লেখক : সুদীপ জোয়ারদার
“দু’টো ক্লাসের ফাঁকে মিনিট পাঁচেকও যদি সময় না পাওয়া যায়, কীরকম বাজে লাগে বল তো!”
“আমাদের বাজে লাগলে মেজদিস্যরের কি এল গেল? উনি ঘণ্টা পড়তে না পড়তেই একেবারে হাজির!”
“আচ্ছা, মেজদিস্যরকে একদিন বললে হয় না!”
“কে বলবে ওই দুর্বাসামুনিকে!”
তবু কথাটা বলা হল। বললাম আমিই। স্যরের ভুরু কুঁচকে গেল। “বলিস কী রে! তোদের জলখাওয়া, বাথরুম – এসবের জন্য আমি দেরি করে আসব ক্লাসে! তার মানে এই ক্লাসটা তোদের কাছে ফেলনা?”
“না স্যর, না! আসলে অন্য স্যরেরা সকলেই তো আসেন। আপনার ক্লাস শুরুর আগে দু’ পাঁচ মিনিট সময় পেলে আমরা একটু রিফ্রেশ হতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে কি সুইচ বদল করা যায়? এই ভূগোল শেষ হল, রেশ না মেলাতে মেলাতেই আবার অঙ্ক!”
আমার বাবা এই স্কুলেই ইংরেজির শিক্ষক। সেই সুবাদে স্যরের বাড়িতে যাতায়াত আছে। স্যরের মেয়ে দোলার সঙ্গে অনেকদিন বিকেলে ক্যারামও খেলি। তাই একটু সাহস করে বলে ফেলি এতগুলো কথা। মেজদিস্যর ভুরু কুঁচকেই জবাব দিলেন, “দেখ, ঠিক সময়ে ক্লাসে আসা আমার ডিউটি। এটা আমাকে পালন করতেই হবে। তোদের যদি খুব প্রয়োজন পড়ে, আমি তো বাইরে যেতেই দিই, দিই না?”
এইখানটাতে মনে মনে হয়ত প্রায় সবাই-ই গজগজ করে। স্যরের অনুমতি নিয়ে বাইরে জল খেতে গেলে বা বাথরুমে গেলে কে কবে ঠিক সময়ে ফিরতে পারে? এইসময়ে বাইরের আকাশ বাতাস যেন একবারে হাতছানি দিয়ে ডাকে। স্কুলের সামনের রাস্তাগুলো আশেপাশের দু’চারটে পরীহুরীর গমানাগমনে কেমন যেন মায়াবী হয়ে ওঠে। আর আমাদেরই মত স্যরের অনুমতি নিয়ে অন্য ক্লাস থেকে বাইরে যাওয়া ছেলেরা কলের পাড়ে বা বাথরুমের কোণায় এমন মজাদার আর আকর্ষক গল্প ফাঁদে, সিঁড়ির কোণায় এমন মোহময়ী ধোঁয়া বিস্তার করে, যে সেসবের স্বাদ নিতে একটু আধটু দেরি সবার হয়েই যায়। কিন্তু তারপর ঘরে এসে যা হয়, তা বলার নয়। মেজদিস্যরের কাছে বাইরে কাটানো প্রতিটা সেকেণ্ডের হিসেব কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে হয়। আর তা দিতে দিতে আমাদের অবস্থা একেবারে যাকে বলে ল্যাজেগোবরে হয়ে যায়। একদিন সৃজন বলেছিল, “স্যর, বিশ্বাস করুন আমি কোথাও দাঁড়াইনি। গেছি আর জল খেয়ে ফিরেছি!”
স্যর আমাকে নিজের মোবাইলটা দিয়ে বললেন, “তুই স্টপওয়াচ চালু করে আমার পিছন পিছন আয় তো!”
স্যর বেরোলেন, কলে গিয়ে জল খেলেন, তারপর ক্লাসে ফিরে এসে আমাকে বললেন, “এবার বন্ধ কর ঘড়ি!”
স্যর সৃজনকে ডেকে বললেন, “দেখ, একই কাজ তোর করতে সময় লেগেছে আট মিনিট সাতচল্লিশ সেকেণ্ড, আমার লাগল তিন মিনিট ছত্রিশ সেকেণ্ড!”
সেকেন্ডের হিসেব বোঝানো আমাদের কম্ম নয়। তাই স্যরের ক্লাসে বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি আমরা কেউ নিই না সচরাচর!
