লেখক : অভীক সিংহ
আচ্ছা ধরুন, আপনার বেজায় কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে, দু’দিন ধরে পাপমুক্তি ঘটেনি। তখন তৃতীয় দিন সকালে আপনি কী করবেন? অবশ্যই আরও জোর দেবেন। তখন আপনার চোখ লাল হয়ে উঠবে, গলার এবং কপালের শিরা ফুলে উঠবে, আপনার মনের মধ্যে একটা অভাবনীয় বিধ্বংসী মনোভাব জেগে উঠবে। কিন্তু শেষে দেখবেন, হঠাৎ “ছপাক” করে একটি অনির্বচনীয় শব্দধ্বনিতে আরামে আপনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে, নিজেকে মনে হবে খুব হালকা আর ফুরুফুরে, শরীরে এবং মনে আসবে এক অনাবিল প্রশান্তি। ঠিক যেন কোষ্ঠকাঠিন্যের কোলনাইজেশন থেকে হঠাৎ মুক্তি। সত্যি কথা কি না? ভাষার মধ্যে গালি অথবা খিস্তির প্রয়োগের পিছনে কারণটা প্রায় একই বলা চলে। মনের গভীরে পাহাড়ের মত তিলে তিলে জমে থাকা একগাদা খিচুড়ি ভাবাবেগের অকস্মাৎ বহিঃপ্রকাশই হল খিস্তি। ধরুন, আপনার বাড়িতে রান্নাঘরের কল খারাপ হয়েছে, আর তিনদিন ধরে ডাকার পরেও মিস্ত্রি আসছে না। তখন চতুর্থ দিনে আপনি কী করবেন? মাল্টিপ্লেক্সে তিনশো টাকা দিয়ে টিকিট আর দেড়শো টাকার পপকর্ণ কিনে সিনেমা দেখতে গিয়েছেন, এবং সিনেমাটির প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই আপনার যাবতীয় প্রত্যাশা ভিজে টিস্যু পেপার হয়ে গেল। তখন সিনেমাহল থেকে বেরিয়ে আপনি কী করবেন? অথবা, ব্যাঙ্কে তিনঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে যখন আপনার পালা এল, তখনই দেখলেন হয় “লিঙ্ক চলে গিয়েছে” বা “লাঞ্চটাইম” হয়ে গিয়েছে। তখন আপনি ব্যাঙ্কের বাইরে এসে কী করবেন? এক্কেবারে ঠিক ধরেছেন, তিনটি ক্ষেত্রেই আপনি প্রাণভরে খিস্তি করে সামনের ব্যক্তির ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করবেন। কারণ তা না করলে আপনার মনের মধ্যে চেপে রাখা ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ, অভিমান – সবকিছু একসাথে বিক্রিয়া ঘটিয়ে অচিরেই আপনার পাকস্থলীর বনস্থলীতে দাবানল ঘটিয়ে সৃষ্টি করতে পারে পূতিগন্ধময় বায়ুর, যাতে আপনার তো বটেই, আশেপাশের জনগণের জন্যও সশব্দ অথবা নিঃশব্দ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঠিক সেই কারণেই মনের ভাঁড়ারে অযথা খুচরো ভাবাবেগ জমিয়ে নিজের এবং অন্যান্যদের বিপদ ডেকে না এনে বেছে নিন সবচেয়ে সস্তা এবং পুষ্টিকর উপায় – নির্ভেজাল খিস্তি। তবে হ্যাঁ, এই পন্থা অবলম্বন করলে অবশ্যই সর্বপ্রথম স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে নেবেন, আশেপাশে একটু টুক করে দেখে নেবেন, আর তারপরেই অস্ত্রপ্রয়োগ করবেন। নইলে আপনার সুরক্ষার গ্যারাণ্টি কিন্তু কেউ নেবে না। আর সত্যি কথা বলতে কি, এই জিনিসটা আমার সাথেও হ’ল। গোটা বছর ক্লাসের মধ্যে গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করবার এক মহৎ প্রকল্পে নিয়োজিত ছিলাম। ভেবেছিলাম হয়ত তেজী আরবি ঘোড়া নাহ’ক, অন্ততপক্ষে খানপাঁচেক পাহাড়ি খচ্চর তো তৈরি হবে। কিন্তু আমার সেই প্রত্যাশার খেজুরের রসে তারা যে এভাবে পাইকারি দরে বালতি বালতি বালি ঢেলে দিয়ে চলে যাবে, তা কে জানত। সবে হাতে পরীক্ষার খাতাগুলো এসেছে, আর আমিও সক্কাল সক্কাল বেশ খোশমেজাজে খাতাগুলো চেক করতে বসলাম। প্রথম খাতাটি খোলা মাত্রই আমার অন্তরাত্মা একবার হেঁচকি তুলে গলায় ঠোক্কর খেল। এসব কী? এ তো উত্তরের নামে আমার নিজের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের সামনে ফেলে দিয়েছে। তারপর চটজলদি পরপর বেশ কয়েকটি খাতা উল্টে দেখলাম। বুঝলাম, এইভাবে আমার অন্তরাত্মাকে ক্রমাগত হেঁচকি খাওয়াতে থাকলে আমার কেবিনের জানালায় হয়ত এবারে স্বয়ং যমরাজ এসে “চিয়ার্স” বলবেন। তাই পত্রপাঠ খাতাপত্র ফেলে ছুটলাম লাউঞ্জের দিকে। মাথা ভিসুভিয়াস হব-হব করছে, যে কোন মুহূর্তে ফাটতে পারে। একমাত্র এককাপ চা-ই পারে এই বিপত্তি থেকে অবিলম্বে রক্ষা করতে।
কোনওমতে একছুটে গিয়ে পৌঁছলাম লাউঞ্জে। আস্তে আস্তে প্রফেসরদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কিন্তু গিয়েই প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। আমাদের লাউঞ্জের বেয়ারা আজ ছুটিতে, এবং তার জায়গায় এক অন্য বেয়ারা। বেয়াড়া স্বাদের চায়ের জন্য কলেজে কুখ্যাত এই বেয়ারা। “অভাগা যেদিকে চায়, বিয়ার শুকায়ে যায়।” কি কপাল! আজকে, মানে আজকেই এই বেয়ারার কবলে পড়তে হ’ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার কাছে গিয়ে বললাম আমাকে বাইরে এককাপ চা দিয়ে যেতে। সে একটা গুটকারঞ্জিত দেঁতো হাসি হেসে আমাকে বাইরে সোফায় বসতে বলল। আমি বাইরে সোফায় গিয়ে বসার কয়েকমিনিট পরেই সে আমার সামনে এনে রাখল একটা চায়ের কাপ। আপাতদৃষ্টিতে চায়ের কাপটাকে নিরীহ, নির্দোষ দেখতে লাগলেও মনটা একটু খুঁতখুঁত করতে লাগল। একটু গড়িমসি করে চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিতেই মনে হ’ল কেউ যেন আমার জিবটাকে রসগোল্লার গরম রসের মধ্যে চুবিয়ে দিল। কি বিদকুটে মিষ্টি! চায়ের কাপে আখের চাষ করেছে নাকি! সারা বছরের পড়ানো, পরীক্ষার খাতা, আর এই চা – সব মিলিয়ে ভিসুভিয়াসের বিস্ফোরণ ঘটল। “ধুর বাঁ*, এটা চা হয়েছে বাঁ*?” আমি চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, “শালা, আমি সকালে মুতলেও এর থেকে ভাল স্বাদ হয়।”
“ছি ছি ছি, কি ভাষা”, পাশ থেকে আওয়াজটা আসল। মুখ ঘুরিয়ে দেখি সান্যালদা। হাসতে হাসতে আমার সামনের সোফাটায় বসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, “আর তুমি নিজে মুতে তার স্বাদপরীক্ষা করেছ, একথা কোনদিন বলো নি তো?”
