একটি পবিত্র প্রেম

লেখক : সুমন বিপ্লব

“আমাকে একটি কবিতা দিও।”
একটি মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এল কাজলের কানে। সে লজ্জায় পিছনে তাকাতে পারেনি। মনে মনে সে ভাবে কে এই মেয়েটা? কি করে জানল, যে সে কবিতা লেখে? মাত্র চারদিন সিলেটের আকিলপুর গ্রামে কাজের লোক হয়ে এসেছে। এ গ্রামের সাবেক মেম্বর মুক্তার আলী তাকে শাহজামাল (র.) মাজার থেকে নিয়ে এসেছেন। আকিলপুর আসার চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় আনফর চাচা তাকে নিয়ে পাড়ায় এল একটি বাড়িতে। তাদের বসতে দেওয়া হ’ল। একজন বয়স্ক লোককে চিনতে পারল। তিনি পূর্বের দিন কাজল যখন রানাদের বাড়িতে ছড়া পড়ছিল, তিনি তখন বসে বসে ছড়াগুলো মনোযোগ সহকারে শুনেছিলেন। তিনি দু’টি মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “এই আমার বড় মেয়ে নাম করুনা। শিক্ষকতা করে। ছোট মেয়ে হেনা, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।”
কাজল মনে মনে ভাবল তার মত একজন সামান্য কাজের লোককে কেন তার মেয়েদের সাথে পরিচয় করে দিচ্ছে। চাচা একসময় বললেন, “তোমার কবিতাগুলো কও।” কাজল একে একে চারটি নিজের লেখা ছড়া বলল। করুনা খাতায় লিখে ফেলল। হেনার একটি ছড়া দেখাল। সে ভুলগুলি ঠিক করল। হেনাকে নিয়ে একটি ছড়া লিখল। তা শুনে সবাই খুব খুশি হল।
“শোন বাবা, আমার মেয়েরা লেখালেখি করে। তুমি সময় পেলে চলে আসবে। আজ থেকে তুমি আমার এক ছেলে।”
কাজল অবাক হয়ে গেল কারণ তার মত একজন ছেলের সাথে তার শিক্ষিত মেয়েদের সাথে কেন পরিচয় করে দিল।

কয়েক দিন পর মুক্তার আলী তাকে একটি কলম ও খাতা কিনে দিলেন। ছড়া লিখে ওদের দেখাত, ওরা মনোযোগ সহকারে পড়ত। তার উৎসাহে ওরাও একসময় ছড়া লেখা শুরু করে। তারা ছড়া লিখে অপেক্ষা করত কখন কাজল আসবে, আর তাদের ছড়া ঠিক করে দেবে। একসময় তাদের লেখা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থাও করে দেয়। তারা আরও উৎসাহ পেতে থাকে। হেনা কাজল ছাড়া ভাবতে পারে না। একদিন না এলে হেনা ভাত খেতে পারে না। তার মাথায় একটাই কাজল তার জীবন থেকে চলে গেলে বড় লেখক হতে পারবে না। কাজল যখনই আসত, তখনই কিছু না কিছু খাওয়াতে না পারলে হেনা মনে শান্তি পেত না। কাজল মনে মনে ভাবে, কোন নারী তাকে এমনভাবে হৃদয়ে ঠাঁই দেবে, কখনও তো আশাই করিনি। একদিন হেনার ঘাড়ে ব্যথা হল, কাজল তখন সিলেট শহরে। হেনা কান্নাকাটি করছে। তার পিতা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইছেন, কিন্তু হেনা যাবে না। তার বিশ্বাস, কাজল ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলে সেরে যাবে। কাজল সিলেট থেকে এসে আগে হেনাদের বাড়ি যায়। বাড়ি আসতেই হেনার বাবা বললেন, “তুমি কোথায় ছিলে?”
“সিলেট।”
“তাড়াতাড়ি ঘরে যাও। হেনার ঘাড়ে ব্যথা।”
কাজল ঘরে গিয়ে হেনার ঘাড়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে দিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে বললে তখন গেল।

