লেখক : প্রিয়াংকা রাণী শীল
অনিন্দ্য যখন স্টেশনে এলো তখন প্রায় সকাল সাতটা। স্টেশনে মানুষের ভিড় তখন নেই। কিছুক্ষণ আগে একটা ট্রেন যেতে দেখেছে অনিন্দ্য। হয়তো এই কারণে স্টেশনটা এখন ফাঁকা। অনিন্দ্য অবশ্য যাত্রী নয়। সে এসেছে মিরার জন্যে। মিরা আজ চলে যাচ্ছে এ শহর ছেড়ে। অনিন্দ্য জানে না, মিরা কয়টার ট্রেনে যাচ্ছে? কারও মারফতে সে খবর পেয়েছে সকালে যাচ্ছে। অনিন্দ্য একেবারে প্লাটফরমে ঢোকার গেইটের কাছাকাছি বেঞ্চিতে বসলো।
মিরা কখন আসবে অনিন্দ্য জানেনা? সে তাকিয়ে আছে গেইটের দিকে। যাতে মিরা আসলে সে দেখতে পায়। মিরাকে অনিন্দ্য ভালোবাসে। মিরার গায়ের রং কালো। তবে অনিন্দ্য মিরাকে আপন করে নিতে চায় মিরার সুন্দর রুচিশীলতা আর ব্যক্তিত্ববোধের জন্যে।
কিছু সময় পর , অনিন্দ্য লক্ষ্য করলো মিরা গেইট দিয়ে ঢুকছে। পরনে কালো শাড়ি। এতো সুন্দর করে শাড়ি শরীরে সেট করেছে যে মিরার হাঁটতে কোনই সমস্যা হচ্ছে না। একটু ঠাণ্ডা হওয়াতে একটা নীল চাদর গায়ের এক পাশে মেলে রেখেছে। বাম হাতে একটা হ্যাণ্ডব্যাগ আর ডান হাতে একটা ট্রলি টানতে টানতে সে হেঁটে আসছে।অনিন্দ্যর কাছাকাছি আসতেই দু’জন দু’জনকে দেখলো। মিরা কিছু না বলে একটু দূরে গিয়ে বসলো। অনিন্দ্য এবার মিরার কাছে গিয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসলো। মিরা তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। যেন মনে হচ্ছে অনিন্দ্যকে সে চেনে না। অনিন্দ্য এবার ডাক দিলো,“ মিরা……”
মিরা এবার হালকা একটু তাকালো। এই হলো সমস্যা । মিরা এমনভাবে তাকায় আর তার কালো চশমার আড়ালে এমনভাবে দেখে যে অনিন্দ্যর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। অনিন্দ্য তখন হয়ে যায় একেবারে বোকা একটা মানুষ। মিরা এবার বলে,“ কিছু বলবে?”
“হুম।” অনিন্দ্য মাথা নাড়ে।
“ বলো।”
“ তুমি নাকি আজ চলে যাচ্ছো।”
“ হুম।”
“ কোথায়?”
“পোস্টিং হয়েছে কুমিল্লার একটা কলেজে।”
“ওহ্।” “বলছি, আবার কবে দেখা হবে।”
“দেখা হবে কেন?”
“কেন? তুমি চাও না আর দেখা হোক!!!”
“ না”
অনিন্দ্য কি বলবে ভেবে পেলো না? হঠাৎ কেন জানি তার নিজের উপর বড্ড রাগ হতে লাগলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো অনিন্দ্য। বললো, “মিরা। তোমাকে আমি হারাতে চাইনা।”
মিরা এবার একটু বিরক্তি দেখালো।
অনিন্দ্য এরপর বললো, “তুমি তো জানো মিরা আমি তোমাকে কতটা চাই।”
মিরা এবার রেগে বললো,“ সেইটা কি সম্ভব?”
“ সম্ভব………তুমি চাইলে সম্ভব। চলো আমরা না হয় নিজেরাই………” মিরা তাকালো রাগান্বিত চোখে। অনিন্দ্য আর সাহস পেল না পুরোটা শেষ করার। অনিন্দ্য দেখলো মিরা এবার চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। এরপর কিছুক্ষণ সময় নিলো। তারপর বললো,“ অনিন্দ্য, তুমি খুব ভালো করে জানো এটা সম্ভব না। তোমার মা আমাকে পছন্দ করেননা। উনি তোমার জন্য একটা সাদা ফর্সা মেয়ে চান।”
অনিন্দ্য চুপ থাকলো। মিরার কথা তো সত্যি। গায়ের রং কালো বলে অনিন্দ্যর মা মিরাকে পছন্দ করেননি তার ছেলের বউ হিসেবে। কিন্তু অনিন্দ্য ! ও তো মিরাকে তার গায়ের রং দেখে ভালোবাসেনি। একই ভার্সিটিতে পড়াশুনা করতে গিয়ে মিরার সাথে পরিচয়। মিরার কথা বলার ধরন, তার ব্যক্তিত্ব, রুচিশীলতা সবকিছু মুগ্ধ করেছে অনিন্দ্যকে। সবথেকে বেশি মুগ্ধ করেছে কালো ফ্রেমের আড়ালে থাকা মিরার ঐ দু’চোখ।
অনিন্দ্য হঠাৎ দেখলো মিরা বসা থেকে একটা তাড়াহুড়া ভাব নিয়ে উঠলো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলো,“ সাড়ে আটটার ট্রেনটা আসছেনা কেন?”
