লেখক : মিত্রা হাজরা
আসছিলাম গৌরিপুর থেকে, স্টেশনে দেখলাম মেয়েটাকে, হেসে বলল, “চিনতে পারো বাবু?” “রুণি তো!” “হ্যাঁ দাদা।” মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগের এক রাত। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটা দোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ সেই ঘরের দরজা খুলে একটি মেয়ে বলল, “বাবু ভিতরে এসে বসো, ভিজে যাবে।” তাকিয়ে দেখি উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে, কালোর উপর সুন্দর দেখতে, বড় মমতামাখা দু’টো চোখ, গায়ে একটা পুরানো শাড়ি জড়ানো। ইতস্তত করে ভিতরে আসি, এটা দেহপসারিনীদের পাড়া। কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে, টুল দিল বসতে। একটা তক্তাপোষে তেলচিটে বিছানা, দেওয়ালে কবে চূণ পড়েছিল কে জানে! কোণে হাঁড়ি বালতি, স্টোভ, হতশ্রী দশা।
বলল, “বাবু কি নতুন নাকি এ তল্লাটে?” বলি, “হ্যাঁ, বোন গৌরিপুর বালিকা বিদ্যালয়ের টিচার, ওকে দেখতে এসেছিলাম। তুমি এখানে একা থাকো?” বলল, “না বাবু, আমার ছোট একটা ভাই আছে, তবে এখন সে মাস্টারের কাছে পড়তে গেছে, কাল সকালে আসবে। খুব মাথা ভাইটার, অকালে মা-বাবা চলে গেল, কষ্ট করেও ভাইকে মানুষ করছি।” এমন সময় “কে রে রুণি, এই বিষ্টি বাদলায় খদ্দের পেলি?” রুণি ঝঙ্কার দিল, “মরণ! তোর বর এয়েছে, তার সঙ্গে আলাপ করছি।” দেখি দশাসই এক মহিলা, হেসে বলল, “কতার ছিরি দেখ, সবাই শুকনো মুখে আছে, তাই শুধোচ্ছি।” আমি বুঝলাম ব্যাপারটা। এখন এদের খদ্দের নেওয়ার সময়, উঠে দাঁড়াই। বলল, “বাবু, আজ এই বিষ্টিতে কেউ আসবে না। তুমি বসো। ভাইকে একটু পরে নিয়ে আসব। আমার কাছে থাকবে।” বলি, “তবে যে বললে সকালে আসবে?” বলল, “হ্যাঁ, মাস্টারবাবু ওকে রাতে নিজের ঘরে রেখে দেয়। আমার তো আর ঘর নেই, কোথা থাকবে? আজ খিচুড়ি করব, ভাইবোনে খাব। তুমি দুটি খেয়ে যেও গরীবের ঘরে, অবশ্য যদি খেতে ঘেন্না না করে।” বলি, “না, এখন আমাকে ফিরতেই হবে।”
পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে রুণির হাতে দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম বৃষ্টিতে ওর উপার্জন হ’ল না। কিছুতেই নেবে না। বলি, “তোমার ভাইয়ের জন্য খাতা কিনবে।” আর কখনও ঐ পাড়ায় যাওয়া হয়নি, আজ মনে পড়ে গেল। বলি, “ভাই কেমন আছে রুণি?” চোখ ছলছল করে রুণি বলল, “করোনায় ভাইটা মরে গেছে বাবু।” মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে কি জীবন যুদ্ধে হেরে গেছে রুণি? হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক। রুণি আলাপ করাল, “মাস্টার বাবু।” ভদ্রলোক হাত তুলে নমস্কার করলেন। হাসিতে ভরে গেল রুণির মুখ। না হারেনি রুণি, কত আলো দু’জনের চোখে, দিব্যি আছে দু’জনে।
লেখক পরিচিতি : মিত্রা হাজরা
মিত্রা হাজরা, বাসস্থান ঝাড়খণ্ডের চাইবাসায়। ডিএভি পাবলিক স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা, আকাশবাণী চাইবাসা কেন্দ্রের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন উপস্থাপিকা। অবকাশে গল্পের বই, কবিতা পড়ে সময় কাটান।