খাপে খাপ, পঞ্চুর বাপ (সত্য ঘটনাভিত্তিক গোয়েন্দা গল্প)

লেখক : দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়

গত বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে বসন্তের ঠান্ডা আর গরমের মাঝামঝি সময়ের একটা শনিবার। সন্ধ্যায় বাড়িতে তিন মূর্তিতে একসাথে বসে চা খাচ্ছি, সঙ্গে পাঁচুর দোকানের গরম গরম সিঙ্গারা। তিন মূর্তি বলতে আমি অরণ্য কুমার দেব ওরফে অরণ্যদেব একটা কলেজে পার্ট টাইম পড়াই, আমার গৃহবধু স্ত্রী সম্পুর্ণা আর আমাদের হোমিসাইল্ড (ডোমিসাইল্ডের মতো, হোমে থাকে তাই হোমিসাইল্ড) ব্যাচেলর বন্ধু কিংশুক …… আমাদের মিথ্যান্বেষী। আমার দুই মেয়েও তিতাস আর বিয়াসও সাধারণত দু’বেলা এই চা-পানের আসরে থাকে, কিন্তু সেদিন ওদের প্রাইভেট টিউশন থাকায় ওরা দু’জনেই ছিলো না। কিংশুক আমার সাথে স্কুলে পড়তো, শুনেছিলাম ও কোনও এক বিখ্যাত জমিদার বংশের বংশধর। স্কুলের গাঁট্টা স্পেশাল আঢ্য স্যার কিংশুক নারায়ণ রায় থেকে ওকে “কি না রা” বানিয়ে দিয়েছিলেন। কলেজে ওঠার পরে সেই অর্থে আর কোনো রকম যোগাযোগ ছিলো না। সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে সপরিবার অরুণাচল বেড়াতে গিয়ে ল্যান্ড স্লাইডের দরুণ বিধ্বস্ত হয়ে ফেরার সময়ে ঘটনাচক্রে গৌহাটি স্টেশনে আবার দেখা হয়ে যায়। এক কথায় সে যাত্রা ওর সাহায্যেই আমরা বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম। সে আর এক মারাত্মক গল্প, অন্য কখনো আপনাদের শোনাবো।

ওর সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম যে ও সুকিয়া স্ট্রীটের কোথাও মেসে একটা ঘরে থাকে। বাবা, মা মারা যাবার পরে আমাদের ডানলপের দিলীপ গাঙ্গুলি সরণির বাড়ির একতলাটা একেবারে খালিই পড়ে ছিলো। আমাদের সাথে ওকে থাকতে বলায় ও সানন্দে রাজী হয়ে যায়। সেই থেকে আমাদের পরিবারের একজন হয়ে ও এখানে থেকে গিয়েছে। আমরা চাই না, কিন্তু ও এক রকম জোর করেই মাস গেলে একটা মোটা টাকা আমার হাতে, থুড়ি আমার বৌয়ের হাতে গুঁজে দেয়। এছাড়া সংসারের টুকিটাকি বাজার দোকান, মেয়েদের জন্যে ক্যাডবেরি, আমাদের সকলের জন্যে কোনও ভালো সিনেমার টিকিট এসব তো করেই থাকে।

কিনারা একেবারেই সেলফ মেড ম্যান। স্কুল লাইফ থেকেই ইন্সট্যান্ট কবিতা লিখতে পারতো। দারুণ ছবি আঁকে, শুনে শুনে কাউকে এঁকে দেওয়াটা ওর কাছে জল ভাত ছিলো। মারোয়াড়ী কালোয়ারদের দাদা পরদাদার ছবি এঁকে এঁকে বেশ নাম করেছিলো। উদাত্ত ভরাট গলায় গান গায়; শুনেছি এক সময়ে এক বিখ্যাত অসমীয়া শিল্পীর সাথে স্টেজেও নাকি গানটান গেয়েছে। যে কোনও আসর মুহূর্তে জমিয়ে দিতে পারে, আউট নলেজ আর গল্পের স্টক মারাত্মক। মিটার ঘরের ফিউজ সারানো থেকে হান্ডি কাবাব বানানো পর্যন্ত সব কাজেই পটু, কিন্তু সাধারণত কিছুই করতে চায় না, বাড়িতে সে বড্ড কুঁড়ে। সব রকম বই বিশেষত রহস্য উপন্যাসের একেবারে পোকা। আমাদের বাড়িতে আসবার পরে তার পছন্দের শুকতারার হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট আর আনন্দমেলা থেকে শুরু করে ডঃ পঞ্চানন ঘোষালের অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে সত্যজিৎ রায়, আগাথা ক্রিস্টি, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ফ্রেডরিক ফরসাইথ প্রভৃতি লেখকের লেখা বইয়ে সে আমাদের বসার ঘরের দুটো বুক কেস একেবারে ভর্তি করে ফেলেছিলো। প্রতিদিন সকালে ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে লিডিং নিউজ পেপারগুলোয় রাহাজানি, ডাকাতি, খুন, জখমের ঘটনা আর সব ধরণের বিজ্ঞাপনগুলো খুব মন দিয়ে পড়া ছিলো তার দৈনন্দিন অভ্যাস। একেবারে সুত্রবিহীন কেস গুলোর সন্দেহভাজনদের বিবরণ শুনে সেটা ফেক না কি জেনুইন বিচার করে তারপরে বিবরণ শুনে শুনে সন্দেহভাজনের ছবি এঁকে অথবা অকুস্থলে গিয়ে পারিপার্শ্বিক সব কিছু তলিয়ে দেখে সুত্র দিয়ে সে তদন্তে সাহায্য করতো আর বিনিময়ে নিজের পকেট ভরতো। বড় বড় সব পুলিশ, আধা সেনা আর সেনাবাহিনীর অয়াকাডেমিতে মাঝে মাঝে কী সব অপরাধ সংক্রান্ত দুর্বোধ্য সব বিষয়ে ট্রেনিং দিতেও যেতো। কখনও কখনও সেমিনারে আমি ওর সঙ্গী হয়ে গিয়ে গেস্ট রুমে বা অফিসার্স মেসে ভবের ঠাট বসে থাকতাম। এক্সট্রিমিস্ট রিলেটেড কেসগুলোর ক্ষেত্রে তাকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাসমুহ ও সেনা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগকেও সাহায্য করতে দেখেছি। কিনারা আসার পর থেকে প্রায়শই আমাদের বাড়িতে পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী ও সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্তারা যাতায়াত করতেন। পথচারী আর পাড়ার লোকেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, লাল বাড়ির কুঁদুলে গিন্নির কৌতুহল বাড়িয়ে রাস্তার মোড়ে গোপাল লাল ঠাকুর রোডের ওপরে তারা লাগানো গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকতো।

যাই হোক সেদিন সন্ধ্যায় চায়ের আসরে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে আমাদের আলোচনা কলকাতা থেকে ফ্লাই করে সবে উত্তর মেরুতে ল্যান্ড করতে শুরু করেছে, এমন সময় আমাদের সাদা রঙের টাটা ইন্ডিকমের ওয়্যারলেস ওয়াকিটা রিনরিন করে বেজে উঠলো। ফোনের কাছাকাছি আমি বসে থাকায় ক্রেডলটা হাত দিয়ে ওঠালাম।

“রায় সাহেব কি বাড়িতে আছেন”?

