লেখক : চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
ভোর পাঁচটা। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া। শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে। বাইরে এখন বেশ অন্ধকার। সৌভিককে চার দিনের জন্য ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে আজ। তুলিকার মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর অফিস না থাকলে ঠিক যেত সৌভিকের সাথে।
বাইরে অফিসের ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। এবার বেরুতে হবে। রোজকার অভ্যেস এর মত আজও তুলিকাকে আদর করে সৌভিক বেরোলো। তুলিকা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সৌভিকের ক্যাবটা মিলিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে থাকলো। অবশেষে দুর্গা দুর্গা বলে গেটটা বন্ধ করে সবে ঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময় সজোরে ধাক্কা দিয়ে কেউ যেন তুলিকাকে ফেলে দিল। তারপর তাড়াতাড়ি দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিল।
তুলিকা চিৎকার করতে চেষ্টা করলে ওর মুখটা চেপে ধরে এবং হাতগুলো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। ফিসফিস করে বলে “চিৎকার করবেন না ম্যাডাম আমি আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি একটু আশ্রয় নিতে এসেছি।”
তুলিকা আলোতে দেখে চমকে ওঠে। এ যে তার অতি চেনা পরিচিত আর্য সেন। তাদের পাড়ার সবচেয়ে বাউন্ডুলে তিনবার চেষ্টা করার পর উচ্চমাধ্যমিকে পাস করা সেই ছেলেটা। আর্যও চমকে ওঠে তুলিকাকে দেখে। এইতো তার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। ছোট থেকে যাকে আভাস ইঙ্গিতে আরো অনেক কিছু ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে এসেছে এই তো তার প্রিয় তুলিকা।
তুলিকা কিছু বোঝার আগে আর্য ওর মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নেয়।
—-সরি এটা তোমার বাড়ি ম্যাডাম আমি জানতাম না। তবে ভগবানের কাছে একবার প্রার্থনা করেছিলাম যাতে তোমার সাথে আমার একবার অন্তত দেখা হয়। কিন্তু সেটা যে এভাবে তা বুঝতে পারিনি।
—–কিন্ত তোমাকে কারা এবং কেন তাড়া করেছে?
——আর কি বলব। সারা রাত দৌড়ে বেড়িয়েছি। আমি দুটো ভালবাসাকে পূর্ণতা দিয়েছি মাত্র। তাই পিছনে পড়েছে শেষ করবে বলে। তুমি কেমন আছো তাই বল।
——-আমি ভালো।
——–আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না আমি কিছুক্ষণ পরেই চলে যাব। কিছু খাবার পাওয়া যাবে?
সেই রাতে থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি।
তুলিকা স্যান্ডউইচ বানিয়ে আনে।
——সাজানো সংসার তোমার। খুব ভালো লাগছে দেখে। কিন্তু জানো তো আমারও এমন একটা সুন্দর সংসার হতো।
——-কেন হল না আর্যদা?
———তোমার জন্য। সত্যি করে বলবে তুমি কি কোনদিন বুঝতে পারোনি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি?
——কি বলছো তুমি? আমি তো জানতাম না এই প্রথম শুনলাম।কখনো সখনো একটা অনুভূতি হয়েছিল কিন্তু সেটাকে যে ভালোবাসা বলে সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আমার খুব মনে হতো আমি যেখানেই যাই না কেন তোমার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। কি করে সম্ভব এটা?
——–আমাকে কেউ বোঝে না তুলিকা। তাই সেদিন তুমিও বুঝতে পারোনি।
——–এতই যখন ভালোবেসেছিলে তখন মুখ ফুটে একবার প্রপোজ করো নি কেন??
———কি করতাম তুলিকা ?? তুমি ইঞ্জিনিয়ার ওয়েল এস্টাব্লিশড আর আমি তিনবার চেষ্টা করার পর টেনেটুনে হায়ার সেকেন্ডারি পাস ,বেকার কি করে বলতে পারতাম মে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি মানতে?
