ফ্লাইটে টাইট

লেখক : অভীক সিংহ

মার্ফি বাবাজী বলে গিয়েছিলেন, যদি আপনি ভাবেন আপনার সাথে কেলো হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলে যাই করে নিন, আপেলে কামড় দেওয়ার পরে আপনি আদ্ধেক পোকাই দেখতে পাবেন। কথাটা এক্কেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে এফ-টিভি দেখতে গিয়ে রিমোটের ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়া, সকালে প্রাতঃকৃত্য সারার পরে হাত থেকে সবেধন সাবানটির লাফিয়ে কমোডে ঝাঁপ দেওয়া, অথবা ঢিলে প্রেমপত্র মুড়ে ছোঁড়ার পরে প্রেমপত্রটি নর্দমায় এবং ঢিলটি প্রেমিকার বাবার টাকে গিয়ে পড়া – এইরকম বিবিধ বিচিত্র অভিজ্ঞতার পরই আমার অটল বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল “মার্ফির সূত্র”-এর উপর। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে চাকরি, চাকরি থেকে বিয়ে, বিয়ে থেকে বাচ্চা – জীবনের প্রতিটি স্তরে মার্ফি বাবাজী একেবারে পদে পদে সঙ্গ দিয়েছেন। কিন্তু জ্ঞানত অথবা অজ্ঞানত অপকম্ম করলে তো বাতকম্মের গন্ধ শুঁকতেই হবে, পালানোর পথ তো নাই। মানে ধরুন, আপনি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় পকেটে করে চোথা নিয়ে গিয়েছেন, আর মনে মনে ভাবছেন “আজ হলে ধরা পড়লে বাঁশ হয়ে যাবে।” তাহলে মার্ফি বাবাজীর মতে আপনি কিন্তু ধরা পড়বেনই পড়বেন, সে আপনি ধরাকে যতই সরা জ্ঞান করুন না কেন। এই যেমন দেখুন, আমি সকালে হাতে চায়ের কাপটা নিয়ে বাইরে সোফাটায় বসতেই দেখলাম কোন এক অজ্ঞাত কারণে চারিদিকে মাছি ভনভন করছে। আদতে আমার সেখান থেকে উঠে যাওয়াটাই উচিৎ ছিল। আর চায়ের কাপের মধ্যে নির্বিকারচিত্তে সাঁতার কাটতে থাকা মাছিটির দিকে তাকিয়ে মনে ঠিক এই ধারণাটাই আসছিল। মেরি-গো-রাউণ্ড খেলতে থাকা মাছিটির দিকে তাকিয়ে নিজের যাবতীয় জ্ঞানপাপের ফিরিস্তিটা যেন চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল, আর বিশেষ করে সেগুলো, যেখানে নির্ঘাত কেলো হবে জেনেও হুলোর মত পা বাড়িয়েছি। প্রথম চাকরি করাকালীন অফিসে ছুটি নেওয়ার জন্য বসকে কাঁদোকাঁদো মুখে “বাবার শরীর খারাপ, আমাকে যেতেই হবে” বলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে চম্পট দিয়েছি। ছুটির তৃতীয় দিন বিকেলে তরল দ্রব্যগুণের বশে চার্জ দিতে ভুলে যাওয়ার কারণে আমার ফোনটি সাময়িকভাবে পরলোকগত হয়, আর এক্কেবারে ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই আমার বস কুশলসংবাদ জানার জন্য আমাকে ফোন করেন। আমার পরলোকগত ফোনটি থেকে উত্তর না পাওয়ায় তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্নচিত্তে পরের ফোনটি করেন আমার বাড়ির টেলিফোনে। আর সবচেয়ে কাকতালীয় ব্যাপার, সেই ফোনটি তোলেন আর কেউ নন, স্বয়ং আমার বাবা। বসের কথাতেই বাবা প্রথম জানতে পারেন যে তিনি অসুস্থ, আর বাবার কথায় বস জানতে পারেন তিনি সুস্থ। সুতরাং, এর পরবর্তী স্যাণ্ডউইচ পর্বটি আপনারা আশাকরি আন্দাজ করে নিতে পেরেছেন। জীবনের এই হরেকরকম জ্ঞানপাপীমার্কা কাণ্ডগুলো যখন ফ্ল্যাশব্যাকের মত একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠছে আর মাছি তখনও আমার কাপের উষ্ণ প্রস্রবণের মধ্যে পাক খেয়ে চলেছে, এমন সময় পিছন থেকে আওয়াজ আসল, “বাইরে তো বড্ড মাছি দেখছি হে। আজ ভিতরেই বসবে নাকি?”