ফোনে নম্বরটা সেভ করা ছিলো না, তাই ফোনের সিএলআই (কম্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার)-এ কোনও নাম উঠলো না। ফোনের কাছাকাছি বসে থাকায় খানিক ইতস্তত করে ক্রেডল উঠিয়ে ফোনটা অবশেষে রিসিভ করলাম। পরিচয় জানতে চাওয়ায় ওপারের গম্ভীর পুরুষ কন্ঠ নিজেকে দক্ষিণবঙ্গের শহরতলীর একটি থানার ইনস্পেক্টর-ইন-চার্জ বলে পরিচয় দিলেন। থানাটি কলকাতা শহরের উপকন্ঠে। বাঁহাত দিয়ে রিসিভারটা চেপে ধরে ফোনকর্তার পরিচয় জানিয়ে “কিরে তোকে চাইছেন তো, কথা বল” বলে কিনারাকে ফোনটা ধরিয়ে দিলাম।

কিনারা স্পীকার ফোনের বোতাম টিপে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে কিছুক্ষণ হাই হ্যালো করে কথা বলতে বলতেই ঠোঁট উল্টে, কাঁধ উঁচিয়ে শ্রাগ করে আমায় বোঝাতে চাইলো যে সেও কিন্তু আই সি ভদ্রলোকটিকে চিনতে পারছে না। তারপরে ভনিতা না করে ফোনে সোজাসুজিই বলে দিলো যে ওনাকে চিনতে পারছে না। ওপারের পুরুষ কন্ঠ হেসে জঙ্গল মহলের একটি জেলার এস পি সাহেবের ক্রাইম কনফারেন্সের দিনের রেফারেন্স দিলেন। সংক্ষিপ্ত ক্রাইম কনফারেন্সের পরে “অপরাধ তদন্তের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি” সংক্রান্ত বিষয়ে দুই ঘণ্টা ব্যাপী সেমিনারে কিনারা জোরদার বক্তব্য রেখেছিলো। আমিও সে যাত্রা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে কিনারাকে সাহায্য করতে সঙ্গী হয়েছিলাম। সেদিন জেলার সমস্ত অফিসার উপস্থিত থাকায় অনেকের সাথেই আমাদের আলাপ হয়েছিলো। তার মাঝে উনি যে কে, এটা মনে করা সেই মুহূর্তে আমাদের দুজনের কাছেই ভীষণ শক্ত বিষয় ছিল। সেমিনারের পরে খাবার টেবিলে আমাদের সাথে নাকি ওনার আলাপ হয়েছিলো। জীবনে চলার পথে কত লোকের সাথেই তো সবার আলাপ হয়, কে আর কাকে মনে রাখে! আজকাল আমরা সবাই বড্ড বেশি ব্যস্ত, ভীষণ রকম পেশাদার আর ভারচ্যুয়্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।

যাই হোক উনি একটা বড় ক্যুরিয়ার কোম্পানীর টাকা লুঠের একটা কেসে তদন্তের কাজে কিনারার সহযোগিতা চাইলেন। সোমবার কিনারার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যাবার কথা ছিল। ও জানালো যে আগামীকাল মানে রবিবার ও ফাঁকা আছে, কেবল সেদিনই ও যেতে পারে। পরের দিন ওর স্টেটের বাইরে চলে যাবার কথা আছে। উনি সন্মত হয়ে সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন আর সঙ্গে পারলে আমাকেও নিয়ে যেতে বললেন। যাবার বিষয়ে আমার সম্মতি নিয়ে কিনারা জানালো যে বাড়িতে গাড়ি পাঠাতে হবে না, কারণ ড্রাইভার বেচারা এসে খুঁজে মরবে। তার থেকে বিধাননগর স্টেশনের কাছে ভি আই পি রোডের ক্রসিংয়ে আমরা সকাল দশটায় অপেক্ষা করবো, ওখান থেকে আমাদের পিক আপ করে নিলেই চলবে। প্রত্যুত্তরে আইসি সাহেব কিছু বললেন আর ও “কপি দ্যাট” বলে ফোনটা কেটে দিল।

দু’জনে মিলে পরের দিন সকাল বরাহনগর রোড স্টেশন থেকে ডাউন ডানকুনি লোকাল ধরে একদম সময়মতো বিধাননগর স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। নেমে ভি আই পি রোডের ক্রসিংয়ে পৌঁছে দুই মূর্তিতে ভাঁড়ে চা খেয়ে, সবে মাত্র একটা করে সিগারেট শেষ করেছি এমন সময়ে মোবাইল ফোনে ড্রাইভারের ফোন এলো। আমাদের রিয়েল টাইম লোকেশন জানিয়ে দিতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কালো কুচকুচে রঙের ওপরে সোনালি গ্রাফিক্সের কাজ করা লাল বাতি লাগানো ঝকঝকে একখানা পুলিশ লেখা মাহিন্দ্রা এক্সইউভি ৫০০ গাড়ি এসে সামনে দাঁড়ালো। দু’জনে উঠে মাঝখানের সীটে বসে পড়লাম। সামনে আর পেছনের সিটে সাদা পোশাকে সশস্ত্র পুলিশ কর্মীরা বসে আছেন। এরপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দু’ধারে বিস্তীর্ণ মাছের ভেড়ির মাঝখান দিয়ে মোটামুটি বত্রিশ কিলোমিটারের মতো রাস্তা ধুলোর ঝড় তুলে পার হয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো গেল। রাস্তার অবস্থা মাঝে মধ্যে খুবই খারাপ হলেও গাড়ির সাসপেনশন খুব ভালো থাকায় কিছুই বোঝা গেল না। রাস্তার ডানদিকে পুরনো দোতলা থানার বাড়ি। হাল ফেরাতে কিছুদিন আগেই নীল সাদা রং করানো হয়েছে বোঝা গেল। মুল ফটক দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে দু’খানা ঘরের পরে বাঁহাতে আই সি সাহেবের চেম্বার। চেম্বারের বাইরে পিতলের ঝকঝকে নামের ফলক লাগানো। ঘরে ঢুকলাম …… এবারে ঠিকঠাক চিনতে পারলাম …… হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওনার সাথে আমাদের আলাপ হয়েছিলো বটে।

দাঁত বের করা নমস্কার, প্রতি নমস্কারের মধ্যে দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব শেষ হল। ইতিমধ্যে কেসের আই ও-র সঙ্গে একজন যুবতী সিভিক ভলান্টিয়ার এক গাল হাসির সাথে দু’টো প্লেটে সিঙ্গারা আর একগাদা মিষ্টি এনে হাজির করেছে। খেতে আমি বরাবরই পটু। শ্বশুরবাড়িতে একসময় আমার পেটকে ইন্ডিয়া গেট বলা হতো আর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বলতো কুত্তার পেট। অতটা জার্নি করে খুব খিদেও পেয়েছিলো, পুরো সাঁটিয়ে দিলাম। কিনারা যা খেতে পারলো না সেগুলোও আমার মহা উদরেই স্থান পেলো। এরপরে বোন-চায়না কাপে করে স্পেশাল আদা এলাচ দেওয়া দুধের চা এলো। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে আই সি সাহেব আমাদের গোটা ঘটনাটা বিস্তারিতভাবে শোনালেন।