তা এমন কড়া স্যরকে কে পছন্দ করবে? অতএব স্যরের নাম বিকৃত হবেই। এখানে হয়ত একটু বেশিই হয়েছে। কিন্তু মেহেদিস্যর যদি বকুনি দিতে গিয়ে রোজ তারক কিম্বা মোমিনকে মুখ বিকৃত করে নিজের নামের হ-টাকে z করে বলেন, “এখন অঙ্ক বুঝছিস না, পরীক্ষায় গোল্লা পেলে তো বলবি ‘মেzদিস্যর’ কিছু বোঝায়নি!” তখন স্যরের নামের রূপান্তরটা মেহেদি>মেZদি> মেজদি এইভাবে না হয়ে আর যায় কোথায়?
স্যর অঙ্ক যে খারাপ করান তা নয়, বোঝানও চমৎকার। কিন্তু চিৎকার করেন খুব বেশি। মাথা একেবারে ঘুরে যায়। আর নানা প্রসঙ্গে ঘুরে ফিরে শুধু একটাই কথা, “এটা তো আমার ডিউটি!”
সেদিন টিফিনে আমরা বেশ কয়েকজন মাঠে বসে মেজদিস্যরের মুণ্ডপাত করছিলাম। করতে করতে নীলের কী একটা কথায় হঠাৎই স্যরের ‘এটা তো আমার ডিউটি’ বলার বিভিন্ন উপলক্ষ্য খুঁজতে লাগলাম। ব্যাপারটা মুণ্ডপাতেরই দ্বিতীয়ভাগ হিসেবে এসেছিল। কিন্তু হয়ে দাঁড়াল অন্যরকম। পুলক বলল, “এমনিতে স্যরকে আমি এড়িয়েই চলি। কিন্তু সেদিন একটা অঙ্ক কিছুতেই পারছিলাম না দেখে টিফিনে স্টাফরুমে গিয়েছিলাম অঙ্কটা নিয়ে। স্যর টিফিন খাচ্ছিলেন। খাতাটা নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতেই পাশে বসা নরেন স্যর বললেন, “এখন যা তো! দেখছিস না টিফিন!”
স্যর টিফিনের বাটি সরিয়ে রেখে বললেন, “যাবে কেন? টিফিন তো কী? স্কুলটাইম তো! বুঝতে না পারলে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া তো আমার ডিউটি! আয়, আয়!”
মিজান বলল, “আমিও একবার কথাটা শুনেছি! মনে আছে ক্লাস সেভেনে একদিন পরিবেশ নিতে গিয়েছিলেন! লাস্ট পিরিয়ড। কয়েকটা প্রশ্ন লিখতে দিয়েছিলেন। সবার খাতা দেখতে দেখতে শেষ ঘণ্টা পড়ে গেল। তখনও আমার খাতা দেখা বাকি। স্যর সবাইকে ছেড়ে দিলেন। দিয়ে আরও পাঁচ মিনিট ক্লাসে বসে গেলেন আমার খাতাটা দেখার জন্য। আমি তোদের সঙ্গ ধরতে বললাম, “স্যর আপনার তো দেরি হয়ে যাবে বাড়ি ফিরতে!” স্যর আমার খাতাটা দেখে ফেরত দিতে দিতে বললেন, “ যতই বাড়ি ফিরতে দেরি হোক, সবার খাতা দেখা দেওয়াটা তো আমার ডিউটি!”
কণিষ্ক বলল, “সিক্সে আমি তোদের সেকশনে ছিলাম না। তা, সেসময় একদিন বিজ্ঞানের স্যর না আসায় সে পিরিয়ডটা অফ যাচ্ছিল। স্কুলে সেদিন স্যর কম থাকায় সাপ্লিমেন্টারি হিসেবে অন্য কাউকে দেওয়াও হয়নি। ক্লাসে স্যর না এলে যা হয়। শুরু হয়ে গিয়েছিল চেঁচামেচি। পাশের ঘরে ক্লাস নিচ্ছিলেন মেজদিস্যর। উনি বার দুই এসে আমাদের আমাদের থামিয়ে গেলেন। কিন্তু আমরা উচ্চিংড়ের দল, এত সহজে কি থামি! স্যর যেতেই আবার চিৎকার। এরই মধ্যে মেহবুব আলটপকা আমার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল। আমিই বা ছাড়ব কেন? দিলাম নখ দিয়ে ওর হাত আঁচড়ে। মেহবুবের শক্তি আমার ডবল। আমাকে এবার মারতে লাগল এলোপাথাড়ি, সঙ্গে গালাগালি। মারে যত না গালাগালিতে আহত হলাম তার চেয়ে বেশি। ওই বয়সেই মা-বাবা তুলে বখাটেদের মত গাল দিতে শিখে গিয়েছিল মেহবুব। অগত্যা আমি আমার সীমিত শক্তি নিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। গোলমালে স্যর ছুটে এলেন। সব শুনে আমাকে বললেন, “তুই আয় আমার সঙ্গে!” আমাকে নিয়ে পাশের ক্লাসে বসালেন। চোখের জল মুছিয়ে বললেন, “মায়ের নামে খারাপ কথা বললে কার না খারাপ লাগে! আমি মেহবুবের ব্যবস্থা করছি, ভাবিস না!” ক্লাস শেষ হতে হেডস্যরের কাছে নিয়ে গেলেন আমাকে। হেডস্যর সব শুনে স্যরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেহবুবের গার্জেন ডাকাচ্ছি। আপনি একে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুব ভাল কাজ করেছেন!” স্যর হেসে বললেন, “পাশের ক্লাসে রয়েছি। এ’টুকু করা তো আমার ডিউটি!”
