লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
আগের পর্ব – পড়ুন এখানে
।।১।।
অ্যাবির শরীর থেকে অবশ মন যখন নিজেকে আলাদা করল, অ্যাবির মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠল সে। অ্যাবি কোথায়, এতো প্রমা, তার স্ত্রী! আজ বিবাহবার্ষিকীর রাতে অনেকদিন পর প্রমাকে আবার আঁকড়ে ধরেছিল মন। কিন্তু অ্যাবির শরীরে ডুব দেওয়ার পর মন বারেবারে তাকেই এখন দেখতে পায়, তাকেই দেখতে চায়। প্রমার মধ্যেও অ্যাবিকেই দেখতে পায়। মন উঠে এল বিছানা থেকে।
“কি হল?” জিজ্ঞেস করল প্রমা।
“কিছু না! আসছি।”
কিন্তু মন কিছুতেই প্রমার প্রতি মন দিতে পারল না সেইরাত। যতবারই তার শরীর ছুঁয়ে তাকে আদর করতে গেল, বারবার অ্যাবির কথাই মনে হল তার। প্রমাকে প্রমা ভেবে তার সঙ্গে সহবাস ভালো লাগছে না। অ্যাবির শরীর কল্পনা না করলে মনের ভালোই লাগছিল না। মন বুঝতে পারল ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু অ্যাবির প্রতি এই টান সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না।
অ্যাবি মনের ছোটবেলার বন্ধু। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা একটু বেশিই খোলামেলা। তবু একটা গণ্ডী ছিল সেই সম্পর্কে। তাদের বিয়ের পরও বহুদিন অবধি ছিল। কিন্তু একটা সময় তারা সেই গণ্ডী পেরিয়ে যায়, যখন কাউকে না জানিয়ে তারা দুজন ঘুরতে চলে আসে তালসারির সমুদ্রে, সকলের অলক্ষ্যে একে ওপরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তারা। তারপর যখন ফিরে আসে, তখন সেই অনুভূতি থেকে কেউই বের হতে পারে না। বিশেষ করে সেইদিনের পর থেকে মনের ওপর অ্যাবির অধিকারবোধ বেড়ে যায় শতগুণ। অ্যাবি তার সব দিয়ে মনকে বেঁধে রাখতে চায় নিজের কাছে। তার মনে হয় মনের ওপর শুধু তারই অধিকার। এ অধিকারবোধ তার ছোট থেকেই ছিল। কিন্তু দুজনের বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই তা কমে গেছিল। সেইদিনের পর আবার তা পূর্ণমাত্রায় জেগে উঠেছে অ্যাবির। এদিকে সেইদিনের পর অ্যাবির প্রতি মনেরও এক নিষিদ্ধ টান তৈরি হয়ে যায়। সে টান এতটাই গভীর যে নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাসেও সে অ্যাবিকে কল্পনা করে।
মন বুঝতে পারে কিছু একটা তাকে করতেই হবে। উপায় একটাই। অ্যাবির থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে হবে। যেভাবে অ্যাবি তার জীবনে ঢুকে পড়েছে তাতে তার সংসার ভাঙতে চলেছে। অ্যাবির প্রতি তার এই টান তাকে বাঁচতে দেবে না। তাকে অ্যাবির থেকে দূরে যেতে হবে। অনেক দূরে। যেখানে চাইলেও অ্যাবির সান্নিধ্য সে পাবে না। অ্যাবির থেকে দূরে না গেলে তার ধ্বংস অনিবার্য। এই ভেবে নিজে থেকে সে অ্যাবির সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিল। অনেক চেষ্টা করে অ্যাবির থেকে নিজেকে দূরে দূরে রাখতে শুরু করল মন। বেশ কিছুদিন অ্যাবির মেসেজের উত্তর সে দিল না বা “ব্যস্ত আছি” লিখে কোনোরকমে তাকে এড়িয়ে চলতে চাইল। অ্যাবি ফোন করলেও মন একই কথা বলে যে সে ব্যস্ত। মনের ভালো না লাগলেও সে করে। খুব ইচ্ছে করে অ্যাবির সাথে একটুখানি কথা বলতে, কিন্তু তারপরই নিজেকে বুঝিয়ে নেয় এটাতে কারও ভালো হবে না।
কিন্তু একদিন প্রমার মুখে অ্যাবির নাম শুনে চমকে ওঠে মন।
“অ্যাবির সাথে কি হয়েছে তোমার?” প্রমা জিজ্ঞেস করল তাকে।
“কি আবার হবে!” মন একটু আমতা আমতা করে বলল, “কিছু না তো!”
“অ্যাবি ফোন করেছিল। বলল তুমি নাকি ওর ফোন ধরছোনা!”
“ধরছিনা নয়। ব্যস্ত আছি বলেছিলাম। জানোই তো অফিসে এখন একটু চাপ চলছে।”
“হম” প্রমা বলল।
মন ঘাবড়ে যায়। প্রমা কি কিছু সন্দেহ করছে! সে হাল্কা হবার চেষ্টা করে, “কি বলছিল?”
“একদিন আসবে বলছিল” প্রমা বলল।
“কি!” চমকে ওঠে মন। তারপরই সামলে নেয় নিজেকে। আর অ্যাবিকে নিয়ে কথা বাড়ায় না সে। কিন্তু সেদিন অফিসে এসেও শান্তি হয় না তার। তার মাথায় ঘুরতে থাকে অ্যাবি। সে কি প্রমাকে সব বলে দিতে চায়! হতেও পারে। মন তার সাথে যোগাযোগ করছে না বলে এরম কিছু না করে বসে!
চিন্তিত মন ফোন করে অ্যাবিকে। ওর সাথে একবার সামনাসামনি কথা বলা দরকার। ফোন তুলেই সরাসরি জিজ্ঞেস করে অ্যাবি, “দেখা করবি?”
“কখন?” মন উত্তর দিল তৎক্ষণাৎ। সে প্রস্তুতই ছিল।
“বিকালে? তাড়াতাড়ি বেরতে পারবি?”
“দেখছি।”
সেদিন বিকালে একটা ক্যাফেতে বসে কফির কাপে চুমুক লাগিয়ে অ্যাবি বলল, “বল।”
“রবি কবে ফিরছে?” মন জিজ্ঞেস করল।
“কেন?” জিজ্ঞেস করল অ্যাবি।
“এই যে তুই একা একা আছিস?”
“কোথায় একা?” অ্যাবি হেসে তাকাল মনের দিকে, “তুই তো আছিস।”
মনের বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। কেমন একটা উত্তেজনা। এই কথাতেই কেমন আটকে যায় মন। বারবার আটকে যায় অ্যাবির কাছে। অ্যাবি বলে চলল, “ভুলে গেলি মন তুই বলেছিলি আমায় ছেড়ে যাবি না”
“কোথায় যাচ্ছি?” জিজ্ঞেস করল মন, “এই কদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম রে”।
“আমি সব বুঝি। আমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস তুই।”
“কেন পালাতে যাব।”
“আমি জানি না”, মনের হাত ধরল অ্যাবি, “আমায় ছেড়ে যাস নারে। শ্বশুরবাড়িতে একা আমার ভালো লাগে না।”
এবার আস্তে আস্তে মনের দুর্বল হওয়ার পালা।
।।২।।
বাংলোর ভেতরে একটা বড় সুইমিং পুল। অ্যাবিকে কোলে করে রুম থেকে নিয়ে এল সুইমিং পুলে। গোটা বাংলোতে আর কেউ কোথাও নেই, পুরো বাংলোটাই তাদের। সুইমিং পুলের জলে চাঁদের আলো পড়ে নীলাভ আভা তৈরি করেছে। অ্যাবিকে কোল থেকে নামাল মন। এক পা এক পা করে জলে নেমে এল দুজন। নেমে এল দুটি আদিম প্রাণী, আদিম দুই জন্তু। শরীর থেকে সব লজ্জাকে বিদায় দিল তারা। পুলের মধ্যেই মেতে উঠল তারা আদিম রিপুর খেলায়। জলের মধ্যে আন্দোলন উঠল। অ্যাবির ভেজা শরীর বেয়ে উঠতে থাকল মন। অ্যাবি তার চুল আঁকড়ে ধরল হাতের মুঠোয়। জলের মধ্যে বাড়তে থাকল আন্দোলন। চাঁদের আলো এসে পড়ছে তাদের শরীরে। রাত বাড়ার সাথে সাথে চাঁদের শরীরে কলঙ্কগুলো যেন ফুটে উঠছে আরও। ফুটে উঠছে অ্যাবির কোমরের অনেকটা নীচের কালো তিলটাও। সেইসঙ্গে জোরালো হচ্ছে চাঁদের আলো। আস্তে আস্তে চাঁদ যেন সূর্য হয়ে উঠছে। চারিদিক আলোকিত করে চাঁদের আলো তাদের চোখ ঝলসে দিল। তখনই ঘুম ভেঙে গেল মনের।
ঘুম ভেঙে মন দেখল প্রমা জানলার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। বাইরে থেকে একরাশ সূর্যের আলো এসে মনের চোখে পড়ছে।
“কি হল?” বিরক্ত মন জিজ্ঞেস করল।
“অফিস যাবেনা?” প্রমা বলল,”কটা বাজে দেখেছো?”
