“নিশিকে যে খুন করেছে, সে তোমাকেও খুন করবে?”
গিনি চোখ দুটো শক্ত করে বলল, “সে কে? কেমন ভাবে খুন করবে?”
এই বলেই, গিনি হাতে একটা সিরিঞ্জ নিয়ে মজা করে বলল, “এটা দিয়ে? শরীরে ফুটিয়ে দিলেই হবে তো?”
মুহূর্তে, গিনির বুকে প্রচন্ড ব্যথা উঠল। সিরিঞ্জ কাঁচের টেবিলের উপর ফেলে, আচমকাই মেঝেতে শুয়ে পড়ল। ম্যাসিভ হার্ট এটাক।
আমি আর্তনাদে চোখ বন্ধ করি; চারপাশ অন্ধকার।
নিবেদিতা হেসে বললেন, “স্যার, কার সাথে কথা বলছেন?”
কানে আসতেই, কথা গুলো শুনে ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “গিনি।”
“তিনি কে?”
বললাম, “আমার স্ত্রী। দেখুন মেঝেয় নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই গিনি মারা গেল।”
একটা ঘরের ও ঘোরের মধ্যে রয়েছি, শুয়ে আছি নরম সরু বিছানার উপর, মুখের সামনে, চোখের উপর নিবেদিতার দুটো নিটোল বুক। নিবেদিতার সাদা ফর্মাল শার্ট থেকে পারফিউমের উগ্র গন্ধ ভেসে আসে। নিবেদিতা বললেন, “কেউ নেই।”
আমি চোখের পাতা বড় বড় করে খুলে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, “আমার পাশের চেয়ারে বসে ছিল। হার্টএটাক করেছে। প্লিজ ডাক্তার ডাকুন।”
নিবেদিতা শান্ত গলায় বললেন, “স্যার, ঘরে শুধু আপনি আর আমি রয়েছি। আপনি বিয়ে করেননি। গিনি আপনার কল্পনা। গিনি নামে আপনার পরিচিত কেউ কখনই ছিল না।”
আমি পাশের চেয়ারে তাকিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, এই গিনি…”
মুহূর্তে চমকে উঠি। হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগেই গিনি এখানেই ছিল। কোথায় গেলো? চিৎকার করতে গেলেই, নিবেদিতা আমার হাত ধরে বললেন, “গিনি নামে কেউ নেই। গিনি আপনার তৈরি।”
আমি এইবার ঘামতে শুরু করেছি। ঘরে এসির শিথিলতা ও শীতলতায় হিমঘরের বেওয়ারিশ লাশ হয়ে, বুকের হৃদকম্পন শুনি। আমি বললাম, “কিছু বুঝতে পারছি না। গিনিকে সেই মেরেছে যে নিশিকে মেরেছিল।”
নিবেদিতা বললেন, “নিশি কে?”
“গিনি তার কথা জানে।”
“যেমন আমি আর আপনি, গিনির কথা জানলাম। তাই তো?”
নিবেদিতার কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়েছি। নিবেদিতা বললেন, “একজন ডাক্তার কখন নিজেকে অসহায় ভাবে জানেন? সে চেষ্টা করেও যখন তাঁর রুগীকে রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে না।”
আমি বললাম, “আমি আপনার কাছে এসেছি কিসের জন্য?”
নিবেদিতা বললেন, “একজন পেশাদার সাইক্রিয়াটিস্ট আমি। মানসিক সমস্যা এই যুগে তেমন কোনও বড় বিষয় নয়। কিন্তু আমার কাছের কেউ সুইসাইড করেছে। এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। আমিও যুদ্ধ করে চলেছি। বিদায় আমাকেও নিতে হবে। গিনি বলে কেউ নেই। এই মেয়েটির কথা আপনি নিজে থেকে কল্পনা করেন। আমার কাছে একমাস ধরে আসছেন, আপনার মানসিক রোগের চিকিৎসা চলছে।”
আমি অবুঝ, বুঝবার দায় নেই আমার। গিনি আমার স্ত্রী, নিশি আমার পরিচিত, আর নিবেদিতা বলছে, এদের কোনও অস্তিত্ব নেই।
আমি চোখ দুটোকে নরম করে বললাম, “ম্যাডাম, আমায় ক্ষমা করে দেবেন?”