———একবার বলেই দেখতে। হতেও তো পারত কিছু।
———কিছু হত না তুলিকা। আমাদের অভাবের সংসার। তুমি এডজাস্ট করতেই পারতে না।
যেদিন তোমার বিয়ে ছিল সেদিন সকাল বেলায় নিজেকে যে কীভাবে সামলেছি একমাত্র মা আর ভগবান জানে। আমি এখনো তোমার বিয়ের ডেট তোমার জন্মদিন সব জানি।
——–এবারে সবকিছু ভুলে যাও আর্য দা।
——–কাকে ভুলে যাব তুলি? তোমার বিয়ে হয়েছে না চার বছর। এই চার বছরে একদিন ও তোমাকে ভুলিনি। তোমার কথা মনে পড়ে খুব আর ,আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।
তুলিকার এবার খুব খারাপ লাগে। ওর অজান্তে কেউ ওকে পাগলের মত ভালোবাসত আর ও টের পায়নি। ছিঃ ছিঃ! এত হার্টলেস নিজেকে আগে কখনো লাগে নি। কোথাও যেন একটা খারাপ লাগা ওর মনটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। তখনকার সমস্ত কথা একটু একটু করে যেন মনে পড়ছে তুলিকা র। ওর প্রতি আর্য দার সব ব্যাপারে এক্সট্রা কেয়ার ওর মনে ভারি কৌতুহলের সৃষ্টি করত। সত্যি ভেবে পেত না এগুলো ভালো লাগা না ভালোবাসা না ইনফ্যাচুয়েশন ? কি ছিল এগজ্যাক্টলি? সেদিন ও উত্তর খুঁজে পায়নি তুলিকা। আজ তবে এত কষ্ট কেন হচ্ছে তুলিকার? মাথায় একগাদা পেছনে ফেলে আসা দিনের ভিড় যেন আজ ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে।
আজ তুলিকার প্রজেক্ট সাবমিট করার লাস্ট দিন। তাই ওকে অফিস যেতেই হবে।
——আর্যদা আমাকে আজ অফিস যেতেই হবে। তোমার লাঞ্চ টেবিলে ঢাকা দেওয়া আছে, খেয়ে নিও। বিকেলে তোমার সাথে কথা হবে।
আর্য তুলিকার ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। কি চমৎকার ভাবে সাজানো গোছানো। দেওয়ালে টাঙানো নানান রকমের তুলিকাও সৌভিকের ছবি ওর মনে ক্ষণিক জ্বালার সৃষ্টি করেছিল। মনে হয়েছিল সব ছারখার করে দেয়। নিজেকে সামলে নেয় আর্য। তুলিকা মেয়েটা বড় ভালো। সন্ধ্যা নামতেই বেরিয়ে পড়ে আর্য ওর অনিশ্চয়তা’ ভরা অন্ধকার জীবনে।আর তুলিকার জন্য রেখে যায় ছোট্ট নোট।
প্রিয় তুলি,
তুমি হয়তো জান না তোমাকে ভালবাসার পর মনে মনে এই নামেই ডাকতাম। আজও আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমার এই বাউন্ডুলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমাকে ই ভালোবাসব। তুমি সুখী হও। এটাই আমি চাই। আমি চলে গেলাম। বেশিক্ষণ থাকলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারব না। বখাটে নষ্ট ছেলে হতে পারি কিন্তু কোনদিন তোমার স্বযত্নে তৈরী করা ভালবাসার নীড় নষ্ট নীড়ে পরিনত করতে পারব না।
আর্যদা
লেখক পরিচিতি : চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
লিখতে খুব ভালোবাসি। ভালো লেখার চেষ্টা করি। মনের ভাবনা গুলো যখন এলোমেলোভাবে ছুটোছুটি করে তখন সাদা পাতায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি মাত্র।
ভালোবাসার সম্পূর্ণতা বোধহয় ভালোবাসাই হয়। এই গল্পে সেই ভাব সুস্পষ্ট। লেখিকাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা তার লেখনির জন্য।