“এই মাইরি বলছি, আজ জ্বালিও না গুরু,” আমি বিস্বাদমুখে বললাম, “মাথাটা হেব্বি গরম হয়ে আছে।”
“কী হয়েছে? চা পোষায় নি?”
এবারে আমি একটু ক্ষেপেই বলে উঠলাম, “সক্কাল সক্কাল এইরকম চা মুখে দিলে মেজাজ আর ভাষা – দু’টোরই একশো আট হয়ে যায়। বা*র চা বানিয়েছে ল্যা** আমার।”
“তুমি না দেশের ভবিষ্যৎ তৈরী করছ? সেই তোমার মুখে কি এই সব কটুভাষা মানায়?” সান্যালদা হাসিটা যথাসম্ভব চেপে জিজ্ঞাসা করল।
“বা*র ভবিষ্যৎ আমার।”
এবারে সান্যালদা একটু আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, “কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে। সক্কাল সক্কাল মেজাজ এইরকম বিগড়ে কেন?” আমি চায়ের কাপটা রেখে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, “আর বলো না গুরু। পরীক্ষার খাতাগুলো চেক করছি, শালারা খাতায় একেবারে হেগেমুতে এক করে রেখে দিয়েছে। এরা নাকি দেশের ভবিষ্যৎ। গাণ*র দল যত্তসব।”
সান্যালদা এবারে হো-হো করে হেসে উঠে বলল, “ওহ, এই ব্যাপার। সে তো আমারও একই অবস্থা। তা অভীক, দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটাই তো ভোগে চলে যাচ্ছে। এদেরই বা দোষ দিই কি করে বলো তো।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললাম, “তা খুব একটা ভুল বলো নি। কিন্তু পুরো ট্রাইমেস্টার পড়ানোর পরে খাতায় এইসব মাল দেখলে মটকা গরম হয়ে যায় কি না বলো।”
“সেটাও ঠিক। তবে তুমি কিন্তু এই ক’দিন একটু মাথাটা ঠাণ্ডা রেখো। বাড়িতে ছেলের সামনে যেন আবার এইসব খিস্তি দিয়ে বসো না। তখন কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।”
“আর বিপরীত। এই গত পরশুই তো, সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে বসে বসে এমন কেস খেয়েছি, যে আর বলার নয়।”
“বলো কি। ছেলের কাছে কেস খেয়েছ নাকি?”
“নাহলে আর বলছি কি।” আমি হাতের সিগারেট থেকে ছাইটা আলতো টোকায় ফেলে সেই চায়ের কাপটা তুলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “তা একটু খেয়েছি তো বটেই।”
“মানে তোমাকে কেস দেওয়ার মত পাবলিক অলরেডি মার্কেটে চলে এসেছে?”