সমর্পণ বলল, “আমাকে একবার স্যর একটা পেন দিয়েছিলেন পরীক্ষার সময়। সেদিন আমি পেনের বাক্সটা বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম। পাশে যার সিট পড়েছিল, সে একটা পেন দিয়েছিল, কিন্তু লেখা পড়ছিল না ঠিকঠাক। স্যর খাতা সই করতে এসে বললেন, “তোর খাতার এই অবস্থা কেন রে?” আমি বললাম কারণ। স্যর বললেন, “তা আমাকে বলছিস না কেন? আমি ঘরে আছি। আমার তো ডিউটির মধ্যে পড়ে ছাত্রদের সমস্যা দেখা!” বলে বুকপকেট থেকে একটা কলম আমাকে দিলেন লেখার জন্য। পরীক্ষার পর ওটা ফেরত দিতে গেলে মেজদিস্যর হেসে বললেন, “থাক, ওটা আর ফেরত দিতে হবে না!”
নীল বলল, “এইট অব্দি আমি পড়ায় ভালই ছিলাম। কিন্তু নাইনে উঠে আর কোনও বিষয়েই আর ইণ্টারেস্ট পাচ্ছিলাম না। আমার প্রিয় সাবজেক্ট অঙ্কেও অনেক ভুল করছিলাম। তোরা কেউ জানিস না, স্যর আমাকে ডেকে কী বলেছিলেন! স্যর বলেছিলেন, “কী সমস্যা হচ্ছে খুলে বল। খুব ব্যক্তিগত কিছু হয়ে থাকলেও।” ব্যক্তিগত ব্যাপারটা তো তোরা জানিস। কিন্তু স্যরকে কি বলা যায়! স্যর বললেন, “এটা আমার ডিউটি কোনও ছাত্রের অমনোযোগিতার কারণ খোঁজা, খুঁজে তাকে সঠিক পথ দেখানো!” আমি খুলেই বলেছিলাম কারণটা। স্যর পথও দেখিয়েছিলেন, যে পথ অনুসরণ করেই আমি এখনও চলছি!”
আমি বললাম, “তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এটাই, আমাদের স্যরের নামকরণে ভুল হয়েছে। আজকে থেকে স্যরকে ডাকা হোক ‘ডিউটি স্যর’ নামে!”
নীল বলল, “এ প্রস্তাব না মানার কিছু নেই। কিন্তু তার আগে তোর কথাটাও তো জানা দরকার। তুই তো স্যরের ডিউটি নিয়ে কিছু বললি না?”
আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “আমি! আমার তো আলাদা করে সেরকম কোনও কথা…”
না কথাটা সত্যি নয়, আবার মিথ্যেও নয়। কারণ আলাদা করে আমার যা মনে পড়ে তা স্যরের স্কুলের ডিউটির গল্প নয়। এ তাঁর বাড়ির ডিউটির কথা, যেখানে আমিও রয়েছি চরিত্র হয়ে। আর এতক্ষণের গল্পের যে টিউনিং তার সঙ্গে এটা মিলবেও না। তাই এটা কি বলা যায়? সত্যি বলতে কী, আমার এতে কিঞ্চিৎ বিরক্তই লাগে।
আসলে আমি তো একেবারে নিজের থেকে স্যরের বাড়ি গিয়ে দোলার সঙ্গে ক্যারাম খেলতে শুরু করিনি! “দোলাটা একা থাকে, জীবেশবাবু রক্তিমটা কী করে বিকেলে? আসতে তো পারে। বিরাট ক্যারাম আছে। দু’টিতে একটু ক্যারাম খেলে মাইণ্ডটাকে একটু হালকা করতে পারে! টেনের পড়ার চাপ তো কম নয়!” এভাবে বাবার কাছে প্রস্তাব পেড়ে রোজ কত অনুনয় আমাকে পাঠানোর জন্য। আর তারপর? এখন যেদিন যাই ক্যারামের পাশে ঠাঁই বসে থাকেন! মনে হয় যেন পাহারা দিচ্ছেন আমাদের! খেলতে গেলে একটু এরকম তো হতেই পারে। আমার জোর স্ট্রাইকে রেড গুটিটা পড়েছিল দোলার কোলে। আনতাবড়ি দোলা খুঁজে যাচ্ছিল ক্যারামের নিচে পাশে। আমি একটু ঝুঁকে ওর কোল হাতড়ে গুটিটা বের করেছিলাম। আর তাতেই…। যাক, এসব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগতই। ডিউটিস্যরের স্কুলের ডিউটি নিয়ে সত্যি কোনও কথা হবে না! সেখানে উনি একশোয় একশো। মাঠে আমাদের গল্পে এসেছিলেন ছাত্রদের নাজেহাল করার ভিলেন হিসেবে। দিনের শেষে একশোয় একশো নিয়ে মেজদিস্যর যেন হিরো হয়ে মাঠ ছাড়লেন।
পরদিন স্কুলে এসে আর এক চমক। স্যর এসেছেন, অথচ আগের ক্লাস শেষ হতেই স্যরের মুখ দেখা যাচ্ছে না। নীল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তার মানে আমাদের ডিউটিস্যর তোর প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন!”
“আর ওসব কে ভাবছে! যেমন আসছিলেন আগের পিরিয়ডের স্যর যেতে না যেতেই, তেমন হলেই বা ক্ষতি কী!” বলল সমর্পণ। বোঝাই যাচ্ছে ওর এরকম কথা কালকের মাঠের আলোচনার ফল। অবশ্য সমর্পণ একা নয়, অন্যদেরও যখন নীলের কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া নেই, তখন আলাদা রকম কথা যে ওদেরও নেই, তা পরিষ্কার। এই কথাবার্তার মধ্যেই মৃদুলাদি, স্কুলের পিওন, গুটিগুটি এসে দাঁড়ান আমাদের ক্লাসরুমের সামনে। হাতে নোটিশের খাতা। কী ব্যাপার? উৎসুক হয়ে তাকাই মৃদুলাদির দিকে। মৃদুলাদি বলেন, “তোমরা সবাই চলে যাও হলঘরে।”
“হলঘরে! কেন?”
“মেহেদিস্যরের ফেয়ারওয়েল যে!”
“মেহেদিস্যরের ফেয়ারওয়েল! স্যরের চাকরি কি শেষ হয়ে গেল আজ?” জিজ্ঞেস করল নীল।
মৃদুলাদি হেসে বলল, “এখনই শেষ কেন হবে? স্যর যে হেডমাস্টার হয়ে অন্য স্কুলে যাচ্ছেন!”
আমরা সবাই স্পিকটিনট! পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। আমি স্যরের বাড়ি যাই। আমিও তো জানতাম না ব্যাপারটা! বাবাও কিছু বলেনি। ব্যাপারটা কি আচমকাই ঘটে গেল? কে জানে!
পুলক বলল, “এতদিন ভয় পেয়েছি, বিরক্ত হয়েছি। কালই প্রথম টের পেলাম, মানুষটাকে ভালও কিছুটা বাসা যায়। আর তারপর আজই এমন ঘটনা…আঘাতটা তাই বুকে এসে লাগছে!”
নীল বলল, “এখন আমাদের কী ডিউটি?”
মিজান বলল, “আমাদের ডিউটি, ডিউটি-স্যরের ফেয়ারওয়েলে না যাওয়া!”
আমি বললাম, “সেই ভাল!”
সবাই ঘরে ঢুকে পড়লাম। সমর্পণ ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এল।
কণিষ্ক বলল, “খুব খারাপ লাগছে, তাই না?”
আমি চোখ মুছে বলে উঠলাম, “স্যরকে খুব মিস করব!”
স্যরের সঙ্গে যে মিস করব আরও একজনকে, সেটা অনুক্তই থাকল, যেমন অনুক্ত থেকে যায় অনেকের।
লেখক পরিচিতি : সুদীপ জোয়ারদার
প্রাবন্ধিক, গল্পকার