গন্ধ

লেখক : মধুমিতা ঘোষ

                      

‘হরিণখুড়ি ধানের গন্ধ পাও ঠাকুমা?’

শোভাদেবী বড় করে নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘না কই? আর সে ধানের গন্ধ তোকে বলে দিতে হবে না। ঘরে থাকলে আপনিই টের পাব।’

বাপ্পাই ওরফে ডঃ সায়ক মিত্র শোভাদেবীর চোখের সামনে মেলে ধরা ধান মুঠিবদ্ধ করে ঈষৎ ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘প্রফেসর সেন এই হরিণখুড়ি ধানটা ফিরিয়ে আনার জন্য কী অক্লান্ত পরিশ্রমই না করেছেন। ডঃ বিশ্বাস, ডঃ ম্যাথুর, ডঃ রায়চৌধুরী আমাদের ফুল টিম পাশ করিয়ে দিল আর তুমি বলছ এটা না? চোখে ছানি বলে দেখতে পাচ্ছ না।’

শোভাদেবী হেসে ফেলে বলেন, ‘ওরে বাপ্পাই এত লেখাপড়া শিখেছিস আর এটা জানিস না যে নাক শুধু গন্ধ নেবার জন্য কাজে লাগে। আসল গন্ধ নেয় আমাদের মস্তিষ্ক। সেটা তো মনে হয় ঠিকই আছে রে দাদুভাই।’

শোভাদেবীর সুগার আর প্রেসার দুইই আছে। তাই ছানির অপারেশন করা যাচ্ছে না। তাছাড়া বয়সও প্রায় তিরাশি হতে চলল। সেজন্য ডাক্তাররা রিস্ক নিতে ভয় পাচ্ছেন। শোভাদেবী নিজেও বলেন, ভগবান চোখ নিয়েছেন নাকটা তো এখনও নিতে পারেননি।

তা ঠিক, শোভাদেবীর ঘ্রাণশক্তি প্রখর।

শোভাদেবী মাথা নেড়ে বললেন, ‘কালীগঙ্গা নদীর ধারে গোপালীকাকা, রশুলচাচারা ক’ঘর চাষ করত। চালটা গোবিন্দভোগের থেকে একটু বড়। আবার মিনিকিটের থেকে ছোট। সে ধানের কী গন্ধ রে বাপ্পাই। পুবের ঘরে মাটির বড় হাঁড়িতে রাখা থাকত। বাড়িময় সে চালের সুবাসে ম ম করত। ও ধানের বীজ সব মরে হেজে গেছে। তোর বাবাও কখনো দেখেনি।’

বাপ্পাই সামান্য অসহিষ্ণু কন্ঠস্বরে বলল, ‘কিন্তু বিজ্ঞানের হাত ধরে আমরা অনেক কিছুই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি ঠাকুমা। তুমি যদি ভেবেই বসে থাকো যে, যা হারিয়ে যায় তা বরাবরের জন্যই যায়, তাহলে কোনদিন আমাদের তৈরি হরিণখুড়ি ধানের মধ্যে তোমার চেনা গন্ধ পাবে না।’

শোভাদেবী মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘তাহলে তো আমায় মিথ্যে করে বলতে হয় রে বাপ্পাই।’

বাপ্পাই অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। তারপর ঠাকুমার ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় ওর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মনটা ছানাকাটা হয়ে রয়েছে। কী করা দরকার বুঝে উঠতে পারছে না। একবার ভাবল প্রফেসর সেনকে ফোন করে ঠাকুমার কথাটা জানাবে। তারপর ভাবল, না সেটা ঠিক হবে না। ঠাকুমার ঘ্রাণশক্তির কদর ওর কাছে যতটা অন্য কারো কাছে নিশ্চয়ই ততটা নয়।

হরিণখুড়ি ধানের জন্মলগ্ন থেকে বাপ্পাই রয়েছে। প্রফেসর সেন একটু পাগলাটে গোছের। হয়ত অরুশিখা কোন রবিবার সিনেমা দেখার প্ল্যান করেছে। কিন্তু প্রফেসর সেন ফোন করে বললেন, ‘সায়ক আধঘন্টা টাইম দিচ্ছি। ম্যাথুর আর রায়চৌধুরীকে পিকআপ করে ফার্মে চলে এস।’ ব্যস অরুশিখা রেগে ফায়ার।