সপ্তাহ দুয়েক আগে নামী ক্যুরিয়ার সার্ভিসের একজন ছোকরা ক্যারিয়ার দুপুরবেলা বাইকে করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে সদ্য ব্যাঙ্কের তকমা পাওয়া একটি প্রাইভেট ফাইনান্সিয়াল সংস্থার স্থানীয় সাপ্তাহিক ফান্ড কালেকশনের টাকা নিয়ে ঐ ব্যাঙ্কের কোনও ব্রাঞ্চে যাচ্ছিলো। আগেই বলেছি এদিকে পাকা রাস্তার দুই দিকে মাছের ভেরি ছাড়া আর কিছুই নেই। কখনো কখনো দূর দূর পর্যন্ত মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। এমনই এক অশুভ মুহূর্তে ডাকাতির ঘটনাটি ঘটেছে। ক্যুরিয়ার সার্ভিসের ছোকরার পিঠে স্থানীয় পাবলিক কালেকশনের প্রায় ষোল লাখ টাকা ছিল। ভিকটিমের স্টেটমেন্ট অনুযায়ী ছয়জন লোক তিনটি বাইকে ওই তার পেছন দিক থেকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একসাথে আসে। একটি বাইক ডান দিক থেকে ঢুকে গিয়ে ওর বাইকের সামনের চাকায় ধাক্কা মারে, গতি অল্প থাকায় ও নাকি টাল সামলে নেয় …… পড়ে যায়নি। আর একটি বাইক বাঁদিক থেকে ঢুকে একেবারে সাঁটিয়ে দেয় …… ফলে ও গাড়ি থেকে নেমে পালাতেও পারেনি। ইতিমধ্যে প্রথম বাইকটির পেছনে যে বসে ছিল সে একটি চকচকে পিস্তল বের করে (নাইন এম এম পিস্তলের মতো দেখতে, রুপোলী রঙের, কখনোই দেশী ওয়ান শটার নয়) এবং ভিকটিমের দিকে পয়েন্ট করে তার কানের পেছনে লাগায়। ভিকটিম দুই হাত ওপরের দিকে উঠিয়ে ধরে আর পেছনের থেকে অন্য একটি বাইকের আরোহীরা না কি হ্যাঁচকা টানে তার পিঠে রাখা টাকার ব্যাগটা ছিনিয়ে নেয়। ছেলেটি কোনও বাইকেরই নম্বর জানাতে পারেনি, তবে জানিয়েছে যে সাসপেক্টদের কারোর মুখই ঢাকা ছিল না। ইতিমধ্যেই জেলা ও রাজ্যের তাবড় তাবড় সাহেবরা এসে ভিকটিমকে জেরা করেছেন …… লালবাজার আর সিআইডি-র পুলিশের শিল্পীরা একদিন এসে জনা দুয়েক সাসপেক্টের পেনসিল স্কেচও এঁকে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কারো কোনও পাত্তাই পাওয়া যায়নি। কোথাও কোনও মুভমেন্টের খবর নেই, সোর্সরাও কিছুই জানাতে পারে নি। ছ’ ছ’টা মানুষ যেন পৃথিবী থেকে একেবারে বেমালুম উবে গিয়েছে।

কিনারার মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম যে গোড়া থেকেই ভিকটিমের স্টেটমেন্ট তার একেবারেই হজম হয়নি, আমারও কেমন কেমন যেন একটা খটকা লাগছিলো। আমি কিনারার সাথে অনেক কেসে সঙ্গী হিসাবে থেকেছি, তাই মনে হচ্ছিল কোথায় না কোথায় যেন একটা গন্ডগোল আছে। কিন্তু কোথায় ধরতে পারছিলাম না। না হওয়ার অবশ্যই অনেক কারণ ছিল …… পাঠকেরা ধৈর্য ধরুন, ধীরে ধীরে জানাচ্ছি। কিনারা আই সি সাহেবের কাছে এফআইআর দেখতে চাইলো। এফআইআর-এর সাথে সব সময় কমপ্লেন কপি এ্যাটাচ করাই থাকে। সেরেস্তা থেকে প্রসেসবাবু বড়বাবুর হুকুম মতো কমপ্লেন কপি সমেত এফআইআর বই এনে হাজির করলেন। মোবাইলে সেগুলোর ছবি তুলে নিলাম। কমপ্লেন কপিটা বেশ কয়েকবার ভালো করে পড়ে নিয়ে কিনারা বড়বাবুকে প্রশ্ন করলো যে লেখাটা কার? বড়বাবু লেখাটা একবার দেখে নিয়ে ভিকটিমের নিজেরই বলে জানালেন। কিনারা আবার প্রশ্ন করলো যে কমপ্লেন লেটার লেখার সময়ে ভিকটিমকে কেউ ডিকটেট করেছিলো কি না? বড়বাবু জানালেন যে ভিকটিম নিজের মতো করেই কমপ্লেন লিখেছিলো, আর সেটা এই ঘরে বড়বাবুর সামনে বসেই লিখেছিলো। এ ব্যাপারে পুলিশের তরফে কেউ তাকে কোনও ভাবে ইনসিস্ট বা ডিকটেট করেনি। ব্যাঙ্কের দু’জন হোমরা চোমরা ও ক্যুরিয়ার সার্ভিসের একজন ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন বটে, কিন্তু যা লিখেছে সেটা ভিকটিম নিজের মতে এবং নিজের বুদ্ধিতেই লিখেছে। সব শুনে নিয়ে কিনারা চুপ করে বসে একটা ফুলস্কেপ সাদা কাগজে জেল পেন দিয়ে কি সব আঁকিবুকি কাটতে লাগলো। বেশ কয়েক বছর ওর সাথে থাকায় বুঝলাম যে ও মনের চোখ দিয়ে ঘটনাটা সাজিয়ে নিয়ে একবার দেখার চেষ্টা করে চলেছে।

দু’হাত দিয়ে কপাল আর মাথাটা চেপে ধরে অনেকক্ষণ বাদে মুখ তুলে বলে উঠলো “নাঃ, অরণ্য এটা ঠিক খাপে খাপে পঞ্চুর বাপ হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সুকুমার রায়ের “চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা” হয়ে গেছে রে! পাক্কা হযবরল কেস”! বুঝলাম অনেকগুলো জায়গায় অসঙ্গতি আছে বলে ওর মনে হচ্ছে। থানার আইসি সাহেব বোধহয় এসব ভাষা আগে কখনও শোনেননি, আমাদের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। কিনারা মুখ তুলে সরাসরি ওনাকে প্রশ্ন করলো উনি কি চান? হাতে অথবা কম্পিউটারে সাসপেক্টের আঁকা ছবি, নাকি সোজাসুজি কেসের ডিটেকশন? প্রত্যাশিতভাবে উনি কেসের ডিটেকশনের কথাই আমাদের জানালেন।

