লেখক : পূর্বিতা পুরকায়স্থ
হঠাৎই একদিন ঈথার তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে অনন্যার ফেসবুকের পাতায় ভেসে এল ওর এক অতি পরিচিতজন, তমোঘ্নদার লেখা। একটা সিনেমার রিভিউ। একটা ঘরোয়া পার্টিতে স্বামীর দ্বারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত একজন স্ত্রীর আত্মসম্মান রক্ষার সংগ্রামের কাহিনী রয়েছে সেই সিনেমায়। অনন্যা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই লেখাটা পড়ে। ঘর ভর্তি লোকের সামনে স্বামীর দ্বারা লাঞ্ছিত এক মানবী-মনের প্রতিটা শব্দ ও নৈঃশব্দকে অনুভব করা এবং তারপর তাকে এমন নিরপেক্ষ ভাবে প্রকাশ করা – এ একজন পুরুষের পক্ষেও সম্ভব?
প্রথমে তো মনে ঘটনার ছায়া পড়তে হবে। তারপর সেই ছায়া চেতনা ও মেধার অজস্র ঢেউ এর পথে আরোহন অবরোহনের পর হৃদয়ের আঁচে পূর্ণ রূপ পাবে। মনে যদি স্বচ্ছ টলটলে জল না থাকে তবে তো তাতে ছায়াই পড়বে না। লেখা তো অনেক দূর! অনন্যা অবাক হয়ে ভাবে তমোঘ্নদার মন এতটাই প্রশস্ত ও সংবেদনশীল! লেখা কি সত্যিই লেখকের হৃদয়ের কথা বা বিশ্বাসের কথা বলে? না কি অনেকটাই বা পুরোটাই আরোপিত ?
এইসব আদ্যোপান্ত ভাবতে ভাবতে সেদিন অনন্যার মনে উল্টো দিক থেকে হাওয়া বইতে শুরু করল। সেই হাওয়ায় একটি ঝরা পাতার মত ভাসতে ভাসতে অনন্যা চলে গেল অনেক অনেক বছর আগের দিনগুলোতে। তখন ওর বয়স কুড়ি বা একুশ। গৌহাটীতে জ্যেঠুর বাড়িতে থেকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। সঙ্গে চলছে ওর লেখালেখি। স্থানীয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে সবে ওর কবিতা বেরনো শুরু হয়েছে।
এক ছুটির সকালে দু’জন ভদ্রলোক অনন্যার সাথে দেখা করতে এলেন ও যাবার সময় ওঁদের ম্যাগাজিন ‘উদিচী’র জন্য কবিতা দেওয়ার অনুরোধ করলেন। সেই আলাপ তমোঘ্নদা আর সুদীপদার সাথে। তমোঘ্ন মিত্র ও সুদীপ চৌধুরী। ওঁরা অনন্যার থেকে খুব বেশি হলে ছয় সাত বছরের বড় হবেন। সেদিনের পর মাঝেমধ্যে ওঁরা আসতেন। সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনজনের মধ্যে নানারকম আলোচনা হত, সেই ঘেরা বারান্দার এক চিলতে বসার জায়গায়। তখন অনন্যা শুধু শুনত। কারণ তখনও ওর পড়াশোনার ব্যাপ্তি এত ছিল না। তাই আলোচনায় অংশ নেবার মত জ্ঞান তখন ওর বিশেষ হয়নি। এইসব আলোচনায় থাকতে পেরে অনন্যার খুব ভাল লাগত। কিন্তু এও বুঝতে পারত যে ওর জ্যেঠুর বাড়ির কেউ তমোঘ্নদাদের আসাকে একদম পছন্দ করতেন না। ওঁরা এলে ও একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ত। তাই মনে মনে চাইত ওঁরা যেন না আসে। যদিও এই কথা ভেবে অনন্যার খুব ভাল লাগত যে ওর কবিতা পড়ে ওঁরা ওর সাথে দেখা করতে এসেছেন । তাই তমোঘ্নদাদের সাথে ওর জমিয়ে আড্ডা বলতে যা বোঝায় তা কখনোই হয়নি। তবে কেন জানি অনন্যার অবাক লাগত এই ভেবে যে শুধুই কি ওর কবিতার টানে ওঁরা আসেন? তমোঘ্নদাকে কি কথা বলার সময় একটু নার্ভাস লাগত না? সুদীপদা তো একেবারেই আড়ষ্ট ছিলেন না। একবার তো কি একটা ব্যাপারে উনি তমোঘ্নদাকে বলেই ফেলেছিলেন, “আরে তুই নিজেই বল না, লজ্জা পাচ্ছিস কেন?” এরকম টুকরো টুকরো ঘটনা টুকরো টুকরো কথাগুলো অনন্যার কাছে এখন একটা স্পষ্ট বার্তা বহন করে আনে।