একদিন অরুশিখার বাপের বাড়িতে একটা গেট টুগেদার ছিল। অরুশিখার কাকা জার্মানি থেকে এসেছেন। অরুশিখার বিয়েতে আসতে পারেননি। তাই বারবার আদরের ভাইঝিকে বলেছেন, ‘তুই সায়ককে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসবি। জামাইয়ের সঙ্গে ভাল করে আলাপ পরিচয় করা যাবে। জামাই তো শুনি ধান-টান নিয়ে রিসার্চ করে। অনেক কথা জামাইয়ের কাছ থেকে জানার আছে। তোরা জানিস না দাদা বা মেজদা জানে বরাবর আমার এগ্রিকালচারের ওপর ঝোঁক। মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিলাম যে বিশ্বভারতীতে এগ্রিকালচার নিয়ে পড়ব। কিন্তু বাবার ইচ্ছেতে জয়েন্টে বসলাম। ভাল র‍্যাঙ্ক করলাম। ব্যাস বাবা জোর করে যাদবপুরে ভর্তি করে দিলেন। বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস ছিল না। কী হবো ভেবেছিলাম আর কী হয়ে গেলাম! জীবনটা অন্য খাতে বয়ে গেল।’

অরুশিখা কাকার হাতের আঙুলগুলো মটকে দিতে দিতে বলেছিল, ‘এত বড় চাকরি করছ। টাকা-পয়সা, সম্মান মানে মানুষ যা যা চায় সবই পেয়েছ। তাহলে আর আফশোস কেন?’

– ‘কিছুটা ঠিক। আবার পুরোপুরিও ঠিক নয়। মনের খিদে না মেটার যন্ত্রণা তো রয়ে গেছে। যাকগে কথায় বলে, গতস্য শোচনা নাস্তি।’

সেদিন সায়ক অরুশিখার বাড়িতে গিয়েছিল কিন্তু প্রফেসর সেনের ডাকে আধঘন্টার বেশি থাকতে পারেনি। এর পরে অরুশিখা টানা তিনদিন কথা বলেনি।

অথচ অরুশিখা সায়কের রিসার্চ নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী। এক রবিবার লঙ ড্রাইভে প্রায় গুসকরার কাছে ওরা চলে গিয়েছিল। মাঠভরা ধানক্ষেতের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সায়ক বলেছিল, ‘এই যে ধান দেখছ, এক একটা প্রজাতির ধান উৎপন্ন করার পিছনে যে কত শ্রম আছে সেটা ভাবতে পারবে না।’

অরুশিখা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘প্লিজ বল না গো।’

সায়ক উৎসাহী হয়ে বলতে শুরু করেছিল, ‘প্রথমে দেখতে হয় পরিবেশে যেসব প্রজাতির ধান ছড়িয়ে আছে সেগুলো থেকে কোনটা বেছে নেওয়া যাবে। এছাড়া কোষের মধ্যে যে ক্রোমোজমগুলো আছে সেগুলো যদি উল্টোপাল্টা করে দিই অর্থাৎ ক্রশিং করি তাহলে নতুন প্রজাতির ধান জন্মায়। আবার এক একসময় দেখা যায় প্রাকৃতিক বিবর্তনের পথ বেয়ে চাষিদের অজান্তেই নতুন প্রজাতির বীজ তৈরি হয়।’

অরুশিখা দু হাত উল্টিয়ে বলেছিল, ‘বাঃ সৃষ্টিকর্তার কাছেই সৃষ্টির রহস্য অজানা থেকে গেল।’

– ‘হ্যাঁ তা বলতে পারো।’

– ‘আচ্ছা কীভাবে বীজগুলি সিলেক্ট করো বা কালেক্ট করো তোমরা?’

– ‘তার একটা প্রসিডিওর আছে। তবে পছন্দর ওপরই সবকিছু নির্ভর করে না। হয়ত কোন ধানের সুগন্ধ আছে তো ফলন ভাল নয়। আবার রোগপোকার আক্রমণ এত বেড়ে গেল যে চাষিরা চাষ করে লাভবান হবে না। অথবা shattering habit মানে ধান পাকার আগেই ঝরে গেল। তাহলে সে ধানও চলবে না।’

অরুশিখা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেছিল, ‘সন্তানের মতোই।’

সায়ক অরুশিখার মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘আসবে অরু। সে নিশ্চয়ই আসবে। কোন ডাক্তার কিন্তু না বলেননি। বিকলাঙ্গ শিশু পূর্ণ শরীর পাবার আগেই চলে গেছে। এবারে যে আসবে দেখবে পূর্ণ রূপ নিয়েই আসবে। কত গবেষণা করে একটা বীজ তৈরি হয়। কিন্তু সেটা যদি সমাজের কাজে না লাগে তখন কিন্তু পরিশ্রমের কথা মনে রাখি না। ধ্বংস করে ফেলি। তবে তফাৎ কোথায় জানো?