আমরা আসবো বলে ভিকটিমকে সকাল থেকেই থানায় এনে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো। এবারে তাকে ডাকা হলো। আমরা দু’জনে ততক্ষণে সুপ্রিমের দুটো লাল কালো চেক কাটা পলি-ফাইবারের চেয়ারে বেশ জমিয়ে বসেছি। আমি ভিকটিমের স্টেটমেন্টের ভিডিও রেকর্ডিং করতে ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। মাথা নিচু করে ভিকটিম এসে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসলো। বড়বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিনারার একটা নিয়ম দেখেছি, যে খেলার সময়ে সে হাতের তাস কাউকেই দেখায় না। তার ইঙ্গিতে আই সি সাহেবকে সম্মানের সাথে বললাম আমরা দু’জনে একান্তে ভিকটিমের সাথে কথা বলতে চাই। উনি স্মিত হেসে সম্মতি জানিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলেন।

অনেক কেসে ওর সঙ্গে দর্শক হিসাবে থাকার সুবাদে দেখেছি যে কোনও ক্লু-লেস বা সুত্রবিহীন কেস ডিটেকশন করতে হলে কয়েকটা জিনিষ খুব ভালো করে কনফার্ম করা জরুরী। প্রথমত মোটিভ অফ ক্রাইম খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়ত রিপিটেডলি ক্রস ইন্টারোগেশন করা। তৃতীয়ত মোডাস অপারেন্ডি অনুসারে পুরনো তথা দাগী অপরাধীদের মধ্যে থেকে মুল অপরাধীকে চিহ্নিত করা এবং সব শেষে প্রয়োজনে পি ও অর্থাৎ প্লেস অফ অকারেন্সে গিয়ে ক্রাইম রিকনস্ট্রাকশন বা অপরাধের পুনর্গঠন করা।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ হিসাবে অচেনা কারো সাথে কথা বলার সময়ে বা কাউকে ইন্টারোগেশন করার সময়ে সাধারণভাবে কিনারা নিজের তৈরি করা একটা পদ্ধতি প্রয়োগ করতো। সেটার নাম দিয়েছিলো “ফর্ম প্রসিডিওর” বা ফর্ম পদ্ধতি। এতে যে বিষয়ে আসলে আমাদের জানার প্রয়োজন সেই দিকে সরাসরি না এগিয়ে তার একেবারে উল্টোদিকে সাবজেক্টের পছন্দের কোনও একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতো। এর কতকগুলো ষ্টেজ অফ এ্যাপ্লিকেবিলিটি  থাকতো; আর সেগুলো হল এফ, ও, আর এবং এম আর এগুলোই সন্মিলিত ভাবে ফর্ম পদ্ধতি। প্রথমে সাবজেক্টের ফ্যামিলি বা পরিবার নিয়ে আলোচনা শুরু করা হতো। এর মধ্যে সাবজেক্টের নাম, বৈবাহিক, পারিবারিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস, সকলের সাথে সম্পর্ক এইগুলো থাকতো। এর থেকে সে তার মানসিক অবস্থা, সাংসারিক ও মানসিক সুখ দুঃখের খোঁজ পেয়ে যেতো। এর পরের ষ্টেজে সাবজেক্টের অকুপেশন বা পেশা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হতো। কারো পেশা জানতে পারার সাথে সাথেই তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক স্ট্যাটাস, ওয়েভ অফ থিঙ্কিং এগুলো অনেকাংশে বোঝা হয়ে যেতো। ফলে সাবজেক্ট যদি একজন রিকশাওয়ালা হয় তার সাথে কথা বলার সময়ে যেমন রবীন্দ্রনাথ বা সাম্প্রতিক ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা সে করা হবে না, ঠিক তেমনই কোনও আই এ এস বা জজ সাহেবের সাথে আলাপ জমাবার সময়ে লুঙ্গি ড্যান্স নিয়ে গল্প করা শিষ্টাচার সন্মত হবে না।

এর পরের ষ্টেজে আসতো সাবজেক্টের সাথে তার একটা রিলেশন বা অন্তরঙ্গতা তৈরি করা। কোনও বিশিষ্ট অতিথি বাড়িতে দুপুরে নিমন্ত্রণ খেতে এলে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সাধ্যমতো বিভিন্ন পদ অর্থাৎ পোড়া, তিতো, ভাজা, ঝাল, ঝোল, অম্বল, মিষ্টিতে পাত সাজিয়ে তাঁকে পরিবেশন করি। তাঁর যেটা পছন্দ হয়, তিনি সেটা আবার চেয়ে নেন। এখানেও ঠিক সেই ভাবেই কিনারা সাবজেক্টের চরিত্র ও আর্থিক সামাজিক স্ট্যাটাস বুঝে তাঁর সামনে বিভিন্ন বিষয় যেমন কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স, সিনেমা, রাজনীতি, খেলা, গান, নাটক এইসব সাজিয়ে দিতো। যে যাঁর নিজের নিজের পছন্দ অনুসারে কোনো একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করতো। সে কক্ষনোই সাবজেক্টের সাথে কোনও বিষয়ে তর্ক করতে যেতো না। কারণ তার মূল উদ্দেশ্যই বন্ধুত্ব স্থাপন করে সাবজেক্টের বিশ্বাস অর্জন করা, বিতর্ক করে বাগযুদ্ধ করা নয়। সাবজেক্টের বক্তব্যকে উৎসাহ দেবার জন্যে তাঁর চোখে চোখ রেখে কথাগুলো গিলতে গিলতে সাধারণভাবে সে বাঁধা কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ করতো আর সেইগুলো হল “ও”, “আচ্ছা”, “তাই না কি”, “তারপর”, “এটা তো জানা ছিল না”, “আপনি এতো কিছু জানেন” ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্যই সাথে সাথে “আরে হ্যাঁ, আমারও এই রকম হয়েছিলো” জাতীয় কথা, যাতে সাবজেক্ট মনে করে যে তার বলা কাহিনীর সাথে কিনারা আন্তরিকতা ও মনোযোগের সাথে সম্পর্কিত করে ও তাঁর কথাকে মান্যতা দিয়ে তাঁর কনফিডেন্স লেভেল বাড়াতে সাহায্য করছেন। এতে অতি দ্রুত কিনারার ওপরে সাবজেক্টের আস্থা তৈরি হতে সাহায্য করতো।

আমরা সবাই কথা বলতে ভালোবাসি। সবাই বলতে চাই, কেউ কখনোই শুনতে চাই না। এক সাথে আড্ডা মারতে বসলে, প্রায় সব সময়েই আমরা সবাই একে অন্যকে থামিয়ে অধিকন্তু উচ্চগ্রামে নিজের বক্তব্য পেশ করার চেষ্টা করি। আপনারা প্রায় প্রত্যেকেই জীবনে এমন অন্তত একজন মানুষকে অবশ্যই দেখেছেন যাঁকে দেখলে সব বয়েসের লোকেই পাশ কাটিয়ে পালাতে চায়। কারণ তাঁর খপ্পরে পড়লেই তাঁর কথা শুনতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় নষ্ট হবে। আসলে মানুষটি কথা বলতে ভালবাসেন, যাকেই পান তাঁকেই স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করে নিজের কথা বলতে থাকেন, সময়ের জ্ঞানগম্যি একদম নেই। কিনারার থিয়োরি অনুসরণ করে আমি এই রকম মানুষের সাথে হাতে সময় নিয়ে কথা বলে দেখেছি যে একদিন সময় নিয়ে তাঁর কথা শোনার পরের দিন থেকে আমি নিজেই তাঁর কথা বলার বিষয় হয়ে গিয়েছি। আর তিনি বিনা পয়সাতে সারা দুনিয়ার লোককে ধরে ধরে দাঁড় করিয়ে তাঁদের মূল্যবান সময়ের ষষ্ঠীপুজো করে আমার সুখ্যাতি গেয়ে, বিনা পয়সায় আমার বিজ্ঞাপন করে বেড়াচ্ছেন। কিনারার মতে জনপ্রিয়তার মুল চাবি কাঠি হল সার্বিকভাবে সার্বজনিক শ্রোতা হয়ে যাওয়া। আর আমরা সকলেই জানি যে বোবার নাকি শত্রু হয় না।