এরকমই এক ছুটির সকালে তমোঘ্নদা ও সুদীপদা এসে অনন্যাকে জানালেন ‘উদিচী’র প্রকাশ অনুষ্ঠান হবে পয়লা বৈশাখের সকালে এবং তারপর স্বরচিত কবিতা ও গল্প পাঠের একটা ছোট্ট আসর বসবে। অনন্যা যেহেতু সেই শহরের কিছুই চিনত না তাই সুদীপদা তমোঘ্নদাকে বলেন, “তুই সকালে এখানে এসে ওকে নিয়ে যাবি।” অনন্যা লক্ষ্য করেছিল সুদীপদা যেন সেদিন ঐ দায়িত্বটা তমোঘ্নদাকে দিয়ে অনন্যাকে কোন ইঙ্গিত করতে চেয়েছিলেন। আর সেই শুনে তমোঘ্নদার একটু লজ্জা মাখানো হাসিমুখ যেন এখনো অনন্যার চোখে ভাসে। তবে তখন ঐ কথাবার্তা ও ঘটনা তেমন কিছু ছায়া ফেলতে পারেনি ওর মনে। তাই কোন রোমান্টিক আবহ তৈরি হয়নি ওদের মাঝে।
সেদিনের কথামত পয়লা বৈশাখের সকালে অনন্যা তমোঘ্নদার সাথে অনুষ্ঠান হলে গিয়ে পৌঁছল। পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সব কবি সাহিত্যিকদের মত ও একটা নিজের লেখা কবিতা পড়ল। অনুষ্ঠান শেষে অনেকের সাথে পরিচয় ও আলাপ হল। তার পর ফিরে এল বাড়িতে। সেদিন বিহুর ছুটি থাকায় অনন্যারা ভাই-বোন মিলে সিনেমা দেখতে গেল। সিনেমা শেষ হবার পর ও হঠাৎ দেখল তমোঘ্নদাকে। সঙ্গে সুদীপদা ও আরও কয়েকজন। ওরাও সিনেমা দেখে বেরোচ্ছে। আর সাথে অবাক চোখে এও দেখল তমোঘ্নদা অনন্যার পাশেই দাঁড়ি়য়ে থাকা ওর দিদির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। অথচ অনন্যাকে খেয়ালই করেনি! অনন্যার সেই মূহুর্তে নিজের জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল ও দেখতে সাধারণ বলে ওকে এই অবজ্ঞার মুখোমুখি হতে হল। এই আপাত সৌন্দর্য ওকে বারবার হারিয়ে দিচ্ছে। বারবার পেছনে ফেলে দিচ্ছে। কোন মহিলা কবির শরীরী সৌন্দর্যের ঘাটতি কি তার লেখা কবিতারা পূর্ণ করতে পারে? কক্ষনো নয়। এ পর্যন্ত অসংখ্যবার প্রমাণিত হয়েছে ভালবাসা এই আপাত সৌন্দর্যের মোহিনী আলোর কাছে ভীষন অসহায়। সেদিন অনন্যার অপমানে ও অভিমানে ভারাক্রান্ত মন ওর অজান্তেই বোধহয় কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিল।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর একসকালে তমোঘ্নদা একা এসেছিলেন অনন্যার সাথে দেখা করতে। সেদিন বেশি কথা হয়নি। অন্যদিনের মত হাসিখুশিও ছিলেন না। যাবার আগে বললেন, “কাল বিকেলে আপনি আমার বাড়িতে আসুন। আমার মা বাবার সাথে পরিচয় হবে। আমি আশা করছি আপনি আসবেন।” তারপর বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে বললেন। পুরো কথা শুনে অনন্যার মনে হয়েছিল তমোঘ্নদার কথার সুরে ছিল একটা প্রচ্ছন্ন অধিকারবোধ । ওর তৈরি মন ভেতরে ভেতরে ওঁর সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই ও ঠিকানাটা ভাল করে শোনার এবং মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
তারপর প্রায় বছর ত্রিশেক পর তমোঘ্নদার লেখার সাথে ফেসবুকে দেখা। অনন্যা ওঁর লেখাগুলো পড়ে আর খুঁজে বেড়ায় সেই অবজ্ঞার ছায়া।
লেখক পরিচিতি : পূর্বিতা পুরকায়স্থ
লেখিকা কবিতা ও গল্প লেখেন। পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী।