আইটি প্রফেশনাল দাশু

লেখক : ইচ্ছেমৃত্যু 

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরোবার মুখে দাশুর সঙ্গে দেখা। দাশুকে এইখানে এইভাবে দেখব কল্পনাই করতে পারিনি। সেই কত যুগ আগে স্কুল লাইফে ওর সঙ্গে শেষ দেখা, তারপরেও যে ওকে চিনতে পেরেছি সেটা ওর বিশেষ চেহারার জন্য, চোখদুটি গোল গোল – এখন অবশ্য চশমা, কানদুটি অনাবশ্যক রকমের বড়, মাথায় একবস্তা না হলেও ঝাঁকড়া চুলের অস্তিত্ব এখনও আছে। আর চেহারা দেখলে এখনও মনে হয় – ‘ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুন্ড তাহে ভারি/ যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী’। হ্যাঁ, আমাদের সবার প্রিয় সেই দাশরথি – এতদিন পর আবার মুখোমুখি। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলাম, যে যার কেরিয়ার গোছানোর ইঁদুর দৌড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ছেলেবেলার বন্ধুদের বেমালুম গিয়েছি ভুলে – ফলত কারোর সাথেই আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। আমিও প্রবাস থেকে মাস কয়েক আগে ফিরে রাজারহাট নিউটাউনের এক বিশাল ক্যাম্পাসের একটি কোম্পানিতে আছি। পৃথিবীর অন্য যেকোন জায়গায় দাশুকে দেখলে এতটা অবাক হতাম না যতটা অবাক হলাম ওকে আমাদেরই ক্যাম্পাসের একটি আইটি কোম্পানির বকলেশ গলায় ঝুলিয়ে বের হতে দেখে। প্রথমে আমাকে চিনতে পারেনি, এত বছর পর এক চান্সে চেনাটাই অস্বাভাবিক। যাইহোক, পরিচয় দিতেই চিংড়ি মাছের মত সেই চিরাচরিতভাবে হাত পা নেড়ে অনেক কিছু বলতে শুরু করে দিল। যার সারমর্ম হল – এতদিন পর ও আমাকে দেখে দারুণ খুশি।
আমিই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হাতে টাইম আছে? তাহলে চল, কফিবারে গিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে খানিক’।
‘ইস্কুলের বন্ধুর জন্যে টাইম থাকবে না – বলিস কি রে! তবে শুক্রবার সন্ধেবেলায় কফিবার? নাহে না, চল ‘শুধু’ বারে যাওয়া যাক’ বলেই খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ করে হাসতে লাগল।
দু’জনে কাছেপিঠের একটা বারে দু গ্লাস বিয়ার নিয়ে বসলাম। দুজনেরই অনেক অনেক কথা জমে আছে। সঙ্গে আমার কৌতূহল, দাশু কি সেই আগের মতই আছে… মানে সেই ইস্কুলের দিনগুলোতে যেমন পাগলামি করত! কিন্তু দুম করে পাগলামি এখনও করে কিনা জিজ্ঞাসা করতেও একটু বাধো-বাধো ঠেকল। হাজার হোক, অনেক বছর পর দেখা আর আমরা দুজনেই এখন দায়িত্ববান, রাশভারি অফিসার – সেই সব বেয়াক্কেলে পাগলামি আর আমাদের মানায় না। তাই পুরনো বন্ধুদের নিয়েই কথা এগোতে লাগল। ওর কাছেই খবর পেলাম – যতীন একটা জুতো কোম্পানির মালিক, জলধর নাকি পুলিশের কনস্টেবল, জগবন্ধু হয়েছে ইংলিশের প্রফেসর, রামপদ মিস্টির চেইন-বিজনেস চালাচ্ছে। শুনে বেশ ভাল লাগল। শুনে মনে হল দাশু অনেকেরই খোঁজ খবর রেখেছে। শুধু একই লাইনে থেকেও কেন জানিনা আমার সাথেই যোগাযোগ রাখেনি। অবশ্য আমারই দোষ হতে পারে, আমিও তো কারোর কোনও খবর রাখি না।
দাশুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়ে থা করেছিস?’
কেমন যেন একটু উদাস হয়ে গেল, বলল, ‘সে আর বলিস না। একটা মেয়ের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ প্রেম জমে উঠেছিল। তারপর দেখাও করেছিলাম।। কিন্তু দেখা করার পর থেকে আমাকে আর বেশি পাত্তা দিল না। বলল, আমাকে নাকি ঢলঢলে প্যান্টালুন ও ঢোল শার্টে কেমন কিম্ভুত দেখায়। চ্যাটে কথাবার্তায় আমি পটু হলেও নাকি আসলেই যশোরের কইয়ের মত দেখতে। তাই সে শুধুই বন্ধু থাকতে চায়, বিয়ে টিয়ে করতে চায় না। সেই থেকে মেয়েটি বন্ধুই আছে আর আমারও…’ অনেকটা কথা বলে লম্বা এক চুমুকে গ্লাসের অবশিষ্ট বিয়ারটা শেষ করে ফেলল।
আমারও কেমন অস্বস্তি লাগল, যে দাশু আগে ওই রকম পোষাক পরে ভারি একটা কিছু করেছে ভাব করত আজ তার কারণেই নাকি… খানিক সান্ত্বনা দিতেই বললাম, ‘সেই মেয়েটিও কি অনুষ্কা শর্মা নাকি যে পাত্রকে বিরাট কোহলির মত দেখতে হতে হবে?’ দাশু বিমর্ষ হয়েই বলল, ‘না রে, মেয়েটা তো ঠিকই বলেছে – তোরাও তো আমাকে নিয়ে ছড়া বলতিস, যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী… যাই হোক যা হয়েছে ভাল হয়েছে, বাদ দে’।

আরেক গ্লাস করে বিয়ারের অর্ডার দিয়ে, আগের কথার রেশ ধরে বললাম, ‘সে, ইস্কুলে তো আমরা কত মজাও করেছি, তুই আমাদের সকলের কত প্রিয় ছিলিস। – ছিলিস না বল?’
‘হ্যাঁ তা করেছি, তোর মনে আছে সেই বাক্সের ঘটনাটা?’
‘অতিরিক্ত কৌতূহল ভাল নয় – তাই তো? উফফ ভোলা যায়! আর সেই রামপদর মিহিদানার হাঁড়িতে চীনে পটকা…’ নিমেষে আগের বিমর্ষতা কেটে গেল, দুজনেই হেসে উঠলাম জোর। হাসির দমক থামতে বললাম, ‘তুই কি এখনও মনে করিস, রামপদও দোষী?’
‘তা নয়ত কি! হতে পারে আমার পটকা, ওরও তো হাঁড়ি… তাই না’।
বুঝলাম, এ পাগল এখনও একই পাগল আছে। আমিই সুর বদলে বললাম, ‘তা ঠিকই বলেছিস… হাঁড়ি না এলে তো পটকাও আসত না’।
‘এই তো…তুই এতদিনে বুঝেছিস’ বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল দাশু।
‘আচ্ছা তুই এখন আর সেরকম কিছু করিস নাকি? মানে অফিসে টফিসে?’
দাশুর গোলগোল চোখগুলো আরও গোল হয়ে উঠল শুনে, একটু চুপ থেকে বলল, ‘তা একটু আধটু করি বইকি! ওই বলে না – ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে… আমিও সেই’।
‘শোনা তাহলে কয়েকটা স্যাম্পল…’
‘তখন আমি প্রজেক্টে নতুন ঢুকেছি। আমাদের সবাইকে কিছু ইমপ্রুভমেন্ট পয়েন্টস দিয়ে পিপিটি বানিয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে বলল। আমি আমাদের একজন টিম মেম্বারের কাছে টেমপ্লেটটা চাইলাম – তাতে নিজের মত পয়েণ্ট যোগ করব। সে ব্যাটা আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে শেষ দিন অব্দি দিলই না। তো,  প্রেজেনটশনের দিন মিটিং রুমে একটা কমন কম্পিউটারে যে যার পিপিটি রাখতে বলল। আমি আমারটা রাখার সময় ওর পিপিটি ফাইলের মাঝে মাঝে কয়েকটা নায়িকার হট, সেক্সি ফটো লাগিয়ে দিলাম। তারপর ও যখন প্রেসেন্টেশনের মাঝখানে…হঠাৎ একটা পেজে স্বল্পবসনা নায়িকা… বুঝতেই পারছিস… গোটা রুম হো হো করে হেসে উঠেছে… দুয়েকজন টিপ্পনি কাটল ‘এটাই আসল মোটিভেশন অ্যান্ড ইমপ্রুভমেনট পয়েন্ট’… ম্যানেজারও যা-তা খিল্লি করল। ও বুঝতে পেরেছিল এটা আমারই কাজ কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই…’
আমিও হাসতে হাসতে বললাম, ‘তুই না যা-তা একেবারে!’
