এক বৃষ্টি দিনে

লেখক : অর্পিতা সাহা

ক্যাণ্টিন থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে অফিস করিডর পেরিয়ে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে চলল মৃত্তিকা। নামী একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর অফিসার পোস্ট হোল্ড করে ও, ওদের অফিসের চত্বরটা সবুজে সবুজ। খুব যত্ন ও পরিকল্পনা করে চারিদিকে গাছ লাগানো। একদিকে দীর্ঘ শাল, সেগুন, শিমুল, বকুল, অন্য দিকে চাঁপা, কাঠগোলাপ, বোগেনভেলিয়া, মাধবীলতার ঝাড়। এবারে বর্ষা ভাল হচ্ছে, তাই ঘন সবুজে যেন ঢেকে গেছে চারিদিক। মাটির সোঁদা গন্ধ আর বুনো সবুজের ঘ্রাণ ভিজে বাতাসের সাথে মিশে অদ্ভুত এক গন্ধ বাতাসে ছড়াচ্ছে, যা বড় টানে মৃত্তিকাকে। আসলে ওর নামের সাথেই যে প্রকৃতি জড়িয়ে।

এতক্ষণ একটানা কাজ করে বড্ড ক্লান্ত লাগছিল ওর। ক্যাণ্টিনে গিয়ে এক কাপ গরম কফিতে চুমুক দিয়ে আর বাইরের ঘন সবুজের দিকে তাকিয়ে এখন একটু ফ্রেশ লাগছে। বর্ষার জল পেয়ে তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে মাধবীলতার ঝাড়টা। গোলাপী আর সাদা ফুলে ফুলে ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু মেখে ভারী অপরূপ হয়ে উঠেছে – যেন ঘন সবুজ পাতায় রং তুলি দিয়ে প্রকৃতি এক টুকরো ক্যানভাস এঁকেছে। এক সময়ে মৃত্তিকাও তো ওই লতানে গাছের মত ভালবাসাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল। হয়ত ওটাই ছিল ওর জীবনের মস্ত বড় ভুল। তাই ক্ষণস্থায়ী ফুলগুলোর মতন ঝরে পড়েছিল ওই ভালবাসা নিঃশব্দে।

হঠাৎ বাইরে লনের দিকে তাকাতেই সমুদ্রের দিকে চোখ পড়ল ওর, হেসে হেসে ফোনে কারও সাথে কথা বলছে – সেই পুরনো চেনা অভিব্যক্তি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অপরপ্রান্তে কোন প্রেমিকার সাথে ঘনিষ্ঠ কথোপকথন চলছে – সেই হাসি, সেই মুখ-ঠোঁট উঁচু করে চুমু ছুঁড়ে দূরভাষে ভালবাসার প্রকাশ, এই অভিব্যক্তিগুলো বড় চেনা মৃত্তিকার। ওর কথা বলার ঢং, তাকানো কিংবা হেসে ওঠা দুঃখ প্রকাশ করা সবটা ভালো করে… খুব ভালো করে চেনে মৃত্তিকা। কি নির্লজ্জ এটা যে ওর বাড়ি নয় অফিস তাতে ওর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।

একসময়ে সমুদ্র মৃত্তিকা বলতে আর মৃত্তিকা সমুদ্র বলতে ছিল অজ্ঞান। দীর্ঘ দশ বছরের সম্পর্ক ছিল ওদের।অন্তত মৃত্তিকা তখন তাই ভাবত। কখনও সামনা-সামনি সবুজের মাঝে, কখনও ওদের পরিচিত কোন বন্ধুর ফ্ল্যাটে, কিংবা ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতের পর রাত, দিনের পর দিন দু’জনে বুঁদ হয়ে গল্প করত। রূপকথার মতন সুখ-সাগরে অবগাহন করতে করতে মৃত্তিকার দিন কেটে যেত সে সময়ে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, সমুদ্র নিজের কথা বলত তখন… তার ফেলে আসা শৈশব, টুকরো কৈশোর কিংবা যৌবনের ভালোমন্দ – যা ওর মনে দাগ কেটে গিয়েছে কোন এক সময়ে… নিজের মনের কষ্ট, নিজের না পাওয়াটুকু বা ভবিষ্যৎ জীবনে ভালবাসা ও সাফল্য পাবার ইচ্ছে, সব কিছু এমন করে ভাগ করে নিতে চাইত ওই সময়গুলোতে যে, মৃত্তিকা ওর অন্তরের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে ভাল রাখতে চেষ্টা করত সমুদ্রকে। ওসব কথা শুনতে শুনতে মৃত্তিকা কখনও কখনও বুকে মাথা রেখে বলত, “তোমার হৃদয়ের সব কথা আমি শুনতে পাচ্ছি…”
সমুদ্র কখনই মৃত্তিকার শরীর স্পর্শ করে ভালবাসা চাইত না। বরং বলত, “থাক না ওসব ভবিষ্যতের জন্যে তোলা।” মৃত্তিকা যখন আকুল হয়ে উঠত সমুদ্রের স্পর্শ পেতে, তখন কখনও কখনও ঠোঁট কিংবা কপালে চুমু এঁকে দিত সমুদ্র, কিংবা আঙুলে আঙুল জড়িয়ে ভালবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে দিত মৃত্তিকার শরীর ও মনে মৃত্তিকা এমন মানুষকে অবিশ্বাস কিংবা সন্দেহ করত কিভাবে… ও যে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসত ওর সমুদ্রকে…

