লেখক : বিশ্বরূপ দাস
কলকাতার উপকণ্ঠে থাকে আবিনাশ। ছোট্ট একটা ব্যবসা চালায় — একটা ফটোকপির দোকান। দিনের পর দিন একই রকমের কাগজ, একই রকমের মুখ, একই রকমের ছাপা লেখা। আয় সামান্য, মাসের শেষে হিসাব মেলাতে গেলে হিমশিম খেতে হয়। তবুও চালায়, কারণ বাবা আছেন — বৃদ্ধ, ভগ্নস্বাস্থ্য, চোখে আশার শেষ দীপশিখাটুকু এখনও নিভে যায়নি। মা চলে গিয়েছেন বহু আগে, একেবারে নিঃশব্দে, যেন আলো নিভে যাওয়ার মত। সেই থেকে বাবা আর আবিনাশ, দুজনের জীবন একসাথে জড়ানো দুটি গাছের মত, যাদের শিকড় একই মাটিতে পচে যাচ্ছে, তবুও দাঁড়িয়ে আছে।
প্রেমিকা এক বছর আগেই ছেড়ে গেছে — ভাল জীবনের খোঁজে। সে বলেছিল, “তুমি পারবে না, আবিনাশ। তোমার মধ্যে কিছুই নেই।” কথাগুলো এখনও রাতের নির্জনতায় ছুরির মত বেঁধে। সে মেনে নিতে পারেনি, আজও না। “কেন? সেই সুন্দর মুহূর্তগুলো কি সবই মিথ্যা ছিল?” প্রতিদিন সকালে সে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে তাকায় — তার মনে হয়, এই প্রশ্নের উত্তর যদি কোথাও থাকে, তা হয়ত ওখানেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু আকাশ নীরব; শুধু ধুলো আর ধোঁয়ায় ঢাকা কলকাতার ভোর।
আর গতকাল . . .
ডাক্তারি রিপোর্টটা হাতে নিয়ে সে হাসপাতালের করিডরে বসে ছিল — একটা নাম না জানা ভয়ে কাঁপছিল। পেটের অসুখের পরীক্ষায় ধরা পড়ে ক্যান্সার, তবে প্রথম স্তরে। ডাক্তার বলেছিল, “চিকিৎসা সম্ভব, কিন্তু দেরি করা চলবে না।” কথাগুলো শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। “চিকিৎসার খরচ? বাবার ওষুধ? দোকানের ভাড়া? . . .”
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকায় আবার — এবার সেখানে ধূসর মেঘের মধ্যে ছিল এক গভীর উদ্বেগ। বাসায় ফিরে বাবাকে কিছু বলেনি আবিনাশ। বিছানায় শুয়ে দেয়ালের পুরনো ফটোগুলো দেখছিল সে। মনে হচ্ছিল, এই নষ্ট হয়ে যাওয়া ফটোগুলোর মত তার জীবনও ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে . . .
বুকে একটা পাথর চেপে বসেছিল — না, শুধু অসুখ নয়, গোটা অস্তিত্বের ভার। ঘুম আসছিল না। সে শুধু ভাবছিল, “এবার কি হবে?”
আবিনাশ আজ যাদবপুরের লোকাল ধরেছে। ট্রেনের জানালার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে সে, গা ঘেঁষে যাতায়াত করছে শহরের নিঃশ্বাস। তার হাতের তালু রেলিংয়ে, কিন্তু স্পর্শটা যেন অনুভব করতে পারছে না সে; শরীরটা কেমন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। জীবনের ইচ্ছে ম্রিয়মাণ, যেন একটা মোমবাতির শেষ শিখা, যে কোন মুহূর্তে নিভে যেতে পারে। ট্রেনের শব্দ, মানুষের কোলাহল — একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন মাত্র, যেন দূরের কোন নদীর স্রোত।
সে ভাবে, এই লোকাল কি শুধুই একটা গাড়ি, নাকি তার নিজের জীবনের মতই এক অনিশ্চিত যাত্রা? গন্তব্য আছে, কিন্তু পৌঁছনোর অর্থ কী?
