খুনী কে ?

লেখক : অর্পিতা সাহা

অনলাইন গ্রসারি অ্যাপে কোন জিনিস কতটা পরিমাণে অর্ডার দিয়েছে, কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে চোখ বুলিয়ে নেয় মহিমা। এতগুলো আইটেম দোকান থেকে গিয়ে কিনে আনতে অনেকটা সময় ব্যয় হতো ওর, সে সময়টা অন্তত বাঁচানো গেল।

এখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ন’টা, বর উজান বেরিয়ে গেছে অফিসে একটু আগেই, ছোটো মেয়ে দিয়াকেও স্কুল বাসে গিয়ে তুলে দিয়ে এলো ওর ঠাকুরদা। এই টুকরো সময়টাতে সকালের ব্যস্ততা শেষে একটু জিরিয়ে নেয় মহিমা। আজ অবশ্য পরপর অনলাইন ট্রান্স্যাকশন করতে হচ্ছে ওকে। কখনো কিউ.আর.কোড স্ক্যান করে মেডিসিন অর্ডার দেওয়া, কখনো দিয়ার স্কুল ফিজ, কিংবা কখনো ইলেকট্রিসিটি বিল পে করা। সব কিছু পে করার পর নিজের অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সটা মিলিয়ে নেয় ও, ঠিকঠাক ডেবিটেড হল তো সব কিছু।

কিচেনের বেসিন থেকে কলের জলের শব্দ, পরিচারিকা মালা রান্নার ফাঁকে বাসন ধুচ্ছে তার টুংটাং আওয়াজ আসছে। খুব লো পিচে পর পর রবীন্দ্র সঙ্গীত চলছে ব্লু-টুথ স্পিকারে সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে, মহিমা চোখ বুজে নিবিষ্ট চিত্তে গান শুনছে। আর দশ মিনিটের মধ্যে উঠে পড়তে হবে ওকে,তারপর স্নান সেরে নিজের স্কুল যাবার পালা। মাঝে ঠাকুরকে একটু ফুল-জল-মিষ্টি দিয়ে ব্রাঞ্চ সেরে নেবে নিজে, এমনি সময় ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। এখন এই সময় আবার কে ফোন করছে? খুব তাড়ার সময় যারা কল করে, তাদের একটু উঞ্ছ টাইপের মনে হয় ওর। ইচ্ছে করে নিজেদের গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে এরা পরীক্ষা করে দেখে এইরকম সময়ে কল রিসিভ করে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে কিনা তাদের। মোবাইলটা রিংটোন সোনার কেল্লার সেই বিখ্যাত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, পণ্ডিত রবিশঙ্করজির অনবদ্য যান্ত্রিক মূর্চ্ছনা। কলার আই.ডি. তে শো করছে অনিরুদ্ধ লাহিড়ী। এই নামে তো ও কাউকে চেনে বলে ওর মনে পড়ল না। এখন তাড়াহুড়োর সময়, “ধুর! যত্তসব ননসেন্স পাবলিক।” ধরব না ধরব করে ধরেই ফেলল।
“হ্যালো, মহিমা, আমি… আমি রূপকথা বলছি।” কথার কন্ঠটা খুব উদ্বিগ্ন শুনতে লাগছে।
“কথা, এটা তোর নম্বর? তুই স্কুলে আসছিস তো, কথা হবে রে। আজ বড্ড লেট করে ফেলেছি।”
“না, আজ আর স্কুল যাচ্ছি না। আমার একটা বিপদ হয়ে গেছে রে।” বলল কথা, “আমার ফোনটাও খুঁজে পাচ্ছি না তাড়াতাড়িতে। তোর সাথে খুব দরকার, তাই বরের অন্য একটা ফোন থেকেই কল করতে বাধ্য হলাম তোকে।”
“তুই ঠিক আছিস তো কথা?”
“আমি ঠিক আছি রে।”
“আচ্ছা! তাহলে এখন রাখি। আমার আজ ফার্স্ট পিরিয়ডের পর অফ। তোকে কল করে শুনব সবটা তখন।”
“আজ তো শনিবার। তুই বরং ছুটির পরে আমার বাড়ি চলে আয়, খুব আর্জেন্ট রে। এসব কথা ফোনে বলা যাবে না।”
“সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আমি এখন রাখি, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আই উইল কল ইউ ব্যাক, সুন।” বলেই ফোনটা রেখে বাথরুমের দিকে ছুট লাগাল মহিমা। “ইস, আজ বড্ড দেরী হয়ে গেল।”

