যোগসূত্র

লেখক : পিয়ালী বোস

পর্ব ১

চেন্নাই থেকে নিঃসন্তান দম্পতি নিলুফার বিবি আর আজান আলী ট্রেনে উঠল। কলকাতা থেকে তারা এসেছিল চিকিৎসা করানোর জন্য। ডাক্তার বলে দিয়েছে, নিলুফার কোনদিন মা হতে পারবে না। ওপরওয়ালার এই নিষ্ঠুরতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না নিলুফার, শান্ত হয়ে গিয়েছে সে। কিছুক্ষণ পরেই ট্রেনে উঠল শিবু দাস আর পার্বতী দাস, সঙ্গে রয়েছে তাদের সদ্যোজাত কন্যা হাসি। একটা কারখাানায় শ্রমিকের কাজ করে শিবু, মেয়ে-বৌ’কে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছে। তিন কুলে কেউ নেই তাদের। আছে শুধু এক বুড়ি পিসি, তাকেই দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েকে। একে একে সবাই উঠল ট্রেনে। ট্রেন ছাড়ল, হঠাৎ ভীষণ শব্দে ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। নিলুফার বিবি আর আজান আলী সহ আরও কিছু লোক জখম হয়ে কিছু সময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর বুঝতে পারল, ট্রেন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। কোন রকমে সবাই ট্রেনের বগির ভিতর থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধীরে ধীরে বেরনোর চেষ্টা করল। সকলের শরীরেই মারাত্মক যন্ত্রণা। হঠাৎ নিলুফার দেখতে পেল একটি শিশু কাতর কণ্ঠে কাঁদছে, তাড়াতাড়ি সে শিশুটিকে কোলে নিল। বুঝতে পারল, এই শিশুটি শিবু আর পার্বতীর। ওদের জ্ঞান ফেরানোর অনেক চেষ্টা করল আজান আলী। কিন্তু তারা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে যাত্রা করেছে। ছোট শিশু কন্যাটিকে কোলে নিয়ে নিলুফার মাতৃত্বের স্বাদ পেল। বাড়ি নিয়ে গেল ছোট শিশুটিকে, নাম রাখল মুসকান। পরম যত্নে শিশু কন্যাটিকে মানুষ করার অঙ্গীকার করল আজান আলী আর নিলুফার বিবি।

পর্ব ২

রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল কানাই। মাথায় তার অনেক চিন্তা, সামনে মেয়ের বিয়ে, অনেক টাকার দরকার। চাষের কাজ করে কোনওমতে সংসার চলে। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে ,পাশের গ্রামের হারান মণ্ডলের বড়ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের ফাল্গুন মাসে। কিন্তু বিয়ের টাকা জোগাড় করতেই তার কালঘাম ছুটছে। রেললাইন দিয়ে একটা দূরপাল্লার ট্রেন যাচ্ছিল, হঠাৎ বিকট শব্দে ট্রেনের আওয়াজ হ’ল। কানাই দেখতে পেল, ট্রেনের অনেকগুলো বগি উল্টে গিয়েছে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল কানাই, অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচাল সে। সরকার থেকে তাই তাকে পুরস্কৃত করা হ’ল, পঞ্চাশ হাজার টাকার নগদ পুরস্কার পেল সে। ওই টাকা দিয়েই সে মেয়ের বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠল।

পর্ব ৩

বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ঋক। উনিশ বছরের উঠতি যুবক সে, জন্মদিনে বাবার দেওয়া বাইকে চেপে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে জন্মদিনের দিনই দুর্ঘটনার কবলে পড়ল সে। ডাক্তার ঋকের বাবাকে জানায়, মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে ঋকের চোখ দু’টি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যদি কারও চোখ ঋককে দান করা হয়, তবেই সে আবার দেখতে পাবে। অন্যদিকে শহরের অন্য আরেকটি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে বছর চব্বিশের ইঞ্জিনিয়ার আদিল। কর্মসূত্রে সে চেন্নাইতে থাকত, কলকাতায় ফিরছিল ছুটিতে। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনায় সে গুরুতর জখম হয়েছে। তাকে কলকাতার একটি হাপাতালে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ডাক্তার পারলেন না আদিলকে বাঁচাতে। ছেলের এই মর্মান্তিক পরিণাম মেনে নিতে পারছেন না আদিলের বাড়ির কেউ। কিন্তু সেই সময় মন শক্ত করে আদিলের বাবা জানান, তাঁর ছেলের চোখ তিনি কাউকে দান করতে চান, যাতে অন্য কেউ সেই চোখ দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। সেই মত খবর ছড়িয়ে গেল অন্য হাসপাতালগুলোতে। এবং অবশেষে আদিলের চোখ দান করা হ’ল ঋককে, আর ঋক পেল নতুন জীবন।

পর্ব ৪

বিকেলের পড়ন্ত বেলায় বারান্দায় বসে আছে সোহাগ। খুব সাধারণ পরিবারের একটি মেয়ে ছিল সে, বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, মা ছিলেন গৃহবধূ। কলেজের পড়াশোনা শেষ করেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল সোহাগের। শ্বশুরমশাই পছন্দ করে এনেছিল সোহাগকে, পেশায় উচ্চপদস্থ অফিসার রঙ্গন সেন কোনদিনই পছন্দ করেনি সোহাগকে। বাবার মুখের ওপর কোন কথা বলার সাহস ছিল না রঙ্গনের, তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছিল। সোহাগও কোনদিন স্ত্রীর মর্যাদা চায়নি। মা-বাবা কষ্ট পাবে, এই ভেবেই মেনে নিয়ে ছিল সব। কানাঘুষো শুনতে পায়, অফিসের এক সুন্দরী মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে রঙ্গনের। সব জেনেও চুপ থাকে সোহাগ। অফিসের কাজে চেন্নাই গিয়েছে রঙ্গন, সঙ্গে তার প্রেমিকাও আছে। মাঝে মাঝে সোহাগের কান্নাগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। ফোনটা ধরল সোহাগ, অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল, “হ্যালো, এটা কি রঙ্গন সেনের বাড়ি ?”
সোহাগ ধীর কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ।”
“আমি লালবাজার থানা থেকে বলছি। রঙ্গন সেন চেন্নাই থেকে যে ট্রেনে করে ফিরছিলেন, সেটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। উনি গুরুতর ভাবে আহত, ওনাকে কলকাতায় আনা হয়েছে। আপনারা কলকাতার কে.পি.সি. হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।”
ফোনটা রেখেই সোহাগ ছুটল হাসপাতালে। গিয়ে দেখল রঙ্গন শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। একজন ডাক্তার এসে জানালেন, “ভগবানের অসীম কৃপা যে উনি বেঁচে গেছেন। কিন্তু সারা জীবনের জন্য উনি হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়েছেন।”

হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরল রঙ্গন। এই কয়দিন সোহাগ তাকে সেবা করে অনেকটা সুস্থ করে তুলেছে। কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে রঙ্গন। প্রেমিকা রাগিনী সামান্য চোট পেয়েছিল, কিন্তু সে রঙ্গনকে একদিনের জন্যও দেখতে আসে নি। অফিসের একজনের মাধ্যমে রঙ্গন জানতে পারে, রাগিনী নাকি রঙ্গনের মত পঙ্গু মানুষের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। রঙ্গনের ভুল ভাঙে, সোহাগের কাছে ক্ষমা চায়, অনুরোধ করে যাতে নতুন করে তাদের সম্পর্ক শুরু হয়।


লেখক পরিচিতি : পিয়ালী বোস
আমি খুব সাধারণ একটি মেয়ে, মধ্য কলকাতায় ৯০ এর দশকে জন্ম আমার, বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছি। বই পড়তে ভাল লাগে আমার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

দীপায়ন ৩ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে ছবিতে ক্লিক করুন