তার প্রিয় লেখক আলবেয়ার কামুর কথা মনে পড়ে — “দ্য মিথ অব সিসিফাস”, যেখানে নিষ্ফল শ্রমই নিয়তি; “দ্য আউটসাইডার”, যেখানে মার্সো মৃত্যুর আগেও আবেগহীন; “দ্য ফল”, যেখানে নৈতিকতা ধুলোয় মিশে যায়। “জীবন কি তাহলে শুধুই নিরর্থক খেলা? ক্যান্সার, দারিদ্র্য, প্রেমিকার চলে যাওয়া… যদি জীবনই অর্থহীন হয়, তাহলে এই যন্ত্রণার মানে কী?” সে ভাবে। প্রশ্নগুলো তার মাথায় ঘুরতে থাকে, কিন্তু উত্তর আসে না। শুধু ট্রেনের চাকার শব্দটা যেন তাল মিলিয়ে বলে, “নেই… নেই… নেই… উত্তর নেই…”
এক পরিচিত বৃদ্ধ দেখে ফেলে আবিনাশকে। লোকটা চেনা — শৈশবে এই মানুষটারই বারান্দায় বসে সে প্রথম শুনেছিল কামুর কথা, প্রথম শুনেছিল যে পৃথিবীতে কোন অর্থ নেই। সেই ছেলেবেলা থেকেই আবিনাশ তাকে ‘সোনা কাকা’ বলে ডাকে। বৃদ্ধ এখনও সেই একই চশমা পরে, সেই একই কাঁধের ভাঁজে জমা হয়েছে সময়ের ধুলো।
“কী হয়েছে বাবা?” প্রশ্নটা শুনে আবিনাশ প্রথমে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু সোনা কাকার চোখে সে দেখে এক গভীর সংশয়, যেন সে আবিনাশের ভেতরের অন্ধকার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। অজান্তেই আবিনাশের গলা ভারী হয়ে আসে। কথা বলতে গিয়ে প্রথমে আটকে যায়, কিন্তু শেষে সব বেরিয়ে পড়ে — ক্যান্সার, প্রেমিকা, বাবার অসহায়তা, জীবনের নিষ্ফলতা…
বৃদ্ধ শান্ত হয়ে শোনে, তারপর একটু হেসে বলে, “চিকিৎসা করাও। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা, বুঝতে হবে — জীবনটা আসলে অ্যাবসার্ড। অর্থ নেই, তবু তা নিয়েই হাসতে হবে।”
সোনা কাকার কথায় কামুর দর্শন যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। “সিসিফাস যখন পাথর গড়াতে গড়াতে হাসে, তখনই সে মুক্ত,” সোনা কাকা বলে, “সিসিফাস জানে, পাথরটা আবার নিচে গড়িয়ে যাবে। তবু সে ঠিক পরের দিন আবার তা ঠেলে ওপরে তোলে।”
আবিনাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কথাগুলো তার মাথায় ঘুরতে থাকে। “কিন্তু… হাসব?” সে ভাবে, “এত কষ্টের মাঝে?”
তারপর হঠাৎ…
লোকালের খোলা জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া আসে। আবিনাশের গায়ে লাগে এক সতেজ স্পর্শ, যেন মহাবিশ্বের অসীম নিষ্পৃহতা স্পর্শ করে তাকে। চোখ বন্ধ করে সে সেই স্পর্শকে অনুভব করে — এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু থেমে যায় — ট্রেনের শব্দ, মানুষের গুঞ্জন, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস…
জানালা দিয়ে সে দেখে আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো নীল, ঠিক যেমনটা দেখা যেত তার শৈশবের সকালগুলোতে, যখন বাবা তাকে কাঁধে চড়িয়ে বলতেন, “দেখ ওই নীলটা কত বড়! ওর মধ্যে হারিয়ে গেলেও কেউ খুঁজে পাবে না।” সেই কথার অর্থ আজ প্রথমবারের মত বুঝতে পারছে সে। সোনা কাকার কণ্ঠস্বর আবারও কানে ভেসে আসে, “জীবনকে জিতে নেওয়ার একটাই উপায়, বাবা — পরিস্থিতির কাছে হার না মানা।”
ট্রেনের অপর প্রান্তে এক শিশু মায়ের কোলে বসে কাঁদছে। আবিনাশ তাকিয়ে দেখে — কান্নার শব্দে মিশে আছে এক অবাধ্যতা, এক প্রাণের জয়গান। সে নিজের বুকে হাত রাখে, যেখানে ডাক্তারের রিপোর্টটা পকেটে গুঁজে রাখা। “ক্যান্সার? হোক। এই ক্যান্সার, এই দারিদ্র্য, এই একাকীত্ব, বিছানার পাশে রাখা বাবার কফ সিরাপ — এগুলোই তো আমার পাথর!”