অরুশিখা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে সায়ক বলেছিল, ‘ব্রীডার আইস দিয়ে বিজ্ঞানী সঠিক ধানের যে যে চরিত্রগুলো পছন্দ হয় সেগুলো বাছতে পারে। কিন্তু মানুষ পারে না। তাহলে তো সন্তান মানুষ করার সময় সব বাবা-মাই চাইত যত ভাল ভাল গুণ আছে সব কিছু তাদের সন্তানের মধ্যে থাকুক।’

অরুশিখা সায়কের হাতটা গলে ঘষতে ঘষতে বলেছিল, ‘আচ্ছা এই ক্রশিং কোথায় হয়?’

সায়ক বলেছিল, ‘নার্সারিতে হয়। কখনও কখনও নেট হাউসেও করা হয়। তারপর এই বীজগুলো মাল্টিপ্লিকেশন করে ভারতের নানা জায়গায় এমনকী সারা পৃথিবীতে কোড নাম্বার দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোন কোন এলাকার জলবায়ুতে সেটা খাপ খাচ্ছে সেটা দেখা হয়। এমন অনেক ধান আছে আমরা পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বসে তৈরি করি অথচ পাকিস্তানের জলবায়ুতে ভাল ফলন দিয়েছে।’

অরুশিখা ফ্লাক্সে কফি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘আমার ছোটকাকাকেই দেখ না। মানুষ হল কসবার এঁদো গলিতে। এখন জার্মানিতে রীতিমত প্রতিষ্ঠিত।’

সায়ক ঘাড় নেড়ে বলল, ‘শৌণককে তো তুমি চেনো। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করত। কলকাতায় তেমন কিছুই করে উঠতে পারেনি। হঠাৎ শুনি মালয়েশিয়ায় ব্যবসার কাজ নিয়ে যাচ্ছে। এখন তো এফ বি তে ওর ফোটো পোষ্ট দেখে বুঝতেই পারি কী অবস্থায় আছে। বন্ধুরা যারা ওখানে গেছে তারাও তো সবাই বলে, শৌণক সাকসেসফুল।’

– ‘আচ্ছা তুমি যে বলেছিলে হরিণখুড়ি ধান এবার ফলবে।’

সায়ক ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ‘আশা তো করছি। সাগরদ্বীপের এক চাষি শুকদেব নাথ লুপ্তপ্রায় ধানের বীজ সংগ্রহ করার জন্য রাজ্যের নানা প্রান্ত প্রায় চষে বেরিয়েছেন। বলা যায় ওনারই আবিষ্কার হরিণখুড়ি ধান। সেখান থেকেই গবেষণার শুরু। শুনলে অবাক হবে ঠাকুমার সেই কালীগঙ্গা গ্রাম থেকেই বীজটা পাওয়া যায়।’

– ‘আচ্ছা তুমি তো কোনদিন হরিণখুড়ি ধান দেখোনি। তোমার স্যারেরাও দেখেননি। তাহলে কী করে বুঝবে যে ওটাই হরিণখুড়ি ধান?’

-‘বাহ ভাল প্রশ্ন করেছ। এক্ষেত্রে আমার অবলম্বন ঠাকুমা। ঠাকুমা নিজেই বলেন, ঠাকুমার নাক নাকি কুকুরের মত।’ অরুশিখা কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, ‘এটা মানতেই হবে ঠাকুমা কিন্তু গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারেন কীসের গন্ধ। প্রায়ই বলেন, তোদের মত পড়াশোনা করিনি বটে কিন্তু মাটি ঘেঁটে জলার দেশে মানুষ হয়েছি।’

-‘আসলে মানুষের ৭৫ শতাংশ ভাবাবেগ গন্ধের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত থাকে। বিশেষত সেটা যদি কোনও আনন্দ বা সুখের স্মৃতিকে স্মরণ করায়।’

-‘তাই নাকি? জানা ছিল না তো!’