আজ আকাশটা বেশ মেঘলা, নিম্নচাপ হয়েছে বঙ্গোপসাগরে, কাল নিউজে বলছিল এই ক’দিন আকাশ মেঘলা থাকবে, ভারী থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হবে সারাক্ষণ। কাল থেকে তাড়াহুড়োতে পেপার পড়ার সময় হয়নি, টি-টেবিলের উপর নিউজপেপারটা এখনও রাখা। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে হঠাৎ প্রথম পাতার লেফট কর্ণার সেকেন্ড কলামে একটা নিউজ চোখে পড়লো – বিখ্যাত ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর বালিগঞ্জ ফার্ণ রোডের পৈতৃক বাড়িতে গতকাল রাতে দুষ্কৃতী হামলা। বাড়িটিতে রাতের অন্ধকারে কিছু বহিরাগত প্রবেশ করে দরজার তালা ভেঙে বাড়ি ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করেছে। সিসিটিভি ফুটেজে কোন ক্লু মেলেনি, কারণ ক্যামেরার ডিভিআর খুলে নেওয়া হয়েছিল। বাড়িতে দামী জিনিস, নগদ টাকাপয়সা,গয়নাগাঁটি ছিল, সেগুলো কোনকিছু খোয়া গেছে কিনা, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। বাড়ির ঠিক পেছনের দিকে বাড়ির দুজন সিকিউরিটি গার্ডকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাড়ির একমাত্র বয়স্ক সদস্য এবং বাড়ির মালিক অঞ্জন লাহিড়ী কাল বিকেলে বিশেষ কাজে ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ আর স্কুল যেতে ইচ্ছে করলো না মহিমার, সোজা চলে গেল কথার বাড়ি।

দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল দোতলা বাড়ি ওদের। ও নিজের পরিচয় দিতেই বিরাট লোহার গেট ও লন পেরিয়ে দামী মেহগনি কাঠের সদর দরজার কাছে পৌঁছে দিল দারোয়ান। মাধবীলতার ঝাড় উঠেছে একতলা থেকে উপরে। ফুটে থাকা সাদা গোলাপী ফুলগুলোর দিকে চোখ যেতেই দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি দেওয়া কোন মুখ হঠাৎ করে সরে গেল।
দরজা খুলল রূপকথা নিজেই। রেড সিল্কের পটি দেওয়া দামী একটা হাউসকোট পরা, মাথার চুল অবিন্যস্ত, মুখে চোখে ভয় ও উদ্বেগের ছাপ। ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
“মহিমা, বাঁচা আমায়!”
“কি হয়েছে আগে তো বল?”
“তুই পেপার পড়িস নি?”
“পড়েছি। তোর শ্বশুরমশাইকে কি পাওয়া গেছে?”
“না, উনি এখনও নিখোঁজ।”

ওরা বিশালকার একটা ডাইনিং এর সোফায় এসে বসলো। মেহগনি কাঠের তৈরি আসবাব হল জুড়ে, দামী অ্যান্টিক কিছু শো’পিস চোখে পড়ল। তার মধ্যে গোল্ডেন কালারের পেতলের তৈরী একটা গৌতমবুদ্ধের আবক্ষ মূর্তি ভীষণ চোখ টানলো মহিমার।
“মহিমা, তুই তো নিজে একজন গোয়েন্দা। কত জটিল কেস সমাধান করেছিস এককালে। প্লিজ, তুই আমার জন্যে কিছু কর।”
“কিন্তু আমি তো প্রফেশনাল নই রে। আর তুই-ই তো বলে ফেললি এককালে ছিলাম।”
“তবু আমি জানি তুই পারবি। আমার বর ব্যবসার কাজে বিদেশে, আজই সন্ধের ফ্লাইটে ফিরবে। এদিকে শ্বশুরমশাই নিখোঁজ, পুলিশ বাড়িতে আসছে যাচ্ছে, হাজারবার ইণ্টেরোগেট করছে। আমি আর নিতে পারছি না রে।”
মহিমা বলে উঠলো, “বেশ। তুই নিউজপেপারের ছাপা খবরের অংশটুকু বাদ দিয়ে প্রথম থেকে বল কি কি ঘটনা ঘটেছিল।”
“বলছি। তুই চা খাবি?”
“স্কুলে যাব বলে ব্রাঞ্চ করে বেরিয়ে ছিলাম, এখন কিছু খাব না। তুই বল তো আগে সবটা।”

কথা শুরু করল, “আমার শ্বশুরবাড়ি জাত ব্যবসায়ী পরিবার। আমার স্বামী অনিরুদ্ধ এক মাত্র ছেলে। শাশুড়ি মারা গেছেন প্রায় বছর দশেক হল। এ বাড়িতে আমি, আমাদের ছেলে অর্ক, শ্বশুরমশাই, আর অনিরুদ্ধ একসাথে থাকি। আর থাকে একজন সব সময়ের কাজের মেয়ে মালতী আর একজন রাঁধুনী, বয়স্ক, আমার শাশুড়ির আমল থেকে আছে। আমরা তাঁকে বাড়ির মেম্বারই ভাবি, তাই প্রতিমা পিসি বলেই ডাকি। এছাড়া বিহারী দারোয়ান রামদয়াল, ড্রাইভার সংযোগ, বাগানের মালী কল্যাণ, আর আমাদের একটি ঠিকে কাজের মেয়ে জবা, মালতীর নিজের বোনের মেয়ে।”

মহিমা একে একে বাড়ির সকল কাজের লোক, ড্রাইভার, মালী, এমনকি প্রতিমা পিসির সাথে একান্তে কথা বলল। তবে কাউকে সন্দেহ করার মত কিছু খুঁজে পেল না। শুধু মালতীর মুখচোখ কেমন স্বাভাবিক লাগল না, কথার মধ্যে কেমন জড়ানো জড়ানো ভাব, কোন কিছু গোপন করছে মনে হল। তবে একটা জিনিস দেখে ভাল লাগল, বাড়ির সকলেই বেশ বিমর্ষ। কারণ বাড়ির অভিভাবক বৃদ্ধ অঞ্জন লাহিড়ী, ওদের সকলের প্রিয় বড়বাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিমা, যিনি রান্না করেন, এরা সকলেই তাঁকে পিসি বলে ডাকে। তাঁকে দেখে মনে হল খুব ভেঙে পড়েছেন। বারংবার অনুরোধ করছে মহিমাকে কিছু করতে, যাতে বড়বাবু ফিরে আসেন, সব কিছু আগের মত হয়ে যায়।

কথা আবার বলতে শুরু করলো। “এছাড়াও আমাদের বালিগঞ্জে যে বাড়িটা আছে, ওটা পুরনো শ্বশুরবাড়ি। ওটা সেল করার কথা চলছিল। বাবা তাই পরশু দিন বিকেলে ওখানে চলে যান।”
“উনি কি একাই যান?”
“না। আমি আর অর্ক গিয়ে ওনাকে ড্রপ করে দিয়েছিলাম, আর সঙ্গে ছিল মালতী। আমি আর অর্ক ফিরে আসি, কারণ আমাদের এক নিকট আত্মীয়া হাসপাতালে ভর্তি, তাকে দেখতেই আমরা ওখানে যাই।”
“আচ্ছা, তখন ঠিক ক’টা বেজেছিল বলতে পারিস?”
“ঘড়ি দেখিনি, তবে মনে হয় সাড়ে চারটে কিংবা পৌনে পাঁচটা। কারণ ওখান থেকে বেরোনোর ঠিক এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা হাসপাতালে পৌঁছে যাই। অর্ক হাসপাতালে ঢোকার সময়ে বারংবার বলছিল, একেবারে এক ঘন্টা লেগে গেল এখানে পৌঁছতে।”
“বেশ। তাহলে এটাই দাঁড়াচ্ছে, যে মালতী তখন তোর শ্বশুরমশাই এর সাথে ও বাড়িতে।”
“হ্যাঁ, মালতী ওখানে বাবার সাথে থেকে যায়। তাছাড়া ওই বাড়িতে দুজন সিকিউরিটি গার্ড সব সময়ে থাকে। হঠাৎ কাল সকালে ফোন আসে একটা অচেনা নম্বর থেকে। বলে, আপনার বাড়ির লোকের খুব বিপদ। আমি বাবাকে বারংবার কল করি সেদিন রাতে, কিন্তু মোবাইল সুইচ্ড অফ বলছিল। বাড়ি বিক্রি ফাইনাল করে সেদিনই কিছু অ্যাডভান্স পেমেন্ট নিয়ে বাবার এ বাড়িতে ফিরে আসার কথা। আমি ওখানে যাই কাল সকালে, তখন কাউকে দেখতে না পেয়ে পুলিশে খবর দিই। বাবা নিখোঁজ, আর দুজন সিকিউরিটি গার্ডকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। এটা তো তুই পড়েছিস আজকের পেপারে।”
“আচ্ছা, মালতী তখন কোথায় ছিল?”
“ওকে নাকি বাবা বাজারে পাঠিয়েছিলেন, ও তো তাই বলছে।”
“যে লোকগুলো তোর শ্বশুরমশাইকে পেমেন্ট করেছে, তারা কোথায় এখন? ওদের সাথে কথা হয়নি তোর?”
“ওনারা বলছেন যে বিকেলের পরেই চেক হাতে দিয়ে স্ট্যাম্প পেপারে সাইন করে ওনারা বেরিয়ে গেছেন। ওনারা মোট দু’জন ছিলেন, মিস্টার অনুপম সেন আর রাজীব মজুমদার। ওনাদের সাথে আমাদের বহু বছরের পরিচয়। তবে এই ঘটনা ঘটার পরেই ওনারা দু’জনেই অ্যারেস্টেড হয়ে এখন পুলিশ কাস্টডিতে।”
“তবে আমার মনে হচ্ছে ওনারা নির্দোষ।”
“কেন মনে হচ্ছে তোর এমন?”
“কারণ ওনাদের তেমন কোন অ্যালিবাই নেই। ওনারা বাড়িটা কিনে নিচ্ছেন যখন, কেন এইসব ফালতু ঝামেলার মধ্যে যাবেন বলতে পারিস? আমার মনে হয় ওই বাড়ি থেকে ওনারা চলে যাবার পর এমন কেউ এসেছিল, যারা এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে। তুই আমায় এখনই একবার ওই বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবি?”
“নিশ্চয়ই, কেন নয়।”
“তাহলে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল। আমি এখনই যাব ওখানে। আর হ্যাঁ, মালতীকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।”

হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল রূপকথার। ও তড়িঘড়ি ফোনটা রিসিভ করতেই ওপার থেকে ভেসে এলো, “থানা থেকে বলছি। এই মাত্র আপনাদের ফার্ণ রোডের বাড়ির ট্যাঙ্ক থেকে আপনার শ্বশুরমশাইয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আপনি একবার থানায় আসুন। ওই বাড়ি আপাততঃ সিল করে দেওয়া হয়েছে এবং বাড়ির বাইরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে ওখানে আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।”
হাত থেকে ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেল কথার। “বাবা খুন হয়েছেন,” বলেই কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লো ও।
“কথা, প্লিজ শান্ত হ’। আর তোর হাজব্যান্ডকে কল করে খবরটা দে।”

তারপর ওরা দু’জন বালিগঞ্জ থানার উদ্দেশ্যে রওনা হল। সেখানে থানার ওসি সমর্পিতা সেন আবার মহিমার কলেজের সহপাঠী। তাই মহিমা যখন জানাল সে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে কেসটা হ্যান্ডেল করছে, তাই তদন্তের বিষয়ে ও যদি হেল্প করে। সমর্পিতা বেশ খুশীই হল কথাটা শুনে এবং এই ব্যাপারে সব রকম সাহায্য করবে বলে ওকে আশ্বাস দিল।
মহিমা বলল, “আজ কি এখনই বালিগঞ্জে ভিকটিমের বাড়িতে যাওয়া যেতে পারে? আসলে আমি স্পটটা দেখতাম একটু।”
সমর্পিতা প্রথমে ঘড়ি দেখল তারপর নিজের ডায়েরি। “ঠিক আছে, এখন আমার হাতে প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের মত সময় আছে।”
মহিমা বলে উঠলো, “ফাইন, দ্যাটস এনাফ।”
ওরা তিনজন, মানে মহিমা, কথা, আর ওসি জিপে উঠল, সঙ্গে দুজন আর্মড পুলিশ। পুলিশের জিপ ছুটল ফার্ণ রোডের সেই অভিশপ্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে।

বাড়ির ভেতরে ঢুকে যে ঘরে কথা ও ওর শ্বশুরমশাই গিয়ে সেদিন বসেছিলেন, সেখানে বিছানা থেকে কিছু ছোট চুলের গোছা দেখতে পেল মহিমা। কাঁচাপাকা মেশানো ছোটো চুলের গোছা দেখে মনে হল কেউ খামচে ছিঁড়ে নিয়েছে ওই চুলগুলো মাথা থেকে।

বাড়িটার সামনে ও পেছনের দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে আগাছা জন্মেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বাড়িটাতে দীর্ঘদিন কেউ বসবাস করে নি। খুব সাবধানে ওই ঝোপের মধ্যে কিছু খুঁজে পাবার প্রত্যাশায় মহিমা ধীরে ধীরে পা ফেলতে লাগল, ওর হাতে গ্লাভস পরা এবং ছোট্ট দুটো প্যাকেট মুঠোয় ধরা। পুলিশ দু’জনও ওকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে লাগল। হঠাৎ ঝোপের মধ্যে থেকে ভাঙা মদের বোতল চোখে পড়লো। ওগুলো বেশ কমদামী দেশী মদের বোতল। এছাড়া ও একটা লাল রঙের শার্টের বোতাম এবং একটা স্টিলের হাতের বালা, ছেলেরা যেমন পরে, চোখে পড়ল। আরও দূরে কয়েকটা আধখাওয়া বিড়ির টুকরো, দুটো চিপসের প্যাকেট দেখতে পেল। সব যত্নে তুলে নিয়ে ওগুলো ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্যে পাঠাতে বলল। এরপর ওরা যে যার মতন নিজের নিজের কাজে ফিরে এলো, শুধু মহিমা সমর্পিতাকে আড়ালে ডেকে কিছু কথা বলল। “তাই হবে,” বলে ওসি হেসে কথা দিল।

এরপর দু’দিন কেটে গেছে। মহিমা স্কুলে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে সারাদিন ফোনকলে ব্যস্ত। কখনও কখনও বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছে একদম একা। তার স্বামী পার্থ একদিন তো বলেই উঠল, “বেশ তো দিদিমণিগিরি করে খাচ্ছিলে। আবার হঠাৎ গোয়েন্দাগিরি করা কেন বাপু? যাই হোক, এইসব খুনের কেস। তাই সাবধানে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করো, আর প্রয়োজনে আমায় ফোন করো।”

আজ সকাল থেকেই মহিমা খুব খুশী। খুনী যে আসলে কে, সেটা ও আগেই বুঝতে পেরেছিল। তবে প্রমাণগুলো এবারে সব হাতে পেয়েছে।

সন্ধে বেলায় পুলিশ ফোর্সসহ সমর্পিতা হাজির কথার বাড়ি। বাড়িতে উপস্থিত কথা, ওর ছেলে অর্ক, স্বামী অনিরুদ্ধ। এছাড়া ওদের রান্নার লোক প্রতিমা পিসি, সব সময়ের কাজের মেয়ে মালতী, বিহারী দারোয়ান রামদয়াল, ড্রাইভার সংযোগ, বাগানের মালী কল্যাণ, আর ঠিকে কাজের মেয়ে জবা।
মহিমা বলল, “এবার আমি আসল ঘটনায় আসি। যেদিন এই ঘটনাটা ঘটে, সেদিন সকাল থেকেই এই বাড়ির মধ্যে একজন পুরো ব্যাপারটা আগে থেকেই জানত। বলা ভাল, যে সে এই প্ল্যানে সামিল ছিল।” ঘরের মধ্যে পিনড্রপ সাইলেন্স। সকলেই সকলের দিকে তাকাচ্ছে। “তবে আসল খুনী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা এখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদেরও আমরা খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেলব।”
এবারে মহিমা মালতীর দিকে ঘুরে বলল, “ঘটনার দিন মালতী তো স্পটে উপস্থিত ছিলে। তুমি বলবে সেদিন কি হয়েছিল? নাকি আমিই বলব?” মালতীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল হঠাৎ।
“আমি যদি ভুল না বলি, তাহলে খুনটা করেছে ওর ছেলে এবং আরও কয়েকজন একসাথে মিলে। সেদিন কথা আর ওর ছেলে অর্ক যখন হাসপাতালে ওদের আত্মীয়াকে দেখতে বেরিয়ে পড়ে, তখন মালতী ওর ছেলে আর তার বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে আনে। ওরা এসে বাড়ির পেছনের দিকে বসে লুকিয়ে মদ আর চিপস খায়। তার আগে ওখানেই মালতীর ছেলের হাতের স্টিলের বালা, যাতে নাম লেখা আছে বাবাই, মনে হয় অসাবধানে ঝোপের মধ্যে পড়ে যায়। মদ্যপ বাবাই তা খেয়াল করেনি। কিন্তু এটাই তো নিয়ম। খুনী খুনের আশেপাশে তো নিজের ক্লু রেখে যাবেই।
যাই হোক, এরপরে ওরা ওদের বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডদের মাথার পেছনে আঘাত করে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে দেয় বাড়ির পেছনের দিকের ঝোপের ধারে। ততক্ষণে যারা টাকা পয়সা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি কিনতে এসেছিল, তাদের সাথে অঞ্জনবাবুর কথা হয়ে যায় এবং ওনারা চলে যান। সন্ধে হয়ে এসেছিল, তাছাড়া এই বয়সে এসে নিজের বাড়িতে একটা রাত কাটাতে ইচ্ছে হয় ওনার। বাড়িটা বেচে দেবার আগে হয়ত উনি খুব নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলেন, তাই সে রাতে ওখানে থাকবেন বলে মনস্থির করেন। ওনারা যা পেমেন্ট করে গিয়েছিলেন, সেটা পুরোটাই এন.এফ.টি. করে, তাই তাঁর দুশ্চিন্তাও নেই, টাকাপয়সা মার যাবারও ভয় নেই। তবে মালতীর কাছে সে খবর ছিল না। সে জানত অন্তত লাখ দশেক ক্যাশ থাকবে বাবুর কাছে। আগে তেমনটাই কথা বলেছিলেন অঞ্জনবাবু তার কাস্টমারের সাথে, যেটা লুকিয়ে এ বাড়িতেই সে শোনে ফোনে আড়ি পেতে। পরে সেই সিদ্ধান্ত যে বদল করেন অঞ্জনবাবু, মালতীর কাছে সে খবর ছিল না।
মালতী রাতে রান্না করবে বলে বাজার যাবার অজুহাতে ছেলে ও বাকিদের ডেকে আনে। তারপর তারা এসে অঞ্জনবাবুর কাছে টাকা দাবি করে। তিনি জানান, তাঁর কাছে কোন টাকা নেই। তারপর তাঁকে মারধর করে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ওরা ঘরের বাইরে বের করে আনে। সেই চুলের গোছা ফরেন্সিক টেস্ট করে প্রমাণিত ওটা অঞ্জনবাবুর। ওরা প্রথমেই ওনাকে প্রাণে মেরে ফেলবে ভাবেনি। কিন্তু অঞ্জনবাবু যখন বুঝতে পারেন, ওর কাজের লোক মালতীর ছেলে ও ছেলের বন্ধুরাই হ’ল এই দুষ্কৃতীরা, তখন তিনি গর্জে ওঠেন। আর এখানেই তিনি ভুলটা করে বসেন। ওনাকে বাঁচিয়ে রাখলে ভারী বিপদ, তা বুঝে ওরা ওনাকে খুন করে ছাদে জলের ট্যাঙ্কে লাশ ফেলে দেয়। কি মালতী, ঠিক বলছি তো আমি?”
“না। মিথ্যে, সব মিথ্যে।” চেঁচিয়ে ওঠে মালতী।
“তাই নাকি? তোমার আর তোমার ছেলের মোবাইলের লোকেশন ও কললিস্ট পুলিশ মিলিয়ে দেখেছে। সেদিন বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে রাতে ক্যানিং লোকাল ধরে তোমার ছেলে ও তার বন্ধুরা পালিয়ে যায়। স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ তাই বলছে।”
এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে মালতী। কথা উঠে গিয়ে পর পর চারটে চড় কষায় ওর গালে। “দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি আমি।”
ততক্ষণে ফোন আসে সমর্পিতার। মালতীর ছেলে বাবাই ধরা পড়েছে পুলিশের জালে। সুন্দরবন হয়ে বাংলাদেশের বর্ডার পেরোনোর চেষ্টা করার সময়ে ওকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। শেষে মহিমা বলে, “আমার প্রথম থেকেই ওকে সন্দেহ হয়েছিল। শুধু টাকার লোভে ও ওর ছেলেকে এ কাজে লাগিয়ে ছিল। নিজের এবং পরিবারের জীবন নষ্ট করলো ও।”

মহিমার বুদ্ধির তারিফ করে ওসি এবং মহিলা কনস্টেবল এসে মালতীকে ভ্যানে তোলে। মহিমা সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, “অর্থই অনর্থের মূল। মালতীর অতি লোভের ফলে সব শেষ হয়ে গেল।”
কথা মহিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

লেখক পরিচিতি : অর্পিতা সাহা
আমি অর্পিতা সাহা। প্রাণীবিদ্যা নিয়ে স্নাতকোত্তর করে বর্তমানে একটি সরকার পোষিত স্কুলের শিক্ষিকা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখি। লেখা আমার খুব ভালোলাগার জায়গা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।