আবিনাশের ভেতর জেগে ওঠে এক বিদ্রোহ — না, মৃত্যুর বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই মৃত্যুভয়কে নিজের করে নেওয়ার। সে হঠাৎই ট্রেনের জানালার গ্রিলটা শক্ত করে ধরে, গভীরভাবে শ্বাস নেয়। “হ্যাঁ হাসব,” সে মনে মনে বলে, “এই হাসিই তো আমার rebellion, আমার freedom…” হয়ত আজই সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না, কিন্তু কোথাও যেন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে — অন্ধকারের মধ্যে আলোর এক রেখা…
“জানি না আগামীকাল কি আছে,” আবিনাশ বলে, “কিন্তু আজ, এই ট্রেনে, আমি আমার পাথরটা ঠেলে নিতে পারি।”
সোনা কাকা হাসে, এক তৃপ্ত হাসি…
প্রায় আধ ঘণ্টা পর ট্রেন পরের স্টেশনে থামে। হঠাৎ দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে আবিনাশ চমকে ওঠে। বাইরে ভিড়, হকারদের চিৎকার, রিকশাওয়ালার ডাক — জীবনের এক অগোছালো সিম্ফনি। সে এগিয়ে যায়, পা বাড়ায় প্ল্যাটফর্মের দিকে। বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আবিনাশ মাথা উঁচু করে হাঁটে, বৃষ্টি মুখে মেখে নেয়। হাসপাতালে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার কথা ভাবে, ভাবে বাবার জন্য ওষুধ কিনবে, দোকানের ভাড়া জোগাড় করার উপায় খুঁজবে। কিন্তু এই মুহূর্তে, সে শুধু হাঁটে — ভিজে যাওয়া পায়ে, ভিজে যাওয়া শরীরে। তার মনে ধ্বনিত হতে থাকে “দ্য মিথ অব সিসিফাস”-এ কামুর কথাগুলো:
Sisyphus, proletarian of the gods, powerless and rebellious, knows the whole extent of his wretched condition: it is what he thinks of during his descent. The lucidity that was to constitute his torture at the same time crowns his victory…
The struggle itself towards the heights is enough to fill a man’s heart.
আবিনাশ অনুভব করে এক অদ্ভুত মুক্তির স্বাদ। আর পেছনে ট্রেন আবার চলা শুরু করে, নতুন যাত্রীদের নিয়ে, এক অর্থহীন গন্তব্যের দিকে…
লেখক পরিচিতি : বিশ্বরূপ দাস
বিশ্বরূপ দাস একজন গবেষক। তার গভীর আগ্রহ রয়েছে অস্তিত্ববাদ, মনঃসমীক্ষণ, ঘটনাবিজ্ঞান এবং অ্যাবসার্ডিজম বিষয়ে। তার গবেষণা বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে Comparative Literature: East and West, Academia Letters, Rupkatha Journal on Interdisciplinary Studies in Humanities, Qeios, The Explicator, প্রভৃতি। গবেষণার পাশাপাশি, বিশ্বরূপ দাস অসংখ্য একাডেমিক নিবন্ধ, বইয়ের অধ্যায় এবং বইয়ের প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিবন্ধের ভাষা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বিশ্বরূপ দাসকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক একাডেমিক সম্মেলনে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তার কাজ বিভিন্ন গবেষকদের প্রকাশনায় উদ্ধৃত হয়েছে। বাংলা গল্প ও কবিতার প্রতিও তার অগাধ ভালোবাসা রয়েছে।