আবার মুল কাহিনীতে ফিরে আসা যাক। ফর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করে সাবজেক্ট সম্পর্কে এমন অনেক কিছুই জানা গেলো, যা এর আগে পুলিশ জানার চেষ্টা করেনি। অনেকেই ভিকটিমকে জেরা করেছেন, কিন্তু প্রথাগত চিরাচরিত পদ্ধতির গণ্ডির মধ্যে। কিনারা তার চোখ দিয়ে ভিকটিমকে ভালো করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে মাপলো। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়েসের ছেলে। ওরা জাতে মুসলমান …… সেটা ওর নাম থেকেই বোঝা গিয়েছিল …… এই জেলার এই দিকটায় মুসলমান ধর্মের মানুষের সঙ্খ্যাধিক্য বেশি। সাধারণ মার্জিত পোশাক পরিচ্ছদ হলেও ছেলেটিকে অবস্থাপন্ন ঘরের বলে একেবারেই মনে হল না। চেহারায়, চোখে মুখে একটা বিষাদের সাথে এক অযাচিত ক্লিষ্টতার ভাব যেন ফুটে উঠেছে। নাম জানাই হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে কারা কারা আছেন এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা হলো। কিনারা ওর সাথে কথা বলছে আর আমি ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ডিং করছি। জানতে পারা গেল যে ওরা তিন ভাই, দুই বোন; বাবা, মাও বর্তমান। ও সবার চেয়ে ছোট। দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওদের ভাইদেরও সবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বছর কয়েক হল ছোড়দির বিয়ে দিয়ে নিজেও বিয়ে করেছে। এবার বাড়ির সার্বিক আয় নিয়ে কথা শুরু হলো। জানা গেল দুই দাদা তাদের সংসার নিয়ে একেবারেই আলাদা থাকে। বাবা, মা, বৌ আর একটি ছোট্ট এক বছরের শিশুকে নিয়ে ওর সংসার। বাবা আগে অন্যের জমিতে মুনিষ খাটতেন, এখন বয়েস হয়ে যাওয়ায় আর পারেন না। মা আর বৌ দুজনেই গৃহবধু। বাবা হার্টের পেসেন্ট, বছর পাঁচেক আগে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরকারী অনুদানে পেসমেকার বসেছে। মায়ের টিবি আছে, ডট সিস্টেমে চিকিৎসা চলছে। বড় ভাইয়েরা বাবা মায়ের জন্যে কোনও খরচ খরচাও দেয় না। দিদিদের বিয়েতে কী কী দিতে হয়েছে তার ফিরিস্তি চাওয়া হলো। শুনলাম বিয়েতে জামাইদের বাইক ছাড়াও যা যা দিতে হয়েছে তার নগদ মূল্য নেহাত কম নয়। ওকেও নিজের বিয়ের সময়ে ভালোই দেনমোহর দিতে হয়েছে। সবচাইতে বড় কথা ওর এক বছরের বাড়ন্ত বাচ্ছা এখন সেরেল্যাক খায়।

কিনারার ইঙ্গিতে তার হয়ে খাতায় আমি আয় ব্যায়ের পুংখানুপুংখ হিসেব রাখছিলাম। পেসমেকারের দাম আজকের বাজারে খুব কম করে হলেও সওয়া লাখ টাকা, হাসপাতালে সব ফ্রী হলেও আগে আর পরে বিভিন্ন টেস্ট এবং ওষুধপত্র নিয়ে আরও হাজার পঞ্চাশেক তো অবশ্যই বেরিয়েছে। দুই বোনের আর নিজের বিয়েতে খুব কম করে হলেও লাখ চারেক টাকা খরচা হয়েছে, সঙ্গে আনুসাঙ্গিক আরও হাজার পঁচাত্তর ধরা যেতেই পারে। তাহলে হিসেবে সর্বমোট গিয়ে দাঁড়ালো নয় নয় করেও প্রায় ছয় লাখ টাকা। বাচ্ছার সেরেল্যাকের মাসিক খরচ খুব কম করে আটশো টাকা, এছাড়াও দুধের খরচা আলাদা। মায়ের খাওয়া দাওয়ার জন্যেও একটা ভালো খরচ আছে। ওর মাস মাইনে জানতে পারলাম সাত হাজার টাকা। সারাদিনে বারো ঘণ্টার ডিউটি; মানে অন্য কোনও পার্ট টাইম জব করার কোনও চান্সই নেই। কোম্পানি তেল খরচ দিলেও গাড়ি আর মেইন্টেন্যান্স সম্পূর্ণ নিজের। তবে টিফিনের পয়সা এক্সট্রা দেয়। সব মিলিয়ে কুব বেশি হলে দশ থেকে বারো হাজার টাকা মাসিক রোজগার। বছর পাঁচেক এই চাকরিটা করছে। এর পরেই কেঁচো খুঁড়তে একেবারে সাপ বেড়িয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছি যে কেসের কথার ধারে কাছে না গিয়েও কিনারা ওকে কথার জালে তখন অজগর সাপের মতো ভালো করে প্যাঁচানো শুরু করে দিয়েছে। আর ও সেই সব বুঝতে না পেরে মহা আনন্দে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় বেরিয়ে এলো স্থানীয় এক রাজনৈতিক দাদাকে গ্রেফতার করার সময়ে ওদের বাপ ব্যাটা চারজনকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল আর তার কেস এখনও কোর্টে চলছে। প্রতি মাসে বার দুয়েক কলকাতার কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। তার মানে মাসিক একটা উকিলবাবুর খরচাও আছে। দেখে শুনে মনে হলো, ওরে বাবা! এতো দেখছি আমাদের সব চিন্তা ভাবনাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। ওর মোটিভ অফ ক্রাইম এখন একেবারে জলের মতো পরিস্কার। আজকের মাগ্যির বাজারে ছোকরার বিশাল দেনা, নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে, রাতের বেলায় ঘুম হচ্ছে না।