কিন্তু মনের মনটা এখন পড়ে আছে অ্যাবির কাছে, স্বপ্নটা এতটাই বাস্তব। অ্যাবির কাছে যাবার জন্য তার মন ছটফট করতে থাকল যেন। ওইরকম একটা বাংলোয় যদি সে আর অ্যাবি থাকতে পারত। বিছানা থেকে উঠে এল মন। তবে তার মনে রাতের স্বপ্নটাই ঘোরাফেরা করতে লাগল।
কয়েক দিন পর মন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে প্রমাকে ডাকল, “শোনো না!”
“হ্যাঁ বলো!” প্রমা পাশে এসে বসল।
“দুই সপ্তাহের জন্য মুম্বাই যেতে হবে।”
“হঠাৎ?”
“হঠাৎ ঠিক না। কথা হচ্ছিল, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম বিকাশই হয়ত যাবে।”
“তাহলে তুমি কেন?”
“আজ ফাইনাল কথা হল। আমাকে যেতে হবে।”
“তা তুমি যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“আমি এত তাড়াতাড়ি অফিসে কি করে বলব?”
“তোমায় অকারণে অফিস কামাই করতে হবে! এই তো কদিনের কাজ!”
“আচ্ছা সব ঠিক করেই এসেছ। ঠিকই আছে” এই বলে প্রমা চলে গেল। মনে মনে বিপদ গুনল মন।
ডিনার টেবিলেও প্রমা কোনও কথা বলল না। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাতে প্রমা বিছানায় উঠে তার দিকে পিঠ করে শুল। প্রমাকে জড়িয়ে ধরল মন, “রাগ করেছো?”
“ছাড়ো!” রাগের সাথেই বলল প্রমা, “সকালে উঠতে হবে।”
“সে তো আমাকেও”, মন আরও চেপে ধরে প্রমাকে বলল, “কিন্তু রাগ করছো কেন?”
“রাগ করবোনা?” প্রমা ঘুরে শুল তার দিকে, “তুমি যাবে বলে একবারও রাগ করছিনা। বরং খুশি হতাম। কিন্তু তুমি তো একা একাই যাবে ডিসাইড করে নিলে! ভালো তো! করেছো যখন তাহলে তুমিই যেয়ো!”
“তুমি যাবে?” প্রমার কানের পাশে চুলে হাত দিয়ে বলল মন। কিন্তু সে মনে মনে চাইছে যেন প্রমা না যায়। আবার একইসাথে চাইছে প্রমা যেন রাগও না করে থাকে।
এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নিয়ে বলল প্রমা, “না। তুমি যাও।”
“বোঝো না ব্যাপারটা! রাগ করছ কেন? ওখানে তো খুব কাজের প্রেসার থাকবে। অথচ তুমি ছুটি নিয়ে গেলে তোমার ছুটিই নষ্ট।”, একটু থেমে বলল মন, “এই অ্যাসাইনমেন্টটা করে ফেললে কদিন পরই ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরে আসব কি বলো ।”
এবার ঘুরে শুল প্রমা। “জানি না”
প্রমাকে জড়িয়ে ধরল মন। প্রমা তার মাথায় মাথা ঠেকাল। মন জানে প্রমার মন গলতে শুরু করেছে। এখন শুধু চুপচাপ তার কথা শুনে যেতে হবে। মন চুপচাপ শুনে গেল যা বলছে প্রমা। কোন উত্তর দিল না।
“কি হল?” প্রমা জিজ্ঞেস করল, “কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? আমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না? বিয়ের পর এই হয়।”
মন জড়িয়ে ধরল প্রমাকে। দুজনের নিঃশ্বাস অনেকটা কাছাকাছি এল। কাছাকছি এল তারা দুজনেও। কিন্তু একইভাবে প্রমার শরীরে অ্যাবিকে দেখল সে। এখন শুধু কদিনের অপেক্ষা, তাহলে অ্যাবির শরীর আবার পাবে সে।
পরদিন অ্যাবির সাথে দেখা করল মন। তার মুম্বাই যাবার কথা বলল অ্যাবিকে।
“তুই যাবি আমার সাথে?” মনের প্রশ্নে চমকে উঠল অ্যাবি।
“আর প্রমা!” জিজ্ঞেস করল অ্যাবি।
“তুই যাবি কিনা বল না।”
“পাগল হয়েছিস? এরম হয় নাকি?”
“কেন হয় না?” অ্যাবির চোখের দিকে চেয়ে মনও জানে অ্যাবি মনে মনে কি চায়।
“আমি হঠাৎ কি করে যাব? কাজকর্ম করি না আমি?”
“চ’ না অ্যাবি।”
“তুই না সত্যি পাগল।”
“তুই যাচ্ছিস। আমি জানি। তুইও জানিস তোর জন্যই করেছি এই প্ল্যান।”
“অফিসে কথা বলি।”
।।৩।।
“কেমন লাগছে?” জিজ্ঞেস করল অ্যাবি।
“সেক্সি” উত্তর দিল মন।
অ্যাবির জন্য আজ কয়েকটা শর্টস আর টি শার্ট কিনে এনেছে মন, সেগুলোই অ্যাবি পরে দেখাচ্ছিল তাকে। তারপর বিছানায় উঠে এল অ্যাবি, মনের পাশে এসে বসল, অনেকটা গা ঘেঁষে। তাকে টেনে নিল মন, টেনে নিল নিজের কোলে। তারপর তাকে নিয়ে ফেলল বিছানার ওপর। অ্যাবির বুকের আন্দোলন চাপা পড়ল মনের বুকে। আস্তে আস্তে দুজনের ঠোঁট এগিয়ে এল দুজনের দিকে। আজ তারা আবার একা, সকলের থেকে দূরে।
মনের টানে অ্যাবিও দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এল মুম্বাই। একই হোটেলে তারা উঠল আলাদা আলাদা রুমে। কাউকে না জানিয়ে, সবার থেকে আলাদা, সবার থেকে দূরে এই হোটেলে দুজনের কোন একটা রুমে রাত বাড়লেই তারা মেতে উঠল নিষিদ্ধতায়। এই ভাবেই একসাথে রাতগুলো কেটে যেতে লাগল পরপর। একসাথে কাটানো সময়টা স্বপ্নের মতই লাগল দুজনের। কিন্তু সময় এগিয়ে চলল দ্রুত, আর এগিয়ে এল তাদের বাড়ি ফেরার সময়।
দিন যত এগিয়ে আসে, তত তারা একে অপরের কাছছাড়া হতে চায়না। “রাতটা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি!” মন বলল।
তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অ্যাবি বলল, “আর সময়ও এগিয়ে আসছে। পরশুর পর তো আবার সেই পুরনো জীবন।”
মন অ্যাবির কাছে এল, অনেকটা কাছে। দুজনের নাক একে অপরকে স্পর্শ করে গেল।
রুমের মধ্যে একটাই আলো পরিবেশটাকে আরো ডার্ক, আরও রোমান্টিক করে তুলেছে। আবি দুই হাত দিয়ে মনের গলা আর দুই পা দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরল। মাধ্যাকর্ষণের টানে মনও বিছানায় অ্যাবির পাশে পড়ে গেল। নরম বিছানাটা কেঁপে উঠল একবার। হঠাৎ মনের কোমরের কাছে বিছানাটা কেঁপে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ কেঁপে চলল অনবরত। হাত দিয়ে সে আবিষ্কার করল তার মোবাইলে প্রমার ফোন এসেছে। সে প্রমার ফোন কেটে দিল। এবং এই প্রথমবার সে কোনও অপরাধবোধ অনুভব করল না। অ্যাবির ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। আদরে টেনে নিল মনকে নিজের বুকে।
ফেরবার সময় তারা রাতের ট্রেন বুক করেছিল, যাতে আরও কিছুটা সময় একসাথে কাটাতে পারে। ট্রেনে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার আনাগোনা কমে গেছে অনেকটাই। কিছু কিছু কূপে নিভে গেছে আলো। রাতের খাওয়া শেষ করে অ্যাবি আর মন নিচের দুটো বার্থে কেউ নেই বলে সেদুটোয় বসে আড্ডা দিচ্ছিল দুজনে। ট্রেনের গতি আস্তে আস্তে কমে এল। এসে থামল একটা স্টেশনে।
“এবার উঠব।” অ্যাবি বলল। তাদের নিজেদের বার্থদুটো ওপরে।
“বস না আর একটু।” মন বলল।
“চ’না ওপরে বসে আড্ডা দেব।”
“আচ্ছা চ” মন আর বাধা দিল না।
প্রায় দুজনে যে যার বার্থে উঠে গেছে, তখন এসি কামরার দরজা ঠেলে ঢুকল একটা মেয়ে। যেটা যত্ন করে সে সিটে রাখল সেটা একটা প্যাকেট। প্যাকেটটা দেখে বোঝা গেল কেকের প্যাকেট। হঠাৎ মনের বেশ ভালো লাগল। আজ রাত ১২টা বাজলেই যে তার জন্মদিন। বাড়িতে থাকলে এতক্ষণে তার জন্যও কেকের আয়োজন হত। কাল সকলেই তো সে পৌঁছে যাচ্ছে বাড়িতে। তার জন্য এতক্ষণে আয়োজন হয়তো হয়েই গেছে। কেক খেতে খুব ভালোবাসে মন। বাড়ির কথা ভাবতেই মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। দুইসপ্তাহ পর বাড়ি ফিরছে সে। আবার ফেলে আসা সময়টার জন্য যেন বেশি মন খারাপ তার। অ্যাবির সঙ্গে কাটানো সময়টা। দুটো মিলিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি। মেয়েটা একবার উপরের বার্থে মনের দিকে তাকাল। কেমন যেন চেনা দৃষ্টি তার। কিন্তু যেটা অদ্ভুত সেটা হল মেয়েটার মুখ ওড়না দিয়ে বাঁধা। শুধু চোখদুটো ছাড়া মুখের আর কোনো অংশই স্পষ্ট নয়। দিনের বেলা হলে না হয় বোঝা যেত রোদের কারণে এরম ভাবে মুখ ঢেকেছে। কিন্তু এই রাতের বেলায় কি কারণে? মেয়েটা তারপর অন্যদিকে চলে গেল। মনে হয় নিজের সিট খুঁজতে গেল। মন পাশ ফিরে শুল।
চোখ দুটো জুড়ে এসেছে মনের। এতক্ষণে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে। চোখ একটু খুলতে দেখল কূপের মধ্যে এখন অন্ধকার। মাঝে মাঝে ট্রেনের বাইরে থেকে আসা রাস্তার আলোয় যা দেখা যাচ্ছে তাতে ঘুমজড়ানো চোখে মন দেখল অ্যাবি ওর বার্থে পর্দা টেনে নিয়েছে। মনে হয় ঘুমিয়েই পড়েছে। নিজের বার্থের আলো জ্বালাল সে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত পৌনে বারোটা। একটু আশ্চর্য হল এই ভেবে যে প্রমার থেকে কোনও ফোন এলোনা এখনও। আর পনেরো মিনিট বাকি তার জন্মদিনের, কিন্তু প্রমা যেন ভুলে গেছে তাকে। একটু অভিমান হল তার, আবার ভয়ও হল। প্রমা কিছু জানতে পারেনি তো! আবার পাশ ফিরে শুল সে। বার্থের আলোটা নিভিয়ে দিল। চোখদুটো প্রায় বুজেই এসেছিল, হঠাৎ পায়ের কাছে একটা ধাক্কায় জেগে উঠল।
“হ্যাপি বার্থডে।” মিষ্টি করে গালভরা হেসে বলল অ্যাবি।
প্রমার ওপর সব অভিমান ভুলে গেল সে।
“থ্যাঙ্ক ইউ।” একটু থেমে বলল, “আমি ভাবলাম তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস।”
“পড়েছিলাম।” মনের বার্থে উঠতে উঠতে বলল অ্যাবি, “কিন্তু ঠিক টাইমে এসে গেছি”
“টাইমের পাঁচ মিনিট আগেই এসে গেছিস”, হাসল মন। তার বার্থে পুরোপুরি উঠে এল অ্যাবি।
“আজ তো সেলিব্রেট করব সারারাত।”
“এই হাফপ্যান্টটা পড়ে?” হেসে উঠল মন।
“গাধা তুইই তো কিনে দিলি। আর এটা হাফপ্যান্ট?”
একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল মন, “কিন্তু চেঞ্জ করলি কখন?”
উত্তরে অ্যাবিও একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, “বুঝে নে। কিন্তু কেক কৈ? সেলিব্রেট করতে হবে তো?”
কেমন একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরল মনকে।
“কিরে কি হল?” মনের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল অ্যাবি। নিচে তাকিয়ে মুখবাঁধা সেই মেয়েটাকে দেখল সে। কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দেখছে মেয়েটা। বিরক্তি লাগল অ্যাবির। চোখ দুটো ছাড়া বাকি মুখ পুরোটাই ওড়নায় ঢাকা। বিরক্তির সাথে আপার বার্থের পর্দা টেনে দিল সে।
কিন্তু পর্দা টেনে নিলেও মেয়েটার চোখ দুটো কেমন অস্বস্তি দিচ্ছে মনকে। মেয়েটা কি ভাবছে এই ভাবনাটাই বোধয় তাকে অস্বস্তি দিতে থাকল।
“কি ভাবছিস বল তো?”
অন্যমনস্ক ভাবেই জবাব দিল মন, “কিছু না।”
কিন্তু কিছু একটা তাকে যেন সহজ হতে দিচ্ছিল না। মন থেকে এবার জোর করে সেই অস্বস্তি কাটিয়ে উঠল সে, “তো! এরপর তো দেখা হবে না তাহলে ।”
আর এই কথাতেই মুষড়ে পড়ল অ্যাবি।
পিঠটা দেওয়ালে এলিয়ে দিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল অ্যাবি, “সত্যি না, কি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল এই দিনগুলো?”
“হুম। কি করব বল। আমরা তো জব করি।”
একটু থেমে চোখ দুটোকে প্রসারিত করে বলল অ্যাবি, “আবার কবে যাবি এরম?”
“এটাই শেষ।” অ্যাবিকে কাছে টেনে নিল মন, “বারবার কি এরম যাওয়া যায় বল?”
অ্যাবি মুষড়ে পড়ছে দেখে মন বলল, “আচ্ছা পরের কথা পরে, আজকে থাক না আমার সাথে। এই জন্যই তো ট্রেন জার্নি করলাম বল। “
এবার অ্যাবির মুখে খুশির হাসি ফুটল।
“তুই তো মিষ্টি ছেলে।” বলে মনের দুই গাল টিপে দিল।
অ্যাবির স্পর্শ ভালো লাগল মনের, চিরকালই লাগে। এইরকম স্পর্শের পরই সাধারণত বাঁক নেয় ওদের গল্প। ট্রেনটাও বোধয় বাঁক নিল একটা। অ্যাবি এলিয়ে পড়ল মনের গায়ে। তার বুকের নরম স্পর্শে মনের তন্দ্রা একেবারেই কেটে গেল। অন্যরকম অনুভূতিরা নড়েচড়ে বসল তার মনে। কিন্তু অ্যাবি একটুও নড়ল না। মনের ওপর যেভাবে এলিয়ে পড়েছিল সেভাবেই বসে রইল।
“তোর ফিরে যেতে ভালো লাগছে মন?”