‘আরেকটা শোন। গতবছর একদিন অফিসে হাজির হলাম একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। প্রজেক্টের সবাইকে ডেকে ডেকে মিষ্টি খাওয়ালাম – আমার এনগেজমেন্ট ব’লে। সবাই খুব কংগ্রাচুলেট করল। ম্যানেজার আলাদা করে ডেকে নিয়ে বিয়ের ডেট জিজ্ঞেস করল – বললাম ‘এই তো একমাস পর, ৩০-শে এপ্রিল’। তারপর ম্যানেজারদের যা স্বভাব – কতদিনের ছুটি নেব জিজ্ঞেস করল। বললাম – ‘দু’সপ্তাহ, ২৬ থেকে ১০ই মে’। বলল, ‘অতদিন তো হবে না, দেখি কতদিন ম্যানেজ করা যায়। তুমিও টিমে তোমার কাজগুলো একটু বুঝিয়ে দিও’। আমি হ্যাঁ বলে চলে এলাম’।
‘সত্যি? এনগেজমেন্ট! বিয়ের কি হল?’
‘আরে পুরো তো শোন!’
‘তা ঠিক, দাশুর এটা আবার কি খ্যাপামো সেটা না শুনেই মন্তব্য করা ঠিক হয়নি’ ভাবলাম মনে মনে, বললাম – ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বল’।
‘তো, দিন কুড়ি-বাইশ গেছে, ম্যানেজার একদিন বলল, ‘তোমার ছুটিটা একটু অ্যাডজাস্ট করতে হবে। ২৮ থেকে ৮ অব্দি নাও’। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এরপর ২৮ তারিখে একটু দেরি করে অফিস গেছি, ম্যানেজার আমাকে ফ্লোরে ঢুকতে দেখে অবাক – ‘তুমি! তোমার না বিয়ে?’ আমি তো হো হো হা হা করে হাসতে শুরু করে দিলাম। আশেপাশের সবাই হাজির হাসি শুনে। তারপর হাসি থামিয়ে বললাম, এটা তো এপ্রিল ফুল করছিলাম’।
‘সত্যি তুই পারিসও বটে! তারজন্যে প্রোজেক্টের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানো!’ বলে আমিও খুব হাসতে লাগলাম।
‘সেটাই সব বলছিল – তবে শ’ পাঁচেক খরচ করে সবাইকে কেমন মুর্গি বানালাম সেটাও দেখ’।
এরকমই আরও দুয়েকট ঘটনা বলল, কখনও ম্যানেজারের খিল্লি তো কখনও টিম মেম্বারদের সাথে। সবই অবশ্য নিছক মজারই… আমি কয়েকটা ঘটনা শুনে বললাম ‘বাঃ, তাহলে বেশ মজায় আছিস’।
ততক্ষণে গোটা তিনেক করে গ্লাস শেষ হয়েছে, বললাম, ‘চল আরেকটা করে নিয়ে নিই, লাস্ট… আবার বাড়িও ফিরতে হবে’।
‘হ্যাঁরে, এই তো জীবন! এই উইক এন্ডের শুরুতে একটু পান; শনি, রবি ল্যাদ খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া… তারপর আবার ছুটতে থাকো… নাকে দড়ি দিয়ে কাজ… কাজের কাজ করো আর নাই করো, কাজটাকে শো-অফ করো, ম্যানাজারকে তেল দাও। আর তেল না দিতে পারলে, বা শো-অফ না করতে পারলে বছরের শেষে রেটিং খারাপ – চাকরি ছাঁটাই… ছাঁটাইয়ের ভয়…’
শেষ গ্লাসটায় চুমুক দিতে দিতে বললাম ‘কেনরে, তুই তো বেশ ভালই আছিস… হ্যাঁ, এই সব চাপ তো আছেই… টেনশনও… তবে তার মাঝেও যে তুই এরকম রিলিফ খুঁজে নিস এটা তোর আলাদা ক্যালিবার… আমাদের জীবনে তো তাও নেই’।