এরপরে ভিক্টিমের থেকে অপরাধীদের ডেসক্রিপশন নেবার পালা। পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির হিউম্যান এ্যানথ্রোপলজির সুত্র অনুসারে একজন মানুষের উচ্চতাকে আটটি সমান ভাগে ভাগ করা যায়। অর্থাৎ একজন ছয় ফুট অর্থাৎ বাহাত্তর ইঞ্চির উচ্চতার মানুষের মুখের মাপ হবে পুরোপুরি নয় ইঞ্চি। আবার একটি মুখকে কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত তিন ইঞ্চি করে সমান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের এ্যানথ্রোপলজি অনুযায়ী একজন মানুষের মুখ যত গোলাকার হতে থাকবে, এই সুত্র অনুসারে তাঁর চেহারাও ততই মেদ বহুল হবে। মুখাবয়ব যত লম্বা হবে মানুষটিও ততই রোগা বা পাতলা চেহারার হবেন। খুব লম্বা মানুষ খুব মোটা হবে না আর খুব বেঁটে মানুষ কখোনোই খুব রোগা হবে না। মানুষ যত বেশি মোটা হতে থাকবে, তার গলার দৈর্ঘ্য আনুপাতিক হারে ততই হ্রাস পেতে থাকবে। এছাড়াও একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে কিনারা একদিন কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলো যে একটি মুখে আরও বত্রিশ রকমের মাপ থাকে যেগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সমানুপাতিক। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ফাইন আর্টের ছাত্রছাত্রীদের এর বেশ কিছুটা জানা থাকলেও, বলাই বাহুল্য সাধারণ মানুষের এতো কিছু জানা নেই।

ছেলেটি আমাদের একজন সম্ভাব্য অপরাধীর বিবরণ দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করলো। আর প্রতি ক্ষেত্রেই কিনারা ওকে বিবরণ দেবার সময়ে মন্তব্য করে ওকে ভুল পথে পরিচালিত করে গেলো। অর্থাৎ মোটা বললেই বলা হবে গলাটা লম্বা, মানুষটা পাতলা বা রোগা …… অথবা চেহারা রোগা বললেই বলা হবে মুখাবয়ব গোল, এই রকম আর কি! আসলে যা হওয়া উচিৎ এগুলো তার একেবারে বিপরীত। ক্রিমিন্যাল সাইকোলজি বলছে মানুষ যদি কারো সম্পর্কে মিথ্যা বিবরণ দেয় তাহলে সে তখন কখনোই একজন মানুষের বর্ণনা দেবে না। অনেকগুলো মানুষের চেহারার এক একটা অংশ নিয়ে মেলাতে চেষ্টা করবে, আর তখনই এই অংশগুলো একটা অন্যটার সাথে মিলবে না। কারণ আগেই বলেছি একটা মানুষের মুখের মাপ কেমন হয় বা হওয়া উচিৎ, কোনটা কার সাথে ঠিক কেমন সমানুপাতিক হারে মেলে সেটা সাধারণ মানুষের জানা থাকে না। যথারীতি ছেলেটি ভুলভাল বকতে শুরু করলো আর কিনারার সব কথায় “হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার” বলে সায় দিয়ে তাকে ইমপ্রেস করার ব্যর্থ এক প্রচেষ্টায় নিজের অজান্তেই জালে আরও জড়িয়ে ফেলতে শুরু করলো। একটা সময়ে জেরা করা বন্ধ করে রেকর্ডিং বন্ধ করে দুজনে একদম চুপ করে গেলাম। অপরাধ বিজ্ঞানে একটা কথা আছে “ভিক্টিম ইস দ্য প্রাইম সাসপেক্ট”। আমরা দু’জনেই তখন একেবারে কনফার্ম যে এই ছোকরা সম্পূর্ণ নাটক করছে, আসলে ফান্ডের সাপ্তাহিক ক্যাশ কালেকশনের টাকা সে নিজেই কোথাও রেখেছে; কোথাও কোনও ডাকাতির ঘটনাই ঘটে নি।

দু’জনে আরাম করে দুটো সিগারেট ধরিয়ে ওর চোখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে তারিয়ে তারিয়ে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে থাকলাম। অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি যে আচমকা এই চুপ করে যাওয়াটা অপরাধীদের ওপরে একটা ভীষণ রকমের প্রভাব ফেলে। লক্ষ্য করলাম যে ও আমাদের চোখের দিকে মাঝে মধ্যেই তাকাচ্ছে আর চোখে চোখ পড়লেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে, এদিক ওদিকে অস্থির হয়ে তাকাচ্ছে, উসখুস করছে; ক্রিমিন্যাল সাইকোলজির পরিভাষায় “মিসব্যালেন্সড বডি ল্যাঙ্গুয়েজ”, এ হল অপরাধীর একেবারে পাক্কা নিদর্শন।

সিগারেটটা শেষ করে অনেকক্ষণ বাদে কিনারা ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে মুখের সামনে মুখ নিয়ে গিয়ে চোখে চোখ রেখে একটাই প্রশ্ন সোজাসুজি ছুঁড়ে দিলো “কি রে ভাই, টাকাটা কোথায় রেখেছিস”? বুঝলাম যে এই কথা এর আগে কেউ ওকে এই ভাবে বলেনি। ওর কথায় বিশ্বাস করে সবাই অপরাধীর খোঁজ করেছে। কিন্তু ভিকটিম নিজেই যে অপরাধী হতে পারে এটা কারোরই মাথায় আসেনি। ও তখনকার মতো কাঁপা কাঁপা গলায় সোজাসুজি অস্বীকার করলেও ওর চোখে মুখে দেখলাম ভয়ের ছাপ ভীষণ রকম স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

কর্ডলেসের সুইচ টিপে কলিং বেল বাজানো হলো। সেন্ট্রি আসতে কিনারা বড়বাবুকে ডেকে দিতে আর ওকে বাইরে নিয়ে গিয়ে কোনও ঘরে একদম একা বসাতে বললো। কিনারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো যে কেউ যেন কোনও ভাবেই ভিকটিমের সাথে দেখা করতে, চোখাচুখি করতে বা কথা বলতে না পারে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আই সি সাহেব জিজ্ঞাসু মুখ নিয়ে চেম্বারে এলেন। কিনারা ওর সিদ্ধান্তের কথা আই সি সাহেবকে জানালো। আই সি বললেন যে ওনারও সন্দেহ যে হয়নি এরকম নয়, কিন্তু কিছুতেই ওকে ব্রেক করা যাচ্ছে না; পলিটিক্যাল লিঙ্কও ভালোই আছে, ফলে খুব চাপ দেওয়াও মুশকিল।

মাথার পেছনে দুই হাত নিয়ে গিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে আমার অতি পরিচিত কুঁড়ে মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো “আচ্ছা অরণ্য, এবার তাহলে আমাদের ট্রাম্প কার্ড খেলতেই হচ্ছে। বাজীটা তো জিততে হবে”।

আই সি সাহেবের দিকে ঘুরে গিয়ে কিনারা বলে উঠলো “আপনি আমায় এখনই আপনার পি সি পার্টির থেকে গোটা চারেক লোক, চারটে বাইক আর একটা ব্ল্যাঙ্ক নাইন এম এম দিতে পারবেন তো ? আমি আর পি সি পার্টির লোকেরা ভিকটিমকে সঙ্গে নিয়ে বাইকে করে পি ও-তে যাবো, আর পেছন পেছন গাড়িতে আপনি আমাদের আর্মড ফোর্স নিয়ে ফলো করবেন”।

কিনারার প্রস্তাবে সন্মতি দিলেও সে যে ঠিক কি করতে চাইছে, আই সি সাহেব সেটা বুঝতে পারছিলেন না, আর আমি তো একেবারেই অন্ধকারে। থানার ডিউটি অফিসার একখানা ব্ল্যাঙ্ক নাইন এম এম দিলেন। ম্যাগাজিন খুলে কক করে ট্রিগার টিপে সত্যি সত্যিই গুলি নেই এই বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ হয়ে কিনারা সেটা কোমরের পেছনে প্যান্টে পুলিশের মতো করে গুঁজে নিলো, বাঁটটা বের হয়ে রইলো বিঘত খানেক। আমরা কেউই বুঝতে পারছিলাম না যে কি নাটক হতে চলেছে !