“হ্যাঁ, আর সে আবার আমার গোকুলেই বাড়ছে।”
“তা তুমি যখন কেস খেয়েছ, তাহলে তো শুনতেই হচ্ছে। কী হয়েছে বলো শুনি।”
“বলছি,” আমি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে শুরু করলাম।
জানোই তো, আমাদের কলেজের হাউসিংয়ে নতুন ক্রেস খুলেছে। সেই গত দু’বছর ধরে যুদ্ধ করার পরে ক্রেসটা শেষমেশ খুলল। একটু শান্তি, দিনের মধ্যে অন্তত কয়েকটা ঘণ্টা বিচ্ছুটাকে ওরা সামলে নেবে, আর গিন্নিও একটু শান্তি পাবে। তোমার ছেলে তো স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, তাই তুমি এই ব্যাপারগুলো ঠিক জানো না। সেখানে গিয়েই তার নতুন বন্ধু হয়েছে, সবার সাথে হাসছে, খেলছে, দিব্যি আছে। বেশ ভালই কাটল প্রথম কয়েকটা মাস।
এই কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের ক্রেস থেকে ডাকল। বলল যে ওরা বাচ্চাদের একটু একটু করে ইংরেজি বর্ণমালা শেখাবে। আমরা ভাবলাম, ভালই হ’ল। ক্রেসে খেলার সাথে সাথে নতুন কিছুও শিখবে। আমরা সবাই সায় দিলাম। কিন্তু শুধু ক্রেসে পড়ালেই তো হবে না, নিজেদেরকেও পড়াতে হবে। ক্রেস থেকেই বলল যে ওকে একটু একটু করে বর্ণমালার সাথে পরিচয় করাতে, তাতে ওর শেখাটা আরও ভাল হবে। কোই বাত নেহি। সেদিনই গিয়ে একটা ইংরেজি বর্ণমালার বই কিনে এনে আমি আর গিন্নি পালা করে ওকে সন্ধ্যেবেলায় একটু একটু করে পড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু সে মক্কেল তো একেবারে ল্যাজকাটা বাঁদর। তাকে পড়ানোটা আরেক যুদ্ধ। সে তো আর এক জায়গায় বসে বসে পড়ে না। তাই সে ছুটে বেড়ায়, আর তার পিছনে ঘুরে ঘুরে “A to Z” আউড়ে যেতে হয়। তো এইভাবে শুনতে শুনতেই আস্তে আস্তে মক্কেল একটু একটু করে শিখতে শুরু করেছে, কখনও সখনও বইটা নিজে নিজে নিয়েই বর্ণগুলো দেখে। রংচঙে বই, তার দেখতেও মজা লাগে। মাঝে মাঝেই ঘরের মধ্যে এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে বর্ণগুলো এলোমেলোভাবে নিজে নিজেই বলতে থাকে। আমরা শুনি আর ভাবি, এই তো বেশ বলছে। এইভাবেই আস্তে আস্তে শিখে যাবে। এই করতে করতে বিপত্তিটা বাধল, যেদিন সে বর্ণগুলো ঠিকঠাকভাবে বলতে শুরু করল। এই ঘটনায় কোথায় খুশি হব, তা না হয়ে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
তো গত পরশু রোজকার মতই কলেজ থেকে ফিরে গিয়ে নিজের ঘরে বসে কম্পিউটারে মেলবক্সটা দেখছি, আর একটা দরকারি ইমেলের উত্তর লিখছি। আর আমার খুদে বিচ্ছুটি ঘরের মধ্যে ঘুরঘুর করছেন। আচমকা ছুটে এসে আমার চেয়ারের হাতলটা ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে একরকম উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, “BC”। আমি প্রথমে অতটা খেয়াল করিনি। আমি তার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী বললি আরেকবার বল।” সে উৎসাহের সাথে আমার চেয়ারের হাতল ধরে একটা ছোট্ট লাফ মেরে বলল, “BC”। শব্দদু’টো ওর মুখে শুনে আমার প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। একলহমায় “BC” শব্দটির বাংলা এবং হিন্দি অর্থগুলো মাথায় ভেসে উঠতেই পেটের মধ্যে গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল। মাথার মধ্যে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত ভেসে উঠতে লাগল, আমি বিগত দু’-তিন সপ্তাহের মধ্যে ওর সামনে কি কি বলেছি, আর ভেবে চলেছি তার মধ্যে খিস্তি কত শতাংশ হতে পারে। কোনকিছুর উত্তর না পেয়ে ওকে নার্ভাস স্বরে একটা আলতো ধমক দিয়ে বললাম, “এই, এসব কি বলছিস?” একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখবে, বাচ্চারা যদি তাদের কোন কাজে তোমাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে, তারা হেব্বি মজা পেয়ে যায়, আর সেই কাজটা একেবারে কাটা রেকর্ডের মত বারবার করতে থাকে। আমার কাঁপাকাঁপা গলায় ধমক শুনে তিনি আরও উৎসাহিত হয়ে চেয়ারের হাতল ধরে আরেকটা ছোট্ট লাফ দিয়ে দ্বিগুণ জোরে বলে উঠলেন, “BC”। এবারে আমার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। সবে আড়াই বছর বয়স, এইসব শিখলো কোত্থেকে? নিশ্চয়ই ক্রেসে অন্য কোন বাচ্চার কাছে। এই ক্রেসে দিয়ে তো ভয়ানক বিপদ হয়ে গেল। এসব কী শিখে আসছে? কিন্তু, আমি নিজে কি কখনও এইসব কথা বাড়িতে ওর সামনে বলেছি? মাথার মধ্যে সার্চ অ্যালগোরিদম দুদ্দাড়িয়ে চলছে, কিন্তু হাজার খুঁজেও কিছু উত্তর পাচ্ছি না। ইমেলের উত্তর তখন মাথায় উঠেছে, আর আমার দুশ্চিন্তার পারদটা ক্রমশঃ রকেটের মত ঊর্ধ্বগামী হয়ে চলেছে। এই আড়াই বছরেই এখন “BC” বলছে, এরপরে কি হবে? “KC”…”MC”… ভেবেই গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
আমার রক্তচাপ বাড়তে বাড়তে ছাদের কাছাকাছি গিয়ে দুলছে, ঠিক এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলেন আমার গিন্নি। মাকে দেখেই আমার খুদে বিচ্ছুটি আমার চেয়ার ছেড়ে একছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল। এবং তারপরেই ঘটল এক অত্যাশ্চর্য্য ঘটনা। সে মাকে জড়িয়ে ধরে আধোআধো স্বরে বলে উঠল, “D-E-F”। আমি শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছি। কেসটা কী হ’ল? ব্যাপারটা পুরোপুরি বোধগম্য হওয়ার আগেই গিন্নি বলে উঠলেন, “এই দেখেছ, কি সুন্দর বলছে। ব্যাটা রান্নাঘরে আমাকে A বলেই পালিয়ে চলে এল তোমার কাছে। আর এখন আমাকে দেখে D-E-F বলছে। মাঝের B-C টা কি তোমায় বলেছে?”
আমি হাঁ। মনে মনে আমার খুদেটিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললাম, “হ্যাঁ বাওয়া, তাই-ই বটে। ইংরেজিতে BC বলে আমাকে বাংলায় BC বানিয়ে দিয়ে গেল।”
সিগারেটটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফিল্টারটা অ্যাশট্রেতে ফেলতে ফেলতে সান্যালদা হো-হো করে হেসে উঠে বলল, “তোমার ছেলে তো তোমার মতই যন্ত্র। এইটুকু বয়েসেই তোমায় এই লেভেলের কেস খাইয়ে দিল?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “তাহলে বুঝলে গুরু, এরপরেও কি বাড়িতে কোন খিস্তি দেওয়ার রিস্ক নেব ভেবেছ?”
“সে সব নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে কী বলে ডাকব ভাবছি।”
“আমায় আবার কী বলে ডাকবে?” আমি একটু সন্দেহের চোখে সান্যালদার দিকে তাকালাম।
“ভাবছি, তোমায় আজ থেকে ABC বলেই ডাকব। প্রথমে থাকবে A, তারপরে BC। বুঝলে কি না?” সান্যালদা হাসতে হাসতে বলল।
“ধ্যুৎ, আমি কাটলাম।”
“এই পালাচ্ছ কোথায়? এই ABC, ABC, এদিকে এসো…” সান্যালদা হাসতে হাসতে আমায় ডাকতে লাগল।
আমি পত্রপাঠ চম্পট দিলাম।
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
খিস্তির নেপথ্যে কিছু চরম সত্যি উত্থাপন করলেন লেখক। আর গল্পটি বেশ ভালো লাগলো।
অনেক, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে বিশ্বনাথ বাবু