‘এই ১২ বছরের আইটি কেরিয়ারে একবার তো কোম্পানিই উঠে গেল – গত রিসেশনের সময়… আর একবার ফোর্সড রেজিগনেশন। …তারপরেও বলছিস…’ বলতে বলতে বিয়ারটা যেন বড্ড বিস্বাদ এরকম মুখ করে থেমে গেল।
আমিও কিছু বলতে পারলাম না… শুধু মুখে একটা ‘ওহ্‌’ শব্দ করা ছাড়া।
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ। গমগমে বারটাও যেন হঠাৎ শান্ত হয়ে সময় গুণতে শুরু করেছে – নীরব…নীরবতা…অবিচ্ছিন্ন নীরবতা…
দাশুই মুখ খুলল, ‘বিয়ে-থার কথা বলছিলি না? প্রেমের ঝটকাটা যদি একটা সত্যি হয় তাহলে আরেকটা সত্যি বেসরকারি চাকরির এই অনিশ্চয়তাটা…’
‘তাই বলে কি কেউ বিয়ে করছে না? করে নে, খারাপ কিছু হবে না দেখিস… আর সেরকম কিছু হলে অন্য একটা উপায় হয়ে যাবে… এত কোম্পানি আছে…’
‘নারে এত অনিশ্চয়তা নিয়ে চলা যায় না… বিশেষ করে অন্য একটা জীবনের দায়িত্ব নেওয়া – যায় না…’
‘দাশু, তুই এই কথা বলছিস? তুই কোনওদিন কি ঘটবে না ঘটবে ভেবে কাজ করেছিস? সেই যে স্কুল লাইফে স্যরের পিছনে চীনে পটকা বা এখন ম্যানেজারের পিছনে লাগা… এগুলোর পরিণতি কি হবে ভেবে তুই করেছিস? ভবিষ্যতের গর্ভে কী আছে সেই নিয়ে তো আমরা ভাবি, আমাদের মত মানুষেরা মাথার চুল সাদা করে ফেলি সেইসব ভাবতে ভাবতে… তাই বলে তুই?… দাশু?’
দাশু যেন হঠাৎ আবার উৎসাহ পেয়েছে, উৎসাহে ওর গোলগোল চোখগুলো আরও গোল গোল হয়ে ওঠে, চকচক করে – সেরকমই হল, বলল, ‘তুই তাহলে অফিসের ঘটনাগুলো বিশ্বাস করলি?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম, ‘মানে… মানে এগুলো করিসনি? গুল দিচ্ছিলি?’
দাশু খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল, হাসতে হাসতেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, আবার সেই বিষাদমাখা উদাস মুখ… বলল, ‘তোদের সেই দাশু, সে–ই পাগলা দাশু মরে গেছেরে! যেদিন থেকে এই চব্বিশ বাই সাতের আইটি আপিসে গাল ভরা নামের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গলায় বকলেশ ঝুলিয়েছে, মুখে ফুটিয়েছে ইংরিজি বোল সেদিন থেকে তোদের পাগলা দাশু মরে গেছে… বেঁচে আছে এই ক্লান্ত, অবসন্ন আইটি কেরানী – দাশরথি!’
শুনে আমার গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠল – এ তো আমাদের সবারই কথা! কিন্তু প্রকাশ করতে পারলাম না… গ্লাসের বাকি বিয়ারটা এক ঝটকায় গলায় ঢেলে ক্রমশই উপরে উঠতে থাকা দলাটাকে গিলে নিলাম। বললাম, ‘ওঠ, এবার ফেরা যাক’।


লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।


লেখকের কন্ঠে গল্পটির পাঠ শুনতে এখানে দেখুন

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।