“ আধা ঘণ্টা লেইট হবে। আগের স্টেশনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।” গার্ড উত্তর দিলো।
“ধ্যাত্………” মিরার যেন বিরক্তি লাগতে লাগলো আরও বেশি। আগের জায়গায় বসে হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে একটা বই বের করে নিবিড়ে পড়তে লাগলো মিরা।
প্লাটফর্মে এর মধ্যে মানুষের ভিড় বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনিন্দ্য মিরাকে লক্ষ্য করলো। মিরা বেশ রেগে আছে। মিরার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু অনিন্দ্য ভেবে পাচ্ছে না মিরাকে আবার কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা।
কয়েক মিনিট অতিবাহিত হলো। অনিন্দ্য আর বসে থাকার পাত্র নয়। কেন জানি মিরার এই নীরবতা তাকে বড্ড রাগাচ্ছে। অনিন্দ্য তখন মিরাকে ডাকলো। মিরা শুনলো কিনা বুঝা গেল না। অনিন্দ্য তখন দ্বিতীয়বার ডাকলো। আগের থেকে একটু জোরে। এবার মিরা শুনলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,“ কি চাই, তোমার?”
অনিন্দ্যর বেশ অস্বস্তি বোধ হলো। শান্তভাবে সে উত্তর দিলো,“ তোমাকে চাই।”
মিরা কিছুক্ষণের জন্য যেন চুপ হয়ে গেলো। অনিন্দ্যর কণ্ঠস্বর আর চোখের ভাষা এখন পুরোপুরি আলাদা। কিন্তু মিরা দুর্বল হবার পাত্র নয়।
অনিন্দ্য তখন বলে যাচ্ছে, “ আমি তোমাকে চাই, মিরা। তোমাকে ভালোবাসি।”
চারপাশে ভিড় , কোলাহল বাড়ছে। কিন্তু মিরা শুধু যেন অনিন্দ্যর কণ্ঠ শুনছে। তার মতো কালো একটা মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসা ঐ অনিন্দ্য নামের সুদর্শন ছেলেটার পাগলামি দেখছে আর অবাক হচ্ছে।
মিরা ভালোবাসে হয়তো অনিন্দ্যকে কিন্তু তার কালো রং এর সাথে মিলিয়ে অনিন্দ্যর জীবনটাকেও তেমনই করে দিতে চায় না। এই সংসার শুধু রং চায়। কালো কে কেউ বরণ করে নেয় না। যেমন নিতে চায় না অনিন্দ্যর মা।
মিরা হঠাৎ টের পেল অনিন্দ্য তাকে ধাক্কা দিচ্ছে।অনিন্দ্য বলছে,“ কি হলো? কোথায় হারালে?”
মিরা আবিষ্কার করলো, তার চোখে জল। কিন্তু অনিন্দ্যকে তা বুঝতে দেয়া যাবে না। তাই চশমা ঠিক করতে করতে বললো,“ বলো।”
“ তুমি শোনো নি আমি কি বলে যাচ্ছি এতক্ষণ ধরে!!!”
“ হুম।”
“তাহলে।”
“আমি তোমাকে চাই না। চাই না আমার কালো রং এর সাথে তোমাকে জড়াতে।”
“ মিরা………, আমরা যখন একে অপরকে জেনেছি, ভালোবাসতে শুরু করেছি তখন কিন্তু রংএর প্রশ্নটা আসে নি। তবে আজ কেন?”