নিবেদিতা আমার দিকে তাকিয়ে, শান্ত হেসে বললেন, “ক্ষমা ? কেন?”
আমি বললাম, “সে এসেছে। এখানেই আছে।”
নিবেদিতা বললেন, “আপনি যেটা বলবেন, আমি জেনে গিয়েছি।”
কাঁচের টেবিলের উপর নীল রঙের প্রেসক্রিপশন, হ্যাঁ আমার নাম লেখা আছে, প্রথম এপয়েন্টমেন্ট একমাস আগেই।
নিবেদিতা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কল্পনার মধ্যেই একটা জীবন কাটিয়ে চলেছেন।”
নিবেদিতার কথা গুলো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, “আপনাকে তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু বলবার আছে।”
নিবেদিতার চোখ দুটো শান্ত হয়ে আসছে।
নিবেদিতা বললেন, “দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, সীমান্ত সমস্যায় শরণার্থী শিবিরের উপচে পড়া জনস্রোত। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে নতুন নতুন উদ্বাস্তু। আমি মনোবিদ হয়ে ক্লান্ত হয়ে যাই। এতো অসুস্থ মানুষের ভিড়ে সুস্থ মুখ নেই।”
আমি বললাম, “আমার হতাশার কারণ অন্য কিছু। আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। প্লিজ ফরগিভ মি।”
নিবেদিতা বললেন, “পরিণতি আটকানো যায় না। জীবনের ভার আমিও আর বইতে পারছি না।”
কথাগুলো যখন বলছিল, নিবেদিতার দুই চোখে, অদ্ভুত এক ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম।
নিবেদিতা আমার সামনেই বসে ছিলেন। গিনির সেই সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে নিজের কনুইয়ের উপর অংশে ফুটিয়ে দিয়েছে। বাথরুমের বাথটবের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
আমি সিঙ্গেল বেডে শুয়ে আছি, অ্যানেস্থেসিয়ার ঘোর মাখা চোখে, কোণাকুণি বাথরুমের ভিতর থাকা বাথটবে জলে ভাসছে নিবেদিতার প্রাণহীন দেহ। আমার শরীরে খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি আর দেখতে পারছি না। প্রতিদিন একই দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত, ঘুমোতে চাই, দুই চোখে ঘুম নেই। আমি হাতের তালু দিয়ে, দুটো চোখ রগড়ে দিলাম।
মুহূর্তে, এক লহমায়, ঘরটা পাল্টে গেলো। দেখলাম – স্লাইডিং ছাড়া জানালার ধারে দাঁড়িয়ে , অনেক নীচে, প্রায় সাততলার নীচে মানুষের কালো কালো মাথা। এই ঘরে নিবেদিতা নেই, বাথরুমের বাথটব নেই। নিবেদিতার দেহ নেই।
কিছু না বুঝে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসতেই লম্বা, ফর্সা, পেটানো চেহারার আদিল দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে এগিয়ে বলল, “স্যার, নিবেদিতা বলে কেউ নেই। ওটা আপনার একটা কল্পনা।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেমন ভাবে জানলে?”