চোখের কোল দুটো জলে ভরে গিয়েছে। রুমাল দিয়ে চট করে মুছে ফেলল ও, এখন ওর চোখের জল কেউ দেখলে না জানি কী ভাববে। এখনও এরকমভাবে সমুদ্রকে অন্যের সাথে কথা বলতে দেখলে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুমরে ওঠে ও মনে মনে। সারা শরীর জুড়ে কাঁটা ফোটে ওর। ঘন ঘন নতুন নারীর সাথে ঘনিষ্ঠতা দেখে মৃত্তিকার মনে হয়, এরা কেউই ওর ভালবাসা হতে পারে না। এটা সমুদ্রর মতন চরিত্রহীন ছেলেদের নোংরা অভ্যাস। তখন ওদের ফোনের মাঝে মাঝে কল আসত সমুদ্রের… আর সমুদ্র বলত ওর কোনও আত্মীয় ফোন করেছে। মৃত্তিকা দেখত, সবুজ আলো জ্বালিয়ে সমুদ্র বসে রয়েছে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে অনলাইন। সমুদ্রকে কল করতে গেলে কেটে দিত, মেসেজ করতে গেলে নীল টিক হত না মেসেজে, অর্থাৎ মেসেজ আনসিন থাকত। পরে অবশ্য সমুদ্র নিজের থেকে ফোন করে স্যরি বলত মৃত্তিকাকে, অজুহাত দিত নানা অনলাইন কাজের। তবে নিন্দুকেরা বলত, সমুদ্র ভিডিও কলে সুন্দরী মেয়েদের সাথে ডুবে থাকত, যাকে কেষ্টলীলা বলে, তেমনই ব্যাপার – যেটার প্রমাণ মৃত্তিকা পরে পেয়েছিল।

সমুদ্রকে মৃত্তিকা মনপ্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিল। একসময় স্বপ্ন দেখেছিল ওর সাথে একটা ঘর বাঁধার। এমনকি যে ফ্ল্যাটে ওদের স্বপ্নের সংসার পাতার কথা ভেবেছিল, সেখানে দেওয়ালে কি রং হবে, ঘরের পর্দার কোন রং ম্যাচিং করে কেনা হবে, আসবাবপত্র কোথায় কোন পজিশনে থাকবে, ঘরে কী কী শো পিস থাকবে, ওয়াল-ডেকর কেমন হবে – সবটা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল মৃত্তিকা। মৃত্তিকা তখন সদ্য চাকরী জয়েন করেছে, তবু সমুদ্র যখনই ফ্ল্যাট বুক করার অছিলায় টাকা চাইত, তখনই মৃত্তিকা তা দিত। দশ, বিশ, পঞ্চাশ হাজার যখন যেমন থাকত মৃত্তিকার অ্যাকাউণ্টে। কখনও কোন কারণে সমুদ্রকে অবিশ্বাস করার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি ও। মৃত্তিকা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল চিরকালই, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ডও বেশ ভাল। ওদের বাড়ির সকলেই ধনী ও উচ্চ-শিক্ষিত, তাই শ্যামলা রঙের এই মেয়েটাকে সমুদ্র বেশ সমীহ করে চলত। তবে দীর্ঘদেহী, তন্বী, দীঘল চোখ, পুরু ঠোঁট আর নারীসুলভ চেহারার মৃত্তিকা অনেক পুরুষের বুকেই ঝড় তুলতে পারে এখনও, যদিও ভালবাসা শব্দটাকে ও আর বিশ্বাস করতে পারে না এখন।