কাজল মনে মনে ভাবে, তার মধ্যে কী পেয়েছে। হেনা যখন শিক্ষকের কাছে পড়ে, কাজল পাশে বসে থাকত। মনে মনে ভাবত, ওকে যদি পড়াতে পারত। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ পেতে থাকে, সাথে সাথে বাড়তে থাকে তার খ্যাতি। দিন দিন কাজলের প্রতি তার ভালবাসা বাড়তে থাকে। প্রায় তারা শুধু দুইজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আলোচনা করত, মাঝে মাঝে তার বোনেরা চা নিয়ে আসত। হেনা তখন দশম শ্রেণিতে, ওরা ঘরে বসে কথা বলছে, পরিবারের কেউ কিছু মনে করে না। ওদের ছিল পবিত্র প্রেম। কাজল তার শরীরে কখনও হাত দেই নি। ইচ্ছে করলে দিতে পারত হয়ত, হেনা কিছুই মনে করত না। কিন্তু সে তার প্রেমকে অপবিত্র করতে চায়নি।

সিলেটে ছড়া পরিষদ থেকে ছড়া উৎসব হবে। ছড়াকার সুফিয়ান আমেদ চৌদুরী আকিলপুর থেকে ওদের নিয়ে যেতে বলেছিলেন। গ্রামের বেশ কয়েক জনকে নিয়ে ছড়া উৎসবে যায়। ঘোষক একে একে ছড়াকারদের নাম ঘোষণা করতেই সবাই মাইকের সামনে গিয়ে ছড়া বলছে। এক সময় হেনার নাম বলতেই সামনের সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল, “এই সেই হেনা?”
হেনা লজ্জা পেল। মনে মনে ভীষণ আনন্দিত হল তার পরিচিতি ও খ্যাতির কথা জানতে পেরে কাজলের প্রতি ভালবাসা আরও গভীর হল। এতদিন গ্রামের সবাই জানত তাদের প্রেমের কথা, কিন্তু এই ছড়া উৎসবের পর শহরের লেখকরাও বুঝতে পারল তাদের প্রেমের কথা। ঢাকার পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ পাওয়া শুরু করল। আর ঢাকার লেখকরা তাদের প্রেমের কথা জেনে গেল। তাদের নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হত, কিন্তু হেনার পরিবারের কেউ কিছুই মনে করত না।

সে এস.এস.সি পাশ করে সিলেট শহরের আম্বরখানায় একটি কলেজে ভর্তি হল। হেনা কাজলকে জানাল শহর থেকে কিছু বিজ্ঞানের সেরা ছাত্রদের হাতের লেখা নোটের ব্যবস্থা করতে। মিহির ও জাকির নামে দুজন ছাত্রের নিকট থেকে নোট নিয়ে আসে। হেনাদের ঘরে বসে কথা বলছে এক সময় বলল, “আমি একটা সমস্যার মধ্যে পড়েছি।”
“কিসের সমস্যা?”
“ইংরেজির জন্য একটি কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছি। এখানে ৩৫ জন ছাত্রছাত্রী পড়ে। এখন টেনস পড়াচ্ছে, কিন্তু আমি গ্রামের স্কুলে শিখিনি। আমি ছাড়া সবাই শহরের, তারা সবাই পারে। আমার জন্য প্রথমে যেতে পারছে না। এখন কি করি।”
কাজল রাতে এসে গ্রামার নিয়ে বসল। পড়তে পড়তে রাত তিনটায় ঘুমলো। একাই চেষ্টা করে শিখে ফেলল। পরদিন হেনাকে জানাল সে শেখাতে পারবে। পরদিন সকাল ছ’টায় পড়ানো শুরু করল। মনে মনে ভাবে, সে যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত, সেই সময় ভাবত হেনাকে পড়ানো। সে যখন কলেজে, তখন পড়ানোর সুযোগ এল। ওদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হল। কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারত না। ১৯৯৫ সালে ড. মঞ্জুশ্রী একাডেমির পাঠাগার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হলে হেনা তাকে অনেক সাহায্য করত। তারা তখনও জানে না প্রেমের শেষ কোথায়?


লেখক পরিচিতি : সুমন বিপ্লব
সুমন বিপ্লব, শাহ্পুর, ডুমুরিয়া, খুলনা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।