“ঠিক জানি না। মিক্সড ফিলিং।”
মনের দুই হাত আস্তে আস্তে অ্যাবির পেটের দুইপাশ থেকে যেন বেড়ি পরিয়ে দিল। অ্যাবি তার দুই হাতের মুঠোর ওপর নিজের হাত দিয়ে বলল, “আমার তো স্যাড ফিলিং।”
তারপর অ্যাবি আর একটু কাছে এল মনের, “না। এই কয়েক ঘন্টা আর ঘ্যানঘ্যান করব না। “
পা দুটোকে সামনে জড়ো করে বসল অ্যাবি। মনের হাত দুটোকে তার তলপেট থেকে আরও ওপরের দিকে তুলল সে। অ্যাবির উষ্ণতা অনুভব করে এই এসিতেও যেন হালকা গরম লাগল মনের। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ল অ্যাবির কাঁধে। হঠাৎ করে বার্থের আলো নিভিয়ে দিল অ্যাবি।
“কি হল?” জিজ্ঞেস করল মন। উত্তর না দিয়ে ঘুরে গিয়ে সজোরে তাকে আঁকড়ে ধরল অ্যাবি। আবার শুরু হল তাদের আদিম খেলা। অ্যাবির গলা থেকে শুরু করে পা অবধি নেমে এল মন। তারপর পা বেয়ে আবার উঠতে থাকল। অ্যাবি আস্তে আস্তে গিলে খেল তাকে। তার দুপায়ের মাঝে সে গিলে খেল তাকে। মন উঠে এল অ্যাবির ওপর, মিশে গেল দুজনে। তাদের দোদুল্যমান দুটো শরীর ট্রেনের গতির সাথে দুলতে থাকল।
।।৪।।
মাঝরাতে মন অনুভব করল কোনো একটা প্রচন্ড ঠান্ডা ঘরে তাকে রাখা হয়েছে। তার মুখ ঢাকা চাদরে। শরীরের ওপর ভারী কিছু রাখা। অনেকক্ষণ অবধি কিছু বুঝতে পারল না সে। তারপর হঠাৎ করেই যেন বুঝতে পারল সে আর বেঁচে নেই। হাত পা স্থির হয়ে গেছে তার। সে এখন একটা লাশ। তাকে জড়িয়ে আছে আর একটা লাশ, সেটা অ্যাবির। তাদের দুজনের নগ্ন লাশ দুটো সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে রাখা হয়েছে হিমঘরের মধ্যে একটা ঠান্ডা বাক্সে। কেউ তাদের নিতে আসেনি, কেউ তাদের ছুঁতে আসেনি। বাক্সটার ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর প্রচন্ড ঠান্ডা। তার ভয় লাগছে প্রচন্ড। নিজের ওপর থেকে অ্যাবির ভারী লাশটাকে সরাতে পারছে না সে। কাল রাতেও অ্যাবির যেই বুকের স্পর্শে সে সব ভুলেছিল, এখন তা শুধুই যেন শরীরের ওপর একটা ভার, নিজের বুকের উপর একটা বোঝা। যেই পায়ের মাঝে সে আনন্দ খুঁজেছিল, এখন যেন সাঁড়াশির মত আটকে রেখেছে তাকে। অ্যাবির থেকে কোনো মুক্তি নেই তার।
হঠাৎ একটা শব্দে বুঝল ঠান্ডা বাক্সটাকে কেউ টেনে বার করছে। আস্তে আস্তে অন্ধকার কাটছে তার। কেউ তাকে অবশেষে মুক্তি দিতে চলেছে। ঠান্ডা বাক্সটা টেনে যেই মুখটা তার মুখের ওপর এসে থামল সেটা তার চেনা। কালকের সেই মুখে ওড়না বাঁধা মেয়েটা। এখনো মুখে ওড়না জড়ানো কিন্তু একদৃষ্টিতে দেখছে তাকে। আর কি বীভৎস সেই দৃষ্টি। ধড়ফড় করে উঠে বসল মন। ঘুম ভেঙে হঠাৎ করে উঠে বসল সে। ট্রেনটা তখন সবে একটা স্টেশনে ঢুকছে। চোখদুটো খুব চেনা তার। হঠাৎ মনে পড়ল। আর মনে পড়েই একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তার শরীরে। চোখ দুটোর সাথে প্রমার চোখের প্রচুর মিল। তাহলে কি প্রমা তাকে সারপ্রাইজ দিতে কেক নিয়ে এসেছিল?ভাবতে ভাবতেই অ্যাবি উঠে বসল। একটা অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখেছে সেও। স্বপ্নটা এত বাস্তবের মত, মনটাই কেমন বিগড়ে গেল তার। এতদিনের এত আনন্দ কেমন মাটি হয়ে গেল যেন। আর একটা অস্বস্তি কাঁটার মত তার গলায় লেগে রইল।
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।