সেই কবেকার কথা, যখন দু’দিকে বেণী ঝুলিয়ে ফ্রক ছেড়ে সদ্য সালোয়ার-কামিজ পরা শুরু করেছে। ওর দাদার বন্ধু ছিল অরণ্য, তাই প্রায়ই ওদের বাড়ি আসা যাওয়া লেগেই থাকত ওর। লম্বা ছিপছিপে এক মাথা কোঁকড়া চুল আর সারল্যমাখা মুখটা দেখে যে কোনও মেয়ে প্রেমে পড়তে বাধ্য, আর ষোড়শী মৃত্তিকা মজেছিল সমুদ্রের প্রেমে…

হঠাৎ পবিত্র সেন চলে আসে ওর সামনে। উনি মৃত্তিকার ডিপার্টমেণ্টের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার – স্মার্ট, ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব এবং নিপাট ভালমানুষ। মহিলাদের সাথে খুব একটা ভাবসাব নেই, কিন্তু মৃত্তিকাকে যে বেশ পছন্দ করে, তা ওঁর হাবেভাবে প্রকাশ পায় প্রায়শই। মৃত্তিকারও এই মানুষটাকে নিজের বন্ধু হিসেবে ভাবতে বেশ ভালই লাগে।
“কি এত ভাবছেন ম্যাডাম? স্পেশাল কারও কথা? আজ যেন বড্ড অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে আপনাকে, মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। প্লিজ ডোণ্ট মাইণ্ড, আপনার শরীর ঠিক আছে তো?”
মৃত্তিকার কথা বলতে আজ একটুও ভাল লাগছে না, তবু বলল, “”না না, কোন প্রবলেম নেই, ঠিক আছি আমি…”
পবিত্র চলে গেল নিজের কেবিনের দিকে। মৃত্তিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শুধু… সমুদ্র এখনও ফোনকলে…
আজ যে কী হয়েছে মৃত্তিকার… কেন ভাবছে ওই নোংরা মানুষটার সম্বন্ধে? “থাক সে সব কথা,” প্রবোধ দেয় মৃত্তিকা নিজের মনকে। সমুদ্রের স্বরূপ বিয়ের পর জানতে পারলে সারাটা জীবন ভুলের বোঝা বয়ে বেড়াতে হত ওকে।

সেদিন দুপুরের কথা আজও চোখের সামনে ভাসে। ঠিক এমনই একটা বৃষ্টির দিন ছিল সেদিন। বাজার থেকে টাটকা ইলিশ – মাছ ভাজা, তেল আর সর্ষে দিয়ে টিফিনবক্সে করে ভাপা ইলিশ বানাতে বানাতে হঠাৎ মনে হয়েছিল, এগুলো টিফিনবক্সে করে নিয়ে সমুদ্রর ফ্ল্যাটে চলে গেলে কেমন হয়? সঙ্গে গরম ভাতও নিয়ে নিয়েছিল বেশ খানিকটা। ও ইলিশ খেতে ভীষণ ভালবাসে। আর আজ রবিবার, বাবু নিশ্চিত ঘুম থেকে উঠবে বেলা করে। তারপর যদি এরকম লাঞ্চ পায়, উফ – ওর খুশি মুখটা মনে মনে কল্পনা করে যারপরনাই আনন্দিত হল মৃত্তিকা।

যথাসময়ে পৌঁছে গেল সমুদ্রর ভাড়া করা নতুন ফ্ল্যাটে। হঠাৎ মৃত্তিকা খেয়াল করল, ফ্ল্যাটের দরজা ভেজানো। পায়ে পায়ে ঢুকে ডাইনিংয়ে নিজের ব্যাগপত্র রেখে সমুদ্রর বেডরুমের দিকে যাবার সময়ে থমকে দাঁড়াল ও। কি দেখছে ও এটা? সমুদ্রর সাথে দৃঢ় আলিঙ্গনবদ্ধ কে ওই মহিলা? ওরা যে বেশ ঘনিষ্ঠ, তা বোঝা যাচ্ছে। সারারাত কি মেয়েটি এখানেই ছিল? বিছানা আর ওদের আলুথালু পোশাক তো তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে গেছিল মৃত্তিকা চেঁচিয়ে বলেছিল, “ছি ছি সমুদ্র, তুমি এত নীচে নামতে পার?”
সমুদ্র শান্তভাবে বলেছিল, “আমি যে তোমায় ভালবাসি, তা কি কখনও তোমায় বলেছি? তুমি আমার বন্ধু শুধু বন্ধু হয়েই থেকো।”
“এরকম মিথ্যে বলতে বাধছে না তোমার? দিনের পর দিন আমায় নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়ে টাকা নিয়ে গেছ, আর এখন এ কথা বলছ?”
এতক্ষণে মেয়েটি বলে উঠল, “আমি দেবশ্রী, ডিভোর্সী। ওর সাথে আমার এক মাস হল রেজিস্ট্রি হয়েছে। আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী। প্লিজ, আপনি নিজেকে সামলান।” ওই মহিলার গায়ের রং বেশ ফর্সা, সুন্দর ফিগার ও মুখশ্রী, হয়ত তাই সমুদ্র…
সেদিন প্রচণ্ড রাগে, অপমানে সমুদ্রর ফ্ল্যাট থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল মৃত্তিকা। ওকে ইউজ করল এরকমভাবে সমুদ্র? ভীষণ কান্না পাচ্ছিল ওর, মনে হচ্ছিল এখুনি মরে যাবে। অনেক কষ্টে নিজেকে বাড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছিল। তারপর ঘরে ঢুকে বিছানায় আছড়ে পড়ে কেঁদে ভাসিয়েছিল। ও এখন কি নিয়ে বাঁচবে? সমুদ্র যে ওকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।