-‘আরে মিলিয়ে দেখো তোমারও কোন না কোন গন্ধ এরকম নাকে লেগে আছে। যেমন হরিণখুড়ি ধানের সঙ্গে ঠাকুমার ছেলেবেলাটা জড়িয়ে আছে।’

অরুশিখার নাকে চট করে চ্যুইংগামের গন্ধটা ঝাপটা মারল। সেই কবেকার কথা। রজতস্যারের কোচিং ক্লাসে পার্থজিৎ পড়তে আসত। খুব ভাল ম্যাথস করত। অরুশিখা ওর খাতা দেখেই হোমওয়ার্কের ম্যাথসগুলো টুকে নিত। এভাবেই ওরা দুজনে কখন যে কাছাকাছি এসে পড়েছিল জানেই না। ২৫শে ডিসেম্বর কোচিং ক্লাসের সবাই দল বেঁধে ইমামবাড়া গিয়েছিল। ১৫২টা সিঁড়ি ভেঙে ওরা একদম ওপরে উঠেছিল। সবাই নেমে গেলেও ও আর পার্থজিৎ রয়ে গেছিল। চ্যুইংগাম চিবনো মুখটা অরুশিখার মুখের ওপর হঠাৎ করে নেমে এসেছিল। সেই শুরু। তারপরও কয়েকবার সেই গন্ধের স্বাদ পেয়েছিল অরুশিখা। কিন্তু টুয়েলভের রেজাল্ট বেরনোর পর পার্থজিৎ পড়তে চলে গেল বেঙ্গালুরু আর অরুশিখা বেথুনে। অনেককিছু হারিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধটাও হারিয়ে গেল। কিন্তু সত্যি কী হারিয়ে যায় কিছু! নাহলে সেদিন দিদির মেয়ে সোনালী যখন বলল, ‘কেন গো মাসিমণি চ্যুইংগাম খাও না? গন্ধটা ভাল লাগে না?’ অরুশিখার মনের মনিটরে ঝট করে সেইদিনটার কথা ভেসে উঠেছিল। মাথাটা নেড়ে না-হ্যাঁ এর মাঝামাঝি রেখেছিল।

 সায়ক ওর হাত ধরে গালে টোকা মেরে বলল, ‘এই কোন গন্ধে হারিয়ে গেলে গো? কে জানে কেন তোমার গা থেকে আমি মাটির সোঁদা গন্ধ পাই। খুব ভাল লাগে আমার।’

সেদিন গুসকরা থেকে ফেরার সময় অরুশিখা বলেছিল, ‘আমার মাটিতে কী কম আছে বলতো। বীজ থেকে চারা বেরোচ্ছে না কেন?’

সায়ক অরুশিখাকে কাছে টেনে নিয়ে আশ্বস্ত করার সুরে বলেছিল, ‘সময় দাও। ধৈর্য ধরো। আর প্লিজ বারবার এই একই চিন্তা মাথা থেকে বার করে দাও।’

-‘কী গো এমন অন্ধকারের মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছ কখন থেকে?’

অরুশিখার কথাতে সায়ক ফিরে তাকাল।

-‘এনি প্রবলেম সায়ক? অফিসে কোন ঝামেলা?’

সায়ক নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।

অরুশিখার প্রায় তিন বছরের বিবাহিত জীবন। তারও আগে চার বছর মেলামেশা সায়কের সঙ্গে। তাই ও জানে এই সময় সায়ক কোন কথার জবাব দেবে না। কিছুক্ষণ একলা থাকতে চাইবে। আর এরকম দিনে সায়ক অরুশিখার শরীরের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে শুধু গন্ধ নেবে। প্রথম প্রথম অরুশিখার খুব অদ্ভুত লাগত। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সায়ক আর অরুশিখা বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে।

হঠাৎ সায়ক বলল, ‘আচ্ছা এতোয়ারের কথা তোমায় বলেছি অরু?’

মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে অরুশিখা বলল, ‘সেই সাঁওতাল পরগণার চাষিটা?’

-‘হ্যাঁ। আমাদের বলেছিল, বাবু পুন্নিমার রা’তে ধানের মাঠে আমরা স্বামী-ইস্ত্রী উদোম হয়ে শুয়ে থাকি। ভালবাসি। আমাদের দেখে ধানগাচগুলান হাসে। তারাও ভালবাসে। জানো অরু, ওদের ধারণা ওদের বীর্যরসেই ধান গর্ভবতী হয়। ধানের বুকে দুধ জমে।’

অরুশিখা সায়কের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলেছিল, ‘সায়ক ওরা অশিক্ষিত। তাই বুজরুকি বা তুকতাকে বিশ্বাস করে। তোমরা বিজ্ঞানী হয়ে এসব কথা বিশ্বাস করো?’

