লেখক : মোঃ খায়রুজ্জামান চৌধুরী মামুন
মুত্তাকী সাত বছরের একজন দুরন্ত বালক। তার মুখে সারাক্ষণ একটা হাসি লেগেই থাকে, আর চোখে থাকে হাজারটা প্রশ্ন। সে সবসময় জানতে চায়—কেন আকাশ এত নীল? মাছেরা কেন কথা বলে না? আর আল্লাহর তৈরি এত জিনিস কেন এত অদ্ভুত আর সুন্দর? তার বাবা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। একদিন মুত্তাকীর বাবা নতুন একটা গ্রামে বদলি হলেন। গ্রামের নাম “জাদুপুর”। নামটা শুনেই মুত্তাকীর কল্পনার জগতে জাদুর ঝড় বয়ে গেল! সে ভাবল, “এই গ্রামে বুঝি জাদু চলে! গাছে চকলেট ফলে, মাছেরা গান গায়, আর বাতাসে উড়ে বেড়ানো যায়!” কিন্তু জাদুপুরে পৌঁছে সে বুঝল, এখানে কোনো জাদু নেই। তবে এক-রকম রহস্য ঠিকই আছে!
গ্রামটা শহর থেকে অনেক দূরে। সেখানে নেই কোন উঁচু বিল্ডিং, নেই দারুণ দারুণ খেলনার দোকান। তবে গ্রামে যা আছে, তা হ’ল—পুরুষ মানুষেরা সবাই টুপি পরে, দাড়ি রাখে, আর মসজিদে যায় নামাজ আদায়ে। মুত্তাকী ভাবল, “আহা! সবাই তো খুব ভাল মানুষ!” কিন্তু কিছুদিন পরই সে টের পেল, এখানকার ‘ভাল’ মানুষগুলো একটু অদ্ভুত! যেমন, একদিন মুত্তাকী দেখল, এক চাচা পুকুর থেকে মাছ ধরে নিচ্ছেন। কিন্তু সেটা তার নিজের পুকুর না! আরেকদিন দেখল, এক আণ্টি অন্যের ক্ষেত থেকে শসা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কিছু বলছে না! সে নিজের বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, এটা কি ঠিক?” বাবা হাসিমুখে বললেন, “না রে মুত্তাকী, এটা অন্যের হক নষ্ট করা। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’”
মুত্তাকী তখন থেকেই ঠিক করল—সে কিছু করবে। সে গ্রামের রহস্য উদঘাটন করবে, ঠিক যেন অন্যের পুকুরের মাছ কিংবা সবজি ক্ষেতের সবজি রক্ষায় প্রহরী মুত্তাকী! সে খেয়াল করল, গ্রামের বয়স্ক আর প্রভাবশালী লোকেরাই সবচেয়ে বেশি এই কাজগুলো করছে! যেমন, তোফায়েল চাচা, মসজিদে নামাজ পড়ে, ইসলাম নিয়ে অনেক কথা বলে। কিন্তু হক আদায়ের বিষয়ে চুপ!
একদিন স্কুলে মুত্তাকীর শিক্ষক বাবা একটি গল্প বললেন, “যদি কেউ নামাজ পড়ে, কিন্তু কারও হক নষ্ট করে, তার নামাজ কবুল হবে না।” এই কথা শুনে তোফায়েল চাচা ক্ষেপে গেলেন! বললেন, “এইসব আধুনিক পণ্ডিতির কথা আমাদের গ্রামে চলবে না!”
মুত্তাকী এসব শুনে ভয় পায় না, বরং তার চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সে ভাবে, “আমি ছোট হতে পারি, কিন্তু মিথ্যাকে ভয় পাই না। আমি জানি, কুরআনে আল্লাহ মানবজাতির জন্যে কী নির্দেশ দিয়েছেন।” সে তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে একটি ছোট ‘গল্প সভা’ তৈরি করে। সেখানে সবাই বসে, মুত্তাকী একখানা কাগজে আঁকা গাছ দেখায়। গাছে ফল আছে, কিন্তু গায়ে লেখা ‘চুরি’, ‘অন্যের পুকুর’, ‘গোপনে ফল খাওয়া’। সে বলে, “এই গাছ দেখতে সুন্দর, কিন্তু এর ফল বিষাক্ত। কারণ, এটা অন্যের হক।”
বন্ধুরা অবাক হয়ে বলে, “তাই নাকি মুত্তাকী?” মুত্তাকী গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে, “রাসূল (সা.) বলেছেন, কেউ যদি অন্যের হক নষ্ট করে, তার নামাজও কাজে আসবে না।” সবাই চুপ হয়ে যায়। ছোট ছোট চোখগুলো ভাবনায় ডুবে যায়।
এদিকে, মুত্তাকীর বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, যে তিনি ধর্মের অপব্যখ্যা দিচ্ছেন। স্কুলে তাঁকে নিয়ে মিটিং হয়। মুত্তাকীর মনে কষ্ট হয়। সে ভাবে, “বাবা তো কুরআনের কথা বলেছে! এতে দোষ কোথায়?” সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সে বড়দের বোঝাবে।
একদিন মুত্তাকী তার বন্ধুদের নিয়ে সাহস করে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যায়, হাতে ছোট্ট কুরআন। বলে, “ইমাম সাহেব আংকেল, আপনি তো সবার নেতা। আপনি যদি বলেন, ‘কারও ক্ষেত থেকে ফল খাওয়া ঠিক না’, তাহলে সবাই মানবে।”
ইমাম সাহেব হেসে বলেন, “তুই এত ছোট, এত কিছু জানলি কিভাবে?”