ধীরে ধীরে সামলে নিয়েছিল মৃত্তিকা নিজেকে, ব্যস্ত করে তুলেছিল নিজেকে, সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকত। অফিসে যখন ওকে আর সমুদ্রকে নিয়ে গসিপ চলত, তখন একমাত্র পবিত্র ওকে আড়াল করে রাখত এইসব থেকে। মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে হাসিঠাট্টা, কিংবা ক্যান্টিনে বসে একসাথে লাঞ্চ করা…

অফিস ছুটির সাথে সাথেই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে লিফটের দিকে ছুটল। লিফটে উঠেই চমকে গেল মৃত্তিকা। ওর ঠিক পাশেই সমুদ্র, ওর নিঃশ্বাস পড়ছে মৃত্তিকার ঘাড়ে। আরও দু’তিনজন রয়েছে, তবে এক এক করে অন্য ফ্লোরে নেমে গেল তারা। সমুদ্র কারও সাথে ফোনে কথা বলছিল, মৃত্তিকাকে দেখে কলটা কেটে দিল। হয়ত অন্তরঙ্গতায় ছেদ পড়ল ওর, কিংবা নেটওয়ার্ক ইস্যু। ভীষণ বিরক্ত লাগছে মৃত্তিকার। কতক্ষণে লিফট থেকে নামবে, সেটাই ভাবছে ও। সমুদ্র বোধহয় কথা বলার চেষ্টা করছিল আর মৃত্তিকা মুখটা ঘুরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে। লিফট গ্রাউণ্ডফ্লোর টাচ করতেই এক লাফে বাইরে বেরিয়ে গেটের দিকে দৌড় দিল মৃত্তিকা। ওই মানুষটাকে ও এখন ঘেন্না করে জাস্ট…

অফিসের বাইরের আকাশটা দেখে বেশ মুক্ত লাগছিল নিজেকে। দূরে বাক্স-বাড়িগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ির দেওয়ালগুলো কালচে দেখাচ্ছে। কালো পিচের রাস্তায় অগুনতি গাড়ি সারি সারি পিঁপড়ের মতন ছুটছে গন্তব্যে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধে নেমে আসবে। আকাশজুড়ে ধূসর মেঘ জড়াজড়ি করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে যে কোনও সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে বলে। আজ মনটা সত্যিই ভাল নেই মৃত্তিকার। হঠাৎ পবিত্র সামনে এসে দাঁড়াল। “কিছু যদি মনে না করেন, একটু দাঁড়িয়ে যাবেন প্লিজ? কথা ছিল আপনার সাথে।”
“কি কথা?” মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করল।
“এরকম তাড়াতাড়ি করলে বলব কী করে? গাড়িতে উঠে পড়ুন, সামনেই একটা ক্যাফেটেরিয়া আছে। ওখানে গিয়ে গরম কফি খাওয়া যাক। তাছাড়া আমার খুব খিদেও পেয়েছে। আপনার পায়নি?”
মৃত্তিকা এবার হেসে ফেলল ওর ছেলেমানুষী আব্দারে। গাড়িতে উঠে বসল ও পবিত্র ড্রাইভ করতে করতে বলল, “একটু হাসুন ম্যাডাম এবার। সারাদিন মুখটা যা করে আছেন, তাতে তো আপনার আজই না বদহজম হয়…”
“আপনি না সত্যি!” বলেই হা হা করে হেসে উঠল ও।
“এরকমই থাকবেন মৃত্তিকা, আপনাকে এরকম থাকলে ভীষণ সুন্দর লাগে।”
জানলার কাচে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা এক-একটা বুদবুদ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছু ফোঁটা এসে মৃত্তিকার মুখ, চিবুক আর কপালের উপরের চুলগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। পবিত্র উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন! দাঁড়ান, কাচ তুলে দিই।”
মৃত্তিকা বলে উঠল, “না, আমার এই বৃষ্টির ফোঁটা মাখতে ভারি ভাল লাগছে।”
পবিত্র মৃদু হেসে গাড়ি ক্যাফেটেরিয়াতে পার্কিং জোনে পার্ক করল, তারপর নিজে নেমে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। “আসুন ম্যাডাম।”
মৃত্তিকার মনে হ’ল, আজ পবিত্র যেন বড্ড কেয়ারিং ওর প্রতি, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

টেবিলে বসে পবিত্র মৃত্তিকার পছন্দের ক্যাপুচিনো আর ফিশফ্রাই অর্ডার করল, হাসি-ঠাট্টা-গল্পে কাটিয়ে ফেলল ওরা কিছুক্ষণ। হঠাৎ মৃত্তিকা খেয়াল করল, সমুদ্র আর দেবশ্রী ওর উল্টোদিকের কর্নার টেবিলে অন্তরঙ্গ হয়ে বসে। চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল মৃত্তিকা সমুদ্রের থেকে।
“চলুন পবিত্র, এবার ওঠা যাক…”
“কিন্তু আপনাকে যে বলা হল না, যা বলতে চেয়েছিলাম।”
“বলুন না, কি বলবেন,” মৃত্তিকা বলে উঠল।
পবিত্র বলল, “আমি আর আপনি যদি নিজেদের জীবনটা শুরু করি নতুন করে…”
“মানে?” মৃত্তিকা বলে উঠল।
“প্লিজ রেগে যাবেন না, আমি আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি,” বলেই তাকাল পবিত্র মৃত্তিকার চোখের দিকে। নিষ্পাপ ওই চোখের ভালবাসার আর্তি মৃত্তিকা ফেরাতে পারল না। পবিত্র বলে উঠল, “বাবা মারা গিয়েছেন বহুদিন আগে, মা আর আমি একটা ফ্ল্যাটে থাকি। তুমি আমাদের মা-ছেলের সংসার আলো করে এস, প্লিজ।”
মৃত্তিকার এক দাদা-বৌদি ছাড়া কেউ নেই, তারাও আলাদা থাকে। বাবা মা তো কবেই মারা গিয়েছেন। পবিত্রকে বড্ড বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হ’ল। আসলে একটু একটু করে ও মনে মনে পবিত্রকে ভালবেসে ফেলেছে নিজের অজান্তেই। মৃত্তিকা পবিত্রকে বলল, “এমনি হবে না। যান, একটা হলুদ গোলাপ হাতে প্রপোজ করুন, হাঁটু গেড়ে বসে, তবে আমি ভেবে দেখব।”
এমন কথায় ঘাবড়ে গেল পবিত্র। ক্যাফেটেরিয়ার বাইরে একটা ছেলে কিছু গোলাপ বিক্রি করছিল। পবিত্র দৌড়ে গিয়ে এক গোছা গোলাপী গোলাপ নিয়ে এল। “মৃত্তিকা হলুদ রঙের গোলাপ নেই যে…”
মৃত্তিকা বলে উঠল, “এতেই হবে।”
পবিত্র হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসল আর বলে উঠল, “আই লাভ ইউ, উইল ইউ ম্যারি মি?”
মৃত্তিকা হেসে পবিত্রর হাতে হাত রেখে বলে উঠল, “ইয়েস।”
দূর থেকে সমুদ্র ওদের দেখছে নিষ্পলক দৃষ্টিতে, মৃত্তিকা পবিত্রর সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হ’ল। আজ সমুদ্রকে দেখিয়ে দেখিয়ে ও নতুন ভালবাসাকে বরণ করে নিচ্ছে – ভাবতেই একটা অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে। পবিত্র যে খাঁটি মানুষ, আর এই মানুষটাকে ও সারাজীবন ভীষণ ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে, মনে মনে প্রমিস করল।

ক্যাফেটেরিয়ার বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে, ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু জমছে কাচে। পবিত্র আর ও এখন এক অনাবিল আনন্দে দু’জনে দু’জনের হাতে হাত, চোখে চোখ রেখে বসে… মৃত্তিকা আবার সেই বৃষ্টি ভেজা সোঁদা-গন্ধে বিভোর হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ…


লেখক পরিচিতি : অর্পিতা সাহা
আমি অর্পিতা সাহা। প্রাণীবিদ্যা নিয়ে স্নাতকোত্তর করে বর্তমানে একটি সরকার পোষিত স্কুলের শিক্ষিকা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখি ...লেখা আমার খুব ভালোলাগার জায়গা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।