“একমাস আমিই আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। প্রতিবার এই সব কিছুই ঘটে, প্রতিবার আপনি ভুলে যান। আবার আসেন। একমাস এইসব চলছে।”
আমি আদিলের মুখের দিকে তাকিয়ে, মনে মনে বললাম, “এই ছেলেটি জানে না, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মহত্যা করবে। এইসবের জন্য আমিই দায়ী হয়ে থাকবো। ক্ষমা না পাওয়া অবধি, ওদের সাথে আমার দেখা হবেই। যতদিন বেঁচে রয়েছি, রেহাই নেই আমার।”
পকেট থেকে পাঁচশ টাকার দুটো নোট বের করে দিলাম। “কাল আমি কলকাতা ছাড়ছি। লাদাখ যাবো।”
আদিল বলল, “যুদ্ধ থামবে না স্যার। রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধে, আমাদের পৃথিবী পাল্টে গেলো। ক্রুড অয়েল আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কেড়ে নিয়েছে।”
আদিল উর্দূভাষী মুসলিম ছেলে। ইংরেজিতেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
চোখের সামনে দেখলাম, আদিল সাততলার ভাঙা রেলিং থেকে ঝাঁপ মারল।
রক্ত, যন্ত্রণা, চিৎকার।
মৃত আদিল , রক্তাক্ত চেহারায় মিষ্টি হেসে, হাত নেড়ে, হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
৩
আমি লাদাখের হোটেলে রয়েছি। লাদাখের বাইরে, সমগ্র বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ চলছে। অনেক কষ্ট করে যেই “এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের” কোম্পানি খুলেছিলাম, ঋণের দায়ে বিক্রি হয়ে যায়। দেউলিয়া আমি। বাজারের ঋণ ও মানুষের বদনাম, আমার আর কলকাতা ফেরা হবে না। আদিল, নিবেদিতা, গিনি, নিশি – এবং আরেকজন, আমরা সবাই একটি গল্পের সাথেই যুক্ত। আদিল আমার কোম্পানির পার্টনার , আমিই ওকে জোর করে প্রায় এক কোটি টাকার ক্রুড ওয়েলের ট্রেডিং করতে বাধ্য করি। শেয়ার মার্কেটে ধ্বস নামতেই, কয়েক মুহূর্তেই সব শেষ।
আদিলের দুবাইয়ে কোম্পানি খুলবার ইচ্ছা ছিল। রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ থাকবে, এবং ধ্বংস থামছে না, ক্রুড অয়েলের জন্য এই যুদ্ধ চলতেই থাকবে। মানুষের আশা,ভরসা আর স্টার্টআপ স্বপ্নের” পিছন…বিপ…বিপ…” যুদ্ধ চলছে।
আদিলদের স্বপ্নের সায়াহ্ন সমাধি ঘটেছে। তিরিশের ছেলেটা, একমাস ধরে ভয়ানক নার্ভের রোগে ভুগতে থাকে, একদিন হতাশায় আক্রান্ত হয়ে সুইসাইড করল।
ম্যাডাম নিবেদিতা একজন মনোবিদ, আদিলকে বাঁচাতে পারল না। লিভিং পার্টনার আদিলের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেছে। স্লিপিং পিল খেয়ে ম্যাডাম নিবেদিতা একরাতে হারিয়ে যায়। নিবেদিতার মা গিনি, বড় মেয়ের সুইসাইডের পর, কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে হার্টএটাকে মারা যায়, নিশি হচ্ছে গিনির ছোট মেয়ে। চোখের সামনে দেখি একটা পরিবারের মৃত্যু, নিশি একরাতে কাস্টমারের সাথে ঝামেলায় খুন হয়। এই সব কিছুর জন্য আমি দায়ী ,আমি ওদের বলতে চেয়েছিলাম, একগুপ্ত ঘাতকের উপস্থিতির কথা, ক্রুড অয়েলের অভিশাপের কথা।
বাথটবের দিকে তাকিয়ে আছি। ঐতো, গুপ্ত ঘাতক আসছে। বাথরুমের ভিতর হাঁটু গেড়ে বসে রইলাম, হাতের মুঠির মধ্যে থাকা ঘুমের ওষুধের ট্যাবলেট গুলো মুখের ভিতর এতক্ষণে জিহ্বার লালায় মিশছে। ঘুম নামে – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়া আর আমেরিকার ঠান্ডা বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের কুরবানী হয়ে, আজ ক্ষমতা দখলের মরিয়া হয়ে উঠবার কামড় “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ”, ভূ-রাজনীতির সাগরে সাগরমুখী তেলভান্ডারে দৈত্য জেগে উঠেছে, ক্রুড অয়েলের হাত থেকে মুক্তি নেই আমাদের। স্পষ্ট টের পাই, লাদাখের হোটেল জুড়ে ক্রুড অয়েলের অস্তিত্ব, পুরো বাথরুম জুড়ে তার পদচারণা, ক্রুড অয়েলের নৃশংসতা থেকে পরিত্রাণ নেই। ওই, এগিয়ে আসে, এইবার আমার পালা…
“লাদাখের হোটেল রুমের বাথটবের মধ্যে কলকাতার এক প্রাক্তন বাঙালি ব্যবসায়ীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে লোকসান হয়ে ব্যবসা ডুবে যাওয়ায় ঋণগ্রস্ত ছিলেন।”
লেখক পরিচিতি : পিনাকী চক্রবর্তী
পেশাদার লেখক। চিত্রনাট্যকার ও কন্টেন্ট, স্টোরি লেখেন।