মুত্তাকী মুচকি হেসে বলে, “বাবা শেখান, আর আমি নিজে কুরআন পড়ি। আল্লাহ তো শিশুদের মনও বোঝেন, তাই না?”
ইমাম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “তুই ঠিক বলেছিস।”
এরপর একদিন সন্ধ্যায় গ্রামের পুকুরে চুপিচুপি কিছু ছেলে বিষ দিচ্ছিল। মুত্তাকী দেখেই চিৎকার করে ওঠে, “এই কাজ হারাম! পাপ! আল্লাহর সৃষ্টি নষ্ট করার চেষ্টা চলছে!” সবাই এসে জড়ো হয়। মুত্তাকী বলে, “আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না।’” সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। এমন সাহস, এমন জ্ঞান এক ছোট ছেলের!
এই ঘটনার পর মুত্তাকীর নাম সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে, “এই ছেলে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত!” কেউ বলে, “ও তো ছোট হুজুর!” কিন্তু মোড়ল তোফায়েল কিছুতেই বদলাতে চান না। তিনি মসজিদের খুতবায় মুত্তাকীর বাবার বিরুদ্ধে বলেন, “নতুন লোক এসে আমাদের ধর্ম নষ্ট করছে, আমাদের গ্রামের শান্তি নষ্ট করছে। আমরা আমাদের মত ধর্মকর্ম নিয়ে ভাল ছিলাম।”
মুত্তাকী কাঁদে না। সে চুপচাপ আবার গল্পের আসর বসায়। এবার সে ‘আল্লাহর দুনিয়ার সত্যিকারের মানচিত্র’ আঁকে। সেখানে ভাল মানুষের ঘরগুলো আলোয় ভরা, আর হক নষ্ট করা মানুষের ঘর অন্ধকার। সে সবাইকে বোঝায়, “আল্লাহর কাছে পোশাক নয়, অন্তরের পবিত্রতাই বড়।”
মোড়ল তোফায়েলের নাতি আনাস একদিন তার দাদুকে জিজ্ঞেস করে, “দাদু, আপনি নামাজ পড়েন ঠিকই, কিন্তু হাশেম চাচার গাছ থেকে কলা চুরি করলেন কেন?” তোফায়েল রেগে যান। কিন্তু আনাস তার বন্ধু মুত্তাকীর শেখানো কুরআনের আয়াত পড়ে শোনায়। তোফায়েল স্তব্ধ হয়ে যান।
সেই রাতেই তিনি এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখেন। কিয়ামতের মাঠ, তার ডান পাশে নামাজের খাতা, কিন্তু বাম পাশে হক নষ্টের পাহাড়! ফেরেশতা বলেন, “তোমার নামাজ কোথাও কাজে আসবে না, যদি তুমি মানুষের হক নষ্ট কর।” ঘুম ভাঙতেই তোফায়েল কাঁদতে থাকেন। পরদিন তিনি মসজিদের মাইক দিয়ে ঘোষণা দেন, “আমি ভুল করেছি। মুত্তাকী ও তার বাবা সঠিক কথা বলেছে। আমি সবার কাছে ক্ষমা চাই।” পুরো গ্রামে হইচই পড়ে যায়। মুত্তাকী তখন এক কোণে বসে চুপচাপ কুরআন পড়ছিল। তার মুখে হাসি, চোখে প্রশান্তি।
এরপর মুত্তাকীর গল্প আসর বড় হতে থাকে। সেখানে ছেলেমেয়েরা নাটক করে—একটা নাটকে এক ছেলে গোপনে পুকুর থেকে মাছ ধরে, পরে স্বপ্নে দেখে মাছগুলো কথা বলছে! বলে, “আমরা তো আল্লাহর সৃষ্টি! আমাদের সঙ্গে এমন করো না।” এই নাটক দেখে সবাই হাসে, আবার ভাবেও।
স্কুলেও পরিবর্তন আসে। মুত্তাকীর বাবা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন। তিনি বলেন, “আমরা শিশুদের শুধু অ-আ-ক-খ শেখাব না, আমরা তাদের হৃদয়ে আল্লাহর ভয়, ভালোবাসা ও সততা গেঁথে দেব।”
গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। আর এই বদলের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে ছোট্ট একটা ছায়া—মুত্তাকী। সে জানে, পৃথিবীটা জাদুর মত সুন্দর, যদি মানুষ সত্যিকারের ইসলাম মানে, সত্য কথা বলে আর হক আদায় করে।
একদিন রাতে আকাশে তাকিয়ে সে বলে, “আল্লাহর সৃষ্টি কত রহস্যময়! কিছু আমরা বুঝি, কিছু বুঝি না। কিন্তু জানি, সবই তাঁর কুদরতের নিদর্শন।” মা পাশে বসে হাসেন। মুত্তাকী আবার বলে, “আমি বড় হয়ে সব রহস্য জানব! আর মানুষকে বলব—সত্য, সততা আর হক রক্ষার মাঝেই আছে আল্লাহর কাছে সফলতা।”
আর তখনই দূরে আকাশে একটা ঊজ্জ্বল তারা ঠিক যেন চোখ টিপে বলে উঠল, “অভিনন্দন মুত্তাকী, তুই সঠিক পথেই আছিস!”
লেখক পরিচিতি : মোঃ খায়রুজ্জামান চৌধুরী মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- এর ইসলাম শিক্ষা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী, সরকারি কর্মকর্তা।