মেঘলা দিনের সুর

লেখক : মৌসুমী চন্দ্র

আকাশজুড়ে মেঘের আনাগোনা, ধূসর আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এমন মেঘলা দিনে রেডিওতে গান শোনার মুডে ছিলেন দীপকবাবু। কিন্তু বিধি বাম! ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে টিভির গমগমে আওয়াজ। বিরক্তি চাপতে না পেরে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, “বাপরে বাপ! একটু যে রেডিও শুনব, তারও জো আছে? সারাদিন শুধু সিরিয়াল! এই মেঘলা দিনে একটু যে মেঘের গুরুগুরু ডাক শুনব… ওরে ও নমি রে, একটু টিভিটা কমা না!”
দাদার কথা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল নমিতা। তাকে দেখেই দীপকবাবু খানিক নরম সুরে বললেন, “ভাবছিলাম মেঘলা দিন তো, কতদিন এমন দিনে আকাশ, মেঘ দেখা হয় না। তাই ভাবলাম তোকে নিয়ে একটু মেঘলা দিনের মজা নিই।”
নমিতা ঝাঁঝালো কণ্ঠে উত্তর দিল, “তোমার মেঘলা দিন! আমার সিরিয়ালটা শেষ হওয়ার আগেই লোডশেডিং, মাথা গরম হয়ে গেল! ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বের করা, তারপর এই সব কিছু… বাপরে বাপ!”
দীপকবাবু এবার নরম গলায় বললেন, “আজ রেডিওতে মেঘলা দিনের গান হবে, এখন লোডশেডিংটা বেশ ভাল হ’ল। সারাদিন তোর টিভির জ্বালায় তো একদম শুনতে পাই না।”
দাদার মুখে ‘টিভির জ্বালা’ শুনে নমিতা অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। “আমার টিভির জ্বালায়? জানি দাদা, আমিই তো তোমার জীবনের জ্বালা, তাই না?”
নমিতার চোখ-মুখ দেখে দীপকবাবু মৃদু হাসলেন, “তুই কথায় কথায় এত রাগ করিস, এত মাথা গরম করিস! আমার তো ভীষণ ভয় করে তোকে!”
“দাদা, কেন তুমি আমায় ভয় কর বলো তো? আমি তো চাই তুমি আনন্দে থাক। জানি আমি তো এক অপয়া বিধবা বোন তোমার, দাদা,” নমিতার কণ্ঠস্বর করুণ শোনাল।
বোনের কথা শেষ হতে না হতেই দীপকবাবু চিৎকার করে উঠলেন, “তুই চুপ কর! আর কখনও এ’কথা বলবি না। মাত্র একমাস বিয়ে হয়েছিল তোর, তুই বিধবা কেন হবি বোন? আমি কোনদিন বিয়ে করিনি তোর কথা ভেবে রে। তুই তো আমার মেয়ে, আমার মা, সব! মা মারা যাওয়ার সময় আমায় বলে গিয়েছিলেন, ‘নমুকে দেখিস বাবা’।”
দাদার কথায় নমিতার চোখে জল চিকচিক করে উঠল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “দাদা, গতকাল অসীমাদি তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলেন। বলছিলেন, তোমার শরীর কেমন আছে, একবার দেখা করতে আসতে চান।”
“আমার সাথে কথা বলে কী হবে? কী করব আমি?” দীপকবাবুর কণ্ঠে উদাসীনতা।
নমিতা বলল, “দাদা, তুমি কেন অসীমা দিদিকে বিয়ে করলে না? উনি তোমায় কত ভালবাসেন জানো?”
“নমু, ভালবাসলে কি বিয়ে করতেই হয়? থাক না এসব কথা। বললি ইলিশ মাছ বের করেছিস, এমন মেঘলা দিনে খিচুড়ির সাথে জমে যাবে!” দীপকবাবু প্রসঙ্গ পাল্টালেন।
দাদার কথায় নমিতা একগাল হাসল। “আজ কারেন্ট এলেও আর টিভি দেখব না, এখন নো সিরিয়াল। আমরা ভাই-বোনে মেঘলা দিনের গান শুনব, কেমন?”
রেডিও খুলতেই ভেসে এল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই প্রিয় গান – “এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়…”

বাইরে তখন বৃষ্টি ভীষণ, ভিজছে কদম গাছ। ভাই-বোন দুজনেই সেই মেঘলা দিনের গানে গলা মেলালেন। সেই সুর যেন তাদের সব মান-অভিমান ভাসিয়ে নিয়ে গেল, ফেলে গেল এক নির্মল আনন্দ আর ভালবাসার রেশ।


লেখক পরিচিতি : মৌসুমী চন্দ্র
মৌসুমী চন্দ্র, এম এস সি করেছি। লেখালিখি, বাচিক শিল্পী, অঙ্কন শিল্পী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।