মিরা অনিন্দ্যর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো,
“ তখন বাস্তবতার চেয়ে আবেগটা ছিল জোরালো আর এখন আবেগের থেকে বাস্তবতা।”
মিরা কি বলছে অনিন্দ্য যেন বুঝেও বুঝে উঠতে পারছে না? অনিন্দ্য চুপ হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।
প্লাটফরমে ভিড় বেড়েই চলেছে। এই ভিড় আর কোলাহলের মাঝে মিরা হারিয়ে যাক চিরতরে—এটা যেনো অনিন্দ্য মানতে পারছে না।
অনিন্দ্য তাই শেষ চেষ্টা করতে মিরাকে বললো,“ ঠিকাছে……চলো একটা খেলা খেলি………” মিরা চমকালো। অনিন্দ্য বললো,“ হুম ………খেলা। রং নিয়েই তো সমস্যা। তাই রং নিয়েই খেলাটা। তুমি কালো রং এর একটা একটা খারাপ দিকগুলি বলবে আর আমি তার পরিপ্রেক্ষিতে ভালোটা বলার চেষ্টা করবো। শেষ পর্যন্ত যদি আমি পারি তবে তোমাকে আজ আমার সাথে যেতে হবে।”
মিরা চুপচাপ শুনলো। পরে বললো,“ আর যদি আমি জিতে যাই………”
অনিন্দ্য তাকালো মিরার চোখের দিকে। মিরার চোখে তখনো প্রবল আত্মবিশ্বাস।অনিন্দ্যর কেন যেনো প্রচণ্ড ভয় লাগতে শুরু করলো। অথচ , চশমার আড়ালে ঐ চোখজোড়াতেই তো সে হারিয়েছিল একদিন। মিরা তখনও উত্তরের অপেক্ষায়। অনিন্দ্য চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলো,“ তুমি জিতলে আমি চলে যাব চিরতরে।তোমাকে আর বিরক্ত করবো না।”
মিরা হয়তো এটাই শুনতে চেয়েছে কিন্তু তবুও তার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা তোলপাড় অনুভব করলো । কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মাথা নাড়লো,
“ হুম। তো শুরু করি……”
মাথা নাড়লো অনিন্দ্য।
মিরা তখন শুরু করলো—-
“কালো মৃত্যুর রং………”
অনিন্দ্য বললো,“মৃত্যু আছে বলেই জীবন আমরা এতটা ভালোবাসি।”
মিরা বললো, “ কালো নিরাশার রং………”
অনিন্দ্যর উত্তর, “ নিরাশা আছে বলেই তো আশায় আমরা আবার বুক বাঁধি।”
“ কালো শোকের রং………”
“তাই তো শোক কাটিয়ে উঠার প্রেরণা পাই। তাও তো কালো রংএর জন্যই।”
“ কালো যে অন্ধকারের প্রতীক……”
“ সেজন্যই তো আলোর এত গুরুত্ব।”
“কালো রং নয়। কালো কোন রং দেয় না।”
“ হুম। তা ঠিক। বিজ্ঞানের ভাষায় , কালো বস্তু দৃশ্যমান বর্ণালীর কোন আলোকে প্রতিফলিত করে না। তাই কালো কোন রং নয়। কিন্তু কালো বস্তু দৃশ্যমান বর্ণালীর সব আলো কেই গ্রহণ করে। এর মানে কালোর ভেতরে সকল রং-ই লুকিয়ে থাকে। কালো রং তাই সব রং এর আধার।”
মিরা আবার বললো,“ কালো স্বপ্নভঙ্গের রং।”
অনিন্দ্য বললো,“ কিন্তু কালো শক্তিরও রং। তাইতো স্বপ্নভঙ্গ হলেও নতুন শক্তি ও সাহস নিয়ে আবারও স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।”
অনিন্দ্য এবার দেখলো মিরা চুপ। আবারও কিছুক্ষণ নীরবতা। অনিন্দ্য ভেবে নিলো মিরা আর বলবে না। ট্রেন তখন হুইসেল দিতে দিতে আসছে।মিরা তার ব্যাগ আর ট্রলি নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখন অনিন্দ্য বললো,“ মিরা, আমি জিতেছি। তুমি এখন আমার সাথে যাবে।”
ট্রেনটা থেমে গেছে। মিরা অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বললো,“ কালো আর সাদা এক হতে পারে না অনিন্দ্য। তাতে করে সব ধূসর হয়ে যায়। হয়ে পড়ে বিবর্ণ। আমি চাই না, তোমার জীবনটা বিবর্ণতায় ঢেকে যাক।”
মিরার এ কথার পরিপ্রক্ষিতে কোন উত্তর ছিল না অনিন্দ্যর কাছে।
প্লাটফরমটা এখন জনশূন্য। বহু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল মিরা, হারিয়ে গেল চিরতরে একটা কালো মেয়ে অনিন্দ্যর কাছ থেকে, কিন্তু ………তার মন থেকে ………পারবে কি অনিন্দ্য মুছে ফেলতে মিরাকে???
লেখক পরিচিতি : প্রিয়াংকা রাণী শীল
আমি প্রিয়াংকা।জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছি চট্টগ্রামেই। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। আর ভালবাসি গল্প লিখতে। পড়াশোনা করা অবস্থায় স্কুল,কলেজ ম্যাগাজিনে তিনবার আমার লেখা গল্প ছাপানো হয়েছিল।বর্তমানে বাস করছি ইতালিতে। আমার লেখা গল্প পড়ে ভালো না খারাপ লাগলো তা জানালে অনেক বেশি ভালো লাগবে।
অসাধারণ !
গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
কালো সাজার মিলন হলে আরো ভালো লাগতো
তা তো হতোই। কিন্তু সেক্ষেত্রে মিরাকে বড়ো করে ফুটিয়ে তোলা হতোনা। আমি চেয়েছি মিরাকে ফুটিয়ে তুলতে………একটা কালো মেয়ে কখনও ভেঙে পড়ে না কোনকিছুতেই………গল্পে সেটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছি।
গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।