পিছন ফিরে দেখি, সান্যালদা দাঁড়িয়ে লাউঞ্জের দরজায়, হাতে চায়ের কাপ। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাপটা পাশে ড্রেনের মধ্যে খালি করে লাউঞ্জে গিয়ে ঢুকলাম। বেয়ারাকে আরেক কাপ চা দিতে বলে লাউঞ্জের ভিতর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। সান্যালদা আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে? আজ একটু চুপচাপ লাগছে মনে হচ্ছে।”
“সক্কাল সক্কাল প্রথম চায়ের কাপের মধ্যে মাছি পড়লে মেজাজটা বিগড়ায় কি না বলো।”
“তা বাপু, যা মাইনে আমরা পাই, তাতে চায়ের কাপে মাছি পড়বে না তো কি মার্লিন মনরো এসে পড়বে নাকি?” সান্যালদা মুচকি হেসে বলল।
“হে হে, ব্যাপারটা মন্দ হত না কিন্তু।” আমি হাসতে হাসতে বললাম। “ভাবো একবার –”
“নাহ্‌, সক্কাল সক্কাল খালিপেটে এইসব জিনিস ভেবে আমার পেটগরম করবার কোন ইচ্ছে নেই। আমি মাছিতেই সন্তুষ্ট।”
বেয়ারা ইতিমধ্যে চায়ের কাপটা এনে আমার সামনে রেখে গেল। আমি চায়েরকাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “তা তুমি মাছি নিয়ে থাকো, আমার তাতে কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু আমাকে একটা জিনিস বলো। মার্ফির সূত্র নিয়ে তোমার বক্তব্য কী?”
সান্যালদা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে দু’হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “ওরে বাবা, কার নাম নিলে! উনি তো নমস্য ব্যক্তি। সাক্ষাৎ শ্রীবিষ্ণু এবং আইজাক নিউটনের যুগ্ম অবতার। ওনার প্রতিটা কথা তো শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতা এবং নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রের এক অনন্য সমন্বয়।”
“কী রকম?”
“গীতায় আছে কর্মফল, আর তৃতীয় গতিসূত্র বলেছে ইঁট মারলে পাটকেলটি খেতে হবে। অন্যদিকে মার্ফি বলে গিয়েছেন, বাঁশ খাবে ভাবলে বাঁশঝাড় ঢুকবেই। এবারে ভাবো, বাঁশ খাওয়ার চিন্তা তখনই আসবে, যখন বাঁশ খাওয়ার মত কাজ করবে। ঠিক কি না? ব্যাস, দু’য়ে-দু’য়ে চার।”
“হ্যাঁ, সেটা সত্যি কথাই বলেছ। জেনেশুনে খেজুর করতে গেলে কাঁটা ঢুকবেই।”
“হমম।” বলে সান্যালদা সামনে টেবিলের উপর থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে পড়তে পড়তে বলল, “অভীক, খবর দেখেছ? কী সব চলছে চারিদিকে।”
“সে তো অনেক কিছুই চলছে গুরু। তুমি কিসের কথা বলছ?” আমি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললাম।
“আরে চারিদিকে কত প্লেনের অ্যাক্সিডেণ্ট হচ্ছে। রাস্তায় নাহয় ট্র্যাফিক থাকে, কিন্তু আকাশে তো আর ট্র্যাফিক থাকে না। তাহলে কেন হচ্ছে বলো তো?”
“সে আমি আর কোত্থেকে জানব গুরু? তবে আমার মনে হয় বেশিরভাগটাই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেই।”
“হ্যাঁ, সেটা অবশ্য হতে পারে। অত ওপরেই বা আর মিস্তিরি বা সার্ভিস সেণ্টার পাবে কোত্থেকে?”
