লেখক : মধু মঙ্গল সিনহা
পর্দাটা সরিয়ে ঘরে ঢোকার আগেই চোখে পড়ল- সে দুটো ঠোঁট টানটান করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে । ডাক্তার ছাত্রের চতুর্থ মাঙ্গ্লিক অনুষ্ঠান- তারা দুই সই ননদ বৌদি আমন্ত্রিত সেখানে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার যে ব্যপার সেপার সেটা হঠাৎ করে নয়, গত দুমাস ধরে মনে মনে সেই আয়োজন চলছিল।কোন শাড়ি পরবে, সাথে কি কি গহনা, নেইলপলিশ কি ধরনের হবে এমন কি কাদের সাথে দেখা হবে তাদের সাথে সম্ভাব্য কথা-বার্তাই বা কি ধরনের হবে এই নিয়ে নিয়মিত মনে মনে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। সিদ্ধান্ত ছিল গাড়িটা সে নিজে ড্রাইভ করে তারা দুজন সন্ধ্যার পর আলো আধাঁরের ঘাড় ভেঙ্গে নারীত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ দিতে দিতে অনুষ্ঠানে যোগ দেবে। এখানে হয়তোবা আভিজাত্য ও আনন্দ দুটোই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল।এদিকে গিফটের জন্য কেনা দামি বেডশীট খানা তখনো সোফায় পড়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিল আমার দিকে।
আমি নিরুপায় দুদিন ধরে আমার শরীরটা ভালো নেই কোন কাজ করতে ভালো লাগছিল। না; কথাগুলো বলছিলাম এই কারণেই যে,পাড়ার একটি ছোট্ট ছেলে গাড়ির দুটো চাকার বায়ু ছেড়ে সমস্ত ঘটনা মাটি করে দিয়েছিল। যদিও ব্যাপারটা আমি ঘরে ঢুকার কুড়ি মিনিট আগে সে আমাকে ফোনে জানিয়েছিল। তবু তার কেমন যেন একটা বিশ্বাস ছিল হয়তো বা আমি কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা করবোই। নয়তো একটা মৌখিক অনুমতি হলেও দেবো যাতে দুই সই স্কুটার করে হলেও সেই অনুষ্ঠানে যেতে পারে। বিয়ে বাড়ির বারো মজার আনন্দটাই আলাদা; সেটা কি কোন অবস্থায় মিস করা যায় ?
ওর শরীরটাও যে-এর ভালো নেই সে কথা আমি পূর্ণ শতাংশই জানি। তার রোগের নামটা যে কি- আমি ঠিক জানি না। তবে আমি একটা সাদা বাঙালা নাম দিয়েছি, সেটা হলো-‘বারোমাসি চোখ টেপা রোগ’। ডাক্তার দেখানো হয়েছিল কিন্তু সময় ফুরসতের অভাবে বিভিন্ন টেস্টগুলো করানো যায়নি। যদিওবা আমরা আগরতলা আইএলএস পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ভাঙ্গা শীতের রাত আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা রাস্তা, ইলেকশনের উপদ্রব, আর কুয়াশা-ধোয়া মিশ্রিত বন্যা- যাওয়া আসা মিলে চব্বিশ কিলোমিটার তাও আবার স্কুটারে আমার ভাবতে যেন একটু কষ্ট হচ্ছিল।তাও যাবে সন্ধ্যে সাতটায় ফিরে আসবে কমপক্ষে পরদিন ভোর দুটোর আগে নয়। আমি হালকা সুরে বলি ” আমি একটা গাড়ি ভাড়া করে দিই, ভালো হবে”। তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমি রাজি ছিলাম না এ যাত্রায়।
এবার চললো অপার থেকে হালকা ধরনের ধমক মিশ্রিত আক্ষেপ আর অভিমানের পালা। সন্ধ্যা বেলার অমৃত পেয়েলা থেকে বঞ্চিত হতে হল আমাকেও। কিন্তু করার কিছু নেই আমাদের কারো শরীর ভালো নেই। আমি এ কথা স্বীকার করলেও ,সে স্বীকার করতে চাইছিল না নিশ্চয়ই প্রাপ্ত আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যথার কারণে। মান অভিমান শোক থাকলেও বিষয়টি সে যে বুঝে না এমনটাও নয়-“ Health is the priority” ভোরবেলা উঠে দেখি আমার ডান হাতের পাতায় তার সেই দুটি ঠোঁটের লিপস্টিকের দাগ গোলাপ পাপড়ির মতো ফুটে আছে। মনে প্রশ্ন উঠল্,’’ তাহলে সে আমায় ভুল বুঝে নি তো?’’
লেখক পরিচিতি : মধু মঙ্গল সিনহা
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর ত্রিপুরা জেলার পূর্ব হুরুয়া গ্ৰামে ৬ এপ্রিল ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্ৰহণ করেন।পিতা শ্রী ফুলমোহন সিংহ, মাতা শ্রীমতী হরিপ্রিয়া সিংহের একমাত্র পুত্র,তিন বোন মনোরমা, মঙ্গলা ও মমতা।কবির শিক্ষাগত যোগ্যতা-বি.এ.সান্মানিক(দর্শন শাস্ত্র),ডি.এল.এড্।এছাড়া তিনি এডুকেশনাল লীডারশীপ সহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ কোর্স আই.আই.টি মাদ্রাজ থেকে করেন।কবি পত্নী সীতা সিনহা এবং দুই কন্যা মধুমিতা, মধুশ্রী।বাল্যকাল থেকে কবি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও বাংলা ভাষায় কবিতা ও গল্প লেখা-লেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।কবি মধু মঙ্গল সিনহা একজন যুবা কবি, লেখক, সমাজসেবী,চলচ্চিত্র অভিনেতা; পেশায় শিক্ষক। তার লেখা 'বংশীধ্বনী','হজাক','সমুদ্রমন্থন','বিবেকতারা','সন্ধিক্ষণ','উত্তরণ','শব্দনীল' ইত্যাদি ম্যগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হয়।অন্যদিকে কবি 'পহর', 'সঙ্ঘ' এবং 'মঙ্গলদীপ' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। 'নিঙশিং হপনে'-(বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায়) প্রথম কাব্য গ্ৰন্থ,কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্ৰন্থ 'নিক্কন'।কবির তৃতীয় কাব্যগ্ৰন্থ "ইমার ডাকে" প্রকাশিত হয়।
পাঠ সংখ্যাঃ 89