বাইকে ওঠার আগে সিগারেট ধরিয়ে তাতে সুখ টান দিতে দিতে কিনারা আমায় সাইডে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুপিসারে বললো “অরণ্য আমি ওর লেখা কমপ্লেন লেটারটা খুব ভালো করে পড়েছি। আর তাতেই অনেকগুলো অসামঞ্জস্য আমার নজরে পড়েছে। এখন ওর লেখাটা অনুসারে সেই ক্রাইম রিকনস্ট্রাকশন করে গরমিলগুলোকে সাজিয়ে হাতেনাতে ওর মিথ্যে ধরাই আমার উদ্দেশ্য। আর ও যখন বুঝতে পারবে যে ওর সব মিথ্যে কথাগুলো ধরা পরে গিয়েছে, তখন দেখবি কনফেস করা ছাড়া ওর সামনে আর কোনও রাস্তাই খোলা থাকবে না”।

ভিকটিম ছোকরাকে ডেকে একটা বাইক ওকে দেওয়া হলো। আর বাকি তিনটায় দুই জন করে আমায় নিয়ে মোট ছয়জন বসলাম। এর মধ্যে একটা কিনারা নিজে চালাচ্ছে। আমি নিজে কেসের আই ও-র বাইকের পেছনে বসলাম। সবার পেছনে লাল বাতির চার চাকা নিয়ে আই সি সাহেব নিজে আর্মড ফোরস নিয়ে রইলেন। কিনারা খুব ভালো বাইক চালায়। আমি গুগলের ম্যাপ দেখে দেখে নেভিগেট করে ওকে রাস্তা বাতলে দিতাম আর ও চালাতো। বাইক নিয়ে বিগত কয়েক বছরে আমরা দু’জনায় অনেক দূর দূর গিয়েছি। এতো দূর যে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, হয় পাগল ভাববে নয়তো ভাববে ঢপ মারছি।

যাই হোক ঠিক যেভাবে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেই ভাবে ওকে আমাদের আগে আগে বাইক চালিয়ে যেতে বলা হলো। পেছনে আমাদের তিনটে বাইক। থানার থেকে আমরা রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। একটু পরেই রাস্তার দু’দিকে বিস্তীর্ণ মাছের ভেড়ি শুরু হল। এর দুই এক মিনিটের মধ্যেই আচমকাই স্পীড বাড়িয়ে ওকে ডান দিক দিয়ে ওভারটেক করতে করতে কিনারা ওর বাইকের সামনের চাকায় সাইড চেপে সজোরে ধাক্কা মারলো। ওর স্পীড ঘণ্টায় আঠেরো কুড়ি কিলোমিটারের মতো থাকলেও ধাক্কা মারার সাথে সাথেই রাস্তার ধারে বাঁদিকে বাইক সমেত একেবারে উল্টে পড়ে গেল। পেছনে বাইক স্ট্যান্ড করে কিনারাও সঙ্গে সঙ্গেই এক লাফে নেমে ওকে দুই হাত দিয়ে একেবারে কলার ধরে তুলে বড় বড় চোখ করে হিম শীতল গলায় প্রায় নাকে নাক ঠেকিয়ে বলে উঠলো “কি হলো ? তুই যে এই ভাবে পড়ে গিয়েছিলি এই কথা তো লিখিসনি”। ওর যন্ত্রণা কাতর মুখ তখন একেবারে ফ্যাকাসে মেরে গিয়েছে।

কিনারার পেছনে বসে থাকা পুলিশের একজন স্পেশাল ভিকটিমের বাইকটা তুলে দাঁড় করিয়ে সিঙ্গল স্ট্যান্ড করে রাখলো আর থানার বড়বাবু ততক্ষণে পেছনের গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন। আমরা যে যার বাইকে বসে আছি। উত্তরের অপেক্ষা না করে ওকে কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে আবার বাইকে বসানো হলো। কিনারার ইঙ্গিতে এবার আমাদের আর একটা বাইক ওর বাইকের বাঁদিক দিয়ে একেবারে সাঁটিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। নির্দেশ মতো সাঁটিয়ে বাইক দাঁড় করানোর পরক্ষণেই একেবারে “আঃ উঃ” করে চিৎকার। সপাটে এক চড় কষিয়ে আবার ওর মুখের সামনে আগের মতোই মুখ এনে খিস্তি মেরে হিম করা ঠান্ডা গলায় নিচু স্বরে কিনারা বলে উঠলো “কি রে হারামি, তোর পায়ে যে সাইলেন্সারের গরম ছ্যাঁকা লেগেছিল সেই কথা তো লিখিস নি, বলিসওনি”। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম যে ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভয়ে একেবারে থরথর করে কাঁপছে।

তদন্তের ট্রাম্প কার্ড খেলার তো সেটাই আসল সময় ছিলো। ও তখনও বাইকে মাথা নিচু করে বসে। ওকে ভাববার সময় না দিয়ে বাইকের সামনে বসে, কিনারা তার পেছনে স্পেশালকে বসিয়ে বললো, “ভাই, পিস্তলটা ওর কানের পাশে ঠেকান তো”। কিনারার বাইকটা যেহেতু ওর বাইকে ধাক্কা মেরেছিল তাই ওটা ওর বাইকের সাথে সমান্তরালভাবে না দাঁড়িয়ে একটু ট্যারাচে মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। ডানহাতি কনস্টেবলের হাতের নাইন এম এম পিস্তল ওর ডান পাশে কানের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছালোই না। কিনারা এবারে বাঁহাতে ঠেকাতে বললো। এবারে পিস্তল ছোকরার মাথায় গিয়ে ঠেকলো। আসল কথা কেউ যদি ঐ পজিশনে বসে থাকে তাহলে বাঁহাতি না হলে সে কখনোই বাইকে বসে ভিকটিমের কানের গোড়ায় পিস্তলের নল ঠেকাতে পারবে না। বাইক থেকে নেমে কিনারা ওর বাইকের তেলের ট্যাঙ্কে সজোরে একটা লাথি মারাতে আবার গাড়ি উল্টে এবার ও গাড়ির তলায়।

কাঁকরে রাস্তায় ওর হাতের আঙ্গুলের ওপরে বুট পরা পাটা চাপিয়ে চাপা গলায় সাপের মতো হিস হিস করে খিস্তি মেরে কিনারা বলে উঠলো “তোকে এখানেই মেরে ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবো। লোকে জানবে তুই এ্যাক্সিডেন্টে মরে গেছিস। কি বড়বাবু এটাকে ফ্যাটাল বলে সাজাতে পারবেন তো”?

বড়বাবু আর আমরা সবাই এতক্ষণে নাটকটা বুঝতে পারছিলাম। জনবিহীন, যানবাহনবিহীন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বড়বাবু বললেন “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো। শালাকে একটা দানা খাইয়ে দিন”।

ওর চোখ তখন বড় বড় হয়ে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুখ একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে, বুঝলাম যে পুরোপুরি নার্ভ ফেল করেছে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে উঠল ‘আমায় দয়া করে ছেড়ে দিন স্যার; আমি সব বলছি”। কি না রা ঘটনার কিনারা করে ফেললো। আর কি! ওকে দাঁড় করিয়ে জামাকাপড় ঝেড়ে পরিস্কার করে বাইকে আমার আর আই ও-র মাঝে বসিয়ে থানায় নিয়ে এলাম।

আই সি সাহেব আমাদের দু’জনের দুপুরে খাবার জন্যে মাছ ভাতের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বেশ বড় পাবদা মাছের লাল গরগরে ঝাল দিয়ে আমাদের দুপুরের খাওয়াটা খুব একটা খারাপ হল না। আমাদের খাবার ফাঁকতালে আই সি সাহেব ওর থেকে কোথায় কোথায় টাকা খরচ করেছে আর বাকি টাকাটা কোথায় আছে খোঁজ লাগিয়ে ফেলেছিলেন। টাকা আনতে থানা থেকে চারিদিকে টিমও বেরিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া শেষ হতে এক মুখ হেসে এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক কিং সাইজ সিগারেটের সাথে একটা মুখ বন্ধ খাম দিয়ে আই সি সাহেব আমাদের বাড়িতে ফেরার জন্যে গাড়িতে তুলে দিলেন।

বাড়িতে ফিরে ফোনে জানতে পারলাম যে পনেরো লাখ টাকার ওপরে ক্যাশ রিকভারি হয়ে গেছে। বাকি কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ও এদিকে ওদিকে যা ধার দেনা মিটিয়েছে, সেখান থেকে দু’চার দিনের মধ্যেই তুলে আনা যাবে। পরের দিন সকালের প্রভাতী চায়ের আসরে কিনারার উপস্থিতিতে গোটা ঘটনাটা আমার স্ত্রী সম্পূর্ণা আর দুই মেয়ে তিতাস আর বিয়াসকে বিশদভাবে বলতে হলো। আর এই কেসটা থেকে আমি নিজেও শিখলাম যে অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।।

 


লেখক পরিচিতি : দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় সুত্রবিহীন অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের কাছে এক অতি পরিচিত নাম। ১৯৯৭ সালে হাওড়ার এক ধর্ষণ ও খুনের তদন্তে সাফল্যের সঙ্গে জেলা পুলিশকে সাহায্য করে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সি আই ডি-র তৎকালীন এডিজি শ্রীযুক্ত রঞ্জিত কুমার মহান্তি IPS তাঁকে প্রথম “ফটো আইডেন্টিকাস্ট আর্টিস্ট” হিসাবে স্বীকৃতি দেন। ভারতবর্ষের প্রায় সব সিরিয়াল বোমা বিস্ফোরণের তদন্তে তাঁর আঁকা ছবি বা তাঁর দেওয়া সুত্র থেকেই অপরাধীকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। কলকাতার আমেরিকান সেন্টারে গুলি চালনার ঘটনা, রোমা ঝাওয়ার ও খাদিম কর্তা অপহরণ কান্ড, সিঙ্গুরের তাপসী মালিক হত্যা কান্ড থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের সেনাবাহিনীর উগ্রপন্থী বিরোধী অপারেশন, ঝাড়খন্ড ছত্রিশগড় অন্ধ্রপ্রদেশের মাওবাদী বিরোধী অপারেশন, উত্তরপূর্ব ভারতে উগ্রপন্থী বিরোধী অপারেশন সবেতেই ডাক পড়ে তাঁর। আসাম থেকে মুম্বাই হয়ে জয়পুর পর্যন্ত দেশের প্রায় সব ক’টি ধারাবাহিক বিস্ফোরন থেকে শুরু করে ৯/১১-র আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমনের কেসে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সাফল্যের পেছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ে এক ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনায় উপেক্ষিত অতি সাধারণ এক সুত্রের সন্ধান দিয়ে তিনি ডাকাত দলকে ধরতে সাহায্য করেন। ২০১৩ সালে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে চলন্ত ডাউন জনতা এক্সপ্রেসে জনৈক মহিলা যাত্রীকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় তাঁর আঁকা ছবি থেকেই অপরাধী ধরা পরে যায়। চুল গোঁফ দাড়ি কেটেও সে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। ২০১৬ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার শাসন থানার বন্ধন ব্যাঙ্কের এক ডাকাতির তদন্তে সাহায্য করতে গিয়ে তিনি অভিযোগকারীকেই অপরাধী প্রমাণ করে দেন। একইভাবে ২০১৭ সালে পোস্তা থানার একটি রাহাজানির তদন্তে লালবাজারের গোয়েন্দাদের সাহায্য করতে গিয়ে তিনি জানান যে ঘটনাটিই ঘটেনি, সমস্তটাই অভিযোগকারীনীর সাজানো। ঐ বছরেই অসমের ছাত্র নেতা লাফিকুল ইসলাম হত্যা কান্ডের তদন্তে এক প্রত্যক্ষদর্শীকে খুঁজে বের করে তিনি অপরাধীদের সনাক্ত করতে সহায়তা করেন। ২০১৮ সালে অসমের চলন্ত ট্রেনে জোড়া ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে অপরাধীদের সনাক্ত করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। সারা ভারত জুড়ে অসংখ্য তদন্তে নিজেকে আন্ডার কভার রেখে এইভাবেই সাহায্য করে চলেছেন লেখক। বর্তমানে ভারতের প্রায় সবকটি সেনা, আধা সেনা ও পুলিশ এ্যাকাডেমীতে প্রশিক্ষক বিশেষজ্ঞ (আইডেন্টিকিট, হিউম্যান এ্যানথ্রোপলজি এবং ক্রিমিন্যাল সাইকোলজি) হিসাবে তাঁর অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ২০১৮ সালে তাঁকে হাওড়া জেলার তরফে তাঁকে জেলার সেরা নাগরিক সন্মান ও মিথ্যান্বেষী খেতাব দেওয়া হয়েছে। ঐ বছরেই মার্চ মাসে পুলিশের তদন্তে সহায়ক হিসাবে আমন্ত্রিত বিশেষ প্রতিযোগী হিসাবে তিনি “দাদাগিরি” রিয়েলিটি শো-তে বিজয়ীর খেতাব অর্জন করেছিলেন। অপরাধ তদন্তের পাশাপাশি বাইকে দূর ভ্রমণ সহ কবিতা আর গল্প লেখা তাঁর অন্যতম শখ। তাঁর নিজের জীবনের নানান লোমহর্ষক অপরাধ তদন্তের সত্যিকারের অভিজ্ঞতার কাহিনীর লিখিত ফসল হল এই গল্প।।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।