“মজা করছ গুরু? ওই রকম পরিস্থিতিতে পড়লে পিলে উঠে এসে গলায় আটকে যাবে।”
“তা অবশ্য ঠিক বলেছ। একটু অবিবেচকের মত বলে ফেলেছি।”
“সেটা বুঝেছি গুরু। আমি নিজেই তো একবার –”
“এই দাঁড়াও, দাঁড়াও। কী বলছ? তুমি নিজে প্লেনের মধ্যে ওই রকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলে?”
“নইলে আর বলছি কী গুরু? আর তার সাথে মার্ফি বাবাজীর দয়ায় প্রাণ একেবারে গয়া-কাশী হয়ে যেতে বসেছিল।”
“বলো কী! প্লেনের সাথে মার্ফি?”
“সেটাই তো গুরু। সেটা যে কী ভয়ানক কম্বিনেশন, ওই জায়গায় না পড়লে বোঝা যায় না।”
সান্যালদা কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “এই কেসটা তো কখনও বলোনি আগে। কী হয়েছিল?”
“দাঁড়াও বলছি,” বলে বেয়ারাকে আরেক কাপ চা দিতে বললাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেয়ারা চায়ের কাপটা সামনে রেখে দিয়ে গেলে কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে গল্পটা শুরু করলাম।

সালটা ২০০৯, মুম্বাইতে চাকরি করছি। বাড়ি আসার সময় তখন গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসেই আসতাম। দারুণ ট্রেন, খাওয়াটাও বেশ। আর ট্রেনের মধ্যে লোকজনদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সময়টাও বেশ কেটে যেত। কিন্তু সেবার একটা কাণ্ড হ’ল। পুজোর ঠিক আগে আগেই অফিসে কাজ নিয়ে একটু ঝামেলার জন্য ছুটির আবেদন করতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। আর সেই চক্করে ট্রেনের টিকিটটা করতেও হয়ে গেল আরও দেরি। ভাবলাম তৎকালে টিকিটটা কেটে নেব। কিন্তু ওয়েটিং লিস্টে নিজের নম্বরটা দেখে প্রথমে অফিস, তারপরে বস, এবং শেষে নিজের উপর খিস্তি ছাড়া আর কিছুই বেরোল না। কিছু উপায়ান্তর না দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফ্লাইটের টিকিট কাটতে হ’ল। আর ট্রেনে যাওয়া-আসা করার পরে ফ্লাইটের টিকিটের দাম দেখে তো মনে হচ্ছিল এর চেয়ে এয়ারলাইনসকে নিজের কিডনিগুলো খুলে ঠোঙায় পুরে দিয়ে দিলেই হয়ত ভাল হত। কিন্তু কী আর করা। পুজোর সময় বাড়ি যেতে হ’লে টিকিটের বাড়ি খেতেই হবে। সেদিনই হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, আম আদমি আর আম্বানির সাথে পার্থক্যটা কোথায়। তো সে যাই হোক, নিজের তিন সপ্তাহের মাইনে বায়ুদেবতার পায়ে দক্ষিণা দিয়ে সাতদিন পরের টিকিট পেলাম।

গড়াতে গড়াতে যাওয়ার দিনটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। অফিসে এমনই একদিন বসে আছি, পাশ থেকে আমার এক জুনিয়র সহকর্মী জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা অভীকদা, তুমি তো খুব সিনেমা দেখো?”
আমার সিনেমা দেখার বাতিকটা অফিসে প্রায় সর্বজনবিদিত। মাঝেমধ্যে অফিসের মধ্যেই আমার সিনেমার কালেকশনটা ড্রাইভে পুরে এনে প্রায় হরির লুটের মত বিলিয়ে দিই। সেই সুবাদে অন্যদের কাছ থেকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সিনেমার সন্ধানও পেয়ে যাই। আমি আমার সহকর্মীটিকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে সে আবার বলল, “তুমি সাইকোলজিক্যাল হরর সিনেমা দেখো?”