-‘জানো সেকথা শুনে অশেষ খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলেছিল, মাইরি এ তো দেখছি আমার মত কেস। ব্লু না দেখলে আমার ইরেকশনই হয় না। এতোয়ারারা ব্লু ফিল্ম শ্যুট করে। তবে ধানগাছগুলোর ইরেকশন হয়। সিমেন ঢালে। ধানগাছ প্রেগন্যান্ট হয়।’

অরুশিখা কপটরাগে বলল, ‘ছাড়ো যতসব ফালতু কথা। চল শুতে চল।’

বিছানায় অরুশিখার ঊরুসন্ধির ঘ্রাণ নিতে নিতে সায়ক বলল, ‘অরু গন্ধটা পাচ্ছি।’

অরুশিখা সায়কের চুলগুলো মুঠোর মধ্যে ধরে আলতো স্বরে বলল, ‘হুম।’

সায়ক নাভিকুন্ডলীর মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘোরের মধ্যে বলতে লাগল, ‘ক্রশিং করার সময় ভালবাসা দরকার অরু। মাটির কলসি বা খড়ের তৈরি পাত্রে গর্ভবতী বীজ রাখলে ফলন ভাল হবে। হয়ত বা গন্ধও আসবে। কিন্তু ভালবাসার ছোঁয়া নেই। তাই তো ঠাকুমা হরিণখুড়ি ধানের গন্ধ পেল না।’

-‘ঠাকুমার ভুলও হতে পারে।’

সায়ক মাথা নেড়ে বলল, ‘জানি না।’

হঠাৎ অরুশিখার মুখের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে সায়ক ফিসফিস করে বলল, ‘অরু গন্ধটা আমাকে আনতেই হবে। বীজগুলো আজ বিছানায় রাখব।। ভালবাসার রসে তোমার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও ভিজবে। কাল ল্যাবে গিয়ে আবার ক্রশিং করব। দেখে নিও বীজ আমি ঠিক তৈরি করতে পারব। সত্যিকারের গন্ধ আমি নিয়ে আসবোই।’

অরুশিখা জানে সায়কের এই পাগলামিতে সায় না দিলে ও ভীষণ ডিপ্রেশনের মধ্যে থাকবে। দেখল আজ সায়ক ওকে নিয়ে নতুন খেলায় মেতে উঠেছে। দীর্ঘ সঙ্গম হলেও ক্লান্তিকর লাগেনি। অনেকদিন পরে দুজনেই তৃপ্ত।

অরুশিখা জানে সায়ক যখন যে প্রোজেক্ট নিয়ে লেগে পড়ে থাকে সেটার শেষ না দেখে ছাড়ে না। ইদানিং ও একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেশ কিছুদিন মালদা আর মুর্শিদাবাদে গিয়ে থাকতে হয়েছিল। তিনদিনের জন্য ডঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে আবার কোচবিহারে গেছে। আজ ফেরার পথে প্রফেসর সেনের বাড়ি দেখা করে আসার কথা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে বলে সায়ক ফোন করে বলল, ও টানা বাড়ি চলে আসছে।

রাতে অরুশিখা গলা জড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘শুনছ আজ সকালে প্রেগ কালার টেস্ট করে রিপোর্ট পজিটিভ পেয়েছি।’

সায়ক একলাফে উঠে অরুশিখাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সত্যি!’

অরুশিখা সায়কের বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘাড় নাড়ল।

সায়ক অরুশিখার নাইটিটা খুলে পেটের ওপর আলতো করে নাক বুলিয়ে নিঃশ্বাস টেনে বলল, ‘হুম গন্ধটা পাচ্ছি। মাটি গর্ভবতী হয়েছে। দেখে নিও অরু, এবারে ঠিক ঠাকুমার হরিণখুড়ি ধানের গন্ধটা পেয়ে যাব।’

       ____________

লেখক পরিচিতি : মধুমিতা ঘোষ
পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। ভালবাসেন বই পড়তে, বাগান করতে, গান শুনতে। ভালো লাগে বেড়াতেও। জঙ্গল প্রিয়। শখ গল্প লেখা। অনেক গল্প বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।