অফিসে বসের সাথে ঝামেলা হওয়ার পরে বাড়ি গিয়ে বসকে খতম করার অভিনব পদ্ধতির সন্ধান করতে গিয়েই আমার সাইকোলজিক্যাল হরর সিনেমার সাথে পরিচয়। সিনেমাগুলো দেখতে দেখতে ভিক্টিমদের জায়গায় বসকে কল্পনা করে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত পৈশাচিক আনন্দ আসত, আর রাতের ঘুমটাও চমৎকার হত। কিন্তু সেসব আমার সহকর্মীটিকে ভেঙে না বলে শুধু বললাম, “অবশ্যই দেখি। আমার দারুণ লাগে।”
সহকর্মীটি উৎসাহিত হয়ে বলল, “ব্যাপক। তাহলে আজ তোমার জন্য একটা দারুণ সিনেমা আছে। একেবারে নতুন ধাঁচের। এ জিনিস আগে কখনও দেখোনি।”
“কী সিনেমা?”
“ফাইনাল ডেস্টিনেশন।”
অদ্ভুত নাম লাগল সিনেমাটার। জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের উপরে গল্পটা?”
“আরে অভীকদা, সেটা বলে দিলে তো পুরো সাসপেন্সটাই নষ্ট। তুমি আমার ড্রাইভটা নাও, এতে সিনেমাটা আছে। তুমি নিজে দেখে বলো কেমন লাগল।”
সহকর্মীর কথায় সিনেমাটার প্রতি আগ্রহটা চড়াৎ করে বেড়ে গেল। সিনেমাটা তড়িঘড়ি নিজের ড্রাইভে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম অফিস শেষ হওয়ার। বিকেল পাঁচটা বাজা মাত্রই ড্রাইভটি পকেটে পুরে সোজা দৌড় বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছে ভাবলাম, “সিনেমাটা এখনই দেখে নেব?” কারণ ফ্লাইট পরের দিন সকাল আটটায়। সেজন্য বাড়ি থেকে বেরোতে হবে খুব দেরি করে হ’লেও সকাল সাড়ে চারটেয়। তার মানে ঘুম থেকে উঠে যেতে হবে রাত সাড়ে তিনটের মধ্যে। আর আমার নিজের ঘুমের উপরে অগাধ আস্থা। ইতিহাস সাক্ষী আছে, আমি চোখ বুজলে আমাকে সোঁদরবনের বাঘে এসে কামড়ালেও সে দাঁতে ব্যথা নিয়ে “ম্যাও ম্যাও” করতে করতে কেটে পড়বে। অতএব, রাতে ঘুমনোর প্ল্যানটা মুলতুবি রেখে নতুন সিনেমাটা দেখেই নাহয় কাটানো যাবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। রাত এগারোটা নাগাদ ডিনার সেরে সতান বসে গেলাম সিনেমাটা নিয়ে।

কুড়ি মিনিট যেতে না যেতেই বুঝলাম কী কুক্ষণে সিনেমাটা দেখতে শুরু করেছি। সিনেমাটা শুরুই হ’ল একটা প্লেন অ্যাক্সিডেণ্ট দিয়ে। এক যাত্রী ঘটনার পূর্বাভাষ পেয়ে যাওয়াতে প্লেনের অনেক যাত্রীকেই বাঁচিয়ে নেয়, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই এক এক করে মরতে থাকে। আর সেই যাত্রী প্লেনে ওঠার আগে থেকেই প্লেনের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে একটা অশুভ ইঙ্গিত পেতে থাকে। হয়ে গেল রে! আমার আবার আজ সকালেই ফ্লাইট। কপালে কী নাচছে, কে জানে। পেটের মধ্যে বেমালুম গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল। মনে মনে আমার সেই সহকর্মীর মুণ্ডপাত করছি, “শালা সিনেমাটা দেখানোর আর টাইম পেল না? আজকেই দেখাতে হ’ল?” মাথায় ঘুরতে লাগল, প্লেনে ওঠার আগে যা কলকব্জা হাতের সামনে পাব, একবার ভাল করে টেনেটুনে দেখে নেব। কিছু গড়বড় লাগলে সোজা উল্টোদিকে দৌড় দেব। সিনেমাটা শেষ করে এইসব ভাবতে ভাবতে বেরনোর সময় এসে গেল। গাড়ি এসে গিয়েছে বাড়ির নিচে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তৈরি হয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠলাম গাড়িতে, আর সিনেমাটা ততক্ষণে মাথার মধ্যে বাজে ভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসে গিয়েছে। এই গাড়ি এয়ারপোর্টে পৌঁছবে তো? রাস্তায় কোথাও কোন ট্রাক এসে ক্যারমবোর্ডের ঘুঁটির মত উড়িয়ে দেবে না তো? ব্রিজ থেকে উল্টে গাড়িটা নিচে পচা কাদার মধ্যে গিয়ে ডুবে যাবে না তো? গাড়ির পিছন থেকে তেল লিক করতে করতে দুম করে দোদমার মত ফেটে যাবে না তো? এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি এয়ারপোর্টে পৌঁছে গিয়েছি। পেটের মধ্যে গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল। ফ্লাইট-অ্যাক্সিডেণ্ট-ফাইনাল ডেস্টিনেশন – সব মিলিয়ে মাথার মধ্যে বাঁধাকপির ঘ্যাঁট দশা। বোর্ডিং পাস, সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে এসে বসলাম নির্ধারিত গেটের সামনে এসে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনগুলোকে দেখছি, আর মাথার মধ্যে ঘুরছে সিনেমার সিনগুলো। এমন সময় খেয়াল পড়ল বাইরে আকাশের দিকে। এতক্ষণ এইসব ভাবনার জন্য চোখে পড়েনি। কিন্তু আকাশের দিকে চোখ পড়তেই পিলেটা দুম করে ডিগবাজি খেয়ে গলার কাছে ধাক্কা খেয়ে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে গেল। আকাশে মেঘ, তার সাথে প্রবল ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা। মনে পড়ে গেল মার্ফি বাবাজীর কথা, “যদি ভাবো কেলো হবে, তোমারে বাঁচায় কে ভবে?” একে ফাইনাল ডেস্টিনেশন, তার উপরে আজকেই ফ্লাইট, আর তার সাথে চৈত্র সেলের অফারের মত এসে জুড়ে বসেছে ঝড়বৃষ্টি। আজ আমায় বাঁচায় কে? এই ভাবতে ভাবতে আমার ফ্লাইটের ঘোষণা হ’ল। সমস্ত যাত্রীদের প্লেনের দিকে এগোতে বলা হ’ল। আমি সবার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। আহা রে, এরা জানেও না, যে আজ এরা সবক’টা ওই কালান্তক প্লেনের মধ্যেই তন্দুরি হয়ে যাবে। একটা অজানা দুঃখমিশ্রিত ভয়ে পেটটা ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে যেতে শুরু করল। টুকটুক করে গেট দিয়ে প্লেনের দিকে এগোলাম।

প্লেনে উঠে নিজের সিটে এসে বসেছি। ইতিমধ্যে রাস্তা দিয়ে আসতে গিয়ে প্লেনের দরজা, নাটবল্টু, সিটের হাতল টেনেটুনে দেখতে গিয়ে বেদম ঝাড় খেয়েছি ফ্লাইটের লোকজনের কাছে। বলে দিয়েছে, আর একটাও জিনিস নিয়ে টানাটানি করলে সোজা কান ধরে প্লেন থেকে নামিয়ে দেবে। তাই নিরুপায় হয়ে সিটে বসে ভেবে চলেছি, জান বড় না মান বড়। একবার মনে হ’ল, জান থাকলে তবেই না মান থাকবে। সেই ভেবে যেই আমার সামনের সিটের পিছনের ট্রে-টাকে টেনে দেখতে গিয়েছি, দেখি একজন এয়ার হোস্টেস আমার দিকে কটমট করে চেয়ে দেখছে। অগত্যা নিরস্ত হয়ে হাত গুটিয়ে বসে গেলাম। এরা বুঝতেও পারছে না, যে আমি এদের বাঁচানোর চেষ্টা করছি। মরুক গে, সবাই একসাথে তন্দুরি হয়ে যাব। এই ভেবে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। আমার পাশের সিটে বসেছেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। দেখে মনে হ’ল বেশ বয়স। তিনি সিটে উঠেই দিব্যি ঘুম লাগিয়েছেন, মুখে একটা প্রশান্ত হাসি। আমি ভদ্রলোকটিকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জানালা দিয়ে তাকালাম বাইরের দিকে। আকাশ কালো করে মেঘ, বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ঝড়ের বেগও বাড়ছে, আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় ভাবটা। কী যে আছে কপালে, কে জানে। আকাশপাতাল ভাবছি, এমন সময় প্লেনের মধ্যে স্পীকারে ফ্লাইট ছাড়ার ঘোষণা হ’ল। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল। এই দেখতে দেখতে ছেড়ে দিল আমাদের প্লেন। ধীরে ধীরে রানওয়ের দিকে এগিয়ে তারপর তীব্রগতিতে পাড়ি জমাল আকাশে।

মিনিট কুড়ি হয়েছে, প্লেন তখন মধ্যগগনে। আর সময়ের সাথে সাথে আকাশের অবস্থা হয়ে উঠছে আরও শোচনীয়। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি, আর সাথে বিদ্যুতের চমক। যদি আমাদের প্লেনের উপরে বাজ পড়ে, তাহলে? এত উপর থেকে নিচে পড়লে তন্দুরি না হ’লেও অন্তত কিমা যে হয়ে যাব, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ইতিমধ্যে আমার পাশের ভদ্রলোক জেগে উঠেছেন। তিনি একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার চোখ বুজলেন। ওনাকে দেখে আমার টেনশনের পারদটা একধাক্কায় আরও খানিকটা বেড়ে গেল। হঠাৎ প্লেনটা চলতে চলতে দুম করে কিছুটা নিচের দিকে নেমে আসল। নাগরদোলায় উপর থেকে নিচে নামার সময় পেটটা যেমন খালি লাগে, একেবারে সেই অনুভূতিটা পেলাম। প্লেনটা নিচের দিকে এভাবে পড়ল কেন? যদিও জানতাম যে ওগুলো “এয়ার পকেট”, অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের মধ্যে এমন কিছু কিছু জায়গা, যেখানে বাতাসের চাপ খুবই কম, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার বিজ্ঞানের বদলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার দশা। সিটের হাতলটাকে প্রাণপণে চেপে ধরে রয়েছি, আর চোখ বন্ধ করে বসে আছি। এমন সময় আমার পিঠে কেউ একটা হাত রাখল। চোখ খুলে দেখি, আমার পাশে বসা সেই ভদ্রলোক। মুখে সেই প্রশান্ত হাসিটা নিয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কি বেটা, ভয় করছে?”
আমি শুকনো গলায় উত্তর দিলাম, “তা একটু করছে, আঙ্কল।”
“কিসের ভয়? পড়ে যাওয়ার?”
আমি একটু থতমত খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললাম, “হ্যাঁ আঙ্কল, সে-সে-সেই রকমই বলতে প-পারেন।”
এবারে আমার কথা শুনে ভদ্রলোক যেটা বললেন, সেটা শুনে আমার পুরো ফ্লাইটে আর গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোয়নি। কলকাতায় নামার পরে শেষে ধড়ে প্রাণ এসেছিল।

এই পর্যন্ত বলে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলাম। সান্যালদা এতক্ষণ ধরে হাঁ করে পুরোটা মন দিয়ে শুনছিল। আমাকে থামতে দেখে একটু অসহিষ্ণু হয়েই বলল, “তা তোমাকে ফ্লাইটে চাপার আগে ওসব ছাইপাঁশ সিনেমা দেখতে কে বলেছিল?”
“সে কি আর জেনেশুনে দেখেছিলাম গুরু? ওই জিনিস হবে জানলে কে দেখত?”
“আর সেই ভদ্রলোক তোমায় কী বললেন, সেটা তো বললে না?”
“তিনি আমায় কী বলেছিলেন জানো?”
সান্যালদা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী বলেছিলেন?”
আমি সোজা হয়ে বসে সান্যালদার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গম্ভীরস্বরে বললাম, “বেটা, আমরা অলরেডি এত উপরে আছি। নাহয় আরেকটু উপরেই চলে যাব। ভয় কী?”
সান্যালদা একটা বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে হো-হো করে অট্টহাস্য করে উঠল।


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< ফ্রি কা খানা

লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা জমা দিতে